ইসলাম খান, মির জুমলা ও শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদারি স্বর্ণযুগ বলা চলে। নিচে তাঁদের অবদান তুলে ধরা হল-
-
ইসলাম খান মাশহাদি
- তাঁর পারিবারিক নাম মির আবদুস সালাম; সম্রাট শাহজাহান তাঁকে ‘ইসলাম খান’ উপাধি দেন। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে আসাম ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে আরাকান রাজার বিদ্রোহ দমন ছিল তাঁর দায়িত্ব। কামরূপের রাজার ভাই বলী নারায়ণ হাজো প্রদেশের মুঘল থানাদারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ইসলাম খান শেখ মহিউদ্দিনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে সেনা পাঠান। কিন্তু মুঘল সেনারা এখানে পরাজিত হন। তখন ইসলাম খান মির জৈনুদ্দিন আলীর নেতৃত্বে প্রত্যাক্রমণ করে অহোমদের পরাজিত করেন। বলী নারায়ণ আসামে পালিয়ে যান। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলে অহোম-মুঘল বিরোধিতার অবসান হয়। (১৬৩৯)।
আরাকানের বিরোধটা ছিল ভিন্নরকম। আরাকানের মগরাজ শ্রী সুধর্মার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী নরমেখলা সিংহাসন দখল করলে রাজার ভাই মঙ্গত রায় চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের তাড়িয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে মগরাজ পর্তুগিজদের সহায়তায় চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে মঙ্গত রায় ও তারা অনুসারীরা ঢাকায় মুঘলদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। মগরাজ তাঁকে ধরার জন্য মুঘলের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান চালান কিন্তু সুবাদার তাকে বাধা দিলে মগবাহিনি ফেনী নদী অতিক্রম করার সাহস পায়নি। সম্রাট শাহজাহান ইসলাম খানকে প্রত্যাহার করে আগ্রার প্রধান উজিরপদে নিয়োগ দেন। তাঁর স্থলে যুবরাজ শাহ সুজাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে মগ-মুঘল বিরোধ অমীমাংসিত রয়ে যায়। ১৬১৩-১৬৩৯ সাল শাসকরূপে নয় জন সুবাদারের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের শাসনকার্য আগমন-নির্গমনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। -
শাহ সুজা
- ১৬৩৯ সালে তিনি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৪২ সালে তাঁকে ঊড়িষ্যা প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৬৩৯-১৬৬০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রদেশ দুটি শাসন করেন। তাঁর শাসনের দুটি সংক্ষিপ্ত বিরতি ছিল।
প্রথম বিরতি (১৬৪৭-৪৮) : এই সময় আফগানিস্তানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে তিনি সম্রাটের সাথে ছিলেন।
দ্বিতীয় বিরতি (১৬৫২) : এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কাবুলে অবস্থান করেন। তাঁর সুবেদারির শেষ দিকে ১৬৫৮ সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে দুবার তিনি রাজধানী দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তর করেন। তিনি কামরূপ ও আশ্রিত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন যা তৃতীয় আর এক প্রদেশের সমতুল্য ছিল। তবে তিনি ব্যাপক রাজ্য জয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। -
ঢাকায় সুজার স্থাপত্য কর্ম-
- শাহ সুজা বড় নির্মাতা ছিলেন। ঢাকার প্রাচীন মুগল দালানগুলো তাঁর সময়েই নির্মিত। বড় কাটরা, ও চুড়িহাট্টা মসজিদ। বড় কাটরা মূলত যুবরাজের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয় কিন্তু থাকার জন্য তিনি রাজমহল পছন্দ করায় বড় কাটরা বণিকদের বাসের জন্য দেওয়া হয় অর্থাৎ এটি সরাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। সৈয়দ মুরাদ হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। এখানে শিয়া সম্প্রদায় জামাতে নামাজ আদায় করত।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শাহ সুজা সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি বিদেশি বণিকদের আমন্ত্রণ জানান এবং অবাধে বাণিজ্য করার সুবিধা করে দেন। তিনি পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ‘নিশান’ (যুবরাজের দেওয়া অনুমতি পত্র) প্রদান করেন, যার মাধ্যমে সম্রাটের ‘ফরমানে’ দেওয়া বাণিজ্যিক সুবিধাদি স্বীকার করা হয়। -
ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কারণ
- বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে সকল পণ্য ক্রয় করা যেত না। ফলে তা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হত। সে পণ্যসামগ্রী পরিবহণে বাংলার অসংখ্য নদী পার হতে কোম্পানি বহু বাধার সম্মুখীন হতে লাগল। সেই সাথে বিভিন্ন শুল্ক দফতরে শুল্ক প্রদান করতে হত। এই অবস্থা নিরসনের জন্য কোম্পানির আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬৫১ সালে শাহ সুজা একটি আদেশ দেন। যেখানে তারা বার্ষিক নির্ধারিত ৩০০০ রুপি প্রদানের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক অধিকার ভোগ করার অনুমতি পায়। তারপরও জল-স্থলপথে কোম্পানির মালামাল পরিবহণে বাধা দূর হয় নি। কারণ, ব্যক্তিগত বাণিজ্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করে স্থানীয় কর্মকর্তাগণ প্রায়শই তল্লাশি করে বাড়তি শুল্ক নিত। ফলে শাহ সুজা ১৬৫৬ সালে আরেকটি আদেশে ইংরেজদের কোনো বাধা প্রদান ব্যতীত বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন।
সেই সময় রাজকুমার বা রাজকীয় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় দেশের স্বার্থ বিরোধী ছিল। সুজা অবৈধভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসায় চালাতেন বলে জানা যায়। তাঁর অধীন প্রদেশসমূহে নতুনভাবে রাজস্ব বন্দোবস্তের উদ্যোগ নেন। ফলে আকবরের আমলে রাজস্ব ব্যবস্থার চেয়ে ১৫% রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। -
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
- ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। গুজব রটে যে সম্রাট মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর বড় পুত্র দারাশিকো সিংহাসনে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করার জন্য তা গোপন রেখেছেন। ফলে সুজা রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। গঙ্গা নদীতে বহু সংখ্যক যুদ্ধ নৌকা নিয়ে তিনি রাজধানী (দিল্লী) অভিমুখে অগ্রসর হন। বাহাদুরপুরের যুদ্ধে তিনি দারার নিকট পরাজিত হয়ে রাজমহলে ফিরে আসেন। এরই মধ্যে আওরঙ্গজেব দারাকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
সুজা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। ১৬৫৮ সালে খাজোয়াতে সুজা আওরঙ্গজেবের নিকট পরাজিত হন। আওরঙ্গজেবের সুবাদার মীর জুমলার নিকট ১৬৬০ সালের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনি পরাজয় বরণ করেন। প্রতিটি পরাজয়ের পর তাঁর বাহিনী তাঁকে ছেড়ে যেতে থাকে কিন্তু তিনি তাতে হতোদ্যম হন নি। কিন্তু তান্ডাতে যখন চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সৈন্য পুনর্গঠিত করা আর সম্ভব নয় মনে করলেন তখন চিরকালের জন্য তিনি বাংলা ত্যাগ করে আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলা ত্যাগের পূর্বেই তিনি আরাকানের সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল প্রথমে মক্কা যাওয়া এবং সেখান থেকে পারস্য বা তুরস্কে। কিন্তু মে মাসে সমুদ্র উত্তাল থাকায় তিনি কয়েক মাসের জন্য আরাকানে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আরাকানের রাজধানী ম্রোহং পৌঁছলে রাজা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। শহরের উপকণ্ঠে থাকার জন্য তাঁকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়।
কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই অতিথির প্রতি রাজার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে থাকে। সুজার সম্পদ হস্তগত করা ও তাঁর সুন্দরী মেয়েকে পত্নী হিসেবে পাওয়ার অভিলাষ থেকে সুজার সঙ্গে রাজার বিরোধ বাধে। সুজাকে তাঁর পরিবার ও দলবলসহ নিপীড়ন করে মারা হয়। শুধু সামান্য কয়েকজন গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে হত্যাযজ্ঞ থেকে নিস্তার পায়। কিন্তু কোন মুগল রাজকুমার বা রাজকুমারী জীবিত ছিলেন না। -
