১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ইতিহাস?
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ বিজয় লাভের পরও পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। এর সাথে পিপলস পার্টি যুক্ত হয়। দুই পাকিস্তানে দুই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।
-
ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব ব্যর্থ আলোচনা-
- নির্বাচনের ফল পাকিস্তানি শাসকদের হতাশ করে। ইয়াহিয়া ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ভুট্টো আওয়ামী লীগকে দূরে সরিয়ে রেখে পাকিস্তানের ক্ষমতা চাচ্ছিল। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ক্ষমতার বৈধ দাবিদার। এই তিন নেতার ত্রিমুখী অবস্থান পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল।
নির্বাচন পরবর্তী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। একটি পত্রিকায় লেখা হয়, ‘শেখ মুজিবের জয়লাভে হিন্দু নারীরা উল্লাসে নেচেছে, গান গাইছে।’ এমনও প্রচার করা হয় যে, আওয়ামী লীগের লোকেরা মুসলমান নয়। নির্বাচনি ফলাফল পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলীকেও হতাশ করে। তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা জয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তানের কেউ ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিলে তার নিজ দায়িত্বে তা করবেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে তিনি নতুন সংবিধান প্রণয়নে তাঁর দলের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর ও নির্বাচিত অন্যান্য সদস্যের উপর ভারতীয় হামলার অজুহাত দেখান।
১৮ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো পত্রিকায় এক চাঞ্চল্যকর বক্তব্য পেশ করে। এতে তিনি ঢাকা এসে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা অসম্ভব বলে ঘোষণা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো সংকট নিরসনে ৫ দফা ফর্মুলা পেশ করেন। এতে তিনি সব প্রদেশের জন্য সমান প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন এবং কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠনের কথা বলেন। ভুট্টোর এ ধরনের বক্তব্য রাজনীতিবিদদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। তাঁরা ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য শেখ মুজিবুরকে আহ্বান করেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিতে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। একই দিন ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পেছানো হলে তিনি থাকবেন বলে ঘোষণা দেন। অন্যথায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনের হুমকি দেন। বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখেন। কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতা অধিবেশনে যোগ দিবেন না বলে উল্লেখ করেন। এর প্রতিবাদে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। -
জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
- ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন ছাত্রনেতা আ.স.ম আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে ঐতিহাসিক বটতলায়বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকি, শাহজাহান সিরাজ, আ.স.ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন এই চার নেতা মিলে এক বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিক্ষোভ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয়।
-
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-
- ছাত্রলীগ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়। পল্টনে ঐদিন ছাত্রলীগ এক ইশতেহার ঘোষণা করে যা ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ নামে পরিচিত। এতে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো ছিল-
ক. ৫৪, ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা।
খ. বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রতিটি অঞ্চলে স্বাধীনতা কমিটি, মুক্তিবাহিনী গঠন করা। এছাড়াও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ পরিহার করা।
গ. আন্দোলনের ধারা পরিচালনা করা : বর্তমান সরকারকে বিদেশি সরকার বলে গণ্য করে এর সকল আইনকে অবৈধ বলে বিবেচনা করা। অবাঙালি সেনাদের শত্রুসেনা বলে গণ্য করা। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার। পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্য বর্জন কর্মসূচি ইত্যাদি।
ঘ. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার সর্বাধিনায়ক।
এই সমাবেশে ৪-৬ মার্চ আধাবেলা হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনদিনের এই হরতালে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ৫ মার্চ দেশব্যাপী আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কারফিউ জারি করে। আন্দোলনরত জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়ার নানা স্থানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা গুলি চালাতে অস্বীকার করে। আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য ৬ মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। -
কিন্তু তৎকালীন বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান। ইয়াহিয়া খান ৬ তারিখ বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঘোষণা করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এই আশ্বাসে তৃপ্ত হতে পারেন নি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।
- ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণ দেন। এই ভাষণের মূল দাবি ছিল চারটি। যথা-
ক. চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার
খ. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া
গ. গণহত্যার তদন্ত করা
ঘ. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা
৮ মার্চ সারাদেশে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচারিত হয়। ছাত্রলীগ এক জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের আহ্বান জানায়। ১০ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মাওলানা ভাষানি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন জানান।
১৪ মার্চ পিপিপি প্রধান জুলফিকার ভুট্টো করাচির জনসভায় আওয়ামী লীগ ও পিপিপির হাতে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে হস্তান্তরের আবেদন জানান। কিন্তু ১৬ মার্চ এক বিবৃতিতে ভুট্টো বলে, সংখ্যাভিত্তিক সরকার পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য নয়।
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। তিনি প্রস্তাবে রাজি হলেও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নি। ১৭ মার্চ ইয়াহিয়া খানের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এক আলোচনা সভায় মিলিত হন। ১৮ মার্চ সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করা হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার এই প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তদন্তের ভার এবার তারা নিজেরাই করবেন।
১৯ মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর খান সেনারা আকস্মিক হামলা চালায়। ২১ মার্চ হঠাৎ করে জুলফিকার ভুট্টো ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক করেন। ২৩ মার্চ এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। লাহোর প্রস্তাব দিবসে (২৩ মার্চ) দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ দিবস ও মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন বঙ্গবন্ধু প্রথম নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ধানমন্ডিতে তাঁর নিজ বাসভবনে। এই ঘোষণার মাধ্যমে সংকট সমাধানের শেষ সম্ভাবনার ইতি ঘটে।
২৪ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। ব্রিটেন, ভারত, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দূতাবাসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকা ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায়। সেদিন পাকিস্তানি ঘাতকরা বাংলার নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। -
অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতি-
- ১লা মার্চের আগেই রংপুর সীমান্ত থেকে ট্যাংকগুলো ঢাকায় আনা শুরু হয়। ১লা মার্চ থেকে সেনা পরিবারের সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো শুরু হয়। ৩ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অস্ত্র ও রসদ বোঝাই এম. ভি. সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করতে থাকে। ৭ মার্চ জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠানো হয়। ৯ মার্চ সরকার সকল বিদেশিকে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ জারি করে।
এই সময়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসারদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় এবং সেনাদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ১৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার বৈঠক মূলত প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না। কারণ, একদিকে ১৬ মার্চ থেকে সমঝোতা বৈঠক শুরু হয়। অন্যদিকে ১৭ মার্চ টিক্কা খান, খাদিম হোসেন, রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করে।
১৯ মার্চ থেকে র্পূববাংলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়। এই সময় জয়দেবপুরে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ২০ মার্চ সরকার সেনাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ জারি করে এবং জেনারেল হামিদ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ঘুরাঘুরি শুরু করেন। এই সময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি বিমানে রসদ আসত এবং অসংখ্য জাহাজ সেনা ও অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করছিল। চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিসহ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম. ভি. সোয়াত থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস শুরু হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য বেছে নেওয়া হয়। ঢাকা শহরে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে। - পূর্বের আলোচনা পড়ুন-
- ছয় দফা আন্দোলনের ইতিহাস
- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা