Skip to content

খিলজি শাসন (১২৯১-১৩২০)- দিল্লী সালতানাতের ইতিহাস (২য় পর্ব)

ভারতবর্ষে খিলজি বংশের শাসন

  • খলজিদের রাজত্ব
    খলজিদের রাজত্ব

 

খলজিরা কীভাবে ভারতের ক্ষমতায় বসে?

জালালউদ্দিন খলজির শাসন

  • খলজিদের ক্ষমতারোহণ : বলবন তাঁর পৌত্র কায়খসরুকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেও তাঁর মৃত্যুর পর আমিররা অন্য পৌত্র কায়কোবাদকে ক্ষমতায় বসায়। তাকে যৌবনকাল পর্যন্ত অত্যন্ত কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে লালন-পালন করা হয়েছিল। কিন্তু সুলতান হওয়ার পর সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে পক্ষাগাত রোগে আক্রান্ত হয়। আমিররা তাকে সিংহাসনচ্যুত করে কায়কোবাদের তিন বছর বয়সী ছেলে কায়মুরসকে সুলতান মনোনীত করে। এই সময় খলজি মালিকগণ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। অনেক প্রতিকূলতার পর তারা কায়মুরসকে সরিয়ে জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজিকে সিংহাসনে বসায়।
  • জালালউদ্দিন খলজি : খলজিরা ছিল মূলত তুর্কিস্থানের লোক। সেই সময় তুর্কি বংশোদ্ভূত হলেও খলজি মুসলিমদের তুর্কি-মালিকরা সমপর্যায়ভুক্ত মনে করত না। জালালউদ্দিন ৭০ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসেন। তিনি কিছুদিন পূর্বেও অন্য আমিরদের সমকক্ষ ছিলেন। তাই তাঁর সুলতানপ্রাপ্তি অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। এছাড়াও অনেকে বলবনের বংশধরদের প্রতি অনুরক্ত ছিল। সামাজিক এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তিনি দিল্লির পরিবর্তে কিলোঘিরি প্রাসাদে অভিষেক সম্পন্ন করেন এবং সেখান থেকেই শাসনতার্য চালাতে থাকেন। তবে এক বছরের মধ্যেই আমিরদের মনোভাব পরিবর্তন হয়। তাঁর উদারতা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলে এবং আমিররা তাঁকে সাদরে বরণ করে নেয়।
    তিনি অধিকাংশ তুর্কি-মালিককে স্বপদে বহাল রাখেন এবং বিদ্রোহীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। বলবনের আত্মীয় মালিক চাজ্জুকে কারা-মানিকপুরের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তবে তাঁর উদারতা অনেকে দুর্বলতা মনে করে। ১২৯১ সালে মালিক চাজ্জু বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সুলতান পুত্র আরকলি খাঁ এই বিদ্রোহ দমন করে চাজ্জু ও তাঁর সহযোগীদের বন্দি করে সুলতানের সামনে উপস্থিত করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। ঠগী দস্যুদের প্রতিও তিনি ক্ষমা দেখান। অথচ এরা জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তাঁর এই উদার আচরণ খলজি মালিকদের অসন্তুষ্ট করে তুলে। এমনকি তারা প্রকাশ্যে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করে। সুলতান এই বিষয়ে নীরব থাকেন।
  • মোগল আক্রমণ প্রতিহত করে কীভাবে?

