ভারতবর্ষে তুঘলক শাসন
খলজিদের পর ভারতবর্ষে তুঘলক শাসন শুরু হয়। নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছাড়াও এই বংশের শাসকরা বেশ সমালোচিত কিছু পদক্ষেপ নেয়। বাংলার নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যর্থ হয়।
তুঘলকরা কীভাবে ক্ষমতায় বসে?
- তুঘলকদের ক্ষমতারোহণ : আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর চার বছরের মধ্যে খলজি বংশের অবসান ঘটে। এই বংশের শেষ সুলতান কুতুবউদ্দিন মুবারককে হত্যা করে খসরু মালিক নামক একজন আমির ক্ষমতা দখল করে। খসরু সিংহাসনে বসার পর হীন মানসিকতার পরিচয় দেয়। সে খলজি বংশের প্রতি অনুরক্ত আমিরদের হত্যা করে এবং নিজ বংশের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়। এ সময় দিল্লির আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয় এবং ইসলামের অবমাননা শুরু হয়। ফলে মুসলিম আমিররা খসরুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
জুনা খান এই সময় দিল্লিতে আমিরই আকুর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি পিতা গাজি মালিকের সাথে পাঞ্জাবে দেখা করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। ফলে গাজি মালিক দিল্লিতে অভিযান পরিচালনা করে খসরুকে হত্যা করে। গাজি মালিক খলজি বংশের উত্তরাধিকারকে ক্ষমতায় বসার অনুরোধ করে। কিন্তু যোগ্য কোনো প্রতিনিধি না থাকায় আমিরদের অনুরোধে তিনি ‘গিয়াসউদ্দিন তুঘলক’ নামধারণ করে সিংহাসনে বসেন। এভাবেই দিল্লিতে তুঘলক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন
- গিয়াসউদ্দিন তুঘলক : আলাউদ্দিন খিলজির অধীনে তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। মোগল আক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে সুলতানের সুনজরে আসেন। এজন্য তাঁকে ‘গাজি’ উপাধি দেওয়া হয়। সিংহাসনে বসে তিনি বেশ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। মুবারক শাহ ও খসরুর দুর্বল শাসনে দিল্লির কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়ে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। বাহাদুর শাহ সোনারগাঁও, লখনৌতি দখল করে প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন করতে থাকে। তিনি আলাউদ্দিনের কঠোর নীতি বা মুবারক খলজির অতি নমনীয় শাসননীতি পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। তিনি খলজি আত্মীয়দের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন। খলজি আমলের পদমর্যাদা বহাল রাখেন।
আলাউদ্দিনের দুর্বল উত্তরাধিকারী ও খসরুর সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতি লাঘবের চেষ্টা করেন। যারা তাদের থেকে উপহার পেয়েছিল তাদের তা ফেরত দিতে বাধ্য করেন। নিজামউদ্দিন আওলিয়া প্রাপ্ত অর্থ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ায় তিনি তা ফেরত দিতে পারেন নি। এ নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।গিয়াসউদ্দিনের অবদান-
- অবদান : কৃষিক্ষেত্রে উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য তিনি ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটান। ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সাথে তিনটি শ্রেণি সাধারণ কৃষক (বলাহার), গ্রামপ্রধান (মুকদ্দম) ও প্রাদেশিক শাসক (মুকতি) জড়িত ছিল। রাজস্বের হার অত্যধিক হবার ফলে কৃষক চাষাবাদের বিকল্প জীবিকা অনুসন্ধানে অধিক আগ্রহী ছিল। মুকদ্দমদের সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়ায় রাজস্ব সংগ্রহে তারা নিরুৎসাহিত ছিল। আর মধ্যস্বত্বভোগীদের অবর্তমানে মুকতিদের পক্ষে ভূমিরাজস্ব আদায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তিনি ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে এই তিন শ্রেণির মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করেন। জমি-জরিপের (হুকুম-ই মাসাহাত) ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের পরিবর্তে কৃষি জমিতে উৎপন্ন ফসলের উপর (হুকুম-ই-হাসিল) রাজস্ব চালু করেন। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় রাজস্ব প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে কৃষক মুক্তি পায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নতুন রাস্তা নির্মাণ করেন এবং পুরোনো রাস্তার সংস্কার সাধন করেন। আলাউদ্দিনের আমলের ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’ প্রথা কঠোরভাবে বহাল রাখেন এবং সামরিক বাহিনীর বেতন বাড়িয়ে দেন। তিনি ঘোড়ার মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরকারি চিঠিপত্র আনা-নেয়ার ব্যবস্থা করেন যাকে ‘উলাক’ বলা হত। প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলেন। জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি রাজস্ব হ্রাস এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। কৃষকদের জন্য ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চৌকি ও দুর্গ নির্মাণ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। দিল্লির অদূরে তিনি বিখ্যাত ‘তুঘলকাবাদ’ দুর্গ নির্মাণ করেন। - দাক্ষিণাত্য ও উড়িষ্যা বিজয় : আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পর তেলিঙ্গানার রাজা দ্বিতীয় প্রতাপ দিল্লির আনুগত্য অস্বীকার করে। সুলতান জুনা খানকে তেলিঙ্গানার বিরুদ্ধে পাঠান। জুনা খান বরঙ্গল দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু বিপক্ষ সেনাদের চরম প্রতিরোধ ও মহামারী দেখা দিলে তিনি অবরোধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এর অল্পদিন পরে তিনি আবার বরঙ্গল আক্রমণ করে দ্বিতীয় প্রতাপকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। বরঙ্গলের নতুন নাম রাখা হয় সুলতানপুর।
- বাংলা বিজয় : বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজের মৃত্যুর পর সন্তানদের মধ্যে কলহ দেখা দেয়। এ সুযোগে গিয়াসউদ্দিন বাংলা আক্রমণ করে। তিনি শামসউদ্দিনের বড় ছেলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরকে বন্দি করেন এবং ছোট ছেলে নাসিরউদ্দিন ইব্রহিমকে বাংলার শাসক নিযুক্ত করে দিল্লি ফিরে আসেন। বাংলায় সামরিক সাফল্য অর্জন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সর্বশেষ কৃতিত্ব। বঙ্গ বিজয়ের আনন্দে জুনা খান ওরফে মুহাম্মদ বাবাকে আফগানপুরে এক সংবর্ধনা দেন। যেখানে মণ্ডপের নিচে পড়ে গিয়ে গিয়াসউদ্দিন মারা যান।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ক্ষমতারোহণ
- মুহাম্মদ বিন তুঘলক : তাঁর প্রকৃত নাম জুনা খান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান শাসক। তিনি দেবগিরির নাম পরিবর্তন করে দৌলতাবাদ রাখেন। তিনি ২৬ বছর শাসন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলের প্রথম ১৩ বছর নির্বিঘ্নে কাটলেও শেষের ১৩ বছর নানা রকম বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির মধ্যে কাটে। এই সময় তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত সফল না হওয়ায় ইতিহাসে তাঁকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
- বিদ্রোহ দমন : তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৩২৭ সালে বাহাউদ্দিন দাক্ষিণাত্যের গুলবর্গায় বিদ্রোহ করে। সুলতান তাকে পরাজিত করে। বাহাউদ্দিন কামপিল রাজ্যে আশ্রয় নেয়। ফলে কামপিল রাজ্য দখল করে। এরপর তিনি হয়সল দখল করেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের বিজিত রাজ্যগুলো সরাসরি দিল্লির শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। ফলে দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুলতানের শাসক বাহরাম খান বিদ্রোহ করলে সুলতান তাকে পরাজিত করেন।
-
মুহাম্মদ বিন তুঘলক যেসব কাজের জন্য সমালোচিত-
ক. দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপন : তাঁর সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত ছিল। মুসলিম শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই দাক্ষিণাত্য বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তুলনামূলকভাবে এই অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা কম ছিল। দিল্লি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এর নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য ছিল। তাছাড়া মোঙ্গল আক্রমণের হুমকি সব সময়ই থাকত।
