প্রশ্নগুলো সমাধান করুন
১. বাংলা অঞ্চলের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন কোন সুলতান?
২. বাংলার প্রথম স্বাধীন-সার্বভৌম সুলতান কে?
৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক কে?
৪. যুদ্ধ নয়, চরিত্রের মাধ্যমে প্রজাদের মন জয় করেছেন কে?
৫. ইবনে বতুতার প্রকৃত নাম কী?
৬. ইলিয়াস শাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান কে?
৭. মধ্যযুগের প্রাচীনতম কবি সগির ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য কার আমলে রচিত হয়?
৮. ইলিয়াস শাহী বংশের পতন হয় কেন?
স্বাধীন সুলতানি আমল
- ১৩৩৭ সালে বাহরাম খান মারা গেলে বঙ্গদেশে নতুন শাসক প্রেরণে দেরি হয়। এই সুযোগে তার দেহরক্ষী ও অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফখরুদ্দিন (ফখরা) সোনারগাঁয়ের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ বঙ্গের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তিনি তুর্কি ও সম্ভবত কারাউনা গোত্রীয় ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল সোনরাগাঁও।
-
প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা দেন কোন সুলতান?
ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ সালে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণার পরে দিল্লির সুলতান মুহম্মদ তুগলকের নির্দেশে লখনৌতির শাসক কদর খান, সাতগাঁয়ের শাসক ইয়াহিয়ার সম্মিলিত বাহিনী বিদ্রোহী ফখরুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। কদর খান এর নেতৃত্ব দেয়। ফখরুদ্দীন পরাজিত হন এবং রাজধানী ত্যাগ করে মেঘনার তীরে অবস্থান নেন। কদর খান পূর্বাঞ্চলের রাজধানী সোনারগাঁও দখল করে এবং বিপুল ধনসম্পদ ও বহুসংখ্যক হাতি তার হস্তগত হয় (১৩৩৯)।
বর্ষার শুরুতে মিত্র বাহিনীর সেনারা স্ব স্ব অঞ্চলে ফিরে যায়। কদর খান তাঁর অধিকাংশ সেনাকে রাজস্ব আদায়ের জন্য মফস্বলে পাঠিয়ে দেয়। দিল্লির সুলতানের অজুহাত দিয়ে কদর খান সব ধনসম্পদ আত্মসাৎ করে। এমনকি সে সেনাদের প্রাপ্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। অচিরেই সোনারগাঁও কদর খানের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠে। একদিকে গনিমতের মাল না পেয়ে সেনারা ছিল ক্ষুব্ধ এবং অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী লখনৌতির সাথে তার যোগাযোগ ছিল না।
এদিকে সোনারগাঁও অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ফখরুদ্দীন তখন বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বর্ষার শুরুতে তিনি নৌবহর নিয়ে অগ্রসর হন এবং জলপথে সোনারগাঁও অবরোধ করেন। বর্ষার কর্দমাক্ত ভূমি ও ভ্যাপসা গরমে অনভ্যস্ত কদর খানের বহুসংখ্যক সেনা ও ঘোড়া অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ফখরুদ্দীনের নৌবাহিনী কর্তৃক সোনারগাঁও অবরোধের ফলে কদর খানের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ফখরুদ্দীন কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই লক্ষ্য অর্জনে তিনি কুট-কৌশলের আশ্রয় নেন। কদর খানের সেনাদের মধ্যে অসন্তোষের সংবাদ পেয়ে ফখরুদ্দীন প্রস্তাব পাঠায়, যদি তারা কদর খানকে হত্যা করে এবং তার সাথে যোগ দেয় তাহলে তিনি রাজধানীতে সঞ্চিত ধনসম্পদ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। সেনারা কদর খানকে হত্যা করে (১৩৪০) এবং ফখরুদ্দীনের সাথে যোগ দেয়। ফখরুদ্দীন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
সোনারগাঁয়ে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করে ফখরুদ্দীন লখনৌতি ও সাতগাঁও দখল করার ইচ্ছা করেন। কদর খান ও ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর ফলে লখনৌতি ও সাতগাঁও উভয় প্রদেশই শাসকহীন ছিল। ফখরুদ্দীন তখন মুখলিস খানকে লখনৌতি দখল করার জন্য পাঠান। কিন্তু কদর খানের বিশ্বস্ত অনুচর আলাউদ্দিন আলী মুবারক অভিযান প্রতিহত করেন। যুদ্ধে মুখলিস খান পরাজিত ও নিহত হন। আলী মোবারক লখনৌতির শাসক হন।
