-
নীল আন্দোলন কেন হয়? কারা নীলচাষের পক্ষে যুক্তি দেয়?
- ১. নীল আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেন কে?
২. বাংলা বিহার অঞ্চলে কে সর্বপ্রথম নীল চাষ শুরু করেন?
৩. নীল চাষের সহযোগিতায় কোন ব্যাংক অর্থের যোগান দিত?
৪. কোন জেলার নীল উৎকৃষ্ট মানের ছিল?
৫. জমিদাররা কেন নীল বিদ্রোহে সহযোগিতা করেছিল?
৬. নীল দর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করায় কাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল?
৭. কোন কুঠি উচ্ছেদের মাধ্যমে বাণিজিক্যকভাবে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়?
৮. ঈশ্বররচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোন নাটক দেখতে গিয়ে জুতা ছুড়ে মারেন?
৯. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা কেন নীলচাষে বাধা সৃষ্টি করছিল?
১০. কোন দেশ থেকে নীলচাষের জন্য শ্রমিক আনা হয়েছিল?
-
নীলচাষ কীভাবে শুরু হয়?
- ভূমিকা : ১৮ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন হয় এবং কাপড়ে রং করার জন্য নীলের চাহিদা বেড়ে যায়। ইংরেজরা কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করে। নীল গাছের ফল থেকে নীল রং তৈরি করা হত। তখনও পর্যন্ত কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হয় নি।
নীল চাষের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পেতে থাকে। নীল বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল কৃষকদের ক্ষোভ। নীলচাষ কৃষকদের পক্ষে লাভজনক ছিল না। কৃষকরা এক জোট হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাসে এটিই নীল বিদ্রোহ নামে প্রচলিত। নীলচাষ প্রতিরোধে প্রবাদ পুরুষ ছিলেন বিশ্বনাথ সর্দার। ১৮৬২ সালে এই বিদ্রোহ সফলতার সাথে শেষ হয়। প্রায় ১০০ বছর বাংলায় নীল চাষ অব্যাহত ছিল। রাসায়নকিভাবে নীল তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলে নীলচাষের গুরুত্ব কমে যায়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের কুঠি উচ্ছেদের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কিত করুণ নাটক নীল দর্পণ। নীল চাষের নামে জেলার নামকরণ নীলফামারি।
-
নীল কী?
- নীলচাষ : নীল শুধু রং নয়, নীল এক ধরনের গাছ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Indigo feral Linctoria সংক্ষেপে বলা হত Indigo। এটি মূলত cloth dyers যা কাপড় শুধু সাদা নয়, রঙিন করার জন্য ব্যবহৃত হত। লুই বোনার্ড (Louis Bonnaud) নামক জনৈক ফরাসি বণিক ১৭৭৭ সালে বাংলায় প্রথম নীল চাষ শুরু করেন। একই বছর তিনি হুগলি নদীর তীরবর্তী তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় দুটি নীলকুঠি স্থাপন করা হয়। ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফা কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান এবং গভর্নর জেনারেলের নিকট এই বিষয়ে একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন।
-
নীলচাষে কোম্পানির অবদান-
- ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কোম্পানি উদ্যোক্তাদের সাহায্য করত। ভারতবর্ষে প্রতি পাউন্ড নীলের দাম ছিল ৪ আনা যা ইংল্যান্ডে বিক্রী হত ৫/৭ টাকায়। ১৮১০-১৮৫০ সাল পর্যন্ত ছিল নীলচাষের স্বর্ণযুগ। ১৮২০ এর দশকে কেবল নীল বিক্রি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বছরে দশ-বারো লক্ষ টাকা লাভ করত। ১৮২৬-১৮৫৬ সাল পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য হিসেবে একমাত্র আফিমই নীলের চেয়ে এগিয়ে ছিল। নীলচাষ অব্যাহত রাখার জন্য ব্রিটিশরা এদেশীয় কৃষকদের দাদন চুক্তি করাতে বাধ্য করে। বাংলাতেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নীল উৎপাদিত হত। বিশেষত যশোর ও নদীয়া জেলার নীল উৎকৃষ্ট ছিল। ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলোতে নীলের চাষ জে পি ওয়াইজের (যার নামে ওয়াইজঘাট) অধীনে ছিল।
- প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকর সাহেবরা স্থানীয় জমিদারদের সক্রিয় সহযোগিতায় প্রজাদের দিয়ে প্রজাদেরই জমিতে নীল চাষ করাত এবং সস্তায় ফসল ক্রয় করে নিজেদের অধীনে রং নিষ্কাশন করাত। নীল রংয়ের এসব কেন্দ্রকেই ‘কুঠি’ বলা হত। কিন্তু অল্পদিনেই দেখা যায় যে, ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেরাই জমিদারি ক্রয় করে বা ইজারা গ্রহণ করে প্রজাদের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের ব্যবস্থা করছে। এরপর তারা নিজেদের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জমিদার ও জোতদারদের অধীন প্রজাদের জোর করে দাদন বা অগ্রিম টাকা নিয়ে চুক্তিপত্রে দস্তখত করিয়ে নিতে শুরু করে। চুক্তিবদ্ধ চাষিকে কী পরিমাণ জমিতে নীল চাষ করতে হবে এবং উৎপাদিত ফসল কী মূল্যে কুঠিয়ালদের কাছে বিক্রি করতে হবে তার সবই চুক্তিতে লেখা থাকত।
-
নীলচাষে জমিদারদের প্রতিবন্ধকতা-
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক হয়। এর নিজ জমিদারি সীমার মাঝে রাজা-বাদশার মতো ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই প্রজার জানমাল এমনকি তাদের ইজ্জতেরও মালিক ছিল। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণিটিকে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা মনে করত। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত তবু প্রজারা ঐ ভূস্বামীর অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না।
এই সমস্যা সমাধানে ব্রিটিশরা ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন (Eight regulation of 1819) জারি করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর ‘পত্তনি তালুক’ দেওয়ার সুযোগ পায় এবং জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায় বা অত্যাচারের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। তারপরও সমস্যায় সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত। এর বিনিময়ে ৫ বছরের জন্য জমিস্বত্ব ও দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজা পাওয়া যেত যা বেশ খরচসাধ্য ছিল। তাই খরচ কমাতে নীলকররা দূর থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাত। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে।১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চতুর্থ আইন (Fourth regulation of 1833) পাশ করে যেখানে ইংরেজদের জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলা এসে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। এছাড়াও এই আইনের ফলে অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে বা নীলকরদের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায় নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে নীলকরদের ডেকে আনত। পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি’ কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এভাবেই ইংরেজরা অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় ঘাঁটি স্থাপন করেন।নীলচাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণি নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মধ্যে দ্বারকনাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতায় এক সভায় নীলচাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাসদের এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীলচাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজন হয়। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অযোধ্যা দখল করে।
- রায়তি ব্যবস্থা : রায়তি ব্যবস্থায় নীলকরদের সাথে নীলচাষি বা রায়তদের চুক্তি হত। নীলচাষের জন্য রায়তকে অগ্রিম অর্থ বা দাদন, বীজ ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হত। চাষী তার মোট জমির ২৫% নীলচাষ করতে বাধ্য থাকত। নীল ফলানোর পর রায়ত পুনরায় অগ্রিম পেত। ঐতিহাসিকদের মতে দাদনের জন্য চাষীরা শুরুর দিকে নীলচাষে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই তারা নীলচাষের সর্বগ্রাসী রূপের পরিচয় পেয়েছিল।
-
বিশ্বনাথ সর্দার-
- বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন নীল বিদ্রোহের নেতা। ব্রিটিশরা নীল আন্দোলকারীদের ডাকাত বলে অভিহিত করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ভারতে নীল বিদ্রোহকে সাংগঠনিক রূপ দিয়েছিলেন তিনি। দানশীলতা ও বীরোচিত স্বভাবের জন্য মানুষের কাছে তিনি বাবু খেতাব পেয়েছিলেন। তাঁর সাথীর নাম বৈদ্যনাথ।
তখন শান্তিপুর (নদীয়ার একটি শহর) এলাকার তাঁত শ্রমিক ও নীল চাষিদের উপর চরম অত্যাচার চলছিল। নীলকর স্যামুয়েল ফেডির নেতৃত্বে এই অত্যাচার চলছিল। ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বনাথ সর্দার সেই এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করে ফেডির শান্তিপুরের নীলকুঠি লুট করে। বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা ফেডিকে হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু বিশ্বনাথের দয়ায় ফেডি বেঁচে যায় এবং নীলচাষ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে।
কিন্তু ফেডি ছাড়া পেয়ে জেলা শাসক ইলিয়টকে এই খবর জানিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পরই বিশ্বনাথ সর্দারের আস্তানায় গিয়ে তাঁকে ঘেরাও করে ব্রিটিশ সেনাপতি ব্ল্যাক ওয়ার ও ইলিয়টের পুলিশ। বিশ্বনাথ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। ব্রিটিশদের বিচারে বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁর দেহটাকে লোহার খাঁচায় ভরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের কাছে আসাননগরের একটি অশ্বত্থ গাছে পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল নীলচাষিদের ভয় দেখানো। তাঁর মায়ের আকুতিভরা নিবেদন সত্ত্বেও কঙ্কালটুকু সৎকার করতে দেয় নি ব্রিটিশরা। আজও আসাননগরের মাঠ ‘ফাঁসি তলার মাঠ’ নামে পরিচিত। -
নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন-
- নীলকররা কৃষকদের অগ্রিম টাকা বা দাদন দিয়ে নীলচাষ করাতো। কৃষকরা জমিদারের খাজনা মেটানোর জন্য দাদন নিত। নীলকররা জোর করে উৎকৃষ্ট জমিতে নীল বীজ বপন করতে চাষীদের বাধ্য করত। ফলে যে জমি চাষ করে কৃষকদের সারা বছরের খাবারের সংস্থান হত সেখানে নীলচাষ করা তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
১৮৫০ সালে এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে আয় হত ৭ টাকা অন্যদিকে নীল চাষ করলে আয় হত এক-তৃতীয়াংশের কম। ১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে কৃষকরা সংঘবদ্ধভাবে জানায় যে, আমরা আর নীলচাষ করবো না। যশোরের চৌগাছা থেকে প্রথম নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮৫৯ সালে নীল কমিশন গঠন করা হয়। ১৮৫৯-১৮৬২ সালের মধ্যে এই আন্দোল ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যশোর, পাবনা, রাজশাহী, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় নীল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত কৃত্রিম নীলের কোনো প্রভাব বুঝতে পারা যায় নি। বাংলায় নীল বিদ্রোহ এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, নীলকররা বাধ্য হয়ে নীল চাষ বিহারে সরিয়ে নেয়। অনেকে নীলচাষ বাদ দিয়ে চা-বাগানে বিনিয়োগ করে। নীল বিদ্রোহের অন্যান্য কারণ নিম্নরূপ- -
কলকাতা ইউনিয়ন ব্যাংক বন্ধ হওয়ার প্রভাব-
- মাত্রারিতিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে নীলের বাজারে মন্দা দেখা দেয়। নীলের দাম দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৭ সালে কলকাতা ইউনিয়ন ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নীলকরদের পুঁজিতে টান পড়ে। এই ব্যাংকই ছিল নীলকরদের পুঁজির প্রধান উৎস। ফলে নীলকররা নীলচাষীদের উপর অধিক চাপ দিতে থাকে।
সরকারি হস্তক্ষেপ : বিচারকরাও নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। ১৮৫৫ সালে যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল লতফ ও নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাঙ্গেলস বলপূর্বক নীলচাষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে রায়তরা সাহসী হয়ে ওঠে এবং নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট এডেন একটি পরোয়ানা জারি করে বলেন যে, চাষিরা তাদের জমিতে কী ফসল উৎপাদন করবে তা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। -
জমিদারদের ক্ষোভের কারণ-
- নীল বিদ্রোগের নেতৃত্ব দিয়েছিল মাঝারি ও ছোট জমিদাররা। কারণ-
১. জমিদাররা অনেক আবাদি জমি নীলকরদের নিকট অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি বা লিজ দিতে বাধ্য হয়েছিল।
২. নীলচাষের পরিপ্রেক্ষিতে জমিদার ও রায়তদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। নীলকররা জমিদারদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত।
৩. নীলকরদের সাথে বিচারকদের সম্পর্ক ভালো থাকায় জমিদাররা আদালতের দারস্থ হত না। -
জমিদার শ্রেণির আন্দোলন-
- নীল বিদ্রোহে জমিদারদের বেশ আগ্রহ ছিল এবং তারাই নেতৃত্ব দেয়। তবে কৃষক যে উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেছিল জমিদারদের সে উদ্দেশ্য ছিল না। তবে জমিদাররা কখনোই সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে নীল বিদ্রোহ করে নি। প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে যশোর জেলায় পুনরায় কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই দ্বিতীয় বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় যশোরের উত্তরাঞ্চলের বিজলীয়া বিভাগের মধ্যে। বিজলীয়া কুঠির অধ্যক্ষ ডম্বল ছিলেন ভয়ানক অত্যাচারী। তার অকথ্য নির্যাতনের ফলে ৪৮টি গ্রামের কৃষকরা একত্র হয়ে ষষ্ঠীবরের জমিদার বঙ্কু বিহারি ও তার কনিষ্ঠপুত্র বসন্তকুমার মিত্রের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। উডুবারের কেদার নাথ ঘোষ, প্রিয়নাথ মুখার্জি, আশুতোষ গাঙ্গুলী ও উকিল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নারায়ণপুরের বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় বিদ্রোহী কৃষকদের পক্ষ নেন। কেদারনাথ ঘোষ পরবর্তীকালে কেশবানন্দ ভারতী নাম ধারণ করে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় নড়াইল থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তৎকালে কল্যাণীতে নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লাহোর ‘ট্রিবিউন’ পত্রের সাবেক সম্পাদক যদুনাথ মজুমদার প্রজার পক্ষ হয়ে বিদ্রোহের সময় অসীম সাহসের পরিচয় দেন। তিনি তৎকালীন ঝিনাইদহের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসন মুরের আদালতে অসংখ্য কৃষকের নামে নীলকর সাহেবরা মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় নিঃস্বার্থভাবে প্রজাদের পক্ষে ওকালতি করেন যদুনাথ মজুমদার। -
মিশনারিদের হস্তক্ষেপ-
- খ্রিস্টান মিশনারিরা নীলচাষীদের পক্ষে দাঁড়ায়। তারা মনে করত নীলকরদের অত্যাচার ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। তা নিয়ে সচেতন করতেই তাদের এই বিরোধিতা ছিল। এমনকি জেমস লং নামক জনৈক ইংরেজ নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করেন।
-
নীল দর্পণ নাটক প্রদর্শন-
- দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পন’ লিখে দেশবাসীর সামনে নীলকরদের অত্যাচারের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন। নাটকটি বাংলার পেশাদার থিয়েটার গড়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। এই নাটকে প্রভাবিত হয়েই গীরিশচন্দ্র ঘোষ কোলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার গঠন করেন এবং নীল দর্পণই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয়।
এই নাটকের প্রদর্শনীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও উপস্থিত ছিলেন। আবেগী এবং মেজাজী লোক ছিলেন তিনি। নাটকের মূল চরিত্র উডের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন শক্তিমান অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। নীল চাষীদের উপর তাঁর অত্যাচারের অভিনয় দেখে বিদ্যাসাগর এতই ক্ষিপ্ত হয় যে, পায়ের জুতো খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন অর্ধেন্দুর গায়ে। তিনিও তাঁর অভিনয়ের পুরস্কার হিসাবে সেই জুতোকে তুলে নিয়েছিলেন স্মারক হিসেবে। -
নীল দর্পণের নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে কে?
- ঠাকুরপুরে একটা বাংলা স্কুল চলাতেন রেভারেন্ড জেমস লং। বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সিসহ আরো অনেকগুলো প্রাচ্যদেশীয় ভাষা জানতেন তিনি। ১৮৬১ সালে দীনবন্ধুর কাছ থেকে নীল দর্পণের একটি কপি পান তিনি। পাদ্রি লং বাংলার গভর্নর জেনারেলের সেক্রেটারি এবং ইন্ডিগো কমিশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সেটনকারের নজরে আনেন। এর গুরুত্ব অনুভব করে সেটনকার কথা বলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর যে পি গ্রান্টের সাথে। নাটকটিতে কী লেখা আছে সেটি জানার জন্য ঘনিষ্ঠ কিছু লোকজনকে দেবার জন্য এর ইংরেজি অনুবাদ করা যায় কি না সে বিষয়ে আগ্রহ দেখান। বিষয়টি পাদ্রি লঙের মাথায় গেঁথে যায়।
তিনি নিজেই এর অনুবাদ করা শুরু করেন। কিন্তু কৃষকের চলতি গ্রাম্য ভাষা ছিল এই নাটকের প্রাণ। ফলে, এর অনুবাদে খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি তিনি। তাই লং সাহেব শরণাপন্ন হলেন বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই বিশেষ দখল আছে এমন একজন দেশি ব্যক্তির। তিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি এক রাতের মধ্যে নীল দর্পণের অনুবাদ করে দেন। পাদ্রি লং তখন এই পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেন ক্যালকাটা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং এর স্বত্বাধিকারী ক্লিমেন্ট হেনরি ম্যানুয়েলের কাছে। তিনশ টাকার বিনিময়ে পাঁচশ কপি ছাপানোর সুরাহা হয়। নীল দর্পণ Nil Darpan, The Indigo Palnting Mirror নামে তা ছাপানো হয় অনুবাদকের নাম ছাড়াই। বইতে শুধু লেখা ছিল Translated from the Bengali by a Native. বইটাতে পাদ্রি লং একটা ভূমিকাও জুড়ে দিয়েছিলেন।
নীল দর্পণের নেটিভ অনুবাদকের নাম প্রকাশ্যে ফাঁস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন যে, এই ইংরেজি অনুবাদের ফলে মাইকেল মধুসূদন গোপনে তিরস্কৃত ও অপমানিত হয়েছিলেন এবং এইজন্য শেষে তাঁকে জীবিকানির্বাহের একমাত্র উপায় সুপ্রিম কোর্টের চাকরিও ছেড়ে আসতে হয়েছিল। নাটকের কারণে পাদ্রী লং এক মাসের কারাদ- ও ১ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। তাঁর জরিমানার টাকা কবি কালিপ্রসন্ন সিংহ পরিশোধ করেন। -
নীল চাষ সম্পর্কিত পরিভাষা-
যৌথ মালিকানার ব্যবসা : কারবার।
কারবারের ম্যানেজার : বড় সাহেব।
বড় সাহেবের সহকারী : ছোট সাহেব।
প্রধান কার্যালয়ের কুঠি : সদর কুঠি।
নীল কুঠির প্রধান দালাল : নায়েব/ দেওয়ান।
দেওয়ানের অধীন ছোট দেওয়ান : গোমস্তা।
নীল পরিমাপে নিযুক্ত ব্যক্তি : ওজনদার।
নীল আনার শ্রমিক : জমাদার।
ব্রিটিশরা অনেক ক্ষেত্রেই সাঁওতালদের দ্বারা নীল চাষে বাধ্য করত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুলনায় নীলকরদের দমন করেন নীল আন্দোলন সম্পর্কিত প্রবাদ বাক্য- জমির শত্রু নীল; কাজের শত্রু ঢিল, আর দেশের শত্রু পাদ্রী হিল।
রাসায়নকিভাবে নীল তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলে নীলচাষের গুরুত্ব কমে যায়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের কুঠি উচ্ছেদের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। - আরও পড়ুন : সাঁওতাল বিদ্রোহ