আলীবর্দি খানের শাসনামল- বাংলার নবাবি শাসনের ইতিহাস (২য় পর্ব)

আলীবর্দি খান ও সিরাজউদ্দৌলার শাসন- বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

  • আলীবর্দি খান- 

  • আলীবর্দি খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী। তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কি। ১৭২০ সালে সুজাউদ্দিন তাকে রাজস্ব বিভাগের চাকরিতে নিয়োগ দেন। এই সময়ে তার ভাই হাজী আহমদ উড়িষ্যা আসেন এবং দুই ভাই শাসনকার্যে সুজাউদ্দিনকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। সুজাউদ্দিনের বাংলার মসনদ লাভের ব্যাপারে তাঁরা কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সুজাউদ্দিন হাজী আহমদকে বাংলার দিওয়ান ও মির্জা মুহম্মদকে রাজমহলের ফৌজদার নিয়োগ করেন। এই সময়ে মির্জা মুহম্মদকে ‘আলীবর্দি খান’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খানকে পরাজিত করে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধ সময়। ১৭৪১ সালে উড়িষ্যার সুবাদার রুস্তম জঙ্গকে পরাজিত করে আলীবর্দি উড়িষ্যার দখল নেন। তারপরও রাজ্যজুড়ে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল। এই সময়ে শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির পুনরুত্থান ঘটে। বাংলায় দস্যুবৃত্তিতে মারাঠারা বর্গী নামে পরিচিত। মারাঠারা দীর্ঘ ১০ বছর (১৭৪১-১৭৫১) আক্রমণ চালিয়ে আলীবর্দি খানকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাঁর সাহসী নেতৃত্ব ও সুযোগ্য শাসনের মাধ্যমে বাংলাকে মারাঠাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। বিদেশি আক্রমণ থেকে শুরু করে স্থানীয় নানা অরাজকতার সাথে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছিল। তারপরও প্রায় ১৬ বছর নবাবি অক্ষুণ্ন রাখেন।
  • মারাঠা বিদ্রোহ-

  • ১৭৪২ সালে বাংলায় প্রথম মারাঠা আক্রমণ শুরু হয়। মারাঠা নেতা রঘুজি ভোঁশলে প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতকে বাংলা অভিযানে পাঠায়। আলীবর্দি খানের তৎপরতায় মারাঠা বাহিনী যুদ্ধে পেরে উঠে নি। মারাঠারা ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে স্বদেশে ফিরে যায়। তবে এরপর মারাঠা বাহিনী নবাবের নিকট ১ কোটি টাকা দাবি করে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যখন মুর্শিদকুলি খানের সেনাপতি মীর হাবিব মারাঠাদের দলে যোগ দেয়। এতে মারাঠাদের সাহস অনেক বৃদ্ধি পায় এবং বর্ধমান, উড়িষ্যাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধে লুটতরাজ করে। অনেক মারাঠা নেতাকে হত্যা করা হলেও বাংলায় তাদের লুটতরাজ বন্ধ হচ্ছিল না। অবশেষে বাধ্য হয়ে ১৭৫১ সালে নবাব মারাঠাদের সাথে সন্ধি করেন। চুক্তির শর্ত হিসেবে বলা হয়-
    ক. মীর হাবিব আলীবর্দি খানের অধীনে উড়িষ্যার নায়েবে নাযিম থাকবেন।
    খ. প্রদেশের উদ্বৃত্ত রাজস্ব মারাঠা সেনাদের ব্যয়বহন বাবদ রঘুজি পাবেন।
    গ. বাংলার রাজস্ব থেকে ১২ লক্ষ টাকা রঘুজিকে দিতে হবে।
    ঘ. মারাঠা সেনারা সুবর্ণরেখা নদী পার হয়ে বাংলায় প্রবেশ করতে পারবে না।
    এই চুক্তির পর মারাঠারা আর বাংলায় হানা দেয় নি। এই চুক্তি এক অর্থে বাংলার মানুষকে রক্ষা করে।

    কুইজ
    কুইজ
  • আফগান বিদ্রোহ- 

  • মারাঠাদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন আলীবর্দি খানের আফগান সেনাপতি গোলাম মুস্তফা বিদ্রোহী হন। তাঁর অধীনে বিশাল আফগান বাহিনী ছিল এবং তিনি ধারণা করতেন যে, রাজ্যের নিরাপত্তা আফগানদের উপর নির্ভরশীল। তাই তিনি বিহারের নাজিম পদ দাবি করেন। নবাব তার এই দাবি মেনে না নেওয়ায় তিনি মুর্শিদাবাদ, পাটনা দখলের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ১৭৪৫ সালে পাটনার নাজিম জৈনউদ্দিন ভোজপুরের নিকট এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত করেন এবং হত্যা করেন। আফগান বাহিনী রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যায়। প্রথম আফগান বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে।
    ১৭৪৮ সালে দ্বিতীয় আফগান বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিহারের দুই আফগান সেনাপতি জৈনউদ্দিন ও তাঁর পিতা হাজি আহমদকে হত্যা করে পাটনা দখল করে নেয়। নবাব এই সংবাদ পেয়ে বিহার যাত্রা করেন। মারাঠারাও এই সময়ে বিদ্রোহী আফগানদের সাথে যোগ দেয়। পাটনার অদূরে কালাদিয়ারা নামক স্থানে এক যুদ্ধে নবাব প্রতিপক্ষের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করে পুনরায় বিহার দখল করেন। এই ঘটনার পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বিহারের নাজিম নিযুক্ত করেন।
    আলীবর্দি খান দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ইউরোপীয়দের বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। তিনি ইংরেজ ও ফরাসিদের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দেন নি। তিনি নিয়মমাফিক শুল্ক ছাড়া অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতেন না। কেবল মারাঠা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি সব বণিকগোষ্ঠী থেকে অর্থ সাহায্য নিতে বাধ্য হন। প্রথমে তিনি তাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে সক্ষম হলেও পরে চরমভাবে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে স্থানীয় বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। ইংরেজরা এই সুযোগে শক্তিশালী বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। সেখানে তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি নানামুখী সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়।
    ইউরোপীয় বণিকদের সব ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়া হলেও নবাব তাদের সামরিক বা রাজনৈতিক সুবিধা দেন নি। ১৭৪৫ সালে নবাবের এক নির্দেশে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িত হতে এবং দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। ১৭৫৬ সালে তিনি মারা যান।
  • বি. দ্র. যে জগৎশেঠ আলীবর্দিকে নবাব হওয়ার ষড়যন্ত্রে সাহায্য করে আর যে জগৎশেঠ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে- দুজন এক ব্যক্তি নয়। ‘জগৎশেঠ’ মূলত কারো নাম নয়, এটি একটি উপাধি। আলীবর্দিকে সাহায্য করা জগৎশেঠের প্রকৃত নাম ফতেহ চাঁদসিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী জগৎশেঠের নাম মহতব চাঁদ। সম্পর্কে তারা পিতা-পুত্র। মীর কাসিম মহতব চাঁদকে হত্যা করেন।
  • সিরাজউদ্দৌলা কীভাবে ক্ষমতায় বসে?

  • মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দি খানের দৌহিত্র। জৈনুদ্দীন আহমদ খান ও আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বৃদ্ধ নওয়াবের অন্ধ স্নেহ এবং স্তাবকদের অতি প্রশংসার কারণে প্রথম জীবনে সিরাজ বেশ বাড়াবাড়ি করেন এবং আলীবর্দি তা উপেক্ষা করেন। পরবর্তীতে সিরাজকে ঢাকায় নৌ-বাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করা হয় আর তাঁর ছোট ভাই ইকরামউদ্দৌলা ছিলেন সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে।
    ১৭৪৬ সালে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযানে কিশোর সিরাজকে আলীবর্দী তাঁর সঙ্গে নেন। ১৭৫২ সালে আলীবর্দী খান সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো তাঁকে অভিনন্দন জানায়। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল বৃদ্ধ নওয়াবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সিরাজকে রাজ্যের শত্রুদের দমন এবং প্রজা সাধারণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সকল অন্যায়-অবিচার দূর করার উপদেশ দেন।
  • সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-

  • সিরাজ ১৭৫৬ সালের এপ্রিল থেকে ১৭৫৭ সালের জুন পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। এ সময় তাঁর জন্য বাংলার মসনদ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। নওয়াব পদে সিরাজের মনোনয়ন প্রাপ্তিতে ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ, মীর জাফর ও শওকত জঙ্গ প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। সিরাজের ক্ষমতারোহণ মুর্শিদাবাদের শাসক শ্রেণির প্রভাবশালী অংশের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। প্রথম দিককার নবাবদের সময়ে এই গোষ্ঠী ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করার কাজেই নিয়োজিত ছিল।
    সিরাজ শাসন ক্ষমতায় আরোহণের সাথে সাথে এ গোষ্ঠী আশঙ্কা করে যে, তরুণ নওয়াব তাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। কেননা ক্ষমতা জবরদখলকারী পুরানো গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ হিসেবে সিরাজ এক নতুন গোষ্ঠীর উত্থানে সাহায্য করছিল। সিরাজের সিংহাসন লাভ ইংরেজদের পক্ষেও ছিল হুমকিস্বরূপ। কেননা পূর্ববর্তী নবাবদের মতো সিরাজ ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও বণিক গোষ্ঠী কর্তৃক দস্তকের অপব্যবহার মেনে নিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নবাবের পতন ঘটে।

  • পরবর্তী আলোচনা পড়ুন : সিরাজ পতনের কারণ 
  • পূর্বের আলোচনা পড়ুন : নবাবি আমলের প্রথম পর্ব

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top