সাতগাঁও দখলের জন্য ফখরুদ্দীনের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাঁর বাহিনী সেখানে ব্যাপক লুট করে কিন্তু ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। ফখরুদ্দিন লখনৌতি দখল না করতে পারলেও সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। - ১৩৪০ সালে তিনি ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে রাজা প্রতাপ মাণিক্যকে পরাজিত করেন। এই অভিযানের পর তিনি চট্টগ্রাম দখলের জন্য অগ্রসর হন। চট্টগ্রাম তখন ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন। ফখরুদ্দীন চট্টগ্রাম জয় করে রাজ্যের সীমানা পূর্বদিকের বাড়ান। এ অভিযানে বদরউদ্দিনের (বদর পীর) নেতৃত্বে অনেক সুফি-দরবেশ সুলতানের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। চট্টগ্রামকে তাঁর সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুলতান শায়দা নামক এক দরবেশকে চট্টগ্রামের নায়েব নিয়োগ করা হয়। ফখরুদ্দিন চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন।
- মরোক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা (আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ) ১৩৪৬ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের রাজধানী সোনারগাঁও ভ্রমণ করেছিলেন। তার ভ্রমণবৃত্তান্তে তিনি উল্লেখ করেন যে, ফখরুদ্দিন সন্দেহাতীতভাবে চমৎকার একজন শাসক, বিশেষ করে তিনি মুসাফির-দরবেশ ও সুফিদের পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বঙ্গের প্রথম স্বাধীন সুলতান।
- বঙ্গের বিভক্তি : কদর খানের সেনাপতি আলী মোবারক নির্বিঘ্নে লখনৌতি শাসন করছিলেন। এ সময়ে হাজী ইলিয়াস দিল্লী থেকে বঙ্গে আসেন। হাজী ইলিয়াস ছিলেন আলী মোবারকের বৈমাত্রেয় ভাই। কিছুদিনের মধ্যেই সিংহাসন নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। হাজী ইলিয়াস সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। এ সময় বঙ্গদেশ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়। যথা-
ক. পূর্বাঞ্চল (সোনারগাঁয়ের শাসক ফখরুদ্দিন)
খ. পশ্চিমাঞ্চল (লখনৌতির শাসক আলাউদ্দিন আলী শাহ)
গ. দক্ষিণাঞ্চল (সাতগাঁয়ের শাসক হাজী ইলিয়াস)
ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন
- শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ : শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পূর্ব পারস্যের সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি দিল্লির মালিক ফিরুজের অধীনে চাকরি করেন। কিন্তু সেখানে কোনো এক অপরাধের কারণে তিনি বাংলায় পালিয়ে আসেন এবং সাতগাঁয়ের তুগলক শাসক ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি নেন। ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি সাতগাঁওয়ের ক্ষমতায় বসেন। সেখানে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে তিনি লখনৌতির আলাউদ্দীন আলী শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি নিয়ে ১৩৪২ সালে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
- নেপাল আক্রমণ : লখনৌতি দখলের পর তিনি রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। ১৩৪৪ সালে তিনি সহজেই ত্রিহুত দখল করেন এবং ১৩৫০ সালে নেপালের তরাই অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। পূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি। তিনি নেপালের কাঠমান্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি নেপালের কোনো অংশ তাঁর রাজ্যভুক্ত করেন নি।
- সোনারগাঁও আক্রমণ : ১৩৫২ সালে তিনি পূর্ব বাংলায় অভিযান পরিচালনা করে ফখরুদ্দিন পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁও দখল করেন। এভাবে তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। তারিখ-ই-ফিরুজ শাহীর লেখক শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ বিশেষণে ভূষিত করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জাজনগর (উড়িষ্যা) আক্রমণ করেন এবং জয়পুর ও কটকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছেন। ১৩৫৩ সালে তিনি বিহার আক্রমণ করেন।
-
ইলিয়াস শাহ কীভাবে দিল্লির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখে?