মুসলিম জনসংখ্যা যেন বৃদ্ধি পায় এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রসার ঘটে তাই সুলতান দাক্ষিণাত্যের নিকটবর্তী দেবগিরিতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনা নেন। এর নতুন নাম দেন দৌলতাবাদ। কিন্তু দেবগিরির পরিবেশ অনেকের অনুকূলে ছিল না। অনেকেই পথে মারা যান। পরবর্তীতে সুলতান এই পরিকল্পনা বাদ দেন।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ হলেও এর সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। দিল্লি হতে আসা সব আলেম দিল্লিতে ফিরে যাননি। অনেকেই দেবগিরিতে থেকে যান তাদের প্রচেষ্টায় সেখানে মুসলিম সমাজ গড়ে উঠে। এমনকি পরবর্তী সময়ে দাক্ষিণাত্যে মুসলিম রাজত্বও প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
খ. খোরাসান অভিযানের পরিকল্পনা : খোরাসান থেকে বিতাড়িত হয়ে কতিপয় খোরাসানি আমির সুলতানের নিকট আশ্রয় নেন। তারা সুলতানকে খোরাসান অভিযানের জন্য উৎসাহ জোগান। মধ্য এশিয়ায় তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত ছিল। মোগল নেতা তারমাশিরীন ও মিশরের সুলতান নাসির পারস্য সীমান্তে হামলা চালাচ্ছিল। এই সুযোগে খোরাসান আক্রমণ যুক্তিযুক্ত ছিল।
সুলতান এজন্য ৩,৭০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন। আকর্ষণীয় বেতন ভাতায় প্রলুব্ধ হয়ে বিপুল সংখ্যক রাজপুতসহ অনেকেই এই বাহিনীতে যোগ দেয়। সুলতানের প্রস্তুতি পর্বের শেষ দিকে তারমাশিরীন ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং মিশর ও পারস্যের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হলে যুদ্ধের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। প্রায় ১ বছর এই বিশাল বাহিনীর পেছনে অর্থ ব্যয় হয় এবং এই বাহিনী সালতানাতের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া বা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তীতে ১ লক্ষ সেনা রেখে বাকিদের বিদায় করা হয়।
গ. কারাচিল অভিযান : হিমালয়ের পাদদেশে একটি পার্বত্য অঞ্চলের নাম কারাচিল। এখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী খুবই উদ্ধত প্রকৃতির ছিল। তারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। সুলতান তাদের দমনের জন্য একটি বাহিনী পাঠান। এটি ছিল নগরকোট অভিযানের অংশ বিশেষ। এ অঞ্চলে এক শক্তিশালী হিন্দু রাজা রাজত্ব করত। তাকে দমন করা ছাড়াও হিমালয় অঞ্চলে চীনা অভিযান বন্ধ করা সুলতানের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকবে।
যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে মালিক খসরুকে সেনাপতি করে কারাচিল অভিযানে পাঠানো হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। সেনাপতি প্রথম দিকে সফলতা অর্জন করেন। দুর্ভাগ্যবশত এ সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং সুলতানের বাহিনীতে মহামারী প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পাশাপাশি উপজাতিরা ভয়ংকর আক্রমণ শুরু করে। ফলে সুলতানের বাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
ঘ. প্রতীকি মুদ্রার প্রচলন : দেশে সোনার অনুপাতে রূপার অভাব দেখা দিয়েছিল। দেশ থেকে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করে তিনি তামার মুদ্রা প্রচলন করেন। কিন্তু মুদ্রা যেন জাল না হয় সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। ফলে সুলতানের প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি হয়। দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তামার মুদ্রা ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
ঙ. দোয়াবে কর বৃদ্ধি : পূর্বের পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ হওয়ায় রাজকোষ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলতান ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। দোয়াব অঞ্চল অত্যন্ত উর্বর ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে পরপর কয়েক বছর অনাবৃষ্টির কারণে ফসল কম হয় ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অতিরিক্ত কর না দিতে পেরে জনগণ ভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। চাষাবাদ অবহেলিত হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। সুলতান এসব শোনামাত্রই কর লাঘব করে দেন এবং কৃষকদের ‘তাকাভি’ ঋণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সার্বিক চাষাবাদ পূর্বের অবস্থায় আসতে বেশ সময় লাগে। সুলতানের এ সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় দেশে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সুলতান বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। - রাজ্যব্যাপী বিশৃঙ্খলা : ১৩৩৫ সালে মাবারের শাসক জালালউদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সুলতান তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তিনি দৌলতাবাদে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ফলে মাবার অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায়। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁয়ে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুহাম্মদ তুঘলক বাংলার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন।
