কররানি বংশের শাসন (১৫৬৩-১৫৭৬)- বঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস (৮ম পর্ব)

কররানিরা কীভাবে বাংলার ক্ষমতায় বসে?

  • কররানিরা মূলত পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনওয়া ও পূর্ব আফগানিস্তানের অধিবাসী। এরা পাঠান জাতির একটি অংশ। শেরশাহের অনেক কর্মচারী কররানি বংশের ছিল। তাজ খান ও সুলায়মান খান শেরশাহের সেনাপতি ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শেরশাহ তাদেরকে দক্ষিণ বিহারে জায়গীর প্রদান করেন। আদিল শাহের সময় তিনি পালিয়ে যান এবং ভাইদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব পরিচালনা করেন। জনৈক গিয়াসউদ্দীন সিংহাসন দখল করলে তাজ খান তাকে পরাজিত করে গৌড় দখল করেন। এভাবে বাংলায় কররানি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • তাজ খান কররানির শাসন-

  • তাজ খান কররানি : ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান সেনাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে আদিল শাহের বিরোধিতা করলে তাঁর সেনাপতি হিমু চুনারের নিকট তাদের পরাজিত করে। তাজ খান ও তার ভাই সুলেমান তখন বাংলায় পালিয়ে আসেন এবং বিদ্রোহী আফগানদের সাথে নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেন। ১৫৬২-১৫৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ পূর্ব বিহার ও পশ্চিম বাংলা দখল করেন। বাংলার সিংহাসনের প্রতি তার দৃষ্টি ছিল।

    কে হবে শাসক?
    কে হবে শাসক?

    বাংলার সুলতান তৃতীয় গিয়াস তাদের প্রাধান্য দেখে বিচলিত হন। ১৫৬৪ সালে গিয়াসকে ছলনা করে হত্যা করে তাজ খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। তবে পাঠানদের একটি গোত্র তাজ খানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাঁকে পরাজিত করে। এই মনঃকষ্টে তাজ খান ১৫৬৫ সালে মারা যান এবং ভাই সুলেমান কররানি বাংলার সিংহাসনে বসেন।

  • সুলেমান কররানি কীভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার করে?

  • সুলেমান কররানি : তিনি একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্য সীমানা ক্রমশ দক্ষিণে পুরী, পশ্চিমে শ্যোন নদ, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। দিল্লী, অযোধ্যা, এলাহাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল মুগলদের পদানত হলে অনেক আফগান দলপতি সুলেমান কররানি আশ্রয়ে আসে। তাদের পেয়ে সুলেমান বিশেষ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তিনি গৌড় থেকে রাজধানী মালদহের দক্ষিণে তান্ডায় স্থানান্তর করেন।
    ১৫৬৫ সালে আলী কুলী খান আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাঁর সহযোগিতা কামনা করে। এদিকে আকবর মুহাম্মদ সিস্তানিকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে তাঁকে সহযোগিতা থেকে নিবৃত্ত থাকতে বলে। দূত আসার পূর্বেই তিনি আলী কুলী খানের সহযোগিতায় চলে যান এবং রোটাস দুর্গ জয় করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠান। আকবেরর বাহিনী আসার সংবাদ পেয়ে তিনি সেনা প্রত্যাহার করেন এবং আলী কুলী খান, মুহাম্মদ সিস্তানি ও মুনিম খানের মধ্যস্থতায় আকবরের সাথে সন্ধি করেন। সুলেমান মুনিম খানের সাথে সাক্ষাৎ করে আকবরের নামে মুদ্রাঙ্কন ও খুতবা পাঠ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। তিনি মুগলদের সাথে মিত্রতার নীতি অবলম্বন করেন। তাঁর আমলেই প্রথমবারের মতো সমগ্র উড়িষ্যা মুসলমানদের অধীনে আসে। সেনাপতি কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে তিনি তা জয় করেন। তিনি সর্বশেষ কুচবিহার আক্রমণ করেন। ১৫৭২ সালে সুলেমান কররানি মারা যান। 
  • বায়েজিদ কররানির অবদান-

  • বায়জিদ কররানি : সুলেমানের মৃত্যুর পর বড় ছেলে বায়েজিদ ক্ষমতায় আসে। তিনি কয়েক মাস শাসন করেন। এই স্বল্পকালেই তিনি আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন এবং নিজের নামে খুতবা ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি উদ্ধত আচরণ ও কর্কশ ব্যবহারের জন্য রাজ্যের আফগান নেতাদের নিকট অপ্রিয় হয়ে উঠেন। একদল আমাত্য তার আত্মীয় হানসুর মাধ্যমে তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে সুলায়মান খানের বিশ্বস্ত অভিজাতরা হানসুর আধিপত্য খর্ব করেন। বায়েজিদ খানের ছোট ভাই দাউদ খান কররানি ক্ষমতায় বসেন। 
  • দাউদ কররানির উদ্ধত আচরণ-

  • দাউদ কররানি : তরুণ দাউদ আফগান নেতাদের পরামর্শে মন্ত্রী লোদি খানের জামাতা ইউসুফকে হত্যা করে তার বিরাগভাজ হন। তিনিও বায়জিদের মতো আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন। ফলে আকবরের সাথে তাঁর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে।
    একই সময় আফগান সেনাপতি গুজর খান বায়জিদের ছেলেকে বিহারের সিংহাসনে বসান। দাউদ বিহার দখলের জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে লোদিকে পাঠায়। অন্যদিকে আকবর বিহার দখলের জন্য মুনিম খানকে পাঠায়। মুনিম খানের আসার সংবাদ পেয়ে লোদি খান ও গুজর খান নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে অনেক উপঢৌকন দিয়ে মুনিম খানকে বিদায় করে। দাউদ এতে রাগান্বিত হয়ে নিজেই সসৈন্যে বিহার আসে।
    এমন পরিস্থিতিতে লোদি খান রোটাস দুর্গে পালিয়ে মুনিম খানের সাহায্য প্রার্থনা করে। মুনিম খানের অনুরোধে আকবর টোডরমলের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠায়। গঙ্গা ও সরযুর সংযোগস্থলে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দাউদের সেনাপতি নিজাম পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। এই সময়ে বিভিন্ন আফগান নেতার পরামর্শ নিয়ে দাউদ ছলনা করে লোদি খানকে ডেকে এনে হত্যা করে। ফলে আফগানদের মধ্যে ভাঙন চরমে ওঠে। ইতোমধ্যে মুগল বাহিনী পাটনায় দাউদকে অবরোধ করে। দাউদ ভয় পেয়ে বাংলার রাজধানী তান্ডায় ফিরে যায়।
    মুনিম খান ১৫৭৪ সালে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলা দখলের জন্য আসেন। সব প্রতিরোধ গুড়িয়ে ফেলে মুগল বাহিনী তান্ডায় প্রবেশ করে। দাউদ সাতগাঁও হয়ে উড়িষ্যায় পালিয়ে যায়। মুনিম খান তান্ডা দখল করেন এবং বাংলার সকল স্থানে মুগলদের শাসন কায়েম হয়।[উড়িষ্যায় পালাবার পথে দাউদ তার কোষাধ্যক্ষ হরিদাস ওরফে বিক্রমাদিত্যকে বিপুল ধনসম্পদ নিরাপদে কোথাও নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এর মাধ্যমে হরিদাস যশোরে শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। হরিদাসের ছেলে প্রতাপাদিত্য পরবর্তী সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে জোর লড়াই চালিয়েছিলেন।]এবার মুগল বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে দাউদকে আক্রমণের জন্য উড়িষ্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এই সময় দাউদ হরিপুরে পরিখা খনন ও প্রতিরোধ প্রাচীর নির্মাণে ব্যস্ত ছিল। মুগল বাহিনী এই প্রতিরোধ কৌশল জানতে পারে স্থানীয় লোকদের সহায়তায় এক অজানা ঘুরাপথের মাধ্যমে নানজুর উপস্থিত হয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করে। মুগলদের তুলনায় আফগানরা তেমন শক্তিশালী ছিল না। দাউদ মুগলদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব করলে টোডরমল তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মুনিম খান সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করে বলে যে, দাউদকে আসতে হবে এবং সম্রাটকে মূল্যবার উপহার দিয়ে তাঁর অধীন চাকরি করতে হবে। এমন আরও কিছু শর্তারোপ করা হয় যা দাউদের জন্য অসম্মানজনক ছিল। কাজেই ১৫৭৫ সালে তুকারয় প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। প্রথম দিকে দাউদের অবস্থান ভালো থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হন। দাউদ আত্মসমর্পণ করেন। মুনিম খান তাকে উড়িষ্যার জায়গির প্রদান করে তান্ডায় ফিরে যান।ইতোমধ্যে কালাপাহাড় ও বাবুই প্রভৃতি আফগান নেতারা কুচবিহার থেকে ঘোড়াঘাটে এসে মুগলদের পরাজিত করে। এই সংবাদ পেয়ে মুনিম খান ঘোড়াঘাটের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তান্ডায় চলে যান। সেখানে ১৫৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর হাসান কুলীবেগকে আকবর বাংলার শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। টোডরমলকে তাঁর সহকর্মী নিযুক্ত করা হয়।

    মুনিম খানের মৃত্যুর পর দাউদ খান বিহারে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মুগলদের বিভিন্ন এলাকা দখল করে বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করেন। নবনিযুক্ত বাংলার শাসক হাসান কুলী দাউদকে দমনের জন্য বাংলায় সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। এই সংবাদ শুনে দাউদ রাজমহলে আশ্রয় নেন। হোসান কুলী সেনাবাহিনী নিয়ে কয়েক মাস অপেক্ষা করেন।
    অবশেষে আকবরের নির্দেশে বিহারের শাসক মুজাফফর খান হাসান কুলীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই মুগল বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে আফগান বাহিনী রাজমহলে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। হোসেন কুলি খানের প্রশ্নের জবাবে উদ্ধত দাউদ জানান, মুনায়েম খানের মৃত্যুর সাথে সাথে মুঘলদের সাথে শান্তি চুক্তিও বাতিল হয়েছে তাই তার বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। তার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মুঘল সেনারা দাউদকে খুন করে। তাঁর মাথা কেটে আকবরের কাছে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে বাংলায় আফগান শাসনের সমাপ্তি ঘটে ও মুগল শাসন শুরু হয়। অবশ্য তখনও মুগলদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে পারে নি। বাংলার উত্তর-পশ্চিমেই তাদের শাসন সীমিত থাকে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে বারোভূঁইয়ারা শাসন করছিল। পরবর্তীতে ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলা চূড়ান্তভাবে মোগল প্রদেশে পরিণত হয়।

     

  • পূর্বের আলোচনা পড়ুন : বাংলায় শূর বংশের শাসন
  • পরবর্তী আলোচনা : বারো ভূঁইয়ার শাসন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top