মামলুক শাসন (১২০৬-১২৯০)- দিল্লি সালতানাতের ইতিহাস (১ম পর্ব)

মামলুক শাসনের ইতিবৃত্ত

মামলুক কারা?

  • আরবি ‘মামলুক’ (مملوك) শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। তখন যুদ্ধবন্দীদের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর আমল থেকেই দাসদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হত। মামলুকরা সিংহাসনে আরোহণ করে আইয়ুবিদের সময়। ‘আইয়ুবি’ সুলতান আল মালিকুস সালিহর সময় ক্রীতদাসদের দেহরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেন। অপ্রতিরোধ্য মোগলরা (চেঙ্গিস খান) মিশর আক্রমণ করলে মামলুকরাই সালতানাতের হাল ধরে। তারাই প্রথম মুগলদের পরাজিত করে। নাজিমুদ্দিন আইবেকের মাধ্যমে মামলুক শাসনের সূচনা হয়। সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজের মাধ্যমে মামলুক শাসন পাকাপোক্ত হয়। মামলুক বংশের শাসকরা অধিকাংশই ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস। মামলুক সাম্রাজ্যের মধ্যে রয়েছে-
    ১. মামলুক সালতানাত (দিল্লি) (১২০৬-১২৯০)
    ২. মামলুক সালতানাত (কায়রো) (১২৫০-১৫১৭)
    ৩. ইরাকের মামলুক রাজবংশ (১৭০৪-১৮৩১, উসমানীয় ইরাকের অধীন)
    ৪. বুরজি ও বাহরি রাজবংশ
  • ১২০৬-১২৯০ সাল পর্যন্ত কুতুবউদ্দিন, ইলতুৎমিশ, বলবন ও তাঁদের বংশধররা শাসন করে। প্রথম জীবনে কুতুবউদ্দিন, ইলতুৎমিশ, বলবন এই তিনজনই ক্রীতদাস ছিলেন। সিংহাসনে বসার পূর্বে তাঁরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। তাঁদের শাসনামল ছিল তুর্কি সালতানাদের প্রথম যুগ। এই যুগেই দিল্লী সালতানাতের শাসন কাঠামো গড়ে উঠে।
দিল্লি সালতানাত
 এক নজরে দিল্লি সালতানাত

   কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসন

  • কুতুবউদ্দিন আইবেক : ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক। এক ক্রীতদাস ব্যবসায়ী তাকে নিশাপুরে কাজী ফখরুদ্দীনের নিকট বিক্রি করে দেয়। সেখানে তিনি সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র ও সামরিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে উঠেন। ফখরুদ্দিনের মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ঘুরি কুতুবউদ্দিনকে কিনে নেয়। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আমিরই আকুর (আস্তাবলের প্রধান) পদে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হন। তিনি ১১৯২-১২০৬ পর্যন্ত আফগান প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লি শাসন করেন। আর পরবর্তীতে ১২০৬-১২১০ পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতের সুলতান হন তিনি।
  • তরাইনের যুদ্ধ

  • তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভ করে মুহম্মদ ঘুরি তাঁকে বিজিত অঞ্চলসমূহ শাসনের দায়িত্ব দেন। কুতুবউদ্দিন লাহোর থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১১৯৪ সালে তিনি ঘুরিকে কনৌজ বিজয়ে সাহায্য করেন। রাজা দ্বিতীয় ভীমদেবকে পরাজিত করে গুজরাট দখল করেন। এভাবে তিনি উত্তর ভারতে তুর্কি আধিপত্য কায়েম করেন।
    ১২০৬ সালে ঘুরি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর গিয়াসউদ্দিন ক্ষমতায় আসেন। তিনি কুতুবউদ্দিনকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। শিহাবউদ্দিন অপুত্রক অবস্থায় মারা যাওয়ায় তাঁর সাম্রাজ্য সেনাপতিদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গজনিতে তাজউদ্দিন ইলদিজ, মুলতানে নাসিরউদ্দিন কুবাচা (মুলতান) ও দিল্লিতে কুতুবউদ্দিন আইবেক শাসক হন। দিল্লির সুলতান হিসেবে আইবেক ১২০৬-১২১০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তখন থেকেই দিল্লিতে সুলতানি সাম্রাজ্য শুরু হয়।
    স্বাধীন সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসার পর তিনি মুহম্মদ ঘুরির অনুচরদের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কন্যাকে ইলতুতমিশের নিকট ও বোনকে মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিনের নিকট বিয়ে দেন। তিনি কিরমানের শাসক তাজউদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করেন। তারপরও তিনি তাজউদ্দিন ইয়লদুজের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারেন নি। ইয়লদুজ হঠাৎ করে গজনি ও পাঞ্জাব দখল করে। খাওয়ারিজম শাহ ইয়লদুজকে শাস্তি দিতে পাঞ্জাবে অভিযানের উদ্যোগ নিলে দিল্লী সালতানাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ ভয়ে কুতুবউদ্দিন ইয়লদুজকে পাঞ্জাব ও গজনি থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু কুতুবউদ্দিন গজনীবাসীর নিকট অপ্রিয় হয় উঠেন। ফলে ইয়লদুজ পুনরায় গজনির ক্ষমতায় বসে। কুতুবউদ্দিন দিল্লীতে ফিরে যান। তিনি নিজ নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রাঙ্কনের ব্যবস্থা নেন। ১২১০ সালে লাহোরে চৌগান বা পোলো খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান।

    কুতুব মিনার
    কুতুব মিনার

    দিল্লীর ‘কুতুব মিনার’ নির্মাণ ছিল তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার। ১১৯৯ সালে রাজ্য বিজয়ের স্মারক ও ইসলামের বিজয় গাঁথা বিশ্ব দরবারে উপস্থাপনের জন্য সুফি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামানুসারে তিনি মিনারটির নির্মাণ শুরু করেন এবং তাঁর জামাতা ইলতুৎমিশ কাজটি সম্পন্ন করেন। দূর থেকে মিনারটি বাতিঘরের মতো মনে হয়। এর উচ্চতা ৭৩ মিটার। তাঁর মৃত্যুর পর দত্তকপুত্র আরাম শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে জামাতা ইলতুতমিশ ক্ষমতায় বসেন। প্রথম জীবনে ইলতুতমিশ ছিলেন কুতুবউদ্দিনের ক্রীতদাস। আইবেক দিল্লি সালতানাতের রূপরেখা নির্মাণ করেছিলেন এবং ইলতুৎমিশ দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

ইলতুৎমিশের শাসন

  • শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ : শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন ইলবারি তুর্কি গোষ্ঠীর লোক। তিনি প্রথম জীবনে দাস ছিলেন। কুতুবউদ্দিন তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কিনে নেন এবং মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে বাদায়ুনের শাসক নিযুক্ত করেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরাম শাহ ক্ষমতায় বসে। কিন্তু সে রাজত্ব পরিচালনায় অযোগ্য বলে বিবেচিত হলে আমিরদের অনুরোধে ১২১১ সালে ইলতুৎমিশ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি আমিরদের মধ্যে অনৈক্য ও সুলতানকে না মানার মনোভাব লক্ষ্য করেন। কারণ আমিররা তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা-
    ক. মুইজ্জি আমির : এরা শিহাবুদ্দিন ঘুরির বংশধরদের প্রতি অনুগত ছিল।
    খ. কুতুবি আমির : এরা কুতুবউদ্দিন আইবেকের প্রতি অনুগত ছিল।
    গ. শামসি আমির : এরা শামসুদ্দিনের প্রতি অনুগত ছিল।
    মুইজ্জি আমিরগণ ইলতুৎমিশকে কম মর্যাদার ও কুতুবি আমিররা তাঁকে সমমর্যাদার মনে করত। ফলে এই দুই দলের পক্ষ থেকে ইলতুতমিশ আনুগত্য আশা করতে পারছিলেন না।
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা : তাঁর সিংহাসনে বসার পরই নাসিরউদ্দিন কুবাচা সিন্ধুতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। গজনির শাসক তাজউদ্দিন ভারতে প্রাধান্য বিস্তারে উৎসুক ছিলেন। বাংলার শাসক আলী মর্দান দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন। হিন্দু রাজারাও তাদের হৃত গৌরব উদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ১২২৮ সালে তিনি কুবাচাকে পরাজিত করেন।
  • রাজ্যবিস্তার নীতি : প্রথমেই তিনি জুদের যুদ্ধে বিদ্রোহী আমিরদের পরাজিত করে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দেন। নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে লাহোর থেকে বিতাড়িত করেন। ১২১৪ সালে তিনি ইয়ালদুজকে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত করেন। রণথম্বোর পুনর্দখল করে বাংলায় খলজি শাসকদের দমন করেন। 
  • মোঘল আক্রমণ থেকে রক্ষা-

  • মোঘল আক্রমণ থেকে রক্ষা : মোঘলরা খাওয়ারিজম শাহকে আক্রমণ করলে শাহের পুত্র জালাল ইলতুৎমিশের নিকট আশ্রয় চায়। কিন্তু ইলতুৎমিশ তাঁকে আশ্রয় দিলে চেঙ্গিস খানের কোপানলের শিকার হবেন। তাই তিনি জালালকে বলে পাঠালেন যে, ভারতের আবহাওয়ার তাঁর জন্য প্রতিকূল হবে। তাই তিনি যেন অন্যত্র আশ্রয় নেন। বাধ্য হয়ে জালাল ভারত ত্যাগ করে। জালালের পরপরই চেঙ্গিস খান ভারতের প্রান্তে আসলে ইলতুৎমিশ তাকে অনেক উপহার দিয়ে বিদায় করেন। ১২২৯ সালে বাগদাদীয় খলিফা আল-মুসতানসির তাঁকে ‘সুলতান-উল-আজম’ খেতাব দেন। এসময় তিনি বাংলায় অভিযান পরিচালনা করে গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত করেন। মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুদ্রাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনেন। মোঘল আক্রমণের ফলে অনেক বিজ্ঞজন ভারতে আশ্রয় নেয়। ফলে তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দাস ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করে ‘বিশিষ্ট চল্লিশ’ নামে একদল দাসকে নির্বাচিত করেন। ১২৩৬ সালে তিনি মারা যান।
  • ইলতুতমিশের শাসনব্যবস্থা : তিনি কেন্দ্রে বিভিন্ন দপ্তর স্থাপন করে নিয়মিত হিসাব বিবরণ রাখার ব্যবস্থা করেন। সমগ্র সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ‘ইকতা’য় বিভক্ত করেন। ইকতাদারগণ তাদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ভার বাবদ অর্থ রেখে বাকি রাজস্ব কেন্দ্রে পাঠাতেন। তাঁর দরবারে একটি শিকলে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখা হত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এটি বাজিয়ে ন্যায়বিচারের জন্য সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। তিনিই সর্বপ্রথম আরবি মুদ্রার প্রবর্তন করেন যা রূপাইয়া নামে অভিহিত হত। একটি স্টান্ডার্ড মানের রূপাইয়ার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রেন। 

সুলতানা রাজিয়ার শাসন

  • সুলতানা রাজিয়া : ইলতুৎমিশের প্রিয় পুত্র ছিল নাসিরউদ্দিন। বাংলাকে দখল করার পর ইলতুৎমিশ তাঁকে বঙ্গের শাসক নিযুক্ত করে। কিন্তু তিনি পিতার জীবদ্দশায় মারা যান। ফলে মৃত্যুর সময় ইলতুৎমিশ রাজিয়াকে উত্তরাধিকার নির্বাচিত করেন। কিন্তু আমিররা তাঁর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখায় নি। নারী হওয়ার কারণে রাজিয়াকে তারা মেনে নিতে পারে নি। বরং ইলতুৎমিশের পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসানো হয়। এই সময় ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান’ (চল্লিশ দাস) খুব শক্তিশালী হয়ে উঠে। তারাই সুলতান নির্বাচিত করত। রুকনউদ্দিন শাসক হিসেবে অযোগ্যতার পরিচয় দেয়। তখন আমিররা বাধ্য হয়ে রাজিয়াকে ক্ষমতায় বসায়।
    রাজিয়া ক্ষমতায় বসলে অনেক আমির বিদ্রোহ করে। প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ জুনাইদি এতে নেতৃত্ব দেয়। তারা রাজিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল সৃষ্টি করে। দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। রাজিয়া দক্ষতার সাথে বিদ্রোহ দমন করেন। তিনিই দিল্লীর সিংহাসনে প্রথম নারী শাসক। তিনি পুরুষদের পোশাক পরে রাজদরবার পরিচালনা করতেন। জালালউদ্দিন ইয়াকুত নামে একজন হাবশিকে উচ্চপদে নিয়োগ দিলে আমিররা অসন্তুষ্ট হয়। এই সময় ভাতিন্দার শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন আলতুনিয়ায় বিদ্রোহ করে। রাজিয়া তা দমন করতে গিয়ে বন্দি হন। আমিররা তখন রাজিয়ার ভাই বাহরাম শাহকে ক্ষমতায় বসায়। এতে ইখতিয়ার ক্ষুব্ধ হয় ও সুলতানা রাজিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করেন। তারা দিল্লীর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে পরাজিত হয় এবং পথিমধ্যে দুজনকেই হত্যা করা হয়। ১২৩৬-১২৪০ সাল পর্যন্ত রাজিয়া ক্ষমতায় ছিলেন।
  • রাজিয়া পরবর্তী শাসক : বাহরাম শাহ মাত্র দুই বছর শাসন করেন। এরপর আমিররা তাঁকে হত্যা করে রুকুনউদ্দিনের পুত্র আলাউদ্দিন মাসুদকে ক্ষমতায় বসায়। চার বছর পর তাকেও সিংহাসনচ্যুত করা হয়। এরপর ইলতুৎমিশের ছোট ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। তিনি দরবেশের ন্যায় পবিত্র ও নিরুপদ্রব জীবনযাপন করতেন। 

