নেকলেস

Guy de Maupassant
  • লেখক পরিচিতি-
    গী দ্য মোপাসাঁ ১৮৫০ সালের ৫ই আগস্ট ফ্রান্সের নর্মান্ডি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম Henri René Albert Guy de Maupassant। তাঁর পিতার নাম গুস্তাভ দ্যা মোপাসাঁ ও মায়ের নাম লরা লি পয়টিভিন (Laure Le poittevin)। ১৮৬৭ সালে মোপাসাঁ একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পারিবারিক বন্ধু গুস্তাভ ফ্লবেয়ার মোপাসাঁর সাহিত্য-জীবনে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই মহান লেখকের নির্দেশনা ও সহযোগিতায় তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ফ্লবেয়ারের বাসায় মোপাসাঁর পরিচয় ঘটে এমিল জোলা ও ইভান তুর্গনেভসহ অনেক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে। কাব্যচর্চা দিয়ে তাঁর সাহিত্য-জীবন শুরু হলেও মূলত গল্পকার হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত কোনো বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে তিনি তাঁর সাহিত্য-চর্চার জগৎ তৈরি করেন। তাঁর বস্তুনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার তুলনা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। অসাধারণ সংযম ও বিস্ময়কর জীবনবোধ তাঁর রচনাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। গী দ্য মোপাসাঁ ১৮৯৩ সালে ৬ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার
  • অনুবাদক পরিচিতি-
    পূর্ণেন্দু দস্তিদার চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ধলঘাট গ্রামে ১৯০৯ সালের ২০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর পিতা চন্দ্রকুমার দস্তিদার ও মাতা কুমুদিনী দস্তিদার। তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নেওয়ায় কারাবরণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন আইনজীবী; সমাজ ভাবুক লেখক হিসেবেও খ্যাতি ছিল। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’। এছাড়াও তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘শেখভের গল্প’ ও ‘মোপাসাঁর গল্প’। তিনি ১৯৭১ সালের ৯ই মে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন।
সে ছিল চমৎকার এক সুন্দরী তরুণী। নিয়তির ভুলেই (মন্দভাগ্য) যেন এক কেরানির (নিম্নপদস্থ কর্মচারী) পরিবারে তার জন্ম হয়েছে। তার ছিল না কোনো আনন্দ, কোনো আশা। পরিচিত হবার, প্রশংসা পাওয়ার, প্রেমলাভ করার এবং কোনো ধনী অথবা বিশিষ্ট লোকের সঙ্গে বিবাহিত হওয়ার কোনো উপায় তার ছিল না (সমাজ ব্যবস্থার কারণে)। তাই শিক্ষা পরিষদ আপিসের সমান্য এক কেরানির সঙ্গে বিবাহ সে স্বীকার করে নিয়েছিল (উপায়ান্তর না দেখে)। নিজেকে সজ্জিত করার অক্ষমতার জন্য সে সাধারণভাবেই থাকত। কিন্তু তার শ্রেণির অন্যতম হিসেবে সে ছিল অসুখী (দরিদ্র হলেও বিলাসিতা না করতে পারায় তার মনে দুঃখ ছিল)। তাদের কোনো জাতিবর্ণ নেই (গরিবের কোনো জাতভেদ নেই)। কারণ জন্মের পরে পরিবার থেকেই তারা শ্রী, সৌন্দর্য ও মাধুর্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। সহজাত চাতুর্য, প্রকৃতিগত সুরুচিপূর্ণ ও আর বুদ্ধির নমনীয়তাই হলো তাদের আভিজাত্য, যার ফলে অনেক সাধারণ পরিবারের মেয়েকেও বিশিষ্ট মহিলার সমকক্ষ করে তোলে (বয়সের পরিপক্কতা)। সর্বদা তার মনে দুঃখ।
তার ধারণা (উচ্চাশা), যত সব সুরুচিপূর্ণ ও বিলাসিতার বস্তু আছে, সেগুলির জন্যই তার জন্ম হয়েছে। তার বাসকক্ষের দারিদ্র, হতশ্রী দেওয়াল, জীর্ণ চেয়ার এবং বিবর্ণ জিনিসপত্রের জন্য সে ব্যথিত হতো (দারিদ্র্য দেখে)। তার মতো অবস্থার (দরিদ্র মেয়েরা) অন্য কোনো মেয়ে এসব জিনিস যদিও লক্ষ্য করত না, সে এতে দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হতো। যে খর্বকায় ব্রেটন (ফ্রান্সের একটি অঞ্চল) এই সাধারণ ঘরটি তৈরি করেছিল তাকে দেখলেই তার মনে বেদনাভরা দুঃখ আর বেপরোয়া সব স্বপ্ন জেগে উঠত। সে ভাবত তার থাকবে প্রাচ্য-চিত্র শোভিত, উচ্চ ব্রোঞ্জের আলোকমণ্ডিত পার্শ্বকক্ষ (শোবার ঘর)। আর থাকবে দুজন বেশ মোটাসোটা গৃহ-ভৃত্য। তারা খাটো পায়জামা পরে যে বড় আরামকেদারা দুটি গরম করার যন্ত্র থেকে বিক্ষিপ্ত ভারি হওয়ায় নিদ্রালু হয়ে উঠেছে, তাতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকবে (তখন মেয়েটি প্রভাব খাটাবে)। সে কামনা করে একটি বৈঠকখানা, পুরানো রেশমি পর্দা সেখানে ঝুলবে। থাকবে তাতে বিভিন্ন চমৎকার আসবাব, যার ওপর শোভা পাবে অমূল্য সব প্রাচীন কৌতূহল উদ্দীপক সামগ্রী। যেসব পরিচিত ও আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ সব মেয়েদের কাম্য, সেসব অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে বিকাল পাঁচটায় গল্পগুজব করবার জন্য ছোট সুরভিত একটি কক্ষ সেখানে থাকবে।
তিনদিন ধরে ব্যবহৃত একখানা টেবিলক্লথ ঢাকা গোল একটি টেবিলে তার স্বামীর বিপরীত দিকে সে যখন সান্ধ্যভোজে বসে এবং খুশির আমেজে তার স্বামী বড় সুরুয়ার (তরকারি) পাত্রটির ঢাকনা তুলতে বলে, ও কী ভালো মানুষ! এর চেয়ে ভালো কিছু আমি চাই না (স্বামী মেয়েটির উচ্ছসিত প্রশংসা করবে)- তখন তার মনে পড়বে আড়ম্বরপূর্ণ সান্ধ্যভোজের কথা, উজ্জ্বল রৌপ্যপাত্রাদি, মায়াময় বনভূমির মধ্যে প্রাচীন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিরল পাখির চিত্রশোভিত কারুকার্যপূর্ণ পর্দা দিয়ে ঢাকা দেওয়ালের কামনা। সে ভাবে, অপরূপ পাত্রে পরিবেশিত হবে অপূর্ব খাদ্য আর গোলাপি রংয়ের রোহিত মাছের টুকরা অথবা মুরগির পাখনা খেতে খেতে মুখে সিংহ-মানবীর হাসি (বীরপুরুষের হাসি) নিয়ে কান পেতে শুনবে চুপি-চুপি-বলা প্রণয়লীলার কাহিনি।

