Skip to content

বাংলা শূর বংশের শাসন (১৫৩৮-১৫৬৩)- বঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস (৭ম পর্ব)

মুঘলদের পরাজিত করে শেরশাহের ক্ষমতারোহণ

  • বাংলায় আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেরশাহ শূরি। উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার ও বাংলার দখল নিয়ে তিনি মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ছিলেন বিহারের সাসারম অঞ্চলের জায়গীরদার। পরবর্তীতে তিনি দিল্লী, আগ্রা দখল করেন। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ শেরশাহের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
  • শেরখান ১৫৩৮ সালে এপ্রিলে বাংলায় শূর বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে মাহমুদ শাহের আবেদনের প্রেক্ষিতে হুমায়ুন ১৫৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে গৌড় দখল করেন এবং সেখানে তিনি আট মাস অবস্থান করেন। দিল্লির সিংহাসন নিয়ে হুমায়ুনের ভাইদের মধ্যে ষড়যন্ত্র শুরু হলে হুমায়ুন বাংলা ছেড়ে দিল্লির অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে চৌসারে শেরখান হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। অতঃপর শেরখান ১৫৩৯ সালের অক্টোবরে বাংলার শাসক জাহাঙ্গীর কুলীকে হত্যা করে গৌড় দখল করেন। এভাবে বাংলা শূর সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।

    শেরশাহ
    শেরশাহ



  • শেরশাহের উত্তরাধিকারী ইসলাম শাহের শাসনামল পর্যন্ত বাংলা দিল্লীর অধীনে ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আফগান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে আরাকানের মগরা চট্টগ্রাম দখল করে। মগদের পরাজিত করে মুহাম্মদ শাহ চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করে আরাকান দখল করেন। কিন্তু উচ্চাভিলাসের কারণে তিনি দিল্লি দখল করার চেষ্টা করলে আদিল শাহের সেনাপতি হিমুর নিকট পরাজিত হন। তারপর মুহাম্মদ শাহের পুত্র বাহাদুর শাহ গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তিনি পিতার হত্যার প্রতিশোধে আদিল শাহকে হত্যা করেন। ১৫৬০ সালে বাহাদুর শাহের মৃত্যু হলে তাঁর ভাই জালাল গৌড়ের সুলতান হন। এরপর তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারদের হত্যা করে গিয়াসউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি বাংলার সিংহাসনে বসে। ফলে বাংলায় শূর বংশের শাসনাবসান ঘটে।

  • শেরশাহের প্রশাসনিক সংস্কার-

  • প্রশাসনিক পরিবর্তন : শেরশাহ বাংলা দখল করে খিযির খানকে বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন। ১৫৪১ সালে খিযির খান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শেরশাহ তাকে বন্দি করেন এবং বাংলায় নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তে বেসামরিক শাসন কায়েম করেন। বাংলাকে ১৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি সরকারের শাসনভার একজন আমিনের উপর অর্পণ করেন। বাংলার শাসক হিসেবে কাজী ফযিলতকে নিয়োগ দিয়ে ‘আমিন-ই-বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কাজী ফযিলতের মাধ্যমে শেরশাহ বাংলা প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহ বন্ধ করেন। শেরশাহের পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয় এবং আফগানরা বাংলার আবহাওয়া ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। শেরশাহের মৃত্যুর সাথে সাথে কাজী ফজিলতের শাসন শেষ হয়।
  • শূর শাসনের অধীন বাংলার গভর্নর-
    খিজির খান (১৫৩৯-৪১)
    কাজী ফজিলত (১৫৪১-৪৫)
    মুহাম্মদ খান শূর (১৫৪৫-৫৪)

    বাংলাদেশ বিষয়াবলি
    বাংলাদেশ বিষয়াবলি
  • ইসলাম শাহ : শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ বাংলার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। তিনি মুহাম্মদ খান শূরকে বাংলার গভর্নর এবং সোলায়মান কররানিকে বিহারের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