- দিল্লির সাথে সংঘর্ষ : ইতোমধ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তিনি ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে ১৩৫৩ সালে বঙ্গে অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদিকে ইলিয়াস শাহও নীরব ছিলেন না। ফিরোজ শাহের অভিযানের কথা শুনে তিনি রাজধানী পাণ্ডুয়া ফিরে যান। ইলিয়াস শাহ তাঁর পুত্র সিকান্দারের অধীনে একদল সৈন্য পাণ্ডুয়া রক্ষার জন্য রেখে সসৈন্যে পরিখা বেষ্টিত দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ পাণ্ডুয়া দখল করেন ও সিকান্দার শাহকে বন্দী করেন। এরপর ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ অবরোধ করেন। দিল্লীর বাহিনী ২২ দিন এই দুর্গ অবরোধ করে রাখলেও কোনো সফলতা পায় নি। বরং বঙ্গের উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ, মশার কামড় ইত্যাদিতে তারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
ইলিয়াস শাহকে কোনোভাবেই দুর্গ থেকে বের করতে না পেরে ফিরোজ শাহ কূটনীতির আশ্রয় নেন। তিনি ফকিরবেশে গুপ্তচরদের ইলিয়াস শাহের নিকট পাঠান এবং প্রচার করেন যে ফিরোজ শাহ দিল্লীতে ফিরে গেছেন। ইলিয়াস শাহ গুপ্তচর কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে দুর্গ থেকে বের হলে দিল্লীর গুপ্তবাহিনীর সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ইলিয়াস শাহের ব্যাপক ক্ষতি হলেও তিনি পুনরায় একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ পুনরায় একডালা দুর্গ অবরোধ করলেও তাঁর সেনাবাহিনী দীর্ঘযুদ্ধ ও প্রবল বর্ষার কারণে হতাশ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে ফিরোজ শাহ সন্ধির প্রস্তাব করে। নিচের শর্তাবলিতে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়-
ক. ইলিয়াস শাহ বাংলার শাসক থাকবেন।
খ. দিল্লীর দরবারে বার্ষিক কর ও উপঢৌকন প্রেরণ করতে হবে।
গ. পাণ্ডুয়ার সকল বন্দী সৈন্যকে ফিরোজ শাহ মুক্তি দিবেন।বাংলা ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপহার ও দূত বিনিময়ের মাধ্যমে আরও দৃঢ় হয়। দিল্লির সুলতানের সাথে আপোস ইলিয়াস শাহকে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়। ১৩৫৭ সালে তিনি কামরূপের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি সহজেই কামরূপের কিছু অংশ সহজেই দখল করেন। এটিই ছিল ইলিয়াস শাহের শেষ বিজয়। ইলিয়াস শাহকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বলা যায়। তাঁর রাজত্বকালেই বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় থেকেই বঙ্গের সকল অঞ্চলের অধিবাসী বাঙালি বলে পরিচিতি পায়। জাতি গঠনকারী হিসেবে ইলিয়াস শাহই প্রথম যিনি সাতগাঁও, লখনৌতি ও সোনারগাঁও অঞ্চল একত্র করে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ সম্মিলিত রাজ্যের নামকরণ করেন বাঙ্গালাহ এবং এর অধিবাসীদের অভিহিত করেন বাঙালি নামে। তিনি উদার নীতি গ্রহণ করে জনগণের মধ্যে সংহতি স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে এক নতুন জীবনধারার সূচনা করেন। ১৩৫৮ সালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। - সিকান্দার শাহ : ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর তিনদিন পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজ্যের আমিররা সিকান্দার শাহকে সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। ফলে সিংহাসন নিয়ে কোনো রক্তপাত ঘটেনি। দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসনে তিনি বাংলার মুসলিম শাসনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। দিল্লির সাথে বিবাদ করে স্বীয় ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করা সম্ভব নয়, তা তিনি বুঝেছিলেন। তাই সিংহাসনে আরোহণের পরই তিনি আলম খান নামক জনৈক রাজদূতকে দিল্লির দরবারে পাঠান। এর কয়েক মাস পর তিনি মালিক সাইফউদ্দিনকে পাঁচটি হাতি উপঢৌকন দিয়ে দিল্লির রাজদরবারে পাঠান। দিল্লির সাথে সদ্ভাব বজায় রাখাই ছিল সিকান্দার শাহের উদ্দেশ্য। কিন্তু তাঁর সব প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