তার কাছে ফ্রক বা জড়োয়া গহনা (ভারী গহনা) নেই-নেই বলতে কিছু নেই (বলার মতো কিছুই নেই)। অথচ ঐ সব বস্তুই (বিলাসী দ্রব্য) তার প্রিয়। তার ধারণা ঐসবের জন্যই তার সৃষ্টি। সুখী করার, কাম্য হওয়ার, চালাক ও প্রণয়যাচিকা (কারো আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার) হবার কতই না তার ইচ্ছা। তার কনভেন্টের (মিশনারি পরিচালিত স্কুল) সহপাঠিনী এক ধনী বান্ধবী ছিল। তার সঙ্গে দেখা করতে তার ভালো লাগত না। কারণ, দেখা করে ফিরে এসে তার খুব কষ্ট লাগত। বিরক্তি, দুঃখ, হতাশা ও নৈরাশ্যে সমস্ত দিন ধরে সে কাদঁত।

এক সন্ধ্যায় হাতে একটি বড় খাম নিয়ে বেশ উল্লাসিত হয়ে তার স্বামী ঘরে ফিরল। সে বলল, ‘এই যে, তোমার জন্য এক জিনিস এনেছি।’ মেয়েটি তাড়াতাড়ি খামটি ছিড়ে তার ভিতর থেকে একখানা ছাপানো কার্ড বের করল (নিমন্ত্রণপত্র)। তাতে নিচের কথাগুলি মুদ্রিত ছিল,
জনশিক্ষা মন্ত্রীমাদাম জর্জ রেমপননু আগামী ১৮ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাহাদের নিজ বাসগৃহে মসিঁয়ে ও মাদাম লোইসেলের উপস্থিতি কামনা করেন।’

তার স্বামী যেমন আশা করেছিল তেমনভাবে খুশি হওয়ার পরিবর্তে মেয়েটি বিদ্বেষের ভাব নিয়ে আমন্ত্রণ লিপিখানা টেবিলের উপর নিক্ষেপ করে বিড় বিড় করে বলে, ‘ওখানা নিয়ে তুমি আমায় কী করতে বল?’ কিন্তু লক্ষ্মীটি, আমি ভেবেছিলাম, এতে তুমি খুশি হবে। তুমি বাইরে কখনও যাও না, তাই এই এক চমৎকার সুযোগ! এটা জোগাড় করতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সবাই একখানা চায়, কিন্তু খুব বেছে বেছে দেওয়া হয়েছে (নির্বাচিত লোকদের)। কর্মচারীদের বেশি দেওয়া হয়নি। সেখানে তুমি গোটা সরকারি মহলকে দেখতে পাবে।
বিরক্তির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি অধীরভাবে বলে উঠল; ঐ ঘটনার মতো একটি ব্যাপার কী পরে আমি যাব বলে তুমি মনে কর? সে ঐ সম্পর্কে কিছু ভাবেনি। তাই সে বিব্রতভাবে বলে, কেন? থিয়েটারে যাবার সময় তুমি যেই পোশাকটা পর সেটা পরবে। ওটা আমার কাছে খুব সুন্দর লাগে।
তার স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে সে (স্বামী) আতঙ্কে নির্বাক ও হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তার (স্বামী) চোখের পাশ থেকে বড় দুফোঁটা অশ্রু তার গালের উপর গড়িয়ে পড়ল।
সে থতমতভাবে বলল, “কী হলো? কী হলো তোমার?”
প্রবল চেষ্টায় মেয়েটি নিজের বিরক্তি দমন করে (স্বামীর সহানুভূতি বিরক্ত লাগে), তার সিক্ত গা মুছে ফেলে শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়। কিছুই না। শুধু আমার কোনো পোশাক নেই বলে আমি ঐ ব্যাপারে যেতে পারব না। তোমার যে কোনো সহকর্মীর স্ত্রীর পোশাক আমার চেয়ে যদি ভালো থাকে, কার্ডখানা নিয়ে তাকে দাও।
সে (স্বামী) মনে মনে দুঃখ পায়। তারপর সে জবাব দেয়, “মাতিলদা, বেশ তো চল আলাপ করি আমরা। এমন কোনো পোশাক অন্য কোনো উপলক্ষেও যা দিয় কাজ চলবে অথচ বেশ সাদাসিধা, তার দাম কত আর হবে?