১৩৪১ অযোধ্যার আমির আইনুল মুলুক দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ করে। সুলতান তাকে পরাজিত করেন এবং সম্মানজনক পদে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। ১৩৪৪ সালে কাকাতীয় রাজপুত্র দাক্ষিণাত্যের হিন্দু সামন্তদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে। ফলে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন হিন্দুরাজ্যের অভ্যুদয় হয়। মূলত তখন দেবগিরি ও গুজরাট ছাড়া বাকি এলাকায় সুলতানের কর্তৃত্ব লোপ পায়। একসময় এই রাজ্যগুলোতেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। এভাবে পুরো দাক্ষিণাত্য হাতছাড়া হয়ে যায়। সুলতান এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েই ১৩৫১ সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের ক্ষমতারোহণ - ফিরোজ শাহ তুঘলক : মুহাম্মদ তুঘলকের মৃত্যুর পর নেতৃত্বের অভাবে সেনাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয় এবং বেতনভুক্ত মোগল সেনারা লুটপাট শুরু করে। সুলতান অপুত্রক অবস্থায় মারা যাওয়ায় কাউকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান নি। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দূর করার জন্য ভ্রাতুষ্পুত্র ফিরোজ শাহকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ইতোমধ্যে ওয়াজির খার নামে জনৈক ব্যক্তি সুলতানের পুত্ররূপে পরিচয় দিয়ে দিল্লিতে শাসন শুরু করে। ফিরোজ শাহ দিল্লিতে গেলে সে আত্মসমর্পণ করে। ১৩৫১ সালে ফিরোজ সিংহাসনে বসেন। তাঁর সুদীর্ঘ ৩৭ বছরের রাজত্বকালে দ্রব্যমূল্য কম ছিল। দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ বা মহামারী দেখা যায়নি, কোনো বড় আকারের বিদেশি আক্রমণও ঘটেনি।
- বাংলা অভিযান : বিজেতা হিসাবে ফিরোজ শাহ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। পূর্বের সুলতানের আমলে স্বাধীন হয়ে যাওয়া কয়েকটি রাজ্য তিনি পুনর্দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৩৫৩ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ পান্ডুয়া দখল করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। ইতোমধ্যে বাংলায় ভয়ংকর বর্ষা দেখা দিলে তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হন। উভয়ের মধ্যে সন্ধি হয় যেখানে ইলিয়াস শাহের শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহের আমলে আবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রেও একডালা দুর্গ জয় করতে ফিরোজ ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে সন্ধি হয়। বাংলা জয় করতে তিনি ব্যর্থ হন।
- অন্যান্য রাজ্য আক্রমণ : দ্বিতীয়বার বাংলা অভিযানের সময় উড়িষ্যার রাজা বাংলার পক্ষে যোগ দেয়। ফলে সুলতান উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। সুলতানের আক্রমণে ভীত হয়ে উড়িষ্যার রাজা সন্ধি করতে বাধ্য হয়। প্রতি বছর সুলতানকে কয়েকটি হাতি পাঠানোর অঙ্গীকার করা হয়। সুলতান পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরটি ধ্বংস করে এবং জগন্নাথের মূর্তিটি দিল্লি নিয়ে আসে।
মুহাম্মদ তুঘলকের মৃত্যুর পর নগরকোটের রাজা দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে। ফিরোজ শাহের আক্রমণের সংবাদ পেয়ে নগরকোটের রাজা দুর্গে আশ্রয় নেয়। প্রায় ছয় মাস দুর্গ অবরোধের পর উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। রাজা সুলতানের অধীনতা স্বীকার করে নেয় এবং সুলতানকে বহুমূল্যবান খেলাত প্রদান করে। নগরকোটের মন্দির থেকে ফিরোজ শাহ ৩০০ মূল্যবান সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে আসেন এবং সভাকবি আজউদ্দিন দালাইল-ই-ফিরোজশাহী শিরোনামে ফার্সিতে অনুবাদ করেন। -
ফিরোজ শাহ কেন প্রশংসিত?