নাসিরউদ্দিন মাহমুদের শাসন

  • নাসিরউদ্দিন মাহমুদ : তিনি দরবেশ প্রকৃতির লোক ছিলেন। কোরআন নকল ও টুপি সেলাইয়ের অর্থ দিয়ে জীবন যাপন করতেন। রাজ্য পরিচালনায় কোনো ধরনের কূটকৌশলে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। রাজ্য পরিচালনার সব দায়িত্ব শ্বশুর গিয়াসউদ্দিন বলবনের নিকট ছেড়ে দেন। বলবন ছিলেন ইলতুুৎমিশের ‘চল্লিশ আমিরের’ অন্যতম। নাসিরউদ্দিন তাঁকে ‘উলুঘ খান’ উপাধি দেন। একসময় স্বজনপ্রীতির অভিযোগে বলবনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ক্ষমতায় বসানো হয়। বলবন ক্ষমতা ফিরে পেয়ে আগের চেয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ করেন। অযোধ্যার শাসক কুতলু খান বিদ্রোহ করলে তিনি তা কঠোরভাবে দমন করেন। নাসিরউদ্দিন ক্ষমতায় থাকাকালীন মোঘল নেতা হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করে (১২৫৮)। বিশ বছর রাজত্ব করার পর নাসিরউদ্দিন অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর শ্বশুর বলবনকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান। 

গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসন

  • গিয়াসউদ্দিন বলবন : তিনি প্রাথমিক জীবনে দাস ছিলেন। ইলতুৎমিশ তাঁকে ক্রয় করে বিশিষ্ট চল্লিশের মর্যাদায় আসন দেন। বলবন মূলত ৪০ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথম বিশ বছর ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং শেষ বিশ বছর ছিলেন সুলতান। তার আসল নাম বাহাউদ্দীন। বলবন তাঁর ডাকনাম। ৬০ বছর বয়সে তিনি দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। ক্ষমতায় এসে তিনি রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। তার ধারনা রাজা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি। সুলতানের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তিনি দরবারে পারস্যের রাজকীয় রীতিনীতি প্রবর্তন করেন। এমনকি তাঁর পৌত্রদের নামও পারস্যদের অনুকরণে কায়কোবাদ, কায়খসরু, কায়মুরস রেখেছিলেন। তিনি সবসময় রাজকীয় পোশাকে থাকতেন। তাঁর ব্যক্তিগত ভৃত্যরাও তাঁকে কখনো সাধারণ পোশাকে দেখে নি। জনসাধারণের জন্য তাঁর দরবার উন্মুক্ত ছিল না। এমনকি একবার তিনি দরবারে থাকা অবস্থায় মোঘলদের আক্রমণে ছেলে মুহাম্মদের মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হয়। তিনি তখনও স্থির ছিলেন এবং দরবারের স্বাভাবিক কার্যক্রম বহাল রাখেন।

  • রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা-

  • রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা : সুলতান হিসেবে বলবনের শাসন ছিল অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। রাজনৈতিক সংকট দূরীকরণ ও মোগল আক্রমণ মোকাবিলার জন্য তাঁকে ‘রক্তপাত ও কঠোর নীতি’ (Blood & Iron Policy) অনুসরণ করতে হয়। তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্তির সময় চল্লিশ আমিরের দল ছিল বেপরোয়া। তারা কোনো সুলতানকে মানতে চাইত না। তিনি নিজেও একসময় এদের সদস্য ছিলেন তাই এদের গতিবিধি সম্পর্কে ভালো জানতেন। তিনি বিদ্রোহী ও বিপজ্জনক আমিরদের মৃত্যুদণ্ড দেন। ফলে অন্যান্য আমিররা সুপথে চলে আসে। সারা রাজ্যব্যাপী কঠোর গুপ্তচর ব্যবস্থা চালু করেন। কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার কারণে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। তিনি গুণীজনদের সমাদর করতেন। ভারতের তোতাপাখি খ্যাত আমির খসরু সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
    তিনি সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করেন। অনেক অথর্ব, অকেজো সৈনিক এমনকি মৃত সৈনিকের আত্মীয়রা জায়গীর ভোগ করত। এতে রাষ্ট্রের আয় যেমন কমে গিয়েছিল, সৈন্যবাহিনীর দক্ষতাও তেমনি হ্রাস পেয়েছিল। বলবন এই অপচয় রোধ করেন। তিনি একটি দক্ষ সৈন্যবাহিনী গঠন করেন।
    পূর্ববর্তী দুর্বল সুলতানদের আমলে মেওয়াট অঞ্চলে দস্যুদের উৎপাত বেড়ে যায়। তারা রাজ্যময় অশান্তি সৃষ্টি করে। এমনকি অবস্থা একই নাযুক হয় যে আসরের পরপরই দিল্লীর পশ্চিম দরজা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হত। তিনি মেওয়াটি দস্যুদের হত্যা করেন। তাদের আশ্রয়স্থলের জঙ্গলগুলো কেটে সাফ করে দেন। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেন।
    বলবন রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত থাকায় বাংলার শাসনকর্তা তুঘরিল খান ১২৭৯ সালে বিদ্রোহ করেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘সুলতান মুঘিসউদ্দিন’ নাম ধারণ করেন। তাঁর নামে মুদ্রা চালু ও খুতবা পড়া হয়। বলবন পরপর দুইবার তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেও সফল হয় নি। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তুঘরিল খানকে পরাজিত করে তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়। বাংলার আসনে পুত্র বুগরা খানকে বসান এবং বিদ্রোহের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেন।
  • মোগলদের ব্যাপারে বলবনের নীতি-

  • বলবনের মোগল নীতি : বলবন মোঙ্গলদের ব্যপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পশ্চিম সীমান্তের দুর্গগুলো সংস্কার করেন। এসকল দুর্গে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, উপযুক্ত রসদ মোতায়েন করা হয়। বড় ছেলে মুহম্মদকে প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয়। ছোট ছেলে বুগরা খানকে সামানা ও সুসানের শাসক নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা সুলতানের আস্থার মর্যাদা রক্ষা করেন।
    বলবন নিজেও সব সময় সতর্ক থাকতেন। তাঁর শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজ্য বিজয়ে বের হতেন না। সাম্রাজ্য রক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। ১২৭৯ সালে মোঘলরা পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করে। দুই শাহজাদা দক্ষতার সাথে এই আক্রমণ প্রতিহত করে। ১২৮৫ সালে মোঘল আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বড় ছেলে মুহাম্মদ মারা যান। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে বলবন ভেঙে পড়েন। তিনি ছোট ছেলে বুগরা খানকে দিল্লীর ক্ষমতায় বসতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বুগরা খান তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মুহাম্মদের পুত্র কায়খসরুকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে ১২৮৭ সালে তিনি মারা যান। এর মাত্র তিনবছর পরই দিল্লীতে বলবনি শাসনের সমাপ্তি ঘটে। বলবনের পুত্র ও পৌত্রকে হত্যা করে ১২৯০ সালে খলজি বংশের শাসন শুরু হয়।

    কুইজ

  • পূর্বের আলোচনা পড়ুন : ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top