কয়েক সেকেন্ড মেয়েটি চিন্তা করে দেখে এমন একটি সংখ্যার বিষয় স্থির করল যা চেয়ে বসলে হিসাবি কেরানির (স্বামী) কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গে এক আতঙ্কিত প্রত্যাখান যেন না আসে। শেষপর্যন্ত ইতস্তত করে, মেয়েটি বলল, “আমি ঠিক বলতে পারছিনা, তবে আমার মনে হয় চারশ ফ্রাঁ হলে তা কেনা যাবে।
শুনে তার মুখ ম্লান হয়ে গেল। কারণ, তার যেসব বন্ধু গত রবিবার নানতিয়ারের সমভূতিতে ভরতপাখি (এক ধরনের ছোট্ট পাখি) শিকারে গিয়েছিল, আগামী গ্রীষ্মে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ইচ্ছায় একটি বন্দুক কিনবার জন্য ঠিক ততটা অর্থই সে সঞ্চয় করেছিল। তা সত্ত্বেও জবাব দিল, “বেশ তো। আমি তোমায় চারশত ফ্রাঁ দেব। কিন্তু বেশ সুন্দর একটি পোশাক কিনে নিও।
বল নাচের দিন যতই এগিয়ে আসতে থাকে ততই মাদাম লোইসেলকে বিচলিত উদ্বিগ্ন মনে হয়। অবশ্য তার পোশাক প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। একদিন সন্ধ্যায় তার স্বামী তাকে বলল, “তোমার হয়েছে কী? গত দুই তিনদিন ধরে তোমার কাজকর্ম কেমন অদ্ভুত ঠেকছে (অমনোযোগী আচরণ)। শুনে মেয়েটি জবাব দেয়। আমার কোনো মণিমুক্তা, একটি দামি পাথর কিছুই নেই যা দিয়ে আমি নিজেকে সাজাতে পারি। আমায় দেখলে কেমন গরিব গরিব মনে হবে। তাই এই অনুষ্ঠানে আমার না যাওয়াই ভালো হবে।
স্বামী বলল, কিছু সত্যকার ফুল (তাজা ফুল) দিয়ে তুমি সাজতে পার।এই ঋতুতে তাতে বেশ সরুচিপূর্ণ দেখায়। দশ ফ্রাঁ দিলে তুমি দুটি কি তিনটি অত্যন্ত চমৎকার গোলাপফুল পাবে।

মেয়েটি ঐ কথায় আশ্বস্ত হলো না। সে জবাবে বলল, না ধনী মেয়েদের মাঝখানে পোশাকে পরিচ্ছদে ঐ রকম খেলো দেখানোর (মিথ্যা সাজ দেখানো) মতো আর বেশি কিছু অপমানজনক নেই।
তখন তার স্বামী চেঁচিয়ে উঠল, “আচ্ছা কী বোকা দেখ আমরা! যাও, তোমার বান্ধবী মাদার ফোরসটিয়ারের সঙ্গে দেখা করে তাকে বল তার জড়োয়া গহনা যেন তোমায় ধার দেয়। এটুকু আদায় করার তো তার সঙ্গে তোমায় পরিচয় যথেষ্ট।”
সে আনন্দধ্বনি করে উঠল। তারপর সে বলল, “সত্যিই তো! এটা আমি ভাবিনি।”
পরদিন সে তার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কাহিনি তাকে বলল। মাদাম ফোরসটিয়ার তার কাঁচের দরজা লাগানো গোপনকক্ষে গিয়ে বড় একটি গহনার বাক্স বের করে এনে তা খুলে বলল, “ভাই, যা ইচ্ছা এখান থেকে নাও।”
সে প্রথমে দেখল কয়েকটি কঙ্কণ, তারপর একটি মুক্তার মালা। ও মণিমুক্তা-খচিত চমৎকার কারুকার্য-ভরা-একটি সোনার ভিনিশাঁর ‘ক্রশ’ (ভেনিসের তৈরি ক্রুশ)। আয়নার সামনে গিয়ে সে জড়োয়া গহনাগুলি পরে পরে দেখে আর ইতস্তত করে (পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে দোমনা), কিন্তু ওগুলি নেওয়ার সিদ্ধান্তও করতে ছেড়ে যেতেও পারে না। তারপরও সে জিজ্ঞাসা করে, “আর কিছু নেই তোমার?”
কেন? আছে, তোমার যা পছন্দ তুমি তা বেছে নাও।
হঠাৎ সে কালো স্যাটিনের (মসৃণ ও চকচকে রেশমি কাপড়) একটি বাক্সে দেখল অপরূপ একখানা হীরার হার। অদম্য কামনায় (না পাওয়ার ভয়ে) তার বুক দুর দুর করে। সেটা তুলে নিতে গিয়ে তার হাত কাঁপে।
সে তার পোশাকের উপর দিয়ে সেটা গলায় তুলে নেয় এবং সেগুলো দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়। তারপর উদ্বেগভরা ইতস্ততভাবে সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ঐখানা (হীরার হার) আমায় শুধু ধার দেবে? শুধু এটা?”