  • মোগল আক্রমণ : মোগল আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে তিনি দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ১২৯২ সালে হালাকু খানের পৌত্র আবদুল্লার প্রায় দেড় লক্ষ সেনা নিয়ে ভারত আক্রমণ করে এবং সামান পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তিনি তৎপরতার সঙ্গে মোগলদের পরাজিত করে পিছু হটতে বাধ্য করেন। এই সময়ে কয়েক হাজার মোগল ইসলাম গ্রহণ করে ভারতে বসবাস শুরু করে।
    তাঁর আমলে সফল অভিযান ছিল দক্ষিণ ভারতের দেবগিরি অভিযান। তবে এটি তাঁর অনুমতি নিয়ে করা হয়নি। এই অভিযানটি পরিচালনা করেছিলেন তাঁর জামাতা আলাউদ্দিন খলজি। ১২৯৫ সালে জালালউদ্দিন গোয়ালিয়রে শিকারে বের হলে আলাউদ্দিনের দেবগিরি অভিযানের সংবাদ পান। তিনি দিল্লিতে ফিরে যান। দিল্লিতে আলাউদ্দিনের ভাই উলুঘ খাঁ ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী। তিনি জালালুদ্দিনকে বুঝান যে, আলাউদ্দিন এই কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত। পরবর্তীতে সুলতান তাকে ক্ষমা করে দেন। তাঁর আমলে বড় ধরনের সামরিক সফলতা আসে নি। বরং তাঁর উদারতা অন্যান্য আমিরকে ক্ষুব্ধ করে তুলে। বলা হয়ে থাকে তিনি ১২৯৬ সালে জামাতা আলাউদ্দিন কর্তৃক নিহত হন।

    আলাউদ্দিন খলজি
    আলাউদ্দিন খলজি

    আলাউদ্দিন খলজির শাসন

  • আলাউদ্দিন খলজি : জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন ক্ষমতায় এসে বুঝলেন যে আমিররা তাঁকে সহজে মেনে নিবে না। তারা কোনো না কোনোভাবে পূর্বের সুলতানের হত্যার প্রতিশোধ নিবে। এদিকে জালালি আমিরদের সাথে পরামর্শ করে জালালউদ্দিন খলজির কনিষ্ঠ পুত্র রুকনউদ্দিন ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসানো হয়। এমতাবস্থায় আলাউদ্দিন জালালি আমিরদের অর্থ ও বিভিন্ন উপঢৌকনের মাধ্যমে হাত করেন। অঢেল মোহর দিয়ে বিরুদ্ধভাবাপন্ন আমিরদের মুখ বন্ধ করে দেন। ফলে আমিররা রুকনউদ্দিনের পক্ষ ত্যাগ করে এবং আলাউদ্দিন বিনা বাধায় দিল্লীতে প্রবেশ করে। রুকনউদ্দিন মুলতানে পালিয়ে যান। আলাউদ্দিন রুকনউদ্দিনের পক্ষের আমিরদের পুরস্কৃত করেন এবং বিশ্বাসঘাতক আমিরদের শাস্তি দেন। কারণ, বিশ্বাসঘাতকরা যেকোনো মুহূর্তে পক্ষ ত্যাগ করতে পারে।
    অভ্যন্তরীণ বিপদ সামলে নিয়ে তিনি বাইরের দিকে দৃষ্টি দেন। ১২৯৭-১৩০৭ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার মোঘলরা আক্রমণ করে। তিনি বলবনের নীতি অনুসরণ করে মোঘলদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দুর্গ নির্মাণ করেন। লাহোরের শাসক জাফর খান ও গাজী মালিক (পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক) মোঘল আক্রমণ প্রতিহত করেন। আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণাত্মক নীতির কারণে মোঘলরা পরবর্তীতে আক্রমণের সাহস পায় নি। এরপর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। গুজরাট, রণথম্ভোর, চিতোর, মালব ইত্যাদি জয় করে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত তিনি পদানত করেন। এরপর তিনি দক্ষিণ ভারতের দিকে দৃষ্টি দেন।