    **কালীদাস গজদানি : আলাউদ্দিন হোসেন শাহের দেওয়ান ছিলেন কালীদাস গজদানি। তিনি একদিন রাজ-দরবারে সেনাপতি কালাপাহাড়ের (প্রকৃত নাম রাজচন্দ্র বা রাজেন্দ্র) সাথে ধর্ম নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কালাপাহাড়ের কাছে পরাস্ত হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলেমান খাঁ নাম ধারণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সুলতানের মেয়েকে বিয়ে করে। এই সূত্রে তিনি নিজেকে সুলতান গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদের (যিনি হোসেন শাহী বংশের শেষ রাজা ছিলেন) বৈধ উত্তরাধিকারী মনে করেন।
    তিনি বাংলার ভাটি এলাকায় (ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেটের নিম্নাঞ্চল) বিদ্রোহ করেন। পূর্ববঙ্গের অংশবিশেষ দখল করে সেখানকার স্বাধীন শাসকরূপে আসীন হন। তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে ঈশা খাঁ ছিলেন ইতিহাস খ্যাত বীর।

    ইসলাম শাহ তাজ খান দরিয়া খান নামক দুই সেনাপতিকে সোলায়মানের বিরুদ্ধে পাঠান। যুদ্ধে সুলায়মান পরাজিত হয়ে আনুগত্য স্বীকার করলেও পুনরায় বিদ্রোহ করে। তাজ খান ও দরিয়া খান সুলেমানকে হত্যা করে এবং তাঁর দুই ছেলে ঈসা ও ইসমাইলকে নির্বাসন দেওয়া হয়। এই ঈসা খানই পরবর্তীতে বারোভূঁইয়ার নেতা হয়েছিলেন। ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহ মারা যান।

  • আদিল শাহ : ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর অমাত্যরা তাঁর ছেলে ফিরুজকে সিংহাসনে বসায় কিন্তু ইসলাম শাহের শ্যালক মুবারিজ খান ফিরুজকে হত্যা করে আদিল শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। এই সময় বাংলার আফগান শাসক ছিলেন মুহাম্মদ খান। দিল্লীতে আফগানদের মধ্যে কোন্দলের সুযোগে তিনি বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সুলতান হন। রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি আরাকানের উপর হামলা করেন, জৌনপুর দখল করে আগ্রা ও দিল্লীর অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেন নি। আদিল শাহের সেনাপতি হিমুর নিকট তিনি পরাজিত হন ও নিহত হন।

  • গিয়াসউদ্দিন : শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে হত্যা করার পর শাহবাজ খানকে বাংলার শাসক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মুহাম্মদ শাহের ছেলে খিজির খান এলাহাবাদে বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করে এবং ‘গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর’ নাম ধারণ করেন।
    ১৫৫৬ সালে বাংলা আক্রমণ করে শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার অধিপতি হন। তিনি প্রথমে গৌড়ে তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন এবং তারপর পিতার হত্যাকারীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন। এ সময় দিল্লীর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। বৈরাম খান পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করেন এবং আকবর ক্ষমতায় আসেন। আদিল শাহের সেনাপতি তাজ খান দলত্যাগ করেন। আদিল শাহ বাংলার দিকে পালাতে চাইলে সুরজগড়ে গিয়াসউদ্দিন তাকে হত্যা করে।
    তাজ খান কররানিকে বিহারের শাসক নিযুক্ত করে গিয়াসউদ্দিন গৌড়ে ফিরে আসেন। অতঃপর গিয়াসউদ্দিন জৌনপুরে অভিযান পরিচালনা করেন কিন্তু অযোধ্যার নিকটে মুগল সেনাপতি খান-ই-জাহান তাঁর গতিরোধ করে। গিয়াসউদ্দিন তাঁর সাথে মিত্রতা স্থাপন করে বাংলায় ফিরে আসেন। ১৫৬০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা শাসন করেন।

  • জালালউদ্দিন : গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার ভাই জালালউদ্দিন বাংলার সুলতান হয়। তিনিও ভাইয়ের ন্যায় মুগলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে চলতেন। এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চল কররানি বংশীয় আফগানরা দখল করে নেয়। ফলে রাজ্য শাসনে বিভক্তি দেখা দেয়। ১৫৬৩ সালে জালাল শাহকে হত্যা করে গিয়াসউদ্দীন নামক জনৈক আফগান ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু কয়েকদিন পরই তাজখান কররানী (যাঁকে বাহাদুর শাহ বিহারের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন) গিয়াসউদ্দীনকে হত্যা করে বাংলায় কররানী শাসনের সুত্রপাত করেন।

  • পূর্বের আলোচনা পড়ুন : হুসাইন শাহী বংশের শাসন
    পরের আলোচনা পড়ুন : বাংলায় কররানি বংশের শাসন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page