কেন দেব না? নিশ্চয় দেব।
সে সবেগে তার বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে, পরম আবেগে তাকে বুকে চেপে ধরে। তারপর তার সম্পদ নিয়ে সে চলে আসে।
‘বল’ নাচের দিন এসে গেল। মাদাম লোইসেলের জয়জয়কার। সে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী, সুরুচিময়ী, সুদর্শনা হাস্যময়ী ও আনন্দপূর্ণ। সব পুরুষ তাকে লক্ষ্য করছিল, তার নাম জিজ্ঞাসা করে তার সঙ্গে আলাপের আগ্রহ প্রকাশ করছিল। মন্ত্রিসভার সব সদস্যের তার সঙ্গে ‘ওয়ালটজ’ নৃত্য করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী তার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। আনন্দে মত্ত হয়ে আবেগ ও উৎসাহ নিয়ে সে নৃত্য করছিল। তার রূপের বিজয়গর্বে, সাফল্যের গৌরবে সে আর কিছুই ভাবে না। এক আনন্দের মেঘের ওপর দিয়ে যেন ভেসে আসছিল! এই সব আহুতি (আহ্বান) ও মুগ্ধতা আর জাগ্রত সব কামনা। যে কোনো মেয়ের অন্তরে এই পরিপূর্ণ বিজয় কত মধুর!ভোর চারটার দিকে সে বাড়ি ফিরে গেল। অন্য সেই তিনজন ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব বেশি ফুর্তিতে মত্ত ছিল, তাদের সঙ্গে তার স্বামী ছোট বিশ্রামকক্ষে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আধঘুমে বসেছিল। বাড়ি ফিরবার পথে গায়ে জড়াবার জন্য তারা যে আটপৌরে (সর্বদা ব্যবহার্য) সাধারণ চাদর নিয়ে এসেছিল সে তার কাঁধের ওপর সেটি ছড়িয়ে দেয়। ‘বল’ নাচের পোশাক অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে ঐটির দারিদ্র্য সপুরিস্ফূট হয়ে উঠছিল। মেয়েটি তা অনুভব করতে পারে। তাই অন্য যেসব ধনী মেয়ে দামি পশমি চাদর দিয়ে গা ঢেকেছিল তাদের চোখে না পড়বার জন্য সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল।
লোইসেল তাকে টেনে ধরে বলল, “থামো, তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে ওখানে। আমি একখানা গাড়ি ডেকে আনি।”
কিন্তু মেয়েটি কোনো কথায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। রাস্তায় যখন তারা পৌঁছে গেল, সেখানে কোনো গাড়ি পাওয়া গেল না। তারা গাড়ির খোঁজ করতে করতে দূরে কোনো একখানাকে দেখে তার গাড়োয়ানকে ডাকতে থাকে।
হতাশ হয়ে (গাড়ি না পাওয়ায়) কাঁপতে কাঁপতে তারা সিন নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে পুরাতন একখানা তারা পায়, তাহলো সেই নিশাচর দুই-যাত্রীর গাড়ি যা প্যারিতে (প্যারিস) সন্ধ্যার পর লোকের চোখে পড়ে তার একখানা, যেইদিনে এইগুলি নিজের দুর্দশা দেখাতে লজ্জা পায়। ঐখানি তাদের মার্টার স্ট্রিটে ঘরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারা ক্লান্তভাবে তাদের কক্ষে গেল।

মেয়েটির সব কাজ শেষ। কিন্তু স্বামীর ব্যাপারে তার মনে পড়ল যে দশটায় তাকে আপিসে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। নিজেকে গৌরবময় রূপে (নিজের রূপের সৌন্দর্য) শেষ একবার দেখার জন্য সে আয়নার সামনে গিয়ে তার গলায় চাদরখানা খোলে। হঠাৎ সে আর্তনাদ করে উঠল। তার হারখানা গলায় জড়ানো নেই। তার স্বামীর পোশাক তখন মাত্র অর্ধেক খোলা হয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে?
উত্তেজিতভাবে মেয়েটি তার দিকে ফিরে বলল, “আমার-আমার কাছে-মাদাম ফোরস্টিয়ারের হারখানা নেই।”
আতঙ্কিতভাবে সে (স্বামী) উঠে দাঁড়াল, “কী বললে। তা কী করে হবে? এটা সম্ভব নয়।” পোশাকের ও বর্হিবাসের ভাঁজের মধ্যে, পকেটে, সব জায়গায় তারা খোঁজ করে। কিন্তু তা পাওয়া গেল না।
স্বামী জিজ্ঞাসা করল, “ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার সময় যে তোমার গলায় ছিল, তোমার ঠিক মনে আছে?”

হ্যাঁ, আমরা যখন বিশ্রামকক্ষ দিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, তখনও তা ছিল আমার খেয়াল আছে। কিন্তু তুমি যদি ওটা রাস্তায় হারাতে, ওটা পড়বার শব্দ আমাদের কানে শোনা উচিত ছিল। গাড়ির মধ্যেই নিশ্চয়ই পড়েছে মনে হয়। হ্যাঁ, সম্ভবত তাই।
তুমি গাড়ির নম্বরটি টুকে নিয়েছিল?
না।
আর তুমি কি তা লক্ষ করেছিলে?
না।
হতাশভাবে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত লোইসেল আবার পোশাক পরে। সে বলল, “আমি যাচ্ছি। দেখি যতটা রাস্তা আমরা হেঁটেছিলাম, সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় কি না।”
তারপর সে গেল মেয়েটি তার সান্ধ্য গাউন পরেই সে রয়ে গেল। বিছানায় শুতে যাবার শক্তি তার নেই। কোনো উচ্চাশা বা ভাবনা ছাড়াই সে একখানা চেয়ারে গা এলিয়ে পড়ে রইল।
সকাল সাতটার দিকে তার স্বামী ফিরে এলো। কিছুই সে খুঁজে পায়নি। সে পুলিশের কাছে ও গাড়ির আপিসে গিয়েছিল এবং পুরস্কার ঘোষণা করে একটা বিজ্ঞাপনও দিয়ে এসেছে। সে যথাসাধ্য করে এসেছে বলে তাদের মনে কিছুটা আশা হলো। ঐ ভয়ানক বিপর্যয়ে (দামি হার হারানোর ভয়ে) মেয়েটি সারাদিন এক বিভ্রান্ত অবস্থায় কাটাল।
সন্ধ্যাবেলা যখন লোইসেল ফিরে এলো তখন তার মুখে যন্ত্রণার মলিন ছাপ, কিছুই সে খুঁজে পায়নি। সে বলল, তোমার বান্ধবীকে লিখে দিতে হবে যে হারখানার আংটা তুমি ভেঙে ফেলেছ, তাই তা তুমি মেরামত করতে দিয়েছ।। তাতে আমরা ভেবে দেখবার সময় পাব।
তার নিদের্শমত মেয়েটি তাই লিখে দিল। এক সপ্তাহ শেষ হওয়ায় তারা সব আশা ত্যাগ করল। বয়সে পাঁচ বছরের বড় লোইসেল ঘোষণা করল, “ঐ জড়োয়া গহনা ফেরত দেবার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।”
পরদিন যেই বাক্সে ওটা ছিল, তার ভিতরে যেই স্বর্ণকারের নাম ছিল, তার কাছে তারা সেটা নিয়ে গেল। সে তার খাতাপত্র ঘেঁটে বলল, “মাদাম, ঐ হারখানা আমি বিক্রি করিনি, আমি শুধু বাক্সটা দিয়েছিলাম।”
তারপর তারা সেই হারটির মত হার খোঁজ করার জন্য, তাদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে এক স্বর্ণকার থেকে অন্য স্বর্ণকারের কাছে যেতে থাকে। দুজনেরই শরীর বিরক্তি ও উদ্বেগে খারাপ হয়ে গেছে।
প্যালেস রয়েলে তারা এমন এক হীরার কণ্ঠহার দেখল সেটা ঠিক তাদের হারানো হারের মতো। তার দাম চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ। ছত্রিশ হাজার ফ্রাঁতে তারা তা পেতে পারে। তিনদিন যেন ওটা বিক্রি না করে সে জন্য তারা স্বর্ণকারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করল। তারা আরও ব্যবস্থা করল যে, যদি ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগে ঐ হারটি খুঁজে পাওয়া যায়, তারা এটা ফেরত দিলে চৌত্রিশ হাজার ফ্রাঁ ফেরত নিতে পারবে।