সোনারগাঁওয়ের প্রাক্তন শাসক ফখরুদ্দিনের জামাতা জাফর খান বাংলা থেকে পালিয়ে দিল্লি পৌঁছান। ফিরোজ শাহ তাকে বাংলার ন্যায়সঙ্গত শাসক বলে ঘোষণা করেন। তার প্ররোচণায় ১৩৫৯ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। পিতার মতো সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফলে দিল্লির সুলতান দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ফিরোজ তুঘলক ও সিকান্দার শাহের মধ্যে সন্ধি হয়। সন্ধির শর্তানুসারে স্থির হয় যে-
ক. যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ সিকান্দার শাহ ৪০টি হাতি ও মূল্যবান উপঢৌকন দিবে।
খ. জাফর খানকে সোনারগাঁয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
গ. সিকান্দার শাহ দিল্লিতে নিয়মিত বার্ষিক কর প্রদান করবেন।
এই সময় থেকে প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত বঙ্গদেশ দিল্লির প্রভাবমুক্ত ছিল। সিকান্দার শাহ একজন শিল্পানুরাগী সুলতান ছিলেন। পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, পীর সিরাজউদ্দিনের মসজিদ, গৌড়ের কোতোয়ালি দরোজা ও গঙ্গারামপুরের মোল্লা আতার মসজিদ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত। এগুলো তাঁর স্থাপত্যশিল্পের প্রতি অনুরাগের পরিচয় বহন করে। - গৃহবিবাদের সূত্রপাত : সিকান্দার শাহের শেষ জীবন সুখময় ছিল না। সিকান্দার শাহের দুই স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রীর ১৭ জন দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ছেলে ছিলো। সেই পুত্র গিয়াসউদ্দীন বিমাতার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। গিয়াস উদ্দিন শাসনকার্যে ও যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। তাই সিকান্দার শাহ তাকেই পরবর্তী শাসক নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বিমাতা এতে ষড়যন্ত্র করে। ফলে গিয়াস উদ্দিন পান্ডুয়া ত্যাগ করে সোনারগাঁয়ে চলে যান। সেখানে তিনি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সিকান্দার শাহও একটি সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে পুত্রের মোকাবিলা করতে যান। ১৩৯৩ সালে গোয়ালপাড়ায় পিতা-পুত্রের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে সুলতান সিকান্দার শাহ পুত্র গিয়াসউদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। সিকান্দার শাহ গুরুতর আহত হন। গিয়াসউদ্দিন ব্যথিত হৃদয়ে পিতার পাশে দাঁড়ান। পিতা পুত্রকে দোয়া করে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।
- গিয়াস উদ্দিন : গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ নামধারণ করে বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসে। তিনি ১৩৮৯ থেকে ১৪১০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। রাজ্যের বিস্তৃতির চেয়ে তিনি রাজ্যকে সুদৃঢ় করার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তিনি তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে শুধু কামরূপে অভিযান করে তা দখল করেন এবং কামরূপের উপর কয়েক বছর তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। তিনি চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা ও সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তার বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকরা কাজীর কাছে মামলা করার অধিকার রাখত। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো তিনি সৎ ভাইদের শাস্তি দিয়েছেন।
পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে তাঁর পত্রালাপ ছিল। একবার তিনি হাফিজের নিকট কবিতার একটি চরণ লিখে পাঠান এবং কবিতাটিকে পূর্ণ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান। হাফিজ দ্বিতীয় চরণটি রচনা করে কবিতাটি পূর্ণ করে পাঠান। তিনি সুলতানের নিকট একটি গজলও লিখে পাঠান। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বাংলা সাহিত্যের উন্নতিতেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য রচনা করেন। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তাঁর সময় হিন্দুরা তাঁর দরবারে বেশ প্রাধান্য লাভ করে। ফলে ভাতুরিয়ার বর্তমান দিনাজপুরের জমিদার রাজা গণেশের উত্থান ঘটে। ১৪১০ সালে গিয়াসউদ্দীনের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয় রাজা গণেশ সুলতানকে হত্যা করে। - পূর্বের আলোচনা পড়ুন : বলবনি শাসনপরের আলোচনা দেখুন : রাজা গণেশের শাসন