- জনহিতকরণ কার্যাবলি : তিনি জনহিতকর কাজের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। জনকল্যাণই ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। তিনি শরিয়তের বিধি অনুসারে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি মিশরের খলিফার কাছ থেকে দুবার সনদ লাভ করেছিলেন। হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন। পূর্ববর্তী সুলতানের আমলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের তিনি ক্ষতিপূরণ দেন। জায়গীর প্রথা পুনরায় চালু করেন। সমস্ত সাম্রাজ্য জায়গিরে বিভক্ত করে তা আমিরদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এতে সুলতানের কর্তৃত্ব সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল।
তিনি শুধু চার প্রকার কর আদায় করবেন। যথা- খারাজ, জিজিয়া, যাকাত ও খুমস। এগুলো ছাড়া অন্যান্য সব কর তুলে দেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চালু করা সব ধরনের তাকাভি ঋণ মওকুফ করেন। ব্যবসায় উন্নতির জন্য তিনি অনেক প্রান্তিক কর উঠিয়ে দেন। এই সময় সাধারণ মানুষও সম্পদশালী হয়। তিনি তামা ও রূপা মিশিয়ে বিশেষ ধরনের মুদ্রা চালু করেন। ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম আধুলি, সিকি, দুয়ানি, আনি প্রভৃতি খুচরা মুদ্রা চালু করেন।যৌতুকের জন্য যেসব মেয়ের বিয়ে হত না তাদেরকে ‘বিবাহ দপ্তর’ থেকে সাহায্য দেওয়া হত। বেকার যুবকদের চাকরি পাওয়ার সুবিধার জন্য ‘চাকরি দপ্তর’ খোলেন। দিল্লীতে দার-উস-সাফা নামে একটি বিশাল হাসপাতাল তৈরি করেন। অনাথ, বৃদ্ধ ও দরিদ্রদের জন্য দিওয়ান-ই-খয়রাত থেকে সাহায্য করা হত। ‘দিওয়ান-ই-বন্দেগান’ নামে দাসদের সুবিধার জন্য একটি দপ্তর খোলেন। তখন দাসের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ আশি হাজার। বিশাল সংখ্যক দাস প্রতিপালনে রাজকোষের উপর চাপ পড়ত। বলা হয়ে থাকে এই দাস সমস্যাই তুঘলক বংশের পতনের অন্যতম কারণ।
তিনি ফিরোজাবাদ, ফাতেহাবাদ, জৌনপুর ও হিসার এই চারটি নগরী স্থাপন করেন। তিনি সামন্তপ্রথার উপর ভিত্তি করে তাঁর সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। সেনাদের জায়গীর দেওয়া হত। কোনো সৈন্য বৃদ্ধ বা অক্ষম হয়ে পড়লে তার স্থলে পুত্র, জামাতা বা ক্রীতদাসদের চাকরি দেওয়া হত। যদিও এর ফলে সেনা বাহিনীর সার্বিক দক্ষতা হ্রাস পায়। তাঁকে ভারতে সেঁচ ব্যবস্থার জনক বলা হয়। ফিরোজ শাহের আমলে জনগণ বেশ সুখী-সমৃদ্ধ জীবন যাপন করত। দীর্ঘ ৩৭ বছর রাজত্ব করার পর ফিরোজ শাহ ১৩৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। - ফিরোজ শাহ পরবর্তী শাসকগণ : ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ মারাত্মক গৃহবিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ১৩৮৮-১৩৯৯ সাল পর্যন্ত ছয়জন সুলতান ক্ষমতায় আসেন। তারা ছিলেন প্রভাবশালী আমিরদের ক্রীড়নক। আমিরগণ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ ১৩৯৯ সালে সুলতান হন। এমন পরিস্থিতিতে সমরকন্দের শাসক তৈমুর লং এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন।
- তৈমুর লং : তৈমুর লং ছিলেন তুর্কি চাগতাই বংশীয়। এক পা খোঁড়া ছিল বলে তাঁকে লং বলা হত। সে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তান দখল করে ভারতে আক্রমণ করে। সুলতান মাহমুদ শাহের সেনাবাহিনী নামমাত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করে পরাজিত হয়। তৈমুর অভয় দেয় যে দিল্লীর কাউকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু তার বদলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিতে হবে। তৈমুরের সেনারা অর্থ সংগ্রহ করতে গেলে দিল্লীবাসী বাধা দেয়। ফলে তৈমুর ক্ষুব্ধ হয়ে দিল্লীতে গণহত্যা চালায়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ এ থেকে রেহাই পায় নি। প্রচুর পরিমাণে লুট করে তার অনুচর খিযির খানকে লাহোর, মুলতানের শাসক নিযুক্ত করে তৈমুর চলে যায়। তৈমুর ভারত ত্যাগ করে কিন্তু পেছনে রেখে যায় ‘ভয়, ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ ও মড়কের এক ভীতিপ্রদ কাহিনী’।
তৈমুরের আক্রমণ তুঘলক বংশের উপর ভয়াবহ আঘাত হানে। তৈমুরের ভারত ত্যাগের পর মাহমুদ শাহ দিল্লী ফিরে এলেও গৌরব ফিরে পেলেন না। একের পর এক প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকে। ১৪১৩ সালে মাহমুদ শাহের মৃত্যুর সাথে সাথে তুঘলক বংশের পতন ঘটে। তৈমুরের প্রতিনিধি খিজির খান দিল্লী দখল করে সৈয়দ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। - পূর্বের আলোচনা পড়ুন : খিলজি শাসন
- পরবর্তী আলোচনা : সৈয়দ বংশের শাসন