লোইসেলের কাছে তার বাবার মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত আঠারো হাজার ফ্রাঁ ছিল। বাকিটা সে ধার করল। মাদাম লোইসেল যখন জড়ো গহনা মাদাম ফোরস্টিয়ারকে ফেরত দিতে গেল তখন শেষোক্ত মেয়েটি (ফোরস্টিয়ার) নির্জীবকণ্ঠে (উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে) বলল, “ওটা আরও আগে তোমার ফেরত দেওয়া উচিত ছিল; কারণ তা আমারও দরকার হতে পারত।
তার বান্ধবী সেই ভয় করেছিল, তেমনভাবে সে গহনার বাক্সটি খুলল না। যদি বদলে দেওয়া হয়েছে। টের পেত, সে কী মনে করত? সে কী বলত? সে কী তাকে অপহারক ভাবত?

এবার মাদাম লোইসেল দারিদ্রের জীবনের ভয়াবহতা (জীবনের কঠিন বাস্তবতা) বুঝতে পারে। সে তার নিজের কাজ সম্পূর্ণ সাহসের সঙ্গেই করে যায়। ঐ দুঃখজনক দেনা শোধ করা প্রয়োজন। সে তা দেবে।
দাসীকে তারা বিদায় করে দিল। তারা তাদের বাসা পরিবর্তন করল। নিচু ছাদের কয়েকটি কামরা তারা ভাড়া করল। ঘরকন্নার কঠিন (গৃহস্থালি কাজ) সব কাজ ও রান্নাঘরের বিরক্তিকর কাজকর্ম সে শিখে নিল। তার গোলাপি নখ দিয়ে সে বাসন ধোয়, তৈলাক্ত পাত্র ও ঝোল রাঁধার কড়াই মাজে। ময়লা কাপড় চোপড়, শেমিজ, বাসন মোছার গামছা সে পরিষ্কার করে দড়িতে শুকাতে দেয়। রোজ সকালে সে আবর্জনা নিয়ে রাস্তায় ফেলে। সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপে শ্বাস নেবার জন্য থেমে থেমে সে জল তোলে।

সাধারণ পরিবারের মেয়ের মতো পোশাক পরে সে হাতে ঝুড়ি নিয়ে মুদি, কসাই ও ফলের দোকানে যায় এবং তার দুঃখের পয়সার একটির জন্য পর্যন্ত দর কষাকষি করে। প্রত্যেক মাসেই সময় চেয়ে কিছু দলিল বদল করতে হয়, কাউকে কিছু শোধ দিতে হয় (ঋণ করা ও পরিশোধ করা)।
তার স্বামীও সন্ধ্যাবেলা কাজ করে। সে কয়েজকন ব্যবসায়ীর হিসাবের খাতা ঠিক করে। রাত্রে এক পাতা পাঁচ ‘সাও’ হিসেবে সে প্রায় লেখা নকল করে। এরকম জীবন দশ বছর ধরে চলল। দশ বছরের শেষে তারা সব কিছু মহাজনের সুদসহ প্রাপ্য নিয়ে সব ক্ষতিপূরণ করে ফেলতে পারে। তাছাড়া কিছু তাদের সঞ্চয়ও হলো।
মাদাম লোইসেলকে দেখলে এখন বয়স্কা বলে মনে হয়। সে এখন গরিব গৃহস্থঘরের শক্ত, কর্মঠ ও অমার্জিত মেয়ের মতো হয়ে গেছে। তার চুল অবিন্যস্ত ঘাঘরা একপাশে মোচড়ানো, হাতগুলো লাল। সে চড়াগলায় কথা বলে এবং বড় বড় কলসিতে জল এনে মেঝে ধোয়। কিন্তু কখনও তার স্বামী যখন আপিসে থাকে, জানালার ধারে বসে বিগত দিনের সেই সান্ধ্য অনুষ্ঠান ও সেই ‘বল’ নাচে তাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল ও এমন অতিরিক্ত প্রশংসা পেয়েছিল, তার কথা সে ভাবে (অতীত সুখের দিন স্মরণ)।
যদি সে গলার সেই হারখানা না হারাত তাহলে কেমন হতো? কে জানে কে বলতে পারে? কী অনন্য সাধারণ এই জীবন আর তার মধ্যে কত বৈচিত্র্য! সামান্য একটি বস্তুতে (আকস্মিক বিপদ ও সৌভাগ্যের অনিশ্চয়তা) কী করে একজন ধ্বংস হয়ে যেতে আবার বাঁচতেও পারে!