    আলাউদ্দিন খলজির রাজ্য সম্প্রসারণ

  • গুজরাট বিজয় : গুজরাটে ছিল আলাউদ্দিন খলজীর প্রথম অভিযান। গুজরাট ছিল কৃষি ও শিল্পে উন্নত এবং সুরাট ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ বন্দর। এই বন্দর দিয়ে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য চলত। বাঘেলা রাজপুত বংশীয় কর্ণদেব এ সময় গুজরাট শাসন করছিল। সেনাপতি নসরত খান ও উলুঘ খাঁকে গুজরাট জয়ের জন্য পাঠানো হয়। রাজা কর্ণ আহমেদাবাদের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবগিরিতে পালিয়ে যায়। সুলতানের সৈন্যরা ক্যাম্বে বন্দর ও সোমনাথের মন্দির লুট করে ধনরত্নসহ দিল্লিতে ফিরে আসে। ক্যাম্বেতে নসরৎ খান জনৈক খোজা মালিক কাফুরকে কিনে সুলতানকে উপহার দেন। পরে মালিক কাফুর আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাপতি হন ও দাক্ষিণাত্য বিজয়ে নেতৃত্ব দেন।
  • রণথম্ভোর বিজয় : রণথম্ভোর ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ দুর্গগুলোর অন্যতম। ইলতুৎমিশের সময় এই দুর্গ মুসলিম দখলে এলেও পরবর্তীতে রাজপুতরা তা দখল করে। গুজরাট বিজয়ের পর আলাউদ্দিন দুর্গটি দখলের পরিকল্পনা নেয়। উলুঘ খাঁ ও নসরত খান রণথম্ভোর অবরোধ করে। অবরোধ চলাকালীন নসরত খান গোলার আঘাতে আহত হয়ে মারা যান। রণথম্ভোরের রাজা হাম্মির প্রায় দুই লক্ষ সৈন্যের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালনা করে। উভয়পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে উলুঘ খাঁ অনেক ক্ষতি স্বীকার করে পিছুটান নেয়। এই সংবাদ দিল্লি পৌঁছলে সুলতান নিজে রণথম্ভোর যাত্রা করেন। পথে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আকাত খান অতর্কিত আক্রমণ করলে সুলতান আহত হন। আকাত খানকে তৎক্ষণাত হত্যা করা হয়। এরপরও কয়েকটি বিদ্রোহ সুলতান দমন করে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রণথম্ভোর আক্রমণ করেন। প্রায় এক বছর রণথম্ভোর অবরোধ রাখার পর দিল্লির বাহিনী দুর্গ দখল করে। রানা হাম্মিরকে পরিবারসহ হত্যা করা হয়। ১৩০১ সালে সুলতান দুর্গটি জয় করেন।
  • চিতোর বিজয় : মেবার ছিল রাজপুতনার অত্যন্ত শক্তিশালী রাজ্য। চিতোর ছিল মেবারের রাজধানী। চিতোর দুর্গটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। চিতোর দখল না করা পর্যন্ত দিল্লীর কোনো শাসকই নিজেকে নিরাপদ মনে করত না। আলাউদ্দিনের পূর্বে কোনো সুলতান চিতোর জয়ের সাহস করে নি। চিতোরের রানা রতন সিংহ আলাউদ্দিনের অধীনতা অস্বীকার করলে সুলতান ১৩০৩ সালে চিতোর আক্রমণ করেন। রাজপুতরা বীরত্বের সাথে সুলতানের বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত আলাউদ্দিন কৌশলে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেন। প্রায় সাত মাস অবরুদ্ধ থাকার পর রতনসিংহ আত্মসমর্পণ করে। কয়েকদিন চিতোর থাকার পর পুত্র খিজির খানকে চিতোরের শাসক নিযুক্ত করে সুলতান দিল্লি চলে আসেন।
  • মালব জয় : চিতোর দখলের পর সুলতান মালব আক্রমণ করেন। মালবের রাজা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এরপর সেখানে একজন মুসলিম শাসক নিযুক্ত করা হয়। এরপর সুলতান মান্ডু, উজ্জয়িনী এবং চান্দেরী ইত্যাদি এলাকা জয় করেন। এভাবে সমগ্র উত্তর ভারত সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর অধিকারে আসে।
  • দাক্ষিণাত্য বিজয় : উত্তর ভারত বিজিত হওয়ার পর সুলতান আলাউদ্দিন দাক্ষিণাত্য বিজয়ের দিকে মনোনিবেশ করেন। দাক্ষিণাত্যের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি বিজয় মুসলমানদের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। দক্ষিণে এই সময় চারটি হিন্দু রাজ্য ছিল। যেমন বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবগিরি রাজ্য; বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তেলেঙ্গনা বা বরঙ্গল রাজ্য; কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে দ্বারসমুদ্র রাজ্য ও সর্বদক্ষিণে ছিল পান্ড্যরাজ্য
    ১৩০৬ সালে সুলতান মালিক কাফুরকে দেবগিরি অভিযানের নির্দেশ দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুযোগ সন্ধানী। ১৩০৬-১৩১২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে ৪টি অভিযান পরিচালনা করা হয় যার সবগুলোই সফল হয়।
  • দেবগিরি জয় : বিন্ধ্যের দক্ষিণে খলজি বাহিনীর সফলতা ছিল বিস্ময়কর। সেনাপতি মালিক কাফুর দেবগিরির রামচন্দ্রকে পরাজিত করে দেবলা দেবীকে বন্দি করে পুত্র খিজির খানের সাথে বিয়ে দেয়। রামচন্দ্র দিল্লিতে এসে অধীনতা স্বীকার করে সুলতানের সহযোগী হয়। দেবগিরিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পথ উন্মুক্ত হয়। রাজা রামদেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শঙ্করদেব দিল্লিতে কর পাঠানো বন্ধ করে দেয়। সুলতান মালিক কাফুরকে দেবগিরি আক্রমণে পাঠান। শঙ্করদেব নিজেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
  • তেলেঙ্গানা জয় : ১৩০৯ সালে মালিক কাফুর তেলেঙ্গানা আক্রমণ করেন। দেবগিরির রামচন্দ্র তাঁকে রসদ দিয়ে সাহায্য করে এবং তেলেঙ্গানায় যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। সুলতান বাহিনী দুর্গ অবরোধ করে। অনেক দিন অবরুদ্ধ থাকার পর রাজা প্রতাপ সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু মালিক কাফুর সন্ধিতে অসম্মতি জানান। তিনি দাবি করেন যে, রাজা তার সব ধন-সম্পদ এখন দিবে এবং প্রতি বছর দিল্লিতে কর পাঠাবে। রাজা শর্ত মেনে নেয়। বিপুল ধন-রত্নসহ মালিক কাফুর দিল্লিতে ফিরে আসে।
  • দ্বারসমুদ্র জয় : কৃষ্ণা নদী পার হয়ে ১৩১০ সালে কাফুরের বাহিনী দ্বারসমুদ্র বা হোয়শল রাজ্য আক্রমণ করে। রাজা বীরবল্লাল এই সময় দক্ষিণে বীরপান্ড্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কাফুরের আক্রমণের সংবাদ পেয়ে তিনি রাজধানীতে ফিরে আসেন। বীরপান্ড্যও তাঁর সাহায্যের জন্য সেনা পাঠায়। কিন্তু সুলতানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ অর্থহীন বুঝে বীরবল্লাল যুদ্ধ ত্যাগ করে। আলাউদ্দিনের অধীনতা স্বীকার করে নিয়মিত করপ্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
  • পান্ড্যরাজ্য জয় : মালিক কাফুর মাদুরার পান্ড্য রাজাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। ১৩১১ সালে পান্ড্যের রাজধানী মাদুরায় পৌঁছে। সেখানকার রাজা পালিয়ে যায়। কাফুর প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে দিল্লিতে ফিরে এলে সুলতান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।
    উত্তর ভারতে সকল বিজিত রাজ্য আলাউদ্দিন সাম্রাজ্যভুক্ত করলেও দাক্ষিণাত্যে তিনি ভিন্ন নীতি অবলম্বন করেন। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও দিল্লী থেকে দূরত্বের কারণে সরাসরি দাক্ষিণাত্য শাসন করা সম্ভব ছিল না। তাই এগুলো করদরাজ্যে পরিণত করা হয়। পরাজিত রাজাদের তিনি নিজ রাজ্যের শাসনে বহাল রাখেন। শক্তির দাপটে তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজে হাত দেন নি।

