বাংলার বীর মুজাহিদ তিতুমিরের আন্দোলন
- পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় প্রায় একই সময়ে দুটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব বাংলার আন্দোলনটি ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। আর পশ্চিম বাংলার আন্দোলন ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ বা ‘তারিক-ই-মুহম্মদিয়া’ নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিতুমীর। ১৮২৭ সালে এ আন্দোলন শুরু হয়ে ১৮৩১ সালে শেষ হয়।
-
তিতুমীরের জন্ম-
- তিতুমীর : তিতুমীরের আসল নাম মীর নিসার আলী। ১৭৮২ সালে চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চাঁদপুর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনিশ শতকে ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক কুসংস্কার দূর করে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশাসন পালনের সঠিক পথ নির্দেশনাই এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তিতুমীরের আন্দোলনটি সৈয়দ আহমদ শহীদের বেরলভি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত।
তিতুমীর ১৮২২ সালে মক্কায় যান এবং ১৮২৭ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে ধর্মীয় সংস্কার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এই আন্দোলনে চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলার প্রজারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়। ফলে জমিদাররা প্রজাদের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তিতুমীর এসবের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে সুবিচার চেয়ে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে এই আন্দোলন নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সৈয়দ আহমদ বেরলভির আন্দোলন ছিল সীমান্ত প্রদেশে আর তিতুমীরের আন্দোলন ছিল অবিভক্ত বাংলায়। - তিতুমীর লক্ষ্য করেন যে হিন্দু জমিদাররা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল প্রজার কাছ থেকে পূজোর চাঁদা, বেআইনী কর, আবওয়াব ইত্যাদি আদায় করে। ইংরেজ নীলকররা হিন্দু জমিদারদের সাথে মিলে কৃষকদের নিপীড়ন করে চলছে। তিতুমীর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। এদের মধ্যে পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় প্রমুখ জমিদার তিতুমীরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পাঁচদফা ফরমান জারি করে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধানের উপর হস্তক্ষেপ করে। তিতুমীর তাকে তখন একটি ঐতিহাসিক পত্র লিখেন। যার গুরুত্ব অপরিসীম। পত্রটি হল-
“জনাব জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়,
আমি আপনার প্রজা না হলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি লোক পরম্পরায় জানতে পারলাম যে, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাকে ওহাবি বলে আপনি মুসলমানদের নিকট হেয় করার চেষ্টা করেছেন। আপনি কেন এরকম করছেন বুঝতে পারছি নে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। যদি কেহ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কোনো মিথ্যা কথা বলে আপনাকে উত্তেজিত করে থাকে, তাহলে আপনার উচিত ছিল সত্যের অনুসন্ধান করে হুকুম জারি করা। আমি ‘দ্বীন ইসলাম’ প্রচার করছি। মুসলিমদেরকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছি। এতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকতে পারে? যার ধর্ম সেই বুঝে। আপনি ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। ওহাবি ধর্ম নামে পৃথিবীতে কোনো ধর্ম নেই । আল্লাহর মনঃপূত ধর্মই ইসলাম। ইসলাম ধর্মের অর্থ হচ্ছে শান্তি। একমাত্র ইসলাম ধর্ম ব্যাতিত আর কোনো ধর্মই জগতে শান্তি আনয়ন করতে পারে না। ইসলামি ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট রাখা, ঈদুল আজহার কোরবানি করা ও আকিকা দেওয়া, মুসলমানদের উপর আল্লাহর ও আল্লাহর রসুলের (স.) নির্দেশ । মসজিদ প্রস্তুত করে আল্লাহর ইবাদত করাও আল্লাহর হুকুম। আপনি ইসলাম ধর্মের আদেশ, বিধিনিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। আমি আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করবেন।
ফকত হাকির ও না-চিজ
সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর”তিতুমীরের পত্র পেয়ে কৃষ্ণদেব পত্রবাহক আমিনুল্লাহকে বন্দী করে। ফলে জটিলতা আরও বেড়ে যায়। তিতুমীর বাধ্য হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৮৩০ সালের ৬ ডিসেম্বর ৩০০ জন মুজাহিদ কৃষ্ণদেবকে শায়েস্তা করার জন্য রওনা করে। তাঁরা গ্রামের বারোয়ারি তলায় এসে গরু জবাই করে। দেশের অত্যাচারিত হিন্দু-মুসলমান তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়। জমিদার ও নীলকররা তিতুমীরের বাহিনীর কাছে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তিনি কয়েকটি নীলকুঠি দখল করেন। তাঁর বাহিনীতে ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক মিসকিন শাহ যোগ দিলে দলের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। তিতুমীর মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে তিনি হন খলিফা, প্রধানমন্ত্রী হন মুনশি ময়জুদ্দীন আর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হন মিসকিন শাহ।
সৈয়দ আহমদ শহীদ পেশোয়ারে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করলে তিতুমীরও উৎসাহিত হয়ে ঘোষণা করেন যে, এদেশে ইংরেজদের থাকার কোনো অধিকার নেই। মুসলমানদের উৎখাত করে এদেশে ইংরেজ ক্ষমতা দখল করেছে তাই মুসলমানরা এদেশের দাবিদার। মুসলিম খলিফা হিসেবে তিনি জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব দাবি করেন। অচিরেই তিতুমীর বাহিনী বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজিত হয়। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। সেই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর গোলাম মাসুমের পরামর্শে বারাসতের কাছে নারকেলবাড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করা হয়। বাঁশ ও কাদা দিয়ে তারা নির্মাণ করেন দ্বিস্তর বিশিষ্ট এ কেল্লা। কৃষক-প্রজাদের সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। -
ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ-
- ইংরেজ সরকার তিতুমীরকে দমনের জন্য বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজেন্ডারের নেতৃত্বে একদল সেনা পাঠায়। কিন্তু তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পাঠানো ইংরেজ বাহিনীও তাঁর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তাঁর কর্মকাণ্ড লর্ড বেন্টিংককে বিচলিত করে তুলে।
১৮৩১ সালের ১৭ নভেম্বর তিতুমীরের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার মেজর স্কটের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠায়। তারা বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। ইংরেজদের কামান বন্দুকের সামনে বীরের মতো লড়াই করে পরাজিত হয় তিতুমীরের বাহিনী। গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা উড়ে যায়। এই যুদ্ধে তিতুমীরের ৫০ জন অনুসারী নিহত হন। গোলাম মাসুমসহ ২৫০ জনকে বন্দি করা হয়। পরে এক প্রহসনমূলক বিচারে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি এবং অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। - আরও পড়ুন- ফরায়েজি আন্দোলন