এক রবিবারে সারা সপ্তাহের নানা দুশ্চিন্তা মন থেকে দূর করার জন্য সে যখন চাম্পস এলসিসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ একটি শিশু নিয়ে ভ্রমণরতা একজন মেয়ে তার চোখ পড়ল। সে হলো মাদাম ফোরস্টিয়ার। সে এখনও যুবতী, সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া। দেখে মাদাম লোইসেলের মন খারাপ হয়ে গেল (নিজের দুঃখ স্মরণ করে)।
সে কি ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে? হ্যাঁ, অবশ্যই বলবে। তাকে যখন সব শোধ করা হয়েছে, তখন সব কিছু খুলে সে বলবে। কেন বলবে না? সে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, সুপ্রভাত জেনি, তার বন্ধু তাকে চিনতে পারল না। এক সাধারণ মানুষ তাকে এমন অন্তরঙ্গভাবে সম্বোধন করায় সে অবাক হলো।
সে বিব্রতভাবে বলল, “কিন্তু মাদাম-আপনাকে চিনতে পারলাম না। বোধহয় আপনার ভুল হয়েছে।”
না, আমি মাতিলদা লোইসেল।
তার বান্ধবী বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, হায়, আমার বেচারি মাতিলদা। এমনভাবে কী করে তুমি বদলে গেলে?
হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর তেকে আমার দুর্দিন যাচ্ছে- বেশ কিছু দুঃখের দিন গেছে আর সেটা হয়েছে শুধু তোমার জন্য।
আমার জন্য? তা কী করে হলো?
সেই যে কমিশনারের বল নাচের দিন তুমি আমাকে তোমার হীরার হার পরতে গিয়েছিলে, মনে পড়ে?
হ্যাঁ, বেশ মনে আছে।
কথা হচ্ছে, সেখানা আমি হরিয়ে ফেলেছিলাম।
কী বলছ তুমি? কী করে তা আমায় তুমি ফেরত দিয়েছিলে?
ঠিক সেখানার মতো একটি তোমাকে আমি ফেরত দিয়েছিলাম। তার দাম দিতে দশ বছর লেগেছে। তুমি বুঝতেই পার। আমদের মতো লোক যাদের কিছুই ছিল না, তাদের পক্ষে তা সহজ ছিল না। কিন্তু তা শেষ হযেছে এবং সেজন্য আমি এখন ভালোভাবে নিশ্চিন্ত হয়েছি।

মাদাম ফোরস্টিয়ার তাকে কথার মাঝপথে থামিয়ে বলল, “তুমি বলছ যে, আমারটা ফিরিয়ে দেবার জন্য তুমি একখানা হীরার হার কিনেছিলে?”
হ্যাঁ, তা তুমি খেয়াল করনি? ঐ দুটি এক রকম ছিল বলে সে গর্বের ভাবে ও সরল আনন্দে হাসল (মাতিলদার হার বদলের বিষয়টি ধরতে না পারায়)।
দেখে মাদার ফোরস্টিয়ারের মনে খুব লাগল (মিথ্যা আত্মতৃপ্তি থাকায়)। সে তার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “হায়, আমার বেচারি মাতিলদা। আমারটি ছিল নকল। তার দাম পাঁচশত ফ্রাঁর বেশি হবে না।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top