  • আলাউদ্দিন খলজি শাসন ব্যবস্থা-

  • শাসনকার্য পরিচালনা : আলাউদ্দিন খলজি শাসনক্ষমতায় আসার আগে অভিজাত আমিরগণ ঘনঘন বিদ্রোহ করতেন। তিনি এই বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানে চারটি বিষয় বের করেন। যথা-
    ক. শাসন বিষয়ে সুলতানদের অমনোযোগিতা : শাসন বিষয়ে অমনোযোগিতা দূর করার জন্য তিনি শাসন বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। খাসমহল কিংবা দরবারে নৃত্য-গীত ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা সুলতান কমিয়ে দেন। এভাবে শাসন বিষয়ে সুলতানের চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
    খ. আমিরদের পারস্পরিক আত্মীয়তা ও সামাজিক মেলামেশা : সুলতান আইন করে আমিরদের পারস্পরিক আত্মীয়তা, পারিবারিক বা সামাজিক বৈঠক করতে হলে সুলতানের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন। তিনি দেশে কঠোর গুপ্তচরপ্রথা প্রবর্তন করেন। যে কোনো ধরনের সংবাদ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তা সুলতানকে জানানোর আদেশ ছিল। ফলে আমিররা একান্ত প্রয়োজন না হলে মুখে না বলে আকারে ইঙ্গিতে তা ব্যক্ত করতেন। ফলে ষড়যন্ত্রের সামান্যতম সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
    গ. মদ্যপান : সুলতান নিজে মদ্যপান ছেড়ে দেন এবং মদের পাত্রগুলো ভেঙে ফেলেন। সরকার অনুমোদিত মদ প্রস্তুতকারকদের দিল্লি থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রচলিত আছে, এতো মদ ঢালা হয়েছিল যে, বিস্তীর্ণ এলাকা বর্ষাকালের মতো কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য মদের চোরাই আমদানি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ কিছুটা সংশোধিত করে বলা হয় যে, ব্যক্তিগতভাবে ঘরে মদ প্রস্তুত করা যাবে। তিনি জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন।
    ঘ. সম্পদের প্রাচুর্য : তিনি রাষ্ট্রপ্রদত্ত সমস্ত রকমের ধর্মীয় দান ‘খালিসা’ জমিতে পরিণত করেন। এসব দান পেয়ে অনেকেই সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। আইন মেনে প্রজাদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায়ের আদেশ ছিল। অতিরিক্ত সম্পদশালীদের অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। মানুষের সম্পদ কমে যাওয়ায় তারা বিদ্রোহ বা অশান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ পায়নি। চৌধুরী, খুত ও মুকাদ্দমগণ ঘোড়ায় চড়া, অস্ত্র রাখা, মিহিকাপড় পরা ও পান খাওয়া ছেড়ে বাধ্য হয়েছিল। কঠোর পরিশ্রম করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। যদিও এই কঠোরতায় জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
  • রাজস্ব সংস্কার : প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থা অনুসারে কৃষিজ জমি কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। ‘খালিসা’ জমির রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে জমা পড়ত। উজিরের অধীনে আমিল, কারকুন প্রমুখ কর্মকর্তারা এই রাজস্ব সংগ্রহ করত। কিছু জমি ‘ইজারা’ হিসেবে ইকতাদাররা ভোগ করত। এই জমির খরচ বাদ দিয়ে উদ্বৃত্তাংশ কেন্দ্রীয় রাজকোষে পাঠাতে বাধ্য ছিলেন। তবে এরা নানা অজুহাতে সব রাজস্বই ভোগ করত। স্বাধীন হিন্দু রাজাদের অনেকেই সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে। এরা রাজস্বের নির্দিষ্ট অংশ সুলতানের কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্তে কিছু ভূমি ভোগ-দখল করত। এছাড়া কিছু জমি দান বা উপহার হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছিল।
    রাষ্ট্রের আয় বাড়ানোর জন্য তিনি রাজস্ব সংস্কার করেন। অভিজাত ব্যক্তি বা সরকারি কর্মচারি যাদের যে সকল ভূমি দানস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল তিনি তা বাজেয়াপ্ত করেন। সুলতানের নির্দেশে অপ্রয়োজনীয় বৃত্তি, ভাতা ও জায়গীর বন্ধ করা হয়। অবৈধভাবে দখলকৃত লাখোরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তির উপর কর আরোপ করেন। রাষ্ট্রীয় কর কেউ ফাঁকি দিতে পারত না। খারাজ, জিযিয়া, যাকাত, খুমস ইত্যাদির মাধ্যমে কোষাগারের অর্থ যোগান হত।
  • সামরিক সংস্কার : আলাউদ্দিন খলজি সামরিক বিভাগেও সংস্কার সাধন করেন। তিনি এক বিশাল স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। সেনাদের রেজিস্ট্রার রাখার প্রথা চালু করেন। সেনারা যাতে রাষ্ট্রীয় ঘোড়া বিক্রী করে নিম্নমানের ঘোড়া দেখাতে না পারে সেজন্য ঘোড়ায় ‘দাগ’ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন। জিনিপত্রের দাম জনগণের নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথা’ চালু করেন। নির্ধারিত মূল্যের অধিক দাম চাইলেই শাস্তি দেওয়া হত।

  • মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ-

  • মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা : আলাউদ্দিন খলজি বুঝতে পারেন যে, সা¤্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন । তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করেন এবং এর পাশাপাশি ৫০ হাজার ক্রীতদাস ছিল। ১৩০৩ সালের পর তিনি বেশ কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ফলে তাঁর বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়।
    দাক্ষিণাত্য জয়ের পর দিল্লিতে প্রচুর ধনসম্পদ আমদানির ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। তখন সেনাদের বেতন বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। হিসাব করে দেখা যায় বর্ধিত হারে বেতন দিলে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেন। যাতে অল্প বেতনেই সেনারা সংসার চালাতে পারে। তিনি সেনাদের স্বার্থেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথা চালু করেন।
    তাঁর সময় যুদ্ধ লেগেই থাকত ফলে ব্যবসায়ীদের মালপত্র আনতে বেশ অসুবিধা হত। মোগল আক্রমণের সময় মুলতানের শস্য বিক্রেতারা দিল্লিতে আসতে না পারায় দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগামী থাকত। তিনি এই সংকট নিরসনে দুটি পন্থা অবলম্বন করেন।

    ক. দিল্লির আশেপাশে সরকারি শস্যভান্ডার নির্মাণ করে খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখা হত। যাতে অভাবের সময়
    কম মূল্যে ঐ খাদ্যশস্য বাজারে ছাড়া যায়।
    খ. তিনি বাজারদর নির্ধারণ করে দেন। অভাবের সময় তিনি খাদ্যশস্য বণ্টন ও সীমিত করে দেন অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের বেশি কেউ কিনতে পারত না। অন্যান্য সময়ে জনসাধারণ যথাসাধ্য কেনাবেচা করতে পারত।

    সুলতানের আদেশে খাদ্যশস্য সরকারি শস্যাগারে জমা হতো। শস্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দোয়াব এলাকায় জমির খাজনাস্বরূপ শস্য আদায় করা হয়। সব ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজারদর নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতাভুক্ত হয়। বাজারদর নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবসায়ীদের তালিকা করা হয় এবং তাদের পরিবারের দিল্লিতে বসবাস বাধ্যতামূলক করা হয়। বাজারদর তদারকের জন্য সুলতান আলাউদ্দিন ‘দিওয়ান-ই-রিয়াসাত’ ও ‘শাহানা-ই-মন্ডি’ উপাধিধারী দুজন অফিসার নিযুক্ত করেন। তারা ঘুরে ঘুরে বাজার পরিদর্শন করত এবং আইন ভঙ্গকারীরকে কঠোর শাস্তি দিত। ফলে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। খাদ্যশস্যের দাম নির্দিষ্ট ছিল। সুলতান নিজেও মাঝে মাঝে বাজার তদারক করতেন। তিনি বাজার দর পরীক্ষার জন্য বাজার থেকে জিনিসপত্র ক্রয় করাতেন এবং জিনিসপত্রের ওজন কম হলে বা দাম বেশি হলে সুলতান অফিসারদের সতর্ক করতেন। তবে এই মূল্য নিয়ন্ত্রণ কেবল দিল্লি ও তার আশেপাশেই ছিল। এর মাধ্যমে তিনি মুদ্রাস্ফীতি রোধ করেন। ১৩১৬ সালে তিনি মারা যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page