শেরশাহের পরিচয় কী? শেরশাহের কৃতিত্ব? শেরশাহ কীভাবে দিল্লির ক্ষমতায় বসে?
- শেরশাহের বাল্যনাম ফরিদ। নিজ প্রতিভা ও নিষ্ঠার কারণে সামান্য একজন জায়গীর থেকে দিল্লীর বাদশাহ হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ১৪৭২ সালে। পিতা হাসান শূরের জীবদ্দশায় শেরশাহ সাসারামের জায়গীরের শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঁর ২১ বছরের শাসনামলে সাসারামের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। এতে তাঁর বিমাতা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে সাসারাম ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
১৫২৭ সালে শেরখান আগ্রায় যায় এবং বাবরের অধীনে চাকরি লাভ করেন। ১৫২৮ সালে বাবরের সাহায্যে সাসারামের জায়গীর পুনরুদ্ধার করেন। ইতোমধ্যে বিহারের শাসক বাহার খান মারা গেলে শেরখান তাঁর শিশু পুত্র জামাল খানের অভিভাবক নিযুক্ত হন এবং উপশাসক হিসেবে বিহার শাসন করেন। ১৫৩০ সালে শেরখান চুনার অধিপতি তাজখানের বিধবা স্ত্রী মালেকা জাহানকে বিয়ে করে চুনারের কর্তৃত্ব লাভ করেন। জামাল খান তার অভিভাবক শেরখানের ক্ষমতা বিস্তৃতিতে সন্দিহান হয়ে ছিলেন। তিনি শেরখানের কর্তৃত্ব দূর করার জন্য বাংলার শাসক সুলতান মাহমুদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করেন। সুরুজগড়ের যুদ্ধে শেরখান উভয়ের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে বিহারের শাসক হন। ১৫৩৭ সালে শেরখান বাংলা আক্রমণ করে গৌড় দখল করেন।১৫৪০ সালে দিল্লী বিজয়ের পর বাংলা আক্রমণ করে শেরখান খিজির খানকে পরাজিত করেন। বাংলায় যাতে বিদ্রোহ সংঘটিত হতে না পারে সেজন্য বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করে। যার প্রতিটির শাসনভার একজন আমিরের উপর ন্যস্ত করেন। পশ্চিম ভারতে রাজপুত শক্তি নতুন করে শক্তি লাভ করতে থাকে। শেরশাহ রাজপুতদের দমন করতে সচেষ্ট কন। ১৫৪২ সালে মালব জয় করেন। ১৫৪৫ সালে কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধের সময় বারুদ বিস্ফোরণে তিনি মারা যান।
-
শেরশাহের শাসন প্রকৃতি
- শেরশাহের শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক হলেও স্বেচ্ছাতান্ত্রিক ছিল না। তাঁর শাসনব্যবস্থা ছিল প্রজাকল্যাণমূলক। শাসনের সুবিধার্থে সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি সরকার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেন। তিনি সর্বপ্রথম আবাদি জমির নির্ভুল জরিপের ব্যবস্থা করেন। তিনি জমিতে পাট্টা ও কবুলিয়ত প্রথা চালু করে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। ভূমি থেকে সম্রাটের যা প্রাপ্য তার স্বীকৃতি দিয়ে প্রজারা ‘কবুলিয়ত’ লিখে দিত আর জমিতে প্রজার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে সম্রাট ‘পাট্টা’ লিখে দিতেন। তিনি রূপার পাশাপাশি স্বর্ণমুদ্রাও চালু করেন। তাঁর আমলে নির্মিত রূপার মুদ্রা ‘দাম’ নামে পরিচিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সাম্রাজ্যের বহু স্থানে সুন্দর ও প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর নির্মিত রাস্তাগুলোর মধ্যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড সবচেয়ে বিখ্যাত।
তাঁর নির্মিত বিখ্যাত সড়কগুলো হচ্ছে- সোনারগাঁ থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লী এবং পাঞ্জাব থেকে সিন্ধু পর্যন্ত রাজপথটি। এটি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টি ছিল আগ্রা, যোধপুর ও চিতোর পর্যন্ত। তৃতীয়টি ছিল আগ্রা থেকে বুরহানপুর ও চতুর্থটি ছিল লাহোর থেকে মুলতান পর্যন্ত। পথচারীদের সুবিধার্থে রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষরোপণ ও সরাইখানা স্থাপন করা হয়েছিল। ডাক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে জায়গির প্রথা বিলুপ্ত করে বেতনভোগী সেনা নিয়োগ দিতেন। সেনাদের নিয়মিত হাজিরা ও সেনাবাহিনীতে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার নীতি প্রবর্তন করেন। তিনি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের মধ্যে অন্যতম। -
সলিম শাহের অবদান-
- সলিম শাহ : শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ‘জালাল খান’ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ইসলাম শাহ উপাধি ধারণ করেন। ইতিহাসে তিনি সলিম শাহ নামে পরিচিত। তিনি মানকোট দুর্গ নির্মাণ করে কাশ্মীরে তাঁর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন। তাঁর শাসনামলে সুলায়মান নামে একজন রাজপুত বাংলা দখলের চেষ্টা করলে তিনি তাকে দমন করেন। মাত্র নয় বছর রাজত্ব করার পর ১৫৫৪ সালে তিনি মারা যান। অতঃপর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরোজ খান ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু শীঘ্রই মামা মুবারিজ খান কর্তৃক তিনি নিহত হন।
-
মুবারিজ থানের শাসন-
- মুবারিজ খান : মুবারিজ খান ‘মুহাম্মদ আদিল শাহ’ উপাধি নিয়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। মাত্র দুই বছর রাজত্ব করেন। এই সময়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ চরম আকারে দেখা দেয়। বাংলার শাসক মুহাম্মদ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর সেনাপতি হিমু মুহাম্মদ খানকে পরাজিত ও হত্যা করে। হিমুর পরামর্শে শাহবাজ খানকে বাংলার শাসক করা হয়। কিন্তু শাহবাজ খান নিহত মুহাম্মদ খানের ছেলে খিজির খানের হাতে নিহত হয়। খিজির নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করে। এই সময়ে ইব্রাহির শূর নামে জনৈক বিদ্রোহী আমির দিল্লী ও আগ্রা দখল করলে মুবারিজ খান চুনারে পালিয়ে যায়। ১৫৫৬ সালে তিনি মুঙ্গেরে নিহত হন।
এই সময়ে দিল্লীর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন চলছিল। আফগান শক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন লাহোর ও দিপালপুর দখল করেন। সিরহিন্দের যুদ্ধে সিকান্দর শাহকে পরাজিত করে হুমায়ুন দিল্লী দখল করেন। এভাবেই শূর শাসনের অবসান ঘটে। এ সময়ে হুমায়ুনের অধিকৃত এলাকা ছিল সীমিত। ১১৫৬ সালে মাগরিবের নাম আদায়ের জন্য লাইব্রেরি থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে হুমায়ুন ইন্তেকাল করেন। - পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : হুমায়ুনের শাসনামল
পরবর্তী আলোচনা : আকবরের শাসনামল