বারো ভূঁইয়ার ইতিহাস- History of Baro Bhuyan

বারো ভূঁইয়া কারা? বারো ভূঁইয়ার ইতিহাস

জঙ্গলবাড়ি দুর্গ
জঙ্গলবাড়ি দুর্গ
  • বাংলার বারো ভূঁইয়া বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। দাউদের পতনের পর বাংলায় যে গণজাগরণ ও বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় মোঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করেন, তারা ইতিহাসে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত। বারো ভূঁইয়ার উৎপত্তি হয় বাংলার আফগান শাসনামলে।
    ১৫২৬ সালে বাবর কর্তৃক ইব্রাহিম লোদী পানিপথে নিহত হবার পর ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সময়ে আফগান, তুর্কি ও পাঠান শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লেও বাংলা বিহার উড়িষ্যা ও আসাম অঞ্চলে মোঘল বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ১৫৭৬ সালে আকবর কর্তৃক বাংলা বিজয় পর্যন্ত বাংলা স্বাধীন ছিল। স্বাধীন পাঠান রাজত্বের পতন হলেও বাংলায় তখনও মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘলদের অধীনতা মেনে নেয়নি। ভাটি অঞ্চলের জমিদারগণ একত্র হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই ভাটি অঞ্চলের জমিদারগণ ‘বারো ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। বারো ভূঁইয়া বলতে অনির্দিষ্ট, অসংখ্য জমিদার বুঝায়।

  • বারো ভূঁইয়া কারা?

  • ভূঁইয়া শব্দের অর্থ ভূই মালিক, ভূম্যধিকারী, রাজা বা জমিদার। সে সময় প্রভাবশালী রাজা, জমিদার ও স্থানীয় শাসকরা এই উপাধি গ্রহণ করতেন। অনেক সময় খণ্ডরাজ্য বা এক বা একাধিক পরগনার জমিদাররা ভূঁইয়া উপাধি গ্রহণ করত। ভূঁইয়াদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও নিজস্ব বাহিনীর শক্তির উপর তাদের রাজ্যের সম্মান ও প্রতিপত্তি নির্ভর করত। তারা শুধু রাজস্ব আদায় ও জমিদারি ভোগদখল নিয়ে ব্যস্ত থাকত না বরং তারা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সীমিত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর রাখত।
    তারা কখনো দিল্লীতে কর দিতেন, কখনো কর দিতেন না। অনেক সময় কেন্দ্রীয় শক্তিকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করতেন। বলা হয়, বাবরের সময় থেকেই বাংলায় মোগল আক্রমণ শুরু হলেও মোগল শাসনের সমগ্র বাংলা থেকে পরিপূর্ণ খাজনা আদায় একমাত্র শাহজাহানের শাসনের সময় সম্ভব হয়েছিল।
  • বারো ভুঁইয়া নামে পরিচিত যে সকল জমিদার ছিলেন-

    ১. প্রতাপাদিত্য (যশোর)
    ২. চাঁদ রায় ও কেদার রায় (বিক্রমপুর)
    ৩. মুকুন্দরাম রায় (ফতেহাবাদ)
    ৪. কংস নারায়ন (তাহিরপুর)
    ৫. রামচন্দ্র রায় ও কন্দর্প রায় (চন্দ্রদ্বীপ)
    ৬. লক্ষ্মণ মাণিক্য (ভুলুয়া)
    ৭. রামকৃষ্ণ (সান্তোল)
    ৮. পীতম্বর ও নীলম্বর (পুঁটিয়া)
    ৯. ঈশা খাঁ (খিজিরপুর)
    ১০. বীর হাম্বীর (বিষ্ণুপুর)
    ১১. ফজল গাজী (ভাওয়াল)
    ১২. ঈশা খাঁ ও উসমান খাঁ (উড়িষ্যা ও হিজলি)

    ঈশা খাঁ
    বাংলাদেশের প্রথম নোট
  • ঈশা খান-

  • ঈশা খাঁ বারো ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন। ১৫৩৭ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগনায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন সুলাইমান খাঁ। ১৫৪৫ সালে ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করলে সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করে। ফলে তাঁকে কৌশলে হত্যা করে তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈশা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানি বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়।
    ১৫৬৩ সালে ঈশা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিয়োগ পেয়ে বহু অনুসন্ধানের পর তুরান দেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে দুই ভাতিজাকে উদ্ধার করেন। এ সময় ঈশা খাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর। সুলতান তাজ খাঁ কররানি সিংহাসনে আরোহণ করে তাঁকে তাঁর পিতার জায়গীরদারি ফেরত দেন। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খাঁ কররানির রাজত্বকালে অসাধারণ বীরত্বের জন্য তিনি বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন। তিনি বর্তমান নারায়ণগঞ্জের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত খিজিরপুর নামক স্থানে বাসস্থান নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের অধিনায়ক। ক্রমেই তিনি সোনারগাঁয়ের শাসনভার গ্রহণ করেন।
    তিনি বেশ কয়েকবার মুঘল সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এ সকল যুদ্ধে তিনি পশ্চাদাপসরণ করেন এবং কিছুদিন পর অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। মুঘলের বিরুদ্ধে ঈশা খাঁর অনেক যুদ্ধের মধ্যে এগারসিন্দুরের যুদ্ধটিই ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসাবে পরিগণিত। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে অবস্থিত এগারসিন্দুর এলাকাটি উল্লেখযোগ্য নৌবন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে।
    ১৫৮৬ সালে ঈশা খাঁ মুঘল সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রাজধানী খিজিরপুর থেকে পালিয়ে সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন। ইতোমধ্যেই মুঘল সুবাদারকে বারবার পরাস্ত করায় তাঁর প্রসিদ্ধি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভাওয়ালের ফজল গাজী, বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, ভুলুয়ার লক্ষ্মণ মানিক প্রমুখ ঈশা তাঁর সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন। এদিকে উড়িষ্যা এবং বঙ্গের বিদ্রোহী পাঠান জমিদাররা মুঘলদের নিকট পরাজিত হয়ে দলে দলে ঈশা খাঁ’র সাথে যোগ দেয়। তিনি কামরূপ রাজ্যের রাঙ্গামাটি (বর্তমানে ধুবড়ি) দখল করে জঙ্গলবাড়ির দিকে এগিয়ে আসেন।

    ঈশা খাঁর দুর্গ
    ঈশা খাঁর দুর্গ
  • জঙ্গলবাড়ি দুর্গ

  • কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে আনুমানিক ৬ কি.মি. পূর্বে জঙ্গলবাড়ির অবস্থান। এখানে কোচ বংশীয় সামন্ত রাজা লক্ষ্মণ হাজরা রাজত্ব করতেন। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী নরসুন্দার কূল ঘেঁষে অবস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানটি নানা দিক থেকেই নিরাপদ স্থান হিসাবে বিবেচিত হতো। রাজবাড়ির চতুর্দিকে খননকৃত পরিখা (স্থানীয় ভাষায় আড়া) লক্ষ্মণ হাজরার প্রাসাদকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে অনেকটাই নিরাপদ রেখেছে। এই সামন্তরাজের অধিকৃত স্থানটি ‘হাজরাদি পরগনা’ নামে সুপরিচিত ছিল।
  • জঙ্গলবাড়ি দখল : জঙ্গলবাড়ির রাজা লক্ষ্মণ হাজরার বিরুদ্ধে প্রজা নিপীড়নের অভিযোগ থাকায় ঈশা খাঁ দূত মারফত তাকে বিনাযুদ্ধে জঙ্গলবাড়ি পরিত্যাগের নির্দেশ পাঠান। কিন্তু তিনি এতে সাড়া দেন নি। ফলে ঈশা খাঁ ক্ষিপ্ত হয়ে জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদ আক্রমণ করেন। লক্ষ্মণ হাজরা ঈশা খাঁর সৈন্যের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন এবং পালিয়ে যান। জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদ দখল করে এর নিরাপত্তা বেষ্টনি ও ভৌগোলিক অবস্থান দেখে তিনি জঙ্গলবাড়িতে তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। জঙ্গলবাড়ি কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম একটি। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ঈশা খাঁ’র বংশধরদের দ্বারা এখানে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত আজও টিকে আছে।

                    এগারসিন্ধুর দুর্গ
  • এগারসিন্দুর দুর্গ-

  • ঈশা খাঁর বীরত্বখচিত ঐতিহাসিক দূর্গ। ষোড়শ শতাব্দীতে এগারসিন্দুর বিখ্যাত নৌবন্দর হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে অবস্থিত পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর স্থানটি নদীবন্দরের সুবাদে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। ঈশা খাঁ এগারসিন্দুরে তার দুর্গ স্থাপন করে তিন দিক থেকে জলপথকে সুরক্ষিত করেছিলেন। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দূর্গের চতুর্দিকে পরিখা খননসহ সুদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।১৫৮৭ সালে মুঘল রাজপুত মানসিংহ বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলায় বিদ্রোহ দমনে আসে। মানসিংহ ১৫৯৫ সালে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। সোনারগাঁয়ের পতনের পর ঈশা খাঁ এগারসিন্দুর দূর্গে চলে আসেন।
    ইতোমধ্যে মানসিংহ তার সেনাদের নিয়ে লক্ষ্যা নদী দিয়ে বানার নদীর বাম তীরে শিবির স্থাপন করেন। এমতাবস্থায় ঈশা খাঁ মানসিংহের কাছে দূত মারফত এ মর্মে বার্তা পাঠান যে, উভয় পক্ষের যুদ্ধ হলে হাজার হাজার সৈন্যের মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধে লিপ্ত না করে তিনি স্বয়ং মানসিংহকে তার সঙ্গে সরাসরি মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানান। মানসিংহ ঈশা খাঁর এই ডাকে সাড়া দিয়ে জামাতা দুর্জয় সিংকে (মতান্তরে দুর্জন সিং) পাঠান।
    দুর্জয় সিং ঈশা খাঁর সাথে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হন। জামাতার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে মানসিংহ নিজে ঈশা খাঁর সাথে মল্লযুদ্ধ করেন। যুদ্ধরত অবস্থায় ঈশা খাঁর তরবারির আঘাতে মানসিংহের তরবারি ভেঙে যায়। মানসিংহ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে ঈশা খাঁ নিজের খাপ হতে মানসিংহের হাতে তরবারি তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিরস্ত্র শত্রুর সাথে আমি যুদ্ধ করি না; এবার এই তরবারি দ্বারা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করুন’।
    তাঁর এমন সৌজন্য ও বীরত্ব দেখে মানসিংহ বিস্মিত হন এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। অতঃপর মানসিংহ সসম্মানে ঈশা খাঁকে সম্রাট আকবরের দরবারে নিয়ে যান। আকবর সব বর্ণনা শুনে ঈশা খাঁকে তার দক্ষিণ পাশে পৃথক মসনদে উপবেশন করার অনুমতি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন। তিনি ঈশা খাঁকে ‘মসনদে আলী’‘বার্জুবানে বাঙ্গালা’ উপাধি দিয়ে বার্ষিক ৩৬,০০০ টাকা আয়ের নিষ্কর ভূসম্পত্তির জায়গির ও ২২টি পরগনার শাসনভার প্রদান করেন। ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এগারোসিন্ধুর দুর্গের গৌরব লুপ্ত হতে থাকে। তাঁর মৃত্যুর পর বারো ভূঁইয়ার নেতা হন পুত্র মুসা খাঁ। অন্যদিকে আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট হন জাহাঙ্গীর। বাংলায় জাহাঙ্গীর কর্তৃক নিয়োজিত সুবাদার ইসলাম খান মুসা খানকে পরাজিত করে বারো ভূঁইয়া অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটান।
  • মাসুম খাঁ কাবুলি-

  • তিনি প্রথমে আকবরের সেনাপতি ও বাংলার শাসনকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। আকবর দ্বীন-ই-এলাহি প্রবর্তন করলে মুঘল কর্মকর্তারা বাংলায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মাসুম খাঁ ছিলেন বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মুঘল বিরোধিতা অক্ষুণ্ন রাখেন। সুদূর আফগানিস্তান থেকে বাংলায় একজন বহিরাগত হলেও তিনি কালক্রমে বাংলার রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন। কোনো সুনির্দিষ্ট স্থায়ী রাজ্য গড়ে তুলতে না পারলেও তিনি বাংলার বৃহত্তর অংশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৫৯৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মাসুমাবাদে তাঁর কবর অবস্থিত।

    অনুশীলন প্রকাশন
    অনুশীলন প্রকাশন
  • মুসা খাঁ-

  • ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁ জাহাঙ্গীরের আমলে ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন। তাঁর রাজত্বে ছিল বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ও রংপুর, বগুড়া, পাবনা জেলার কিয়াদংশ। তিনি পিতার মতো সিংহাসন দখলের পর মসনদ-ই-আলা উপাধি ধারণ করেছিলেন। ১৬০৩ সালে এক নৌযুদ্ধে মানসিংহ মুসা খানকে পরাজিত করেন। তবে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার পূর্বে আকবরের অসুস্থতার সংবাদ পেলে তিনি আগ্রায় ফিরে যান।
    এই সময় রাজধানী সোনারগাঁ ছাড়াও খিজিরপুর, কদমরসুল, যাত্রাপুর, ডাকচর ও বিক্রমপুর তাঁর সামরিক ঘাঁটি ছিল। ১৬০৩ সালে পূর্ববঙ্গের অন্যতম ভূঁইয়া কেদার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর অধিকৃত স্থানগুলো ও বিক্রমপুরের দুর্গ মুসা খাঁর হস্তগত হয়। তিনি রাজধানী সোনারগাঁ থেকে ঢাকায় স্থানান্তের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজন্য (বর্তমান) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জনহল এলাকায় প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করেন। একই সাথে পুরো এলাকাতে সুশোভিত বাগান তৈরি করেন যার নাম ছিল ‘বাগ-ই-মুসা’। ১৬০৮ সালে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী বলে ঘোষণা করেন। ১৯০৪ সালের পরে পূর্ব বাংলায় সরকারি ভবন তৈরির সময় মুসা খাঁ তৈরি দালানগুলো ধ্বংস করা হয়।
    ১৬০৮ সালে ইসলাম খান বঙ্গের সুবেদার নিযুক্ত হয়ে বুঝতে পারেন যে, মুসা খানকে দমন করতে পারলেই বাকি জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেজন্য তিনি রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করায় ইসলাম খান বেশ কয়েকজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেন। জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এই সময় থেকে ঢাকা বাংলার রাজধানী হয়। জাহাঙ্গীরের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীর নগর।
    ১৬১০ সালে ইসলাম খাঁ পূর্ববঙ্গ দখলের জন্য ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকেন। ফলে মুসা খাঁর সামরিক শক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। জুলাই মাসে মোগল বাহিনী যাত্রাপুর ও ডাকচারা দুর্গ দখল করে। এই সময় মুসা খাঁ সোনারগাঁয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকেন। তিনি শীতলক্ষা নদীকে প্রতিরোধের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন।
    ১৬১১ সালে মোগলরা সোনারগাঁ আক্রমণ করে। যথাসাধ্য প্রতিরোধের চেষ্টা করেও সোনারগাঁ মোগলদের দখলে চলে যায়। মূসা খান ইব্রাহিমপুরের দ্বীপে পালিয়ে যান। এরপর তিনি অনিয়মিত বাহিনী নিয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি কোদালিয়া ফাঁড়ি দখল করেন। এরপর তিনি মীর্জা নাথানের দূর্গও দখল করেন। কিন্তু এই যুদ্ধের মাধ্যমে মূসা খাঁ সৈন্যহীন দশায় পৌঁছান। বিশেষ করে মোগল বাহিনী পুনরায় আক্রমণ করলে মুসলমান জমিদাররা ইসলাম খাঁর নিকট কাছে আত্মসমর্পণ করেন। নিরুপায় হয়ে মুসা খাঁন আত্মসমর্পন করেন।
    মুসা খাঁ ও তার পরিবারের সদস্যদের ইসলাম খাঁর নির্দেশে বাগ-ই-মূসাতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। পরবর্তীতে সুবাদার ইসলাম খাঁ ও মুসা খাঁর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে মোগল বাহিনীর কর্মচারী হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। ১৬২৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বাগ-ই-মুসা অবস্থিত মুসা খাঁ মসজিদের সন্নিকটে তিনি সমাহিত আছেন। (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হল এবং কার্জন হল প্রাঙ্গনে অবস্থিত)।এভাবে বারো ভূঁইয়া শাসনের ইতি ঘটে।
  • খাজা উসমান খাঁ লোহানি- 

  • তিনি ছিলেন বাংলার সর্বশেষ পাঠান সুলতান। তিনি কখনো মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেননি। তিনি ২ হাজার অশ্বারোহী, ৫ হাজার পদাতিক ও ৪০টি হস্তীর এক বাহিনী নিয়ে মুঘলবাহিনীর গতিরোধ করতে উষার ত্যাগ করেন। শেরে ময়দান, খাজা ইব্রাহিম এবং খাজা দাউদ প্রমুখ আফগান নেতৃবৃন্দ স্ব স্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে উসমান বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন।
    পরগনার দৌলম্ভপুর গ্রামে তারা সমবেত হন। সেখান থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে ছিল মুঘলবাহিনীর শিবির। ১৬১২ সালের ১২ মার্চ, রোববার ভোরবেলা মুঘলবাহিনী প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করে। ক্রমেই উভয়পক্ষের আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠে। দুপুরবেলা মুঘল সৈনিক আব্দুল জলীল শেখের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে খাজা উসমান নিহত হন।
    তাঁর মৃত্যুও সংবাদ গোপন রাখা হয়। তাঁর পুত্র খাজা মুমরিজ হাতির পিঠে করে দ্রুত বাবার মৃতদেহ শিবিওে নিয়ে যান এবং মধ্যরাতে দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে গোপনে সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রাসাদ অঙ্গনে একটি মেকি সমাধি তৈরি করা হয়।
  • বায়েজিদ কররানি-

  •  জাহাঙ্গীরের আমলে তিনি সিলেটে রাজা ছিলেন। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আফগান সর্দার তার অধীনতা স্বীকার করেছিলেন। খাজা উসমানের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। খাজা উসমানের পতন সংবাদে বায়েজিদ আত্মসমর্পণ করেন। বায়েজিদের পতনে মুঘলদের বিরুদ্ধে আজাদি আন্দোলনের শেষ স্ফুলিঙ্গ নিভে যায় এবং গোটা বাংলা দিল্লী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
  • বাহাদুর গাজী : তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে মুসা খাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। মুসা খাঁ পরাজিত হলে বাহাদুর গাজী মুঘলদের পক্ষে যোগদান করে যশোর ও কামরূপ অভিযানে অংশ নেন।
  • রাজা প্রতাপাদিত্য- 

  • শ্রী হরি নামের এক ব্যক্তির ওপর ছিল দাউদ কররানির সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। দাউদ কররানি মারা গেলে শ্রী হরি রাজকোষের সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে পালিয়ে যান। ১৫৭৪ সালে খুলনার দক্ষিণ প্রান্তে জলাভূমি অঞ্চলে এক রাজ্য গড়ে তুলে ‘মহারাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন। ১০ বছর পর ১৫৮৪ সালে পুত্র প্রতাপাদিত্য তার স্থলাভিষিক্ত হন। ধারণা করা হয়, প্রথম পর্যায়ে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল মুকুন্দপুর অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ধুমঘাটে বা ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে রাজধানী স্থাপন করেন। পরে ধুমঘাটেরই নাম হয় যশোহর।
    তাঁর অভিষেক কালে বারো ভুঁইয়াদের অনেকে যশোর গিয়েছিলেন এবং তাঁর নিকট বঙ্গের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন যে, সম্রাট আকবর আগ্রার রাজদরবার, রাজনীতি ও রাজপরিবারের আত্মকলহ- এসব বিষয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এবং এর ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহের দানা বেঁধে উঠেছে। এই সুযোগে তিনি সেন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। মূলত আত্মরক্ষা, পাঠানদের পক্ষ সমর্থন, বঙ্গদেশে হিন্দু শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মুঘল ছাড়াও মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের পাশবিক নির্যাতন থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন।
    ভূঁইয়াদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর এই বিদ্রোহী চেতনার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলেও অনেকেই দূরত্ব বজায় রাখেন। এমনকি প্রতাপের হিতাকাক্সক্ষী বসন্ত রায়ও এই বিদ্রোহ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। ফলে বসন্ত রায় গঙ্গাতীরের রায়গড় দুর্গে স্থানান্তর হন এবং যশোরের ৬ আনা অংশের শাসন করতে থাকেন।
    ১৫৯১ সালে রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে ১৬০৮ সালে সন্ধি হয় বঙ্গের সুবেদার ইসলাম খাঁর সাথে। কিন্তু ১৬১০ সালে পুনরায় ধূমঘাটে নৌযুদ্ধে পরাজিত হন রাজা প্রতাপাদিত্য। তাকে বন্দি অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়। কিছুদিন পর তাঁকে আগ্রায় পাঠানো হয়। পথিমধ্যে বারানসিতে ৫০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

  • পূর্বের আলোচনা পড়ুন : বাংলায় কররানি বংশের শাসন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top