রাজা গণেশ কীভাবে ক্ষমতায় আসেন?
- ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ পর্যায়ে বাংলার ইতিহাসে রাজা গণেশের আবির্ভাব ঘটে। বাংলার ইতিহাসে এই আটাশ বছর (১৪১৪-১৪৪২) মুসলিম শাসনের বিরতিকাল। সুদীর্ঘ দুই শতকের অধিক সময় পর্যন্ত মুসলিম শাসন অব্যাহত থাকার পর বঙ্গে হিন্দু রাজত্বের পুনরুত্থান সত্যি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বের শেষ দিকে রাজদরবারে যে সকল অমাত্য প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, রাজা গণেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সাইফুদ্দীন হামজাহ শাহ, শিহাবউদ্দীন বায়েজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা পালন করেন। রাজা গণেশ ও তার মুসলিম বংশধরগণ প্রায় ২৮ বছর বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন।
-
রাজা গণেশ ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট-
- পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট : বাংলার সীমান্তবর্তী হিন্দু রাজ্যগুলো রাজা গণেশের মিত্র ছিল। কারণ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ তাঁর রাজত্বের শেষ সময়ে প্রতিবেশি কামতা ও উড়িষ্যায় ব্যর্থ সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। কামতা-রাজ যখন অহোম-রাজ কর্তৃক আক্রান্ত হন তখন সুযোগ বুঝে গিয়াসউদ্দিন কামতা আক্রমণ করেন। এই সময় কামতা-রাজ নিজের মেয়ের সাথে অহোম-রাজের বিয়ে দিয়ে মিত্রতা স্থাপন করে যৌথ বাহিনী গঠন করেন। তারা গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত করে। এভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু রাজ্যগুলোর প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে।
- ক্ষমতায় আরোহণ : সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর উপযুক্ত শাসকের অভাবে বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বায়াজিদ শাহ তখন ক্ষমতায় ছিলেন। চতুর রাজা গনেশ উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, সুলতান শিহাবউদ্দীন বায়েজিদ একজন নির্বোধ শাসক। তাই তিনি বায়েজিদকে সরানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর একদিন স্থানীয় বনে শিকারের সময় তীর নিক্ষেপ করে সুলতান শিহাবুদ্দীনকে হত্যা করে। পরবর্তীতে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ক্ষমতায় বসলে গণেশ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মুখোমুখি যুদ্ধে গণেশ ফিরোজ শাহকে হত্যা করে গৌড়ের সিংহাসন দখল করে।{Blockman বলেন যে, গণেশ নিজে সিংহাসনে আরোহন করেননি। তবে তিনি শামসুদ্দীনকে হত্যা করে তাঁর ভাই শাহাবুদ্দীন বায়েজিদকে পুতুল স্বরূপ রেখে স্বয়ং রাজকার্য পরিচালনা করতেন। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে দু’জন শাসকের নাম উল্লেখ করেছেন। যথা- শিহাবুদ্দীন বায়েজিদ ও গণেশ।
হিন্দু রাজত্বের পুনরুত্থান
- রাজা গণেশ : তার প্রকৃত নাম ‘গনেশ নারায়ণ’। তাঁর পুত্র সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মুদ্রায় তাঁর নাম ‘কানস রাউ’ বা ‘কানস শাহ’ বলে উল্লেখ আছে। ফারসি ভাষায় লিখিত ইতিহাসে ‘রাজা কংস’ বা ‘রাজা কানসি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থানুসারে রাজা গণেশ ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়ার জমিদার ছিলেন। অন্যদিকে ফ্রান্সিস হ্যামিল্টন দাবি করেন, তিনি উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের হাকিম ছিলেন।
রাজা গণেশ বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। রাজা গণেশ নিজস্ব একটি সেনাবাহিনী রাখতেন। তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে তাঁকে বাংলার সুলতানের চাকরিতে নিযুক্ত করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে তিনি রাজ্যের খাজাঞ্চিখানার একচ্ছত্র মালিক (সাহেব-ই-ইখতিয়ার-ই-মুলক ও মাল) হয়ে পড়েন। -
সর্বশেষ হিন্দু রাজা কে?
- কার্যক্রম : গণেশ দুইবার সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রথমবার কয়েক মাস মাত্র ক্ষমতায় ছিলেন। রাজা গণেশ তাঁর স্বল্পকালীন শাসনে প্রায় সমগ্র বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মুসলিম নিধনে নিয়োজিত হন। কথিত আছে শায়খ বদরে ইসলাম এবং তাঁর পুত্র ফয়জে ইসলাম গণেশকে অবনত মস্তকে সালাম না করায় তিনি উভয়কে হত্যা করেন। বহু মুসলমান ওলী দরবেশ, মনীষীকে বিতাড়িত করা হয়।
মুসলিম নিধনের এসব কাহিনী শুনে শায়খ নূর কুতুবে আলম জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শার্কিকে বাংলায় আক্রমণের আহবান জানান। তাঁর আসার খবর পেয়ে রাজা গণেশ ভীত হয়ে কুতুবে আলমের শরণাপন্ন হলে তিনি গণেশকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন। গণেশ অস্বীকার করলে তাঁর পুত্র যদুকে (জিৎমল) ইসলামে দীক্ষিত করে গণেশের স্থলে তাকে সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার জন্যে বলা হয়। গণেশ এ কথায় রাজি হন। যদুর নাম জালালউদ্দীন রেখে তাঁকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করা হয়। শায়খ নূর কুতুবে আলম গণেশের এই চালাকি ধরতে ব্যর্থ হন। সিংহাসনে এজন মুসলমান বসবে ভেবে তিনি ইব্রাহিম শার্কিকে ফেরত যেতে অনুরোধ করেন। ইবরাহীম শর্কি মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ফেরত চলে যান। কিন্তু অচিরেই তাঁর ভুল ভাঙে।
ইব্রাহিম শার্কি ও নূরে কুতুব আলমের মৃত্যু হলে রাজা গণেশের সামনে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইল না। জালালুদ্দিনকে পুনরায় ‘সুবর্ণধেনু’ যজ্ঞের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। এই যজ্ঞের নিয়মানুসারে একটি স্বর্ণের গাভী তৈরি করে সেই গাভীর মুখ দিয়ে যদুকে ঢুকিয়ে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বের করে আনা হয়। এরপর স্বর্ণগুলো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এটি ছিল হিন্দু পণ্ডিতদের অর্থসিদ্ধির একটি হাতিয়ার মাত্র। তারপরও ইসলামের প্রতি যদুর আগ্রহ রয়ে যায়। (কোনো কোনো মতে সনাতন হিন্দুরা যদুকে মেনে নিতে পারেনি) যদুর ইসলাম গ্রহণের প্রবল ইচ্ছার কথা জানতে পেরে রাজা গণেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং হিন্দু পণ্ডিতদের পরামর্শে তাঁকে বন্দি করেন। এবার রাজা গণেশ ‘দনুজবর্মণ দেব’ নাম ধারণ করে ক্ষমতায় বসে। এরপর গণেশ দেশ থেকে মুসলমানদের মূলোৎপাটনের কাজ পুনরায় শুরু করে। সে পূর্বের চেয়ে অধিকরত হিংস্রতার সাথে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সে কুতুবে আলমের পুত্র শায়খ আনওয়ারকে হত্যা করে ও পৌত্র শায়খ জাহিদকে নির্বাসনে পাঠায়। এভাবে ১৪ মাস শাসন করার পর রাজা গণেশ মারা যায়। - মহেন্দ্র দেব : রাজা গণেশের মৃত্যুর পর হিন্দু আমাত্যগণ গণেশের পুত্র মহেন্দ্র দেবকে বঙ্গের সিংহাসনে বসান। তিনি মাত্র ২ মাস সিংহাসনে থাকেন। ইতোমধ্যে দরবারে যদুর অনেক অনুসারী জুটে যায়। অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্র দেবকে অপসারিত করে সুলতান জালালউদ্দিন দ্বিতীয়বার বঙ্গের সিংহাসনে বসেন।
- জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ : সুলতান জালালউদ্দিন ছিলেন বাংলা সালতানাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি ১৪১৮ সালে বাংলা সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ পর্যায়ে তিনি একটানা ১৪৩১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সুযোগ্য শাসকের সময় বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রায় সমগ্র বাংলা এবং আরাকান ব্যতীত ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তিনি বাংলায় ইসলাম প্রচারে ও বাংলার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর পূর্ববর্তী কোনো শাসক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ইসলাম প্রচার করেন নি। তিনি ইসলামকে রাজধর্মের মর্যাদা প্রদান করেন। রাজা গণেশ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ ও ইসলামি স্থাপত্যসমূহ পুনর্র্নিমাণ করেন। তিনি অসংখ্য মসজিদ, মাজার, খানকা ও স্থাপত্য নির্মাণ করেন এবং সুফি দরবেশদের বিশেষ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। অর্থলিপ্সু উগ্র ব্রাহ্মণদের তিনি শাস্তি দেন।
প্রায় দু’দশকের শান্তিপূর্ণ রাজত্বকালে জালালুদ্দিন পূর্ববঙ্গ (মুয়াজ্জমাবাদ) ও চট্টগ্রামসহ প্রায় সমগ্র বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তিনি ফতেহাবাদ (ফরিদপুর) দখল করেন এবং দক্ষিণবঙ্গে রাজ্য সম্প্রসারণ করেন। তিনি আরাকানকে বাংলা সালতানাতের করদ রাজ্যে পরিণত করেন (আন্তর্জাতিক আইনে যেসব রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন অবস্থায় থাকে তাকে করদ রাজ্য বা vassal state বলে। প্রধানত পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ব্যাপারে এসব স্টেট সম্পূর্ণভাবে অভিভাবক রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে)।
আরাকানের রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও বাংলার সুলতানের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ তারা ইসলামি নাম গ্রহণ করতেন। এসময় আরাকানে ইসলামের ব্যাপক বিস্তারের পথ সুগম হয়। তিনি রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে স্থানান্তর করেন। বাংলা তখন পৃথিবীর অন্যতম ধনী অঞ্চল ছিল। তিনি মক্কায় বিতরণের জন্য অর্থ প্রেরণ করেন এবং সেখানে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। জালালুদ্দীন হেরাতের তৈমুরি শাসক শাহরুখ, চীনের ইয়াংলো ও মিশরের মামলুক সুলতান আল-আশরাফের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ‘সুলতান’ ও আমীর উপাধি ব্যবহার করে আব্বাসীয় খলিফার নিকট থেকে খিলাত ও খেতাব লাভ করেন। ১৪৩১ সালে তিনি কায়রোর আব্বাসীয় খলিফার থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ‘খলিফাতুল্লাহ’ ঘোষণা করে নতুন মুদ্রা চালু করেন। ১৪৩৩ সালে তিনি মারা যান। - শামসউদ্দিন আহমাদ শাহ : জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন আহমাদ শাহ ১৪ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। বয়সে কম হওয়ায় পুরোপুরি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হননি। তিনি প্রায় তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি পিতার উদারনীতি বজায় রাখেন এবং ন্যায়বিচার ও দানশীলতার জন্য পরিচিত ছিলেন। তার পরামর্শদাতারা তাঁকে বিপথে পরিচালিত করে। তাঁর দুই ক্ষমতাধর ক্রীতদাস সাদি খান ও নাসির খান ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর পর নাসির খান ক্ষমতায় বসে। পরে তারা দুজনই বিবাদে লিপ্ত হয় এবং ক্ষমতাচ্যুত হয়।
- নাসির খান : নাসির খান ক্ষমতায় বসার পর সাদি খানকে হত্যা করে। ইতঃপূর্বে যারা শামসুদ্দিনকে হত্যার ব্যাপারে ইন্ধন দিয়েছিল তারা নাসির খানের শাসন মেনে নিতে পারে নি। এমতাবস্থায় নাসির খান আততায়ীর হাতে নিহত হয়। নাসির খানের মৃত্যুর পর কিছু সময়ের জন্য সিংহাসন শূন্য পড়ে রইল। আহমদ শাহের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিয়োগের ব্যাপারে তাই অভিজাতবর্গ চিন্তিত ছিলেন। তারা পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশের হাতে রাজ্যভার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
- পূর্বের আলোচনা পড়ুন : ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন