বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
-
আর্য ও অনার্য জনগোষ্ঠী-
- বাংলায় আগত জনগোষ্ঠীকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক. অনার্য জনগোষ্ঠী : আর্যদের আগমনের বহু পূর্ব থেকে এদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত ছিল। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এরা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এরাই বাংলার আদিম জনগোষ্ঠী। অনার্য জনগোষ্ঠী আবার চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। যথা-
-
১. নেগ্রিটো
- নিগ্রোদের মতো দেহ গঠনযুক্ত এক আদিম জাতির এ দেশে বসবাসের কথা অনুমান করা হয় যাদের নেগ্রিটো বলা হয়। এদের আদিনিবাস ছিল আফ্রিকা। ঠিক কখন এরা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস শুরু করে তা জানা যায় না। তবে এদেরকে বাংলার জনগোষ্ঠীর প্রথম স্তর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যশোর, সুন্দরবন ও ময়মনসিংহের নিম্নবর্ণের জনগণের মধ্যে এদের প্রভাব লক্ষণীয়।
-
২. অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড
- অস্ট্রেলিয়া সংলগ্ন দ্বীপসমূহ থেকে আগত আদিম অধিবাসীদের অস্ট্রালয়েড বলে। অস্ট্রিকদের আদি বাসস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এখান থেকে তারা পূর্ব ভারত, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসকিদের মতে এরাই এদেশের প্রাচীনতম বাসিন্দা। বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে এ নৃগোষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অস্ট্রিকরা আনুমানিক পাঁচ হাজার পূর্বে ইন্দোচীন-আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। এরা Veddoid ও নিষাদ নামেও পরিচিত। এরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত। বর্তমান মুন্ডারি আদি অস্ট্রিক ভাষার বিবর্তিত রূপ।
- অস্ট্রিক ভাষা : পৃথিবীর অন্যতম একটি ভাষাবংশ হল অস্ট্রিক। অস্ট্রিক ভাষাবংশের অপর নাম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ভাষাবংশ। অস্ট্রিক ভাষাভাষীরাই ভারতের প্রাচীন অধিবাসী। অস্ট্রিক ভাষা কোল বা মুন্ডা ভাষারূপে পরিচিত। এটি প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত। যথা-
ক. পশ্চিমা শাখা : যার অন্তর্ভুক্ত হল শবর, করকু, খড়িয়া প্রভৃতি।
খ. পূর্বী শাখা : যার অন্তর্ভুক্ত হল সাঁওতালি, হো, মুন্ডারি, ক্রোড়া প্রভৃতি।
অস্ট্রিকদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। সাঁওতাল, মুন্ডারি, হো, শবরদের ভাষা অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত। মুন্ডারি ভাষাগুলোর মধ্যে সাঁওতালি ভাষাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে।
-
৩. দ্রাবিড়
- অস্ট্রিক ধাচের একটি জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়। অস্ট্রেলিয় আদিম অধিবাসীদের সাথে এদের মিল আছে বলে এদের আদি অস্ট্রেলীয় বলে। এরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। এ জনগোষ্ঠী সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। দক্ষিণ ভারতে এ গোষ্ঠীর লোকদের প্রাধান্য দেখা যায়।
- দ্রাবিড় ভাষা : ভারতবর্ষে প্রাধান্যের দিক দিয়ে আর্য ভাষাগোষ্ঠীর পরই দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর অবস্থান। ভারতবর্ষের এক-চতুর্থাংশই দ্রাবিড়ভাষী। দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলো ভারত উপমহাদেশের চারটি অঞ্চলে প্রচলিত। যথা- দক্ষিণি, উত্তরা, মধ্যদেশীয় ও বেলুচিস্তান।
-
৪. মঙ্গলয়েড
- পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে। এককভাবে পৃথিবীতে বসবাসকারী মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর পরিমাণই অধিক। এ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ ও পশ্চিম চীন থেকে এদেশে আগমন করে। চাকমা, গারো, মুরং প্রভৃতি এই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত।
পরবর্তীতে আরব, তুর্কি, পারস্য, ইংরেজসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটে। এভাবে দে খা যায়, বাঙালি কোনো বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠীগত জাতি নয়। বাঙালি জাতি গঠনে নানা জনগোষ্ঠীর প্রভাব আছে। বাঙালি একটা সংকর জাতি। বর্ণসংকরতা বাঙালির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
অস্ট্রিকরাই হচ্ছে এদেশের প্রথম জনগোষ্ঠী। অনেকের মতে নেগ্রিটোদের হটিয়ে অস্ট্রিকরা এদেশে বসবাস শুরু করে। এরপর দ্রাবিড়রা এদেশে আগমন করে। সভ্যতায় উন্নত বলে এরা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্রাবিড়-অস্ট্রিকরা মিলে বর্তমান বাঙালি জাতির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। তারপর প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে আর্যদের দাপট পরিলক্ষিত হয়। আর্যরা এদেশে বর্ণাশ্রম প্রথার সৃষ্টি করে। বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা আর্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। মঙ্গোলীয়দের একটি অংশ এদেশে বসবাস করলেও বাঙালি নরগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর পর আসে শক জাতির লোক।
-
আর্যরা কোন পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে?
- খ. আর্য নরগোষ্ঠী : আর্য হচ্ছে একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের আর্য বলা হয়ে থাকে। আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগোষ্ঠী। তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের আগে। উত্তর ভারতের গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করে আর্যরা ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদেশে আর্যরা বৈদিক সভ্যতার জন্ম দেয়। ভারতীয় উপমহাদে
শে আর্যরা দুটি জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। যথা-
১. আলপাইন জনগোষ্ঠী : নৃতত্ত্ববিদদের মতে খ্রিস্টের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই পামির মালভূমি থেকে একটি জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসবাস শুরু করে। নৃতত্ত্ববিদরা এর নাম দেন আলপাইন নরগোষ্ঠী। তবে এদেশের আলপাইন আর্যভাষী গোষ্ঠী ছিল ইন্দো ইরানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এরা এশিয়া মাইনর হতে ভারতের পশ্চিম উপকূল হয়ে এদেশে প্রবেশ করে। আলপাইন গোষ্ঠীর লোকেরা যেমন অসুর নামে পরিচিত।
২. নর্ডিক জনগোষ্ঠী : নর্ডিক জনগোষ্ঠী ইউরোপীয় নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এদেশে নর্ডিকরা আগমন করে উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চল থেকে। নর্ডিক গোষ্ঠীর লোকেরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত।
- সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর এক দল বিদেশি আক্রমণকারী ভারতে প্রবেশ করে। তারা নিজেদের আর্য বলতো। আর্য শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশ্বস্ত মানুষ’ বা ‘একই জাতের মানুষ’। বেদ রচনাকারী ও বেদের অনুসারী বলে আর্যদের মধ্যে খুব অহঙ্কার ছিল। তারা ভারতের স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে নিজেদের উন্নত মনে করত। তারা যে আলাদা তা বোঝানোর জন্যই নিজেদের ‘আর্য’ বলত। ভারতের আদি অধিবাসীদের আর্যরা শত্রু মনে করত। তাই এদের বলা হত ‘দাস’ বা ‘দস্যু’।
- ইরানের মালভূমি অঞ্চল থেকে আর্যদের ভারতে আগমন ঘটে। ভারতে আর্যদের আগমন ও অভিযান চলতে থাকে ধীরে ধীরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই আগমনের সূচনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে।
প্রথমদিকে আর্যবসতি গড়ে উঠে পূর্ব পাঞ্জাবে এবং শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই অঞ্চল আর্যাবর্ত নামে পরিচিত। আর্যরা ক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে মিশে যেতে থাকে। এভাবে দেহের দিক থেকে তাদের অনেকটা পরিবর্তন দেখা যায়। এই মিশ্রণের মধ্য দিয়ে ভারতে এক সময় একটি উচ্চতর সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। যেখানে আর্য ও দ্রাবিড় রীতির অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়।
আর্যদের সম্পর্কে প্রথম জানার সুযোগ হয় তাদের ধর্মীয় সাহিত্য গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদ ছাড়াও আরও তিনটি বেদ রচিত হয়। সুতরাং বেদ মোট চারটি – ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। - বৈদিক যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল ‘পরিবার’। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হতো গ্রাম। পরিবারগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হতেন পরিবার প্রধান। আর্যরা পরিবারকে বলত ‘কুল’। পরিবার প্রধানকে বলা হতো ‘কুলপা’।
- বর্ণবাদী প্রথার সূচনা : আর্যরা যখন ভারতে প্রবেশ করে তখন তাদের সমাজে শ্রেণিভেদ ছিল। প্রথমদিকে ‘ক্ষেত্র’ বা ‘অভিজাত’ এবং ‘বিশ’ বা ‘সাধারণ মানুষ’ এই দুই শ্রেণির কথা জানা যায়। আর্যরা ছিল গৌর বর্ণের। তারা এদেশে এসে স্থানীয় কৃষ্ণ বর্ণের মানুষদের কাছাকাছি অনেক সতর্কতার সাথে বসবাস করতে থাকে। বিজেতা আর্যরা পরাজিত অনার্যদের স্থান দেয় সমাজের এক প্রান্তে। যেসব আর্য অনার্য মহিলাকে বিয়ে করে এবং তাদের জীবন প্রণালি গ্রহণ করে তাদেরও নামিয়ে দেয়া হয় সমাজের নিম্নস্তরে। অন্যদিকে ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব পেয়ে যায় পুরোহিতরা। সমাজের উচ্চতম স্থানটি দখল করে নেয় তারা। ঋগ্বেদ যুগের শেষ পর্যায়ে এসে আর্য সমাজ চার বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বর্ণ বিভক্তিতে ধর্মের অনুমোদন ছিল। বর্ণ চারটি হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। বলা হয়ে থাকে ভগবানের মুখ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণ। বাহু থেকে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত্রিয়। উরু থেকে সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে সৃষ্টি হয়েছে শুদ্র।
- বর্ণবাদী প্রথা : সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বর্ণভেদ প্রথা স্পষ্ট হতে থাকে। বংশানুক্রমিক পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলোর উত্থান ঘটে। পুরোহিত এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবিকা এ সময় বংশগত হয়ে পড়ে। জীবিকার ভিত্তিতে বৈশ্য ও শূদ্ররাও বিভক্ত হতে থাকে।
এ যুগের সমাজের মানুষ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলো হচ্ছে – ব্রা²ণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এ যুগের সমাজে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আর্য সমাজের প্রথমদিকে ধর্ম পরিচালনা করতে পারে এমন যাজক শ্রেণির সংখ্যা ছিল ষোলটি। ধীরে ধীরে বাকি পনেরটি যাজক শ্রেণিকে পিছনে ফেলে রেখে ধর্ম পরিচালনার প্রধান পুরোহিত হয়ে পড়ে ব্রাহ্মণরা। - আর্য সমাজে চার বর্ণের যে বিভাজন আসে তাতে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্যদের ভূমিকার ব্যাপারটিও স্পষ্টভাবে দেখা যায় পরবর্তী বৈদিক সমাজে। এ যুগে ক্ষত্রিয়রা রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব লাভ করতেন। বৈশ্যরা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগে বৈশ্যরাই ছিল একমাত্র শ্রেণি যাদের রাজস্ব দিতে হত এবং এই রাজস্বের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ক্ষত্রিয়রা। এই তিন বর্ণের মানুষেরা উপনয়ন বা পৈতা পড়তে পারতেন। এ অধিকার শুদ্রদের ছিল না। একথা মানতে হবে যে পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজে বর্ণভেদ প্রথা তেমন সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করতে পারেনি। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে তখনও বিয়ে শাদী প্রথা চালু ছিল। কোথাও কোথাও কোন ক্ষত্রিয় এ যুগে ব্রাহ্মণের বদলে যজ্ঞ পরিচালনা করতেন এবং বেদ পাঠ করতেন। তবে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে শূদ্রের তেমন কোন মর্যাদার আসন ছিল না। শুদ্র সম্বন্ধে বক্তব্য পাওয়া যায় ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে শূদ্র অন্যের দাস, যখন ইচ্ছা তাকে তাড়িয়ে দেয়া যায় বা হত্যা করা যায়। ধীরে ধীরে বর্ণগুলো বিভিন্ন বংশে চিহ্নিত হয়ে পড়ে।