বলবনি শাসনের শুরু কীভাবে হয়?
১২৮৭ সালে পিতা গিয়াসউদ্দিন বলবন মারা গেলে বুগরা খান দিল্লীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। এ সময় তিনি নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করলে বঙ্গে ‘স্বাধীন সুলতানি যুগের’ সূচনা ঘটে। এ সময়ে দিল্লীর প্রভাব থেকে বঙ্গ নিরাপদ ছিল। বলবনী শাসনের শেষাংশে বঙ্গদেশ চারটি অংশে– লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁও ও চাটগাঁও- বিভক্ত হয়। এ সময়ে শক্তি সম্পদে সোনারগাঁয়ের বেশ উন্নতি হয়।
- নাসিরউদ্দিন বুগরা খান : বুগরা খান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বলবনের কনিষ্ঠ পুত্র। তুঘরল খানকে পরাজিত বুগরা খানকে লখনৌতির শাসক নিয়োগ করা হয়। তিনি কিছুটা অলস প্রকৃতির ও আরামপ্রিয় ছিলেন। ১২৮৬ সালে গিয়াসউদ্দিন বলবনের ছেলে মুহাম্মদ মোগলদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। ফলে বলবন শোকাহত হয়ে বুগরা খানকে দিল্লীর সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বুগরা খান তা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানান।
বলবনের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র ও বুগরা খানের ছেলে কায়কোবাদ দিল্লীর সিংহাসনে বসে। কিন্তু কায়কোবাদ দ্রুতই পাপপূর্ণ জীবনে পদার্পণ করে। এই সুযোগে তার উপদেষ্টা নিযামউদ্দিন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। পুত্র কায়কোবাদের শাসনকার্যে অবহেলা ও উজির নিযামউদ্দিনের ঔদ্ধত্যের খবর যথারীতি বুগরা খানের নিকট পৌঁছায়। তিনি পুত্রের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য পত্র দিলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। পরবর্তীতে বুগরা খান নিরাশ হয়ে দিল্লীর সিংহাসন আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। যুদ্ধের পূর্বেই পিতা-পুত্রের মিলন হয় এবং পিতা পুত্রকে কিছু উপদেশ দিয়ে লখনৌতিতে ফিরে আসেন। কবি আমির খসরু এই হৃদয়বিদারক ঘটনাকে তাঁর বিখ্যাত কাব্যে ‘কিরান উস সাদাইনে’ তুলে ধরেছেন। -
বুগরা খান কেন দিল্লীর ক্ষমতায় বসেন নি?
কিন্তু কায়কোবাদ পুনরায় পাপপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করে। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে দরবারের উপদেষ্টাগণ কায়কোবাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান কায়র্মুসকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু অচিরেই এই নিয়ে গৃহবিবাদের সূত্র ধরে কায়কোবাদ ও কায়র্মুস নিহত হয় এবং জালালউদ্দিন খলজি দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। পুত্র ও পৌত্রের মৃত্যুর সংবাদ শুনে বুগরা খান শোকাহত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় পুত্র কায়কাউসের নিকট সিংহাসনের দায়িত্ব দিয়ে তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করেন। বুগরা খানের শাসনামলের শেষের দিকে বাংলার মুসলিম রাজ্য চারটি স্বতন্ত্র ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো- বিহার, উত্তর বাংলার লখনৌতি-দেবকোট অঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সাতগাঁও-হুগলি অঞ্চল এবং পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চল।
- রুকনউদ্দিন কায়কাউস : তাঁর রাজত্বকালে মুসলিম আধিপত্য বাংলার পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত হয়। তিনি বঙ্গের রাজস্ব থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। পশ্চিমে বিহার, উত্তরে দেবকোট এবং দক্ষিণে সাতগাঁও পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
কায়কাউস প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। বিহার প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন ফিরুজ আইতিগীন এবং লখনৌতির শাসনকর্তা ছিলেন জাফর খান। উভয় প্রদেশের শাসনর্কতা ‘সিকান্দর-ই-সানি’ উপাধি গ্রহণ করেন। কায়কাউস নিজেও জমকালো উপাধি ধারণ করেন। এ সকল উপাধি বাংলার জৌলুস ও ক্ষমতার পরিচায়ক। বলবনের বংশধরগণ লখনৌতিতে তাদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে সতর্ক ছিলেন। মনে রাখতে হবে আলাউদ্দিন খলজি উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকা দখল করলেও লখনৌতি দখল করেন নি। ধারণা করা হয়, কায়কাউস অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ক্ষমতায় আসেন। - শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ : তাঁর আমলেই সাতগাঁও মুসলিম শাসনের অধীন আসে। তিনি মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য শ্রীহট্টে (সিলেট) রাজা গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। সিলেট বিজয় ছিল সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শিলালিপি অনুসারে ফিরুজ শাহ সিলেট জয় করেন। সিলেট বিজয়ের সাথে বিখ্যাত শাহজালাল (র.) এবং সেনাপতি সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের নাম জড়িত আছে।
নিজের অবস্থা সুসংহত করার পর ফিরুজ শাহ রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে লখনৌতির মুসলিম রাজ্য বিহার, উত্তর-পশ্চিম বাংলা ও লখনৌর এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রুকনুদ্দীন কায়কাউস বাংলার পূর্বাঞ্চলে বিজয়াভিযান শুরু করেছিলেন। কায়কাউসের সে অভিযান ফিরুজ শাহের আমলে শেষ হয়। ফিরুজ শাহের সময়ে সোনারগাঁও অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে একটি টাকশাল স্থাপন করেন। এখান থেকে তাঁর মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে। একইভাবে সাতগাঁও বিজয়াভিযানও শুরু হয়েছে কায়কাউসের আমলে এবং তা শেষ হয়েছে ফিরুজ শাহের শাসনকালে।
ফিরুজ শাহের ময়মনসিংহ বিজয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। কেবল এটুকুই জানা যায় যে, তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর গিয়াসপুর টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। ময়মনসিংহ থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে গিয়াসপুর অবস্থিত বলে মনে করা হয়। ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে সিকান্দর খান গাজী সুন্দরবন অঞ্চলের হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের বিরুদ্ধে এক সফল অভিযান পরিচালনা করেন। ফিরুজ শাহের একটি মুদ্রা সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ প্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর রাজত্ব পরিচালনা করার পর ১৩২২ সালে তিনি মারা যান। - গৃহবিবাদের সূত্রপাত : ফিরুজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মৃত্যুর পূর্বে ফিরুজ তাঁর পুত্র শিহাবউদ্দীন বুগদাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে যান। কিন্তু শিহাবউদ্দীনের ভাই গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সে নাসিরউদ্দীন ইবরাহিম ছাড়া অন্য ভাইদের হত্যা করে। নাসিরউদ্দীন কোনোক্রমে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যান এবং কয়েকজন আমীরের মাধ্যমে দিল্লীর সাহায্য চেয়ে পাঠান।
এ সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। নাসিরউদ্দিন ও লখনৌতির কিছু আমির তুঘলককে বঙ্গে আক্রমণ করতে জোর অনুরোধ জানান। ১৩২৪ সালে তুঘলক সেনাপতি বাহরাম খানকে বঙ্গ অভিযানে পাঠান। বাহরাম খানের নেতৃত্বে লখনৌতি বিজয় হয় ও নাসিরউদ্দিনকে লখনৌতির শাসক করা হয়। এছাড়াও তুঘলক হিন্দু স্বাধীনতার সর্বশেষ প্রতিনিধি হরিসিংকে পরাজিত করেন এবং সেখানে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিহুতের নতুন নাম দেন তুঘলকপুর। বাহাদুর শাহ এ সময় পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান।
নাসিরউদ্দিন লখনৌতি দখল করলে বাহাদুর শাহ আক্রোশে ফেটে পড়ে। তিনি দিল্লী বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও পরাজিত হন এবং বন্দী হন। বাহাদুর শাহকে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের রাজদরবারে হাজির করা হয়। তুঘলক বঙ্গকে দিল্লী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নাসিরউদ্দিনকে লখনৌতির শাসক ও বাহরাম খানকে সাতগাঁও ও সোনারগাঁয়ের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ বিন তুঘলক দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তিনি বঙ্গের শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেন। তিনি বন্দী বাহাদুর শাহকে মুক্তি দেন ও বাহরাম খানের সহযোগী শাসক হিসেবে সোনারগাঁয়ে নিয়োগ দেন।
বাহাদুরের ওপর আরোপিত শর্ত ছিল যে, তার ছেলেকে জিম্মি হিসেবে দিল্লীতে প্রেরণ, নিজ ও সুলতানের যৌথনামে মুদ্রা প্রচলন ও উভয়ের নামে খুতবা পাঠ করাবেন। তিনি তার পুত্রকে দিল্লীতে প্রেরণ ব্যতীত অপর সকল শর্তই পূরণ করেন।
কদর খানকে লখনৌতির শাসক নিয়োগ করা হয়। নাসিরউদ্দীন ইবরাহিমকে দিল্লীতে ডেকে পাঠানো হয়। সাতগাঁওকে পৃথক প্রদেশ হিসেবে ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। অতীতে বাহরাম খান ও বাহাদুর শাহ পরস্পর শত্রু থাকলেও প্রায় তিনবছর যুগ্মভাবে তারা দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু বাহাদুর শাহ ছিলেন জন্মগতভাবে স্বাধীনচেতা। ১৩২৮ সালে আকস্মিকভাবে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাহরাম খান আমীরদের সহায়তায় বাহাদুরকে পরাজিত ও নিহত করেন। তাঁর গায়ের চামড়া ছাড়ায়ে দিল্লীকে পাঠানো হয় এবং ভবিষ্যৎ বিদ্রোহীদের প্রতি ভীতি প্রদর্শনের জন্য দিল্লীতে প্রকাশ্যে তা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এভাবেই বঙ্গে বলবনী শাসনের ইতি ঘটে।
১৩৩৭ সালে বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। এই সুযোগে তাঁরই বর্ম-রক্ষক ফখরউদ্দীন সোনারগাঁয়ের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। এ ঘটনা ক্ষমতা দখলের নতুন ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। ফলে বাংলায় ইলিয়াস শাহী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসন বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করে যা দুশ বছর (১৩৩৮-১৫৩৮) অব্যাহত ছিল।
- পূর্বে আলোচনা পড়ুন : বঙ্গে মামলুক শাসন
- পরবর্তী আলোচনা পড়ুন : ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন