পলাশী পরবর্তী বাংলার ইতিহাস
-
মীর জাফরের ক্ষমতাগ্রহণ-
- পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল পরেই রবার্ট ক্লাইভ প্রকাশ্য দরবারে মীর জাফরকে মসনদে বসান। তার পুরো নাম হয় ‘সুজাউল মূলক হিশামউদদৌলা মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খান মহাব্বত জং।’ পুত্র মিরনের প্রবল আগ্রহে তাকে ‘শাহাম্মত জং’ উপাধি প্রদান কর হয়। মসনদে বসানোর পর ক্লাইভ প্রচলিত রীতি অনুসারে নবাবকে আনুষ্ঠানিক নজরানা প্রদান করে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে।
সিরাজের রক্ষিত অর্থ ও রমণীকূল হস্তগত করার পর মীর জাফর ও মিরন সীমাহীন ভোগবিলাসে মগ্ন হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নতি, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন পরিশোধ বা কৃষকদের অবস্থার উন্নতির কোনো চিন্তাই তাদের মনে আসে নি। অবস্থা এমন হয় যে, বেতনের অভাবে সেনারা তাদের ঘোড়াগুলোকে খাবারের জন্যে মাঠে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
রাজত্বের এক বছর ও তিন মাস অতিক্রান্ত না হতেই সেনারা বিদ্রোহের চেষ্টা করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। মীর জাফরের বড় ভাই মীর কাজিম ও সেনাপতি খাজা আবদুল হাদী নবাব কর্তৃক নিহত হন।
ইংরেজরা তাদের নিয়ে মুশকিলে পড়ে যায়। তারা বিকল্প খুঁজতে থাকে। ১৭৬০ সালে হলওয়েল ব্রিটেনে কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করেন যে, মীর জাফর ঘসেটি বেগম, আমেনা বেগম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত নবাব বংশীয় মহিলাকে ঢাকার রাজকারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। একসময় ইংরেজরা মীরনকে হত্যা করে। মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ১৭৬০ সালে কোম্পানিকে নানা সুবিধা দানের শর্তে মির জাফরের জামাতা মির কাসিম বাংলার ক্ষমতায় বসেন। -
মির কাসিমের ক্ষমতারোহণ-
- মির কাসিম শ্বশুরের মতো অযোগ্য ও নিকৃষ্ট চরিত্রের ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করেন যে এই দেশের মানুষের জন্য ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি। তিনি রাজধানীতে ইংরেজ রেসিডেন্টের শাসনকার্যে অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করার উদ্যোগ নেন। ইংরেজদের সাথে সম্মানজনক উপায়ে বাংলার স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। প্রশাসনকে ইংরেজ প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। নতুন রাজধানী নিরাপত্তার জন্য চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। বিহারের শাসক ও ইংরেজদের দোসর রামনারায়ণকে দুর্নীতির জন্য পদচ্যুত করা হয়। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে ইংরেজরা নবাবের উপর ক্ষিপ্ত হয়।
-
অর্থনৈতিক সংস্কার-
- ফররুখ সিয়ারের নিকট থেকে ১৭১৭ সালে প্রাপ্ত ফরমান বলে ইংরেজ কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একই সুবিধা নিতে থাকে। ফলে দেশীয় বণিকগণ ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারা ইংরেজ বণিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না। তিনি এই সংকট দূর করার জন্য ভ্যান্সিটার্টের কাছে এক আবেদন জানান। কিন্তু তাতেও সংকট নিরসন না হওয়ায় বাধ্য হয়ে নবাব একসময় সব ব্যবসায়ীর উপর বাণিজ্য শুল্ক উঠিয়ে দেন। এতে নবাবের রাজস্ব আয় কমে গেলেও দেশীয় বণিকদের সাথে বিদেশি বণিকদের অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। এই নতুন নিয়ম ইংরেজদের স্বার্থে আঘাত করে।
-
সামরিক উদ্যোগ ও বক্সারের যুদ্ধ-
- মির কাসিম এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আফগান ও আর্মেনীয়দের সেনা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরি (গুরগিন খাঁ)-কে তিনি সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। ফরাসি সমরু (ওয়াল্টার রাইন) ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি সমর বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। এ ছাড়াও আর্মেনীয় কারিগরদের সাহায্য নিয়ে তিনি মুঙ্গেরে কামান ও বন্দুক তৈরির কারখানা নির্মাণ করেন। মির কাসিমের এই সামরিক উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে। ইংরেজরা নবাবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
- বক্সার যুদ্ধের ইতিহাস (Battle of Buxar) : মির কাসিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদদৌলা এবং মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটের সাথে ক্লাইভের বাহিনীর বক্সারের প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধই বক্সারের যুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুতেই কলকাতায় ইংরেজ কুঠির প্রধান এলিসের সাথে নবাবের সংঘর্ষ বাধে। এলিস পাটনা দখল করতে চাইলে নবাব প্রতিরোধ করে। ১৭৬৩ সালে কলকাতা কাউন্সিল নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মির কাসিমের সৈন্য বেশি থাকা সত্ত্বেও পরপর চারটি খণ্ডযুদ্ধে গিরিয়া, কাটোয়া ও উদয়নালায়ে নবাব পরাজিত হন। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি অযোধ্যায় আশ্রয় নেন।
মির কাসিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুগল সম্রাট শাহ আলমের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাদের সহযোগিতায় তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি।১৭৬৪ সালের শরৎকালে পুনরায় যুদ্ধ হয়। ২২ অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে সংঘটিত এ যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করে। বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম পুনরায় ইংরেজ শিবিরে আশ্রয় নেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজ বাহিনীর পদানত হয়। বাংলায় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর ইতিহাসের পাতায় মির কাসিমের নাম তেমন পাওয়া যায় না।
এই সময় মির জাফরকে ক্ষমতায় বসানো হয়। নতুন নবাব হয়ে মির জাফর মির কাসিমের জারিকৃত ইংরেজ স্বার্থবিরোধী সব আইন বাতিল করে। - ফলাফল ও গুরুত্ব : বক্সারের যুদ্ধ ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেয়। অনেক দিক থেকে এই যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব বহন করে। যেমন-
ক. যুদ্ধে মুগল সম্রাট ইংরেজদের বিপক্ষে ছিল। ইংরেজরা যুদ্ধে জয়লাভ করায় সম্রাটের সাথে ইংরেজদের এলাহাবাদ চুক্তি হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজরা বছরে মাত্র ২৬ লক্ষ টাকা করের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। যেখান থেকে খরচ বাদে তাদের রাজস্ব ছিল ১২ কোটি টাকা। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিওয়ানির সনদ লাভ করে।
খ. অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যাওয়ায় ইংরেজরা তার থেকে কারা ও এলাহাবাদ কেড়ে নেয়।
গ. বাংলার স্বাধীনতার শেষ স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। উপমহাদেশে ইংরেজদের প্রভাব বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।
ঘ. উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিনা বাধায় ইংরেজ আধিপত্য বিস্তার হয়। তারা ভারতবর্ষের নানা স্থানে কুঠি নির্মাণ শুরু করে। দিল্লি থেকে শুরু করে বাংলা পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারত ইংরেজদের অধীনে চলে আসে।[বি. দ্র. ১৮৯৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত চীনে বক্সার বিদ্রোহ নামে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের মূল ছিল চীন থেকে বিদেশিদের বিতাড়ন করা। বক্সার হচ্ছে একটি গোপন গ্রুপ যাদের অধিকাংশই কৃষক ছিলেন।]
ব্রিটিশদের দেওয়ানি লাভ
-
সুবাদার ও দেওয়ান পদ কী?
-
ঐতিহাসিকভাবে মুগল শাসনামলে প্রদেশে দুটি সমপর্যায়ের পদ ছিল। একটি পদ হচ্ছে সুবাদার ও অপরটি দেওয়ান। উভয়েই সরাসরি দিল্লীর সম্রাটের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন। তারা একে অপরকে প্রশাসনিক কাজে সহযোগিতা করত কিন্তু কেউ কারো অধীন নয়। সুবাদারের দায়িত্ব ছিল বিচার, প্রতিরক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনা। অন্যদিকে দেওয়ানের দায়িত্ব ছিল রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন। যেমন- ১৭১৭ সালে সুবাদার হওয়ার পূর্বে মুর্শিদুকুলি খান বাংলার দেওয়ান ছিলেন। মুগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলার নবাবরা একই সাথে সুবাদার ও দেওয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন। এমনকি মারাঠা উপদ্রবের সময় আলীবর্দি খান কেন্দ্রে রাজস্ব পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা ও মির জাফরের আমলে কেন্দ্রে রাজস্ব দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরাই দেশের সর্বেসর্বা বনে যায়। ফলে সুবে বাংলা আবার আগের মতো দিল্লীতে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করে দেয়। দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম বাংলা থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিল। তিনি কয়েকবার কোম্পানিকে বাৎসরিক কিছু উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি গ্রহণে অনুরোধ করলেও ইংরেজরা তা প্রত্যাখ্যান করে। বরং বক্সারের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা আদায় করে।
-
ব্রিটিশরা কীভাবে দেওয়ানি লাভ করে?
- ১৭৬৫ সালে ইংরেজদের দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে তাদের অভূতপূর্ব বিজয় হয়। যেমন-
ক. ক্ষমতাহীন নবাব : নবাব একেবারে ক্ষমতাহীন হয়ে ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। রাজস্ব আদায়ের অধিকার ও সেনাদল রাখার মতো অর্থবল ছিল না নবাবের। অর্থের যোগান ছাড়া নবাবের নবাবি অচল। নবাবকে নামমাত্র সিংহাসনে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলায় বাস্তবিক অর্থেই ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে।
খ. দেউলিয়া থেকে মুক্তি : কোম্পানি নিজের দেউলিয়া অবস্থা হতে রক্ষা পায়। দেওয়ানি লাভের সুবিধা সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে জানান, যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যাবে তা দিয়ে সব ধরনের ব্যয় বাদ দিলেও কোম্পানির হাতে ১২ কোটি টাকার অধিক আয় থাকবে। এই সময় ব্রিটিশদের বিভিন্ন উপনিবেশে যুদ্ধ চলায় ব্রিটিশ সরকারের অর্থের সংকট দেখা দেয়।
গ. ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য : এই দেওয়ানির উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানির গোটা বাণিজ্য বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট। ফলে দেওয়ানি লাভের আগে ইউরোপ থেকে যে পুঁজি আনা হত তা এখন আর প্রয়োজন পড়ল না।
ঘ. শুল্কহীন বাণিজ্য : কোম্পানির কর্মচারীরা শুল্কহীন অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পায়। এতে কোম্পানির কর্মচারীদের অর্থলিপ্সা বাড়তে থাকে। অসদুপায় রাজস্ব আদায় করলেও কোম্পানির কর্তারা কোনো পদক্ষেপ নিত না। এভাবে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে এদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
ঙ. সম্পদ পাচার : এই সময় বাংলা থেকে ব্যাপক আকারে অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। এই দেওয়ানি লাভ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এর ফলে বাংলা ধীরে ধীরে অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। -
বাংলায় দ্বৈত শাসন (Dyarchy In Bengal)
-
দ্বৈত শাসন : রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার গভর্নর হয়ে আসলে নতুন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করে যা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। দেওয়ানি ও নেজামত এই দুটি শাসন কাজের ভাগাভাগিকে এক অর্থে দ্বৈত শাসন বলা যায়। রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল কোম্পানির। আর বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্ব ছিল নেজামতের। কোম্পানির সরাসরি দেওয়ানির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যে অর্থ ও লোকবল প্রয়োজন দরকার ছিল, তা কোম্পানির ছিল না। অন্যদিকে এদেশীয় ভাষা ও আইন-কানুন সম্পর্কে কোম্পানির কর্মচারিদের জ্ঞানও ছিল না। তাই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানির পক্ষে পরিচালনা করা অসম্ভব ছিল।
- বাংলায় দ্বৈতশাসন : সরাসরি রাজস্ব আদায় করা কোম্পানির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয়। কেননা, সরাসরি কোম্পানি রাজস্ব গ্রহণ করলে বাণিজ্যরত অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সাথে তাদের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। বিশেষত বাণিজ্যিক শুল্ক আদায় ছিল দেওয়ানির অন্তর্গত। ফলে ক্লাইভ কৌশলে দেওয়ানির সব দায়ভার নবাবের উপর দেয় আর কোম্পানির কাছে রাখা হয় কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধায়ন। নবাবের ভাতা ও শাসনকার্যের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। অতিরিক্ত প্রায় সব অর্থ কোম্পানি নিয়ে নিত। এক্ষেত্রে নবাব প্রায় ক্ষমতাহীন থেকেও সব দায়িত্ব পালন করতে থাকে।
রাজস্ব আদায়ের জন্য কোম্পানি নায়েবে দেওয়ান নামে নতুন একটি পদ তৈরি করে। তার উপরেই বাংলার রাজস্ব আদায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে এরা রাজস্ব আদায় করত। পাশাপাশি কোম্পানির সব আদেশ মেনে চলত। অন্যদিকে কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের উপর নজর রাখা হত। এজন্য মুর্শিদাবাদ দরবারে একজন প্রতিনিধি অবস্থান করত। দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানোর ক্ষমতা ছিল কোম্পানির। এমন সমন্বয়হীনতার কারণে ১৭৭০ সালে এক দুর্ভিক্ষ হয়। -
দ্বৈত শাসনের ফলাফল-
ক. ক্ষমতাহীন নবাব : এই ব্যবস্থায় নবাবের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল নামমাত্র। বাস্তবে নবাবের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। অন্যদিকে কোম্পানির হাতে সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো দায়িত্ব ছিল না। ফলে দেশে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
খ. কৃষি ও শিল্পখাতে অবনতি : বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক অবনতি ঘটে। স্বাধীন নবাবি আমলে বহু বিদেশি ব্যবসায়ী এদেশ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে যেত। কিন্তু কোম্পানির নতুন বাণিজ্য নীতির কারণে এদেশের ব্যবসায় ইংরেজদের একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পায়। দেশের রপ্তানি আয় তলানিতে নেমে যায়। ব্রিটিশরা কম দামি মুর্শিদাবাদি রেশম আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। অথচ ইংল্যান্ডের দামী রেশম শিল্পকে বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এর ফলে দেশীয় শিল্প বিলুপ্তির মুখে পড়ে।
গ. আমিলদারি প্রথা : দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলায় আমিলদারি প্রথার উদ্ভব ঘটে। বিভিন্ন জেলার আমিলদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু আমিলদের মেয়াদ ছিল স্বল্পদিন তাই তারা বেশি করে রাজস্ব আদায় করত। কারণ, যে জেলার জমিদার যত বেশি রাজস্ব দিতে পারত তাকেই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হত। ফলে জমিদাররা ইজারাদারে পরিণত হয়।
ঘ. কৃষক নিপীড়ন : কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। ফলে কৃষকরা কৃষি কাজ ছেড়ে দিতে থাকে। ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচার হওয়ার দরুন রাজস্বের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। যেমন- পূর্ণিয়া জেলার রাজস্ব চার লক্ষ টাকা থেকে ২৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়। দিনাজপুর জেলার রাজস্ব ১২ লক্ষ টাকা থেকে ৭০ লক্ষ টাকায় বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে কৃষকরা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়। -
ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ কেন সংঘটিত হয়?
ঙ. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : দ্বৈত শাসনের চূড়ান্ত পরিণাম ছিল ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। যথেচ্ছা রাজস্ব বৃদ্ধি ও কৃষক নিপীড়নের ফলে কৃষিকাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে পরপর দুই বছর অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দেয়। ফলে ১৭৭০ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। টাকায় এক মণ থেকে চালের মূল্য টাকায় তিন সেরে দাঁড়ায়। খোলাবাজারে শস্য বিক্রী লাভজনক হওয়ায় কোম্পানির কর্মচারীরা মজুদ শুরু করে। খাদ্যের অভাবে এই সময় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। মানুষ খাবারের আশায় ঢাকা, কলকাতা, মুর্শিদাবাদে ছুটতে থাকে। কোম্পানি এই সময়ও খাজনা মওকুফ করে নি।
[কনফিউশন : ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় ভারতের গভর্নর ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ এবং বাংলার গভর্নর ছিলেন কার্টিয়ার। তখন দুজনকেই গভর্নর বলা হত। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের পর ভারতে প্রধান প্রতিনিধিকে বলা হত গভর্নর জেনারেল আর বাংলায় প্রতিনিধিকে বলা হত গভর্নর।]
-
চ. নাজাই প্রথা : এই সময়ে নাজাই নামে একটি প্রথা চালু হয়। যার মূলকথা ছিল কোনো একজন কৃষক রাজস্ব বাকি রাখলে সেই গ্রামের অন্য কৃষকদের সেই রাজস্ব দিতে হত। এই বিশেষ কারণে দুর্ভিক্ষে অনেক কৃষক মারা যাওয়ায় তাদের বকেয়া রাজস্বের দায়িত্ব জীবিত কৃষকদের উপর বর্তায়। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে বহু কৃষক জমির স্বত্ব ছেড়ে সরকারি পাইকে পরিণত হয়। এই দুর্ভিক্ষের ধকল প্রায় ২০ বছর থাকে।
- কোম্পানির রাজস্ব আহরণ কমে যায়। তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়। তাই কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি বাংলার কৃষি ও শিল্পকে বাঁচাতে ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলায় আসেন। ১৭৭২ সালে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়।
১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলা গভর্নর জেনারেল হন। তাঁর শাসনামল নানাবিধ সংস্কারের জন্য বিখ্যাত। তিনি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৩ সালে তিনি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথা চালু করেন। -
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement)
- ১৭৭২ সালের পর থেকেই ভূমি বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কর্নওয়ালিস মনে করতেন ভূমি ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব এলেই জমিদাররা ভূমিতে বিনিয়োগ করবেন। তারা নিজেদের স্বার্থে উদ্বৃত্ত অর্থ জমির উন্নয়নে ব্যয় করবেন। এর ফলে জমি উন্নত হবে। উন্নত জমিতে চাষাবাদ করলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। আর কৃষির উন্নয়ন হলে দেশের উন্নতি হবে। কর্নওয়ালিস নিজেও একজন জমিদারের ছেলে ছিলেন। ফলে তিনি ইংল্যান্ডের মতো করে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রজাদের দিকে নজর না দিয়ে জমিদারদের দিকটিই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি এমন এক শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিলেন যারা সর্বদা ব্রিটিশ সরকারের অনুগত থাকবে।
-
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি-
- কর্নওয়েলিস এদেশের শাসন গ্রহণ করার সময় ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার অন্ত ছিল না। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস পাঁচসনা বন্দোবস্ত চালু করেন। এতে ভূমি রাজস্ব নিলাম করা হত। যে সর্বোচ্চ দর দিত সেই ভূমির মালিক হত। যদিও এই ব্যবস্থায় উচ্চহারে দর দেওয়ার কথা থাকলেও সে অনুসারে রাজস্ব আদায় হত না। পাশাপশি স্বল্প সময় (৫ বছর) থাকায় জমিদাররা ভূমির উন্নতি করেনি। ফলে বছরের পর বছর কৃষকরা জমি চাষ থেকে বিরত থাকে। জমির দাম কমতে থাকে। এই কুফল দূর করার জন্য হেস্টিংস একসনা ব্যবস্থা চালু করলেও তাতে সুফল হয় নি। ১৭৯০ সালে কর্নওয়ালিস দশসনা বন্দোবস্ত চালু করেন। এটি চিরস্থায়ী হওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। এ নিয়ে স্যার জন শোরের সাথে কর্নওয়ালিসের বাদানুবাদ হয়। অবশেষে কোম্পানির অনুমোদনের পর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হয়।
এর মাধ্যমে রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। জমির উপর জমিদারদের মালিকানা, ক্ষমতা ও হস্তান্তরের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদাররা নিজের মনোমত শর্ত সাপেক্ষে জমি পত্তন বা ইজারা দিতে পারত। কেবল শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা, বিচার ও পুলিশি ক্ষমতা বাদে প্রায় সব ক্ষমতাই জমিদারদের হাতে চলে যায়। জমির কিস্তি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যাস্তের আগে না দিতে পারলে জমিদারি নিলামে তোলা হত যা ‘সূর্যাস্ত আইন’ নামে পরিচিত। - সুফল : জমিদারগণ জমির স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব লাভ করে। তারা ক্ষেত্রবিশেষ জমির উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। ফলে জমির উৎপাদন শক্তি ও মূল্য বেড়ে যায়। এর ফলে জমিদাররা ইংরেজদের কাজে সহায়তা করে। তাদের প্রভাবে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিত্তবান জমিদাররা সুনামের জন্য স্কুল, কলেজ ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করে। পাশাপাশি তারা অনেক জলাশয় ও দীঘি খনন করে। বাংলার গ্রামীণ জীবন সচল হয়ে উঠে নানা আয়োজনে। আয় সুনিশ্চিত হওয়ায় কোম্পানির বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে সুবিধা হয়। অস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে দূর হয়।
- কুফল-
ক. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সঠিক জরিপের মাধ্যমে করা হয়নি। ফলে নিষ্কর জমির উপর অধিক রাজস্ব নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি জমির সীমানা নির্ধারিত ছিল না। পরবর্তীতে মামলা মোকাদ্দমার সৃষ্টি হতে থাকে যা পুরো ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
খ. জমির দাম বাড়লেও সরকারের রাজস্ব বাড়ে নি। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হলেও সরকার বর্ধিতাংশ থেকে বঞ্চিত হয়।
গ. চিরস্থায়ী বন্তোবস্তের ফলে প্রজা ও কৃষকদের কোনো উন্নতি হয় নি। জমিতে পুরান স্বত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে তারা জমিদারদের করুণার উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। জমিদার ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় কৃষকদের উচ্ছেদ করতে পারতেন।
ঘ. সূর্যাস্ত আইনের কঠোরতার জন্য অনেক বড় বড় জমিদারি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ‘বর্ধমানের জমিদারি’ ছাড়া অন্য সব জমিদারি প্রথম সাত বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়।
ঙ. জমিদারি স্বত্ব ও আয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নায়েব গোমস্তাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে জমিদারগণ গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস শুরু করে। শহরের উন্নতি হয় কিন্তু গ্রামের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। জমিতে অর্থ বিনিয়োগ করে অনায়াসে সম্পদ পাওয়া যায় বলে শিল্প-বাণিজ্য পরিত্যক্ত হতে থাকে। অধিকাংশ লোক জমিদারির দিকে ঝুঁকে পড়ায় শেষ পর্যন্ত কৃষি ও শিল্প প্রায় বিপন্নের দিকে মোড় নেয়। এই ব্যবস্থার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলমানরা। বিভিন্ন অঞ্চলে নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
পরবর্তীতে নীলচাষের সুবিধার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ১৮৫৯ সালে লর্ড ক্যানিং রাজস্ব আইন দ্বারা খাজনা বৃদ্ধি বন্ধ করেন। ১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা জমি থেকে উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়ে দিয়ে প্রজাদের সাথে সরাসরি জমির বন্দোবস্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। - পূর্বের আলোচনা পড়ুন : সিরাজউদ্দৌলার পতনের কারণ