ফারায়েজি আন্দোলন ও তাইয়ুন আন্দোলন- The Faraizi Movement

ফারায়েজি আন্দোলন ও হাজী শরিয়তউল্লার অবদান

হাজী শরীয়তউল্লাহ
হাজী শরীয়তউল্লাহ
  • ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের ফলে বাংলার মুসলমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। এই অবস্থায় মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য উনিশ শতকে বাংলায় যে সকল সংস্কার আন্দোলন হয় তার মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন (The Faraizi Movement) অন্যতম। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়ত উল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
  • ফরায়েজি মতবাদ-

  • ‘ফরায়েজি’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ফরজ’ থেকে। যাঁরা ফরজ পালন করে তারা হলেন ফরায়েজি। আর বাংলায় যাঁরা হাজী শরীয়তউল্লাহর অনুসারী ছিলেন ইতিহাসে শুধু তাদেরকেই ফরায়েজি বলা হয়ে থাকে। শরীয়ত উল্লাহ যে ফরজের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা ছিল পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পাঁচটি ফরজ।
  • আন্দোলনের পটভূমি

  • ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহ বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলায় ১৭৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৯৯ সালে তিনি মাওলানা বাসারাত আলীর সাথে মক্কা গমন করেন এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮১৮ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন যে বাংলার মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাদের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিনীতি, কুসংস্কার, অনাচার প্রবেশ করেছে। তিনি ইসলাম ধর্মকে এসব কুসংস্কার আর অনৈসলামিক অনাচার মুক্ত করতে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন যা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। যদিও পরবর্তীতে এই আন্দোলনে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সংস্কারের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পায়।
  • ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা-

    ১. হাজী শরীয়তুল্লাহ তালুকদার (১৮১৮-১৮৪০)
    ২. মুহম্মদ মুহসিনউদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া (১৮৪০-১৮৬২)
    ৩. আব্দুল গফুর নয়া মিয়া (১৮৬২-১৮৮৪)
    ৪. খাঁন বাহাদুর সৈয়দউদ্দীন আহমদ (১৮৮৪-১৯০৬)
    ৫. রশীদউদ্দীন আহমদ বাদশাহ মিয়া (১৯০৬-১৯৪৭)

  • আন্দোলনের সূত্রপাত- 

  • ফরায়েজি আন্দোলন ফরিদপুর কেন্দ্রিক শুরু হলেও ক্রমে তা আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় সংস্কারের পাশপাশি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার হতে মুক্ত করা ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। আন্দোলনটি দ্রুতই ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও আসাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব এলাকায় হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকররা অত্যাচার করত সেসকল এলাকায় এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
  • হাজী শরীয়ত উল্লাহ- 

  • মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জমিদাররা অবৈধভাবে বহু অতিরিক্ত আবওয়াব (অবৈধ কর) কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়। ১৮৭২ সালে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের এক তদন্তে প্রকাশ পায় যে, কৃষকদের উপর জমিদারদের আরোপিত অবৈধ করের সংখ্যা তেইশের কম নয়। এমনকি তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে কালীপুজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদির জন্য কর আদায় করত।
    শরীয়তউল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসকল অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য নির্দেশ দেন। দেশ জুড়ে অভাব দেখা দিলে তিনি নুন-ভাতের দাবিও উত্থাপন করেন। জমিদাররা ফরায়েজি প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করলে তিনি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। তিনি জনগনের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলেন।
    তিনি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পরেননি। তিনি ইংরেজ রাজত্বকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ বলে ঘোষণা করেন। ‘দারুল হারব’ অর্থ হলো ‘বিধর্মীর রাষ্ট্র’। তিনি দেশে জুমা ও দুই ঈদের নামাজ বর্জনের জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দেন।

    ১৮৩৭ সালে জমিদাররা তাঁকে তিতুমীরের ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে তিনি একাধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। ১৮৪০ সালে তিনি মারা যান।
  • দুদু মিয়া- 

  • তাঁর মৃত্যুর পরে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর পুত্র মুহম্মদ মুহসিন উদ্দীন আহমদ ওরফে ‘দুদু মিয়া’। ১৮১৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি শান্তিপ্রিয় নীতি বাদ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। জালালউদ্দিন মোল্লাকে সেনাপতি নিয়োগ করে এক সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেন। পূর্ব বাংলাকে কতগুলো হলকায় বিভক্ত করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন একাধারে একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক শ্রেণির শোষণমুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়।  ইংরেজ শাসকদের চরম অর্থনৈতিক শোষণে বিপর্যস্ত বাংলার কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। তিনি ঘোষণা দেন যে, জমি থেকে খাজনা আদায় আল্লাহর আইনের পরিপন্থী।
    দেশীয় জমিদাররা ইংরেজ ও নীলকরদের সহায়তা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে থাকে। কিন্তু সাক্ষী না পেয়ে তাঁকে বার বার মুক্তি দিতে হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন হলে ইংরেজরা দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কলকাতার কারাগারে আটক রাখে। ১৮৬০ সালে তিনি মুক্তি পান এবং ১৮৬২ সালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • নয়া মিয়া- 

  • দুদু মিয়া তার নাবালক পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। পরিষদ ক্ষীয়মান আন্দোলনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। নয়া মিয়ার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে এবং তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন হারানো শক্তি কিছুটা ফিরে পায়। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ফরায়েজি নেতাদের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলেন।
  • সৈয়দউদ্দিন আহমদ- 

  • ১৮৮৪ সালে নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার কনিষ্ঠতম পুত্র সৈয়দউদ্দীন আহমদ নেতা হন। তাঁর সময়ে তাইয়ুনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফরায়েজিদের বিতর্ক চরমে পৌঁছে। সরকার সৈয়দ উদ্দীনকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রশ্নে তিনি বিভাজনের পক্ষে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর প্রতি সমর্থন জানান। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
  • রশিদ উদ্দিন-

  •  তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদউদ্দীন নেতা হন। তিনি প্রথম দিকে সরকারের প্রতি সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ তাকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তুলে এবং তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে ফরায়েজিদের এক সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘোষণা করেন এবং জুমা ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন। 
  • তাইয়ুন আন্দোলন ও মাওলানা কেরামত আলী : এই আন্দোলনের জনক মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি (র.)। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত জৌনপুরের মোল্লাহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রায়বেরিলিতে সৈয়দ আহমদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ তাঁকে বাংলা ভূখণ্ডে বয়ান ও লেখনীর মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন।
    বাংলায় আগমনের পূর্বে তিনি জৌনপুরে মাদ্রাসা হাসাফিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কলকাতায় ধর্মপ্রচারের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে তিনি যশোর ও খুলনা হয়ে বরিশাল পৌঁছেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ধর্মপ্রচার করেন। এ সময় হাজী শরীয়তউল্লাহ, আব্দুল জববার ও অন্যান্যরা ফারায়েজি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ ও কেরামত আলীর সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে নীতির পার্থক্য খুব সামান্যই ছিল।
    কিন্তু এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের ব্যাপারে দুপক্ষের অবস্থান ছিল পৃথক মেরুতে। হাজী শরীয়তউল্লাহ মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারত ছিল দারুল হারব। পক্ষান্তরে মাওলানা কেরামত আলী ইংরেজদের সমর্থনে যুক্তি দেখান, যেহেতু ব্রিটিশরা স্থানীয় জনগণের ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করছে না তাই ভারতবর্ষ দারুল হারব নয়। ভারতবর্ষ দারুল ইসলাম (ইসলামি রাষ্ট্র) না হলেও নিদেনপক্ষে এটি দারুল আমান (নিরাপদ আবাসস্থল) বটে। এ জন্যই মুসলমানরা ভারতে ধর্মীয় কার্যক্রম অনুশীলন করতে পারছে।

    ভারতবর্ষ দারুল হারব কিনা এ বিষয়ে তাঁর সাথে ফরায়েজি নেতাদের বাহাস হয়। এ বিতর্কে কেরামত আলী ভারতবর্ষ দারুল হারব নয় বলে প্রমাণ করেন। এ অবস্থায় দুই ঈদ ও জুমার জামাত অনুষ্ঠান মুসলমানদের জন্য ফরয। বিতর্কে ফরায়েজি নেতারা পরাজিত হলেও তাঁরা কেরামত আলীকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
    তিনি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আযানের প্রচলন করেন। আগে শুধু রাতে আযান দেওয়া হত। মসজিদে যখন দিনের বেলায় আযানের প্রচলন করা হয়, তখন লোকে একে নতুন প্রথা মনে করে। তিনি তাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হন যে, দিনে পাঁচবার আযান দেওয়া ফরয। তাঁর সংস্কার আন্দোলন ‘তাইউনি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। আরবি তাইউন শব্দ থেকে তাইউনি শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ হলো শনাক্ত করা। ১৮৭৩ সালে তিনি মারা যান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top