মীর জুমলা
- প্রকৃত নাম মুহম্মদ সাঈদ। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইরানি। তবে মীর জুমলা নামেই তিনি ইতিহাসে সমধিক পরিচিত। বাল্যকালে তিনি গোলকুন্ডায় এক হীরার ব্যবসায়ীর অধীনে কেরানির চাকরি করেন। পরবর্তীকালে তিনি হীরার ব্যবসায় শুরু করেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত হন। একসময় তিনি গোলকুন্ডার সুলতানের অধীনে চাকরি নিয়ে উজির পদে উন্নীত হন।
-
দক্ষিণ ভারত আক্রমণ ও মীর জুমলার সাফল্য-
- সপ্তদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। তাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মীর জুমলা ১৬৪৬ সালে দক্ষিণ ভারত আক্রমণ করেন। তিনি অনেক রাজ্য জয় করেন। এই বিজয় অভিযানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল দুর্ভেদ্য গান্দিকোটা দুর্গ দখল করা। দুর্গটি দখল করার পর তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অঢেল বিত্তের অধিকারী হয়ে উঠেন। আর তাতেই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন স্বয়ং সুলতান। একসময় গুজব উঠে যে, সুলতান নন, বরং মীর জুমলাই এই সাম্রাজ্যের প্রধান কাণ্ডারি। সুলতান মীর জুমলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওদিকে সুলতানের এমন আচরণে মীর জুমলা মনঃক্ষুণ্ন হন। এক সময় তিনি মাতৃভূমিতে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবেন। তখন শাহজাদা আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে মোঘল সাম্রাজ্যের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেন। মীর জুমলা তা গ্রহণ করেন এবং সম্রাট তাঁকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানান।
সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে শাহ সুজার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য পাঠান। খাজোয়ার যুদ্ধে তিনি শাহ সুজাকে পরাজিত করে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬৬০ সালে তিনি বাংলার সুবাদার হন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে প্রশাসন নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছিল। তিনি পুনরায় ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন। অসৎ কাজীদের বরখাস্ত করেন।ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্গ, সেতু ও রাস্তা নির্মাণ করেন। তাঁর একটি দুর্গ ছিল বর্তমান ময়মনসিংহ রোডের পাশে টঙ্গী জামালপুরে। এই দুর্গের সাহায্যে তিনি উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। নারায়ণগঞ্জ জেলায় তার অন্য দুটি দুর্গ রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর কেল্লা, নারায়ণগঞ্জের তাঁর কীর্তি। নদীপথে মগ জলদস্যুসহ অন্যান্য শত্রুর আক্রমণ থেকে বাংলাকে নিরাপদ রাখতে এসব দুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৬৬৩ সালে তিনি নির্মাণ করেন ঢাকা গেট। ঢাকার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই ফটক ঢাকাবাসীকে মগ দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করত। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি কামান ব্যবহার করতেন। তাঁর ব্যবহৃত কামানের মধ্যে বিবি মরিয়ম এবং কালে খাঁ জমজম ছিল সুবিখ্যাত। বিবি মরিয়ম কামানটি এখনও গুলিস্তানের ওসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলার সুবাদার হিসেবে তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন। তাঁর আমলে পর্তুগিজদের বাণিজ্যে অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানির উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
-
মীর জুমলার কৃতিত্ব-
- তাঁর শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাঁর উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি যার দ্বারা তিনি সীমান্তবর্তী কামরূপ ও কুচবিহার রাজ্যগুলো জয় করেছিলেন। মীরজুমলা আসাম জয়েরও সিদ্ধান্ত নেন। তখনকার দিনে আসাম ছিল একটি বড় ভূখন্ড এবং এর ভৌগোলিক প্রকৃতি ছিল বাংলা থেকে অনেকটা ভিন্নতর। গৌহাটি থেকে যাত্রা শুরু করার পর ছয় সপ্তাহেরও কম সময়ে মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও পর্যন্ত এলাকা জয় করেন। তবে সেখানে প্রবল বর্ষাকালে মুগল বাহিনী উঁচু ভূমিতে আটকে পড়ে। রাস্তাঘাট ডুবে যায় ও ছোট ছোট নদী পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে বড় নদীর আকার ধারণ করে। অসমিয়াগণ রাত্রিকালীন আক্রমণ চালিয়ে মুগলদের নাজেহাল করে তোলে; রাস্তাগুলো প্লাবিত হওয়ায় ঘাঁটি থেকে তাদের জন্য খাবার আসাও বন্ধ হয়ে যায়। সেনারা ঘোড়াগুলো জবাই করে খেতে শুরু করে এবং বহু কষ্টে মুঘলরা সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে মুগল শিবিরে মহামারি দেখা দেয়। এর ফলে মীর জুমলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা মারা যায়। মীর জুমলা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্ষাকাল শেষ হলে মীর জুমলা ও আসামের রাজা এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর শর্তাবলি মুগলদের অনুকূল হলেও মীরজুমলার প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই অধিকৃত আসাম ভূখন্ড হাতছাড়া হয়ে যায়। ফিরে আসার পথে খিজিরপুরের নিকটে মীর জুমলার মৃত্যু হয় (১৬৬৩)।
-
শায়েস্তা খান
- শায়েস্তা খানের সুবেদারি বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মীর জুমলার মৃত্যুর পর অস্থায়ীভাবে এ প্রদেশের শাসক ছিলেন বিহারের শাসক দাউদ খান। পরে আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করে পাঠান। ঐতিহাসিকগণ তাঁর কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি আরাকানি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার থেকে বাংলার অধিবাসীদের রক্ষা করেন। তিনি আলেম, সুফি ও উচ্চ বংশীয় অনেককে লাখোরাজ জমি দান করেন। এই সময়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায় বাণিজ্যে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তাঁর সময়ে জিনিস এত সস্তা ছিলে যে, টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। ইতঃপূর্বে ১৬৬০ সালে মারাঠা নেতা শিবাজিকে দমন করতে তাঁকে পাঠানো হয়। তিনি যখন বাংলায় আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। এ বয়সে তিনি কোনো যুদ্ধে অংশ না নিলেও তাঁর ছেলেরা বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়। একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক হিসেবে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেন এবং বাংলা সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তাঁর সুবেদারি দুই পর্বে বিভক্ত ছিল। যথা-
প্রথম পর্ব (১৬৬৪-১৬৭৮ সাল)
দ্বিতীয় পর্ব (১৬৭৯-১৬৮৮ সাল)
এর মাঝে আজম খান ও মুহাম্মদ আযম বাংলার সুবেদারির দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, শাহজাদা আযম লালবাগ কেল্লা নির্মাণ শুরু করেছিলেন যদিও তিনি তা সমাপ্ত করতে পারেন নি। শায়েস্তা খানের উল্লেখযোগ্য অবদান- -
শায়েস্তা খানের অবদান-
- চট্টগ্রাম বিজয় : বাংলায় শায়েস্তা খানের অনন্য কৃতিত্ব চট্টগ্রাম বিজয়। স্বাধীন সুলতানি আমলের পর চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন আরাকানের অধীনে থাকে। ইসলাম খান চট্টগ্রাম ছাড়া সারা বাংলা মুগল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। আরাকানিদের শক্তিশালী নৌবহর মেঘনা অববাহিকার ভেতর দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত আসতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সে কারণে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষিত করা জরুরি ছিল। এছাড়াও আরাকানি মগ, পর্তুগিজ জলদস্যুরা মিলিত হয়ে প্রায়ই বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে ধন সম্পদ লুট করত। মগরা লোকদের বন্দি করে দাসরূপে বিক্রি করে দিত। শায়েস্তা খান বাংলায় পৌঁছার পূর্বেই আরাকান রাজা মেঘনা অববাহিকায় মুগল নৌবাহিনীকে পরাজিত করেন।
শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের মোকাবিলার জন্য অনেক রণতরীর ব্যবস্থা করা হয়। আরাকান রাজার হাত থেকে সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম জয় করাই এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল। ইতোমধ্যে দিলওয়ার নামে জনৈক পলাতক মুগল নৌ সেনাপতি আরাকানিদের থেকে সন্দ্বীপ দখল করেন। শায়েস্তা খানের নির্দেশে মুগল নৌ সেনাপতি ইবনে হোসেন ১৬৬৫ সালে সন্দ্বীপ আক্রমণ করেন। দিলওয়ার পরাজিত হন।
শায়েস্তা খান কূটনীতির মাধ্যমে মগ ও পর্তুগিজদের মধ্যে ভাঙন ধরায়। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পর্তুগিজদের সাহায্য ছাড়া আরাকানের মগ নৌ-সেনারা তেমন প্রতিরোধ করতে পারবে না। তিনি পর্তুগিজদের মুগল নৌবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অনেক পর্তুগিজদের চাকরি দেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম জয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। পর্তুগিজ ক্যাপ্টেনরা ৪০টি রণতরীসহ মুগল নৌবাহিনীতে যোগ দেয়। ইবনে হোসেনের তীব্র আক্রমণে মগরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর মুগলরা চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ করে। মাত্র একদিন যুদ্ধের পর মগ সেনারা আত্মসমর্পণ করে। সেনাপতি উমেদ খান ১৬৬৬ সালে বিজয়ীর বেশে চট্টগ্রাম দুর্গে প্রবেশ করেন। এখানে অনেক বাঙালি বন্দি ছিল তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। সম্রাটের নির্দেশে চট্টগ্রামের নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ। -
কুচবিহার ও সীমান্ত সম্পর্কিত ব্যবস্থা-
- মীর জুমলা কুচবিহার মুগল সাম্রাজ্যভুক্ত করলেও পরে তা মুগল শক্তির হাতছাড়া হয়ে যায়। কুচবিহারের আদিবাসী প্রজারা মুগলদের প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রোহ করলে পার্বত্য অঞ্চলে রাজা প্রাণ নারায়ণ কুচবিহার পুনর্দখল করেন। শায়েস্তা খানের অভিযানের কথা শুনে প্রাণ নারায়ণ ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে রাজি হন। প্রাণ নারায়ণের ছেলে মধুনারায়ণ পরবর্তীতে কর দিতে অস্বীকার করায় ১৬৭৫ সালে ইবাদত খানের নেতৃত্বে কুচবিহারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। যুদ্ধে মধুনারায়ণ পরাজিত হয়। কুচবিহার পুনরায় মুগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং ইবাদত খান এর ফৌজদার নিযুক্ত হন।
শায়েস্তা খান পার্শ্ববর্তী পার্বত্য রাজ্যগুলোর হামলা থেকে বাংলাকে রক্ষার ব্যবস্থা নেন। ১৬৭৬ সালে তিনি কুচবিহারের পশ্চিমে বিহারের পূর্ণিয়া জেলা সংলগ্ন পার্বত্য মুরং রাজ্যে অভিযান পাঠান। মুগলরা কুচবিহার আক্রমণ করলে সেখানকার পলাতক সেনারা মুরং রাজ্যে আশ্রয় নিত। মুরং রাজা পরাজিত হয়ে নিয়মিত কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৬৮২ সালে তিনি সিলেটের জয়ন্তিয়া রাজ্য দখল করেন।
-
ইংরেজ বণিকদের সাথে সংঘর্ষ-
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করলেও বাংলায় বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিলম্ব ঘটে। তারা ১৬৩৩ সালে উড়িষ্যার বালেশ্বর ও হরিহরপুরে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বাংলায় তখনও তাদের ব্যবসা সীমিত পরিসরে ছিল। বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে ১৬৫০ সালের পর যখন সুবাদার শাহ সুজা তাদেরকে বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ লাভ করে কোম্পানি তাদের ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারণ করতে থাকে। ১৬৫১ সালে হুগলিতে, ১৬৫৮ সালে কাসিমবাজার ও পরবর্তীতে রাজমহল ও মালদহসহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। ১৬৫৯ সালে যেখানে তাদের ব্যবসার মূলধন ছিল মাত্র ১০ হাজার পাউন্ড, ১৬৮১ সালে তা দুই লাখ ত্রিশ হাজার পাউন্ডে উন্নীত হয়। এরপরও ইংরেজরা কেবল ৩ হাজার টাকাই শুল্ক দিত। এতে মুগল সরকার ন্যায্য শুল্ক থেকে বঞ্চিত হয় এবং রাজকোষের প্রচুর ক্ষতি হয়। এছাড়াও অন্যান্য বিদেশি বণিকরা অসম করের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উল্লেখ্য, সুজা একজন সুবাদার হিসেবে ইংরেজদের এই সুবিধা দিয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান এমন কোনো সুবিধা দেন নি।
সম্রাট আওরঙ্গজেব সকল ব্যবসায়ীর জন্য একই হারে শুল্ক নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি ইংরেজ বণিকদের বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা রহিত করেন এবং সকল ব্যবসায়ীর জন্য পণ্যদ্রব্যের ৩.২৫% হারে শুল্ক ধার্য করেন। এতে ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হয় এবং তারা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা শুল্ক কর্মচারিদের হাত করার চেষ্টা করে। অনেক শুল্ক কর্মচারি ইংরেজদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। শুল্ক আদায়ে কর্মচারিদের সাথে ইংরেজদের সাথে মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। ফলে অবস্থা এমন হয় যে, ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সামরিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে থাকে। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে সৈন্য ভর্তি কয়েকটি জাহাজ ভারতে পৌঁছে এবং এর তিনটি হুগলিতে পাঠানো হয়। শায়েস্তা খান এ সংবাদ পেয়ে স্থানীয় ফৌজদারদের হুগলিতে সেনা সমাবেশ করার নির্দেশ দেন। ১৬৮৬ সালে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। হুগলির তিন ইংরেজ সেনা আক্রান্ত হওয়া থেকে এই যুদ্ধের শুরু।
মুগল ফৌজদার আব্দুল গণি শহর রক্ষায় সক্ষম হলেও ইংরেজরা শহরের অধিকাংশ স্থান পুড়িয়ে দেয়। ইংরেজ সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে সুতানটিতে আশ্রয় নেয়। এখানকার ইংরেজ এজেন্ট জব চার্নক সুবাদার শায়েস্তা খানের সাথে আপোষের চেষ্টা করে। কোনো প্রকার সমঝোতা না হওয়ায় ইংরেজরা সুতানটি ত্যাগ করে হিজলি দুর্গ দখল করে। শায়েস্তা খান সেনাপতি আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে বারো হাজার সেনা পাঠান। মুগল বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে ইংরেজরা মাদ্রাজে চলে যায়। এভাবে শায়েস্তা খান ইংরেজদের ঔদ্ধত্যের শাস্তি দেন। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৬৮৭ সালে পুনরায় ইংরেজদের বাংলায় আসার অনুমতি দেন।
এই সময় ভারতের পশ্চিম উপকূলে মুগলদের সাথে ইংরেজর যুদ্ধ হয়। ফলে শায়েস্তা খান তাঁর অনুমতি প্রত্যাহার করেন এবং জব চার্নক সুতানটি ত্যাগ করেন। ইংরেজ নৌবাহিনী বালেশ্বর দখল করে। তারা চট্টগ্রাম বন্দর দখলের চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে শায়েস্তা খান বদলি হয়ে আগ্রায় প্রত্যাবর্তন করেন।
তিনি আনকুরা পদ্ধতি রহিত করেন। কোনো ব্যক্তি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে সে এলাকার জমিদার সকল সম্পত্তি জোর করে দখল করত। এরূপ ঘৃণিত রীতিকে ‘আনকুরা’ বলা হত। এছাড়াও তিনি ‘ক্ষমতা প্রয়োগে ফি’ প্রথা বাতিল করেন। কোনো ব্যক্তি তার পাওনা টাকা আদায়ে সরকারের সহযোগিতা চাইলে উদ্ধারকৃত টাকার একচতুর্থাংশ রাষ্ট্রকে দিতে হত। জনস্বার্থে তিনি এই প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তাঁর শাসনকাল বাংলার স্থাপত্য শিল্পের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে ‘বাংলায় মুঘলদের স্বর্ণযুগ’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তাঁর আমলে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের মধ্যে ছোট কাটরা, লালবাগ কেল্লা, পরি বিবির সমাধি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা অন্য কোনো সুবাদার ঢাকায় শায়েস্তা খানের মতো নিজের স্মৃতিকে এত বেশি জ্বলন্ত রেখে যেতে পারেননি। - পূর্বের আলোচনা পড়ুন : বাংলায় সুবেদারি শাসন (প্রথম পর্ব)
- পরের আলোচনা : বাংলায় নবাবি শাসন