Skip to content

আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাসনামল- মুগল সাম্রাজ্যের ইতিবৃত্ত (২য় পর্ব)

আকবরের শাসনামল কেন ইতিহাসে বিখ্যাত?

 

আকবর
আকবর
  • আকবরের সিংহাসন আরোহণকালে রাজনৈতিক অবস্থা –

  • আকবর যখন সিংহাসনে বসে, তখন মুঘল সাম্রাজ্য পাঞ্জাব, দিল্লি ও আগ্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শেরশাহের উত্তরাধিকারীদের সময় থেকে ভারতে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। হুমায়ুন সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার সময় পায়নি। এ সময়ে দিল্লির সিংহাসনের প্রতি তিনজন নরপতির দৃষ্টি ছিল।
    ১. আদিল শাহের সেনাপতি হিমু দিল্লির সার্বভৌম ক্ষমতা দখলের জন্য তৎপর হয়।
    ২. পাঞ্জাবের শাসক সিকান্দার শূর দিল্লির সার্বভৌম ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা করে।
    ৩. উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আকবরের বৈমাত্রেয় মীর্জা মোহাম্মদ হাকিম স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। সেও দিল্লির সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখত।
    এ সময়ে স্থানীয় এক মুসলিম বংশ কাশ্মীর শাসন করছিল। বাংলায় শাসন করছিল শূর বংশীয়রা। দিল্লির পশ্চিমাঞ্চলে রাজপুতনায় মেবার, যোধপুর প্রভৃতি রাজ্যের রাজপুতরা স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করছিল। তাছাড়া পর্তুগিজরা গোয়া ও দিউ দখল করে পশ্চিম উপকূলে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করছিল। এমন কি এদের কারণে মুসলমানরা হজ্বের জন্য নিরাপদে সাগর পাড়ি দিতে পারত না। একই সময় ভারতের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলেও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দিল্লি ও আগ্রাতেই হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল মহামারী ও প্লেগ।

     আকবরের শাসনামল

  • আকবর : মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে।  বাবার বিশ্বস্ত সহচর বৈরাম খান নাবালক সম্রাটের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে। ১৫৬০ সাল পর্যন্ত আকবর বৈরাম খানের অভিভাবকত্বে দেশ পরিচালনা করে। ১৫৫৬ সালে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর আকবর বৈরাম খানের সাহায্যে গোয়ালিয়র, আজমির ও জৌনপুর দখল করে। মধ্যযুদের ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সাম্রাজ্যের সংগঠক ও বিজেতা হিসেবে আকবর অনন্য স্থান দখল করে আছে। ১৫৬১-১৬০১ সাল পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি অব্যাহত রাখেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি হিমালয়-কৃষ্ণা নদী ও হিন্দুকুশ-ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    আকবরের সাম্রাজ্য
    আকবরের সাম্রাজ্য
  • পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের ইতিহাস-

  • আকবর সিংহাসনে বসার সাথে সাথে আদিল শাহের সেনাপতি হিমু দিল্লি ও আগ্রা দখলের জন্য বের হয়। আগ্রার মুঘল শাসক ইস্কান্দার দিল্লিতে পালিয়ে যায়। দিল্লির শাসক তার্দি বেগ হিমুর হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে পাঞ্জাবে চলে আসে। হিমু আদিল শাহের অধীনতা অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসে।
    পাঞ্জাবে আকবরের নিকট এই সংবাদ পৌঁছলে আমিররা তাঁকে কাবুলে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ এসব অগ্রাহ্য করে হিমুর সাথে যুদ্ধ করা সিদ্ধান্ত নেয়। সিকান্দার শূরকে দমন করার জন্য খিজির খানকে পাঞ্জাবে রেখে বৈরাম খাঁ দিল্লিতে অগ্রসর হন। ঐতিহাসিক পানিপথের প্রান্তরে মুঘল বাহিনীর সাথে হিমুর তুমুল যুদ্ধ হয়। প্রথম দিকে হিমুর অবস্থান ভালো ছিল। কিন্তু হিমুর ডানচোখ তীরবিদ্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ফলে নেতৃত্বের অভাবে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। হিমু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং তার শিরশ্ছেদ করা হয়। আকবর ১৫৫৬ সালের ৬ নভেম্বর দিল্লি প্রবেশ করে। কিছুদিন পরই তিনি আগ্রা দখল করে। অন্যান্য বিদ্রোহী শক্তিও পর্যায়ক্রমে আকবরের অধীনতা মেনে নেয়। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের ফলে আকবরের তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।
  • বৈরাম খাঁর পদচ্যুতি-

  • আকবর প্রথম চার বছর নামমাত্র শাসক ছিলেন। এই সময় মূলত বৈরাম খাঁ রাজত্ব পরিচালনা করতেন। তাঁর কারণে অনেক অঞ্চল আকবরের রাজ্যভুক্ত হয়। আকবরের বড় হওয়ার সাথে সাথে পূর্ণ ক্ষমতার মালিক হতে চেয়েছিল। অন্যদিকে বৈরাম খাঁ কিছুটা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছিল। ১৫৬০ সালে আকবর বৈরাম খাঁকে অপসারণ করে নিজে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করে। বৈরাম খান এই অপমানের জবাব হিসেবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বারংবার পরাজিত হন। আকবর তাঁকে সসম্মানে মক্কায় যাওয়ার অনুরোধ করে। তিনি যেতে রাজি হন। গুজরাটে অবস্থানকালে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন।

    মুগল সাম্রাজ্য
    মুগল সাম্রাজ্য
  • আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার-

  • আকবর অপ্রতিহত গতিতে সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করেছিল। দীর্ঘ চল্লিশ বছর স্থায়ী ধারাবাহিক বিজয়ের মাধ্যমে আকবর সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতে ঐক্য স্থাপন করে এক বিশাল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করে।
  • উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার : উত্তর ভারতে আকবর যেসব রাজ্য জয় করেছিল তা নিম্নরূপ-
    ক. মালব : আকবর প্রথমে উত্তর ভারতে মালব দখল করে। সেখানকার শাসক ছিল বাজবাহাদুর। ১৫৬১ সালে আকবর ধাত্রীমাতার পুত্র আদম খানকে মালব দখলের জন্য পাঠায়। আদম খান তাকে পরাজিত করে রাজধানী সারাংপুর লুট করে। ফলে জনমনে ক্ষোভ দেখা দেয়। আকবর এই সংবাদ শোনামাত্রই মালবের দিকে যাত্রা করে। আদম খান তাঁর নিকট ক্ষমা চায়। আকবর তাকে পদচ্যুত করে পীর মুহাম্মদকে মালবের শাসক নিয়োগ করে আগ্রায় ফিরে আসে। তার দুর্বল শাসনের সুযোগে বাজবাহাদুর পুনরায় মালব দখল করলে সেনাপতি আব্দুল্লা খাঁ তাকে পরাজিত করে। এরপর মালবে আকবরের প্রত্যক্ষ শাসন শুরু হয়। পরবর্তীতে বাজবাহাদুর আকবরের অধীনতা স্বীকার করলে তাকে ‘একহাজারি’ মনসবদার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
    খ. গন্ডোয়ানা : ১৫৬৪ সালে আকবর আসফ খাঁকে গন্ডোয়ানা অভিযানে পাঠায়। গন্ডোয়ানার রাজা বীরনারায়ণ ছিল নাবালক। এই সময়ে রানি দূর্গাবতী অভিভাবিকা রূপে রাজ্য শাসন করত। রানি মুঘল সেনাদের প্রতিহত করতে গিয়ে আহত হয় এবং স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করে। বালক রাজা বীরনারায়ণ যুদ্ধে মারা যায়। আকবর চন্দ্র শাহ নামক এক ব্যক্তিকে গন্ডোয়ানার শাসক করে।
    গ. উজবেক বিদ্রোহ : ১৫৬৫ সালে মালব ও জৌনপুরের শাসক বিদ্রোহ করে। তাদের সাথে আকবরের ভাই মীর্জা হাকিমও নিজেকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা দিয়ে পাঞ্জাব আক্রমণ করে। আকবর সবগুলো বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে।
    ঘ. রাজপুতনা বিজয় : আকবর রাজপুতদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে আফগানদের ধ্বংসের কৌশল গ্রহণ করে। তার মতে সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজপুতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন অপরিহার্য। এছাড়া রাজপুতনার মধ্যে দিয়েই উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্যান্য অংশের বাণিজ্য পথ ছিল। এসব কারণে আকবর রাজপুত জাতির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে। ১৫৬২ সালে অম্বরের রাজা বিহারীমল ও বহু রাজপুত দলপতি তার অধীনতা স্বীকার করে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। বিহারীমল আকবরের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়। এই রাজপুত কন্যাই জাহাঙ্গীরের মাতা। অনেক রাজপুত আকবরের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন জয়।
    পরবর্তীতে মুঘল-রাজপুত মৈত্রী তার সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সকল রাজপুত এই নীতি গ্রহণ করেনি। মেবারের রাজা উদয় সিংহ এতে রাজি ছিল না। ১৫৬৭ সালে আকবর মেবার আক্রমণ করে চিতোর দুর্গ অবরোধ করে। উদয় সিংহ পালিয়ে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করে। প্রায় চার মাস চিতোর দুর্গ অবরোধের পর আকবর তা দখল করতে সক্ষম হয়। চিতোর দুর্গের পতনে অন্যান্য রাজপুত ভীত হয়ে পড়ে। রণথম্ভোর, কালিঞ্জর, যোধপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের রাজপুতরা আকবরের অধীনতা মেনে নেয়। তবে মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ (উদয় সিংহের পুত্র) আকবরকে মেনে নেয় নি যদিও রাজধানী চিতোরের পতন ঘটেছিল। আকবর অত্যন্ত উদার শর্তে তাকে আনুগত্য স্বীকারের আহ্বান জানালে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৫৭৬ সালে দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। উদয় সিংহ পালিয়ে যায়। গোগুন্ডা মুঘলদের অধীনে আসে। যদিও ১৫৯৭ সালে প্রতাপ সিংহ মৃত্যুর পূর্বে কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল এবং আকবরের জীবদ্দশায় সমগ্র মেবার মুগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় নি।

  • পশ্চিম ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার-

  • গুজরাট ছিল তখন শস্য সম্পদে পরিপূর্ণ একটি অঞ্চল। আকবর তা জয়ের পরিকল্পনা করে। কারণ-
    ক. বিদ্রোহী মীর্জারা গুজরাটে আশ্রয় নেয়।
    খ. গুজরাট ছিল সমুদ্রপথে ভারতের বাইরের দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্র।
    গ. পর্তুগিজদের কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখার প্রয়োজনে গুজরাট দখল জরুরি ছিল।
    ঘ. গুজরাটের কিছু আমির আকবরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল।
    ১৫৭২ সালে আকবর সহজেই গুজরাট জয় করেন। ১৫৭৩ সালে মীর্জা গোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা মুঘলদের হাতে পরাজিত হয়। গুজরাটের শাসনভার শাহজাদা আজমের হস্তে অর্পণ করে আকবর ফতেপুর সিক্রীতে ফিরে আসে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে বিদ্রোহীরা সুরাট, ব্রোজ, ক্যাম্বে ও আহমেদাবাদ দখল করে। আকবর পুনরায় সেসব এলাকা মুঘলদের অধীনে এনে গুজরাটকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম ‘সুবা’য় পরিণত করেন। এর ফলে-
    ১. সমুদ্রে ও পশ্চিম উপকূলের সমৃদ্ধ বন্দরগুলোর উপর মুঘলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
    ২. আকবরের সাথে পর্তুগিজদের বন্ধুত্ব হয় এবং তারা মক্কায় গমনের জন্য যাত্রীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়। পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আকবর পরিচিত হন।
    ৩. সমুদ্র উপকূল দখল হওয়ায় মুঘলরা নৌবাহিনী গঠনের সুযোগ লাভ করে।
    ৪. রাজা টোডরমল প্রথম গুজরাটে জমি-জরিপ করে আধুনিক রাজস্ব ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন।
  • পূর্ব ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার : বাংলা ও উড়িষ্যা

    এই সময় সুলেমান কররানি বাংলার শাসক ছিলেন। তিনি আকবরের অধীনতা স্বীকার করে শাসন করছিলেন। তবে তার ছেলে দাউদ মুঘলদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৫৭৪ সালে আকবর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। দাউদকে পাটনা ও হাজীপুর থেকে বিতাড়িত করে আকবর দিল্লি ফিরে যান। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। বাংলায় মুগল শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে বারো ভূঁইয়াদের প্রাধান্যের কারণে সমগ্র বাংলায় আকবরের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এরপর আকবর পর্যায়ক্রমে কাবুল, কান্দাহার, কাশ্মির, সিন্ধু, দাক্ষিণাত্য প্রমুখ অঞ্চল জয় করেন।

  • আকবরের ধর্মীয় বিবর্তন-

  • আকবরের ধর্মীয় বিবর্তনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা-
    ক. প্রথম পর্যায় (১৫৬০-১৫৭৫) : এই সময় আকবর একজন সুন্নি মুসলমানের মতো ইসলামের নিয়মগুলো মেনে চলতেন। যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা ও অন্যান্য আমল করতেন।
    খ. দ্বিতীয় পর্যায় (১৫৭৫-১৫৮০) : এ সময়ে আকবর ও তাঁর দুই পুত্র সুফি মতবাদে প্রভাবিত হয়ে ‘আত্মা অবিনশ্বর ও পরমাত্মার অংশ বিশেষ’ এই ধারণার বশবর্তী হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৫৭৫ সালে সকল ধর্মের সার আহরণের জন্য ফতেপুর সিক্রিতে ‘ইবাদত খানা’ নির্মাণ করে। প্রথম দিকে ধর্মালোচনার জন্য মুসলিমদের আহ্বান করা হয়। কিন্তু ধর্মীয় আলোচনরা পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণই মুখ্য হয়ে উঠে। আলেমদের পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যথিত হয়ে আকবর কিছুদিন ইবাদতখানার আলোচনা বন্ধ রাখে।
    ১৫৭৮ সালে আকবর পুনরায় ইবাদতখানায় ধর্মালোচনার ব্যবস্থা নেয়। এই সময় মুসলমানদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় পণ্ডিতদের আহ্বান করা হয়। আকবরের উদ্দেশ্য ছিল- তুলনামূলক ধর্মালোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। আকবর এসব ধর্মতত্ত্ববিদদের আলোচনা ধৈর্যের সাথে শুনত। এখানেও পরস্পর বিদ্বেষ তাকে ব্যথিত করে তুলে। ১৫৭৯ সালের ২২ জুন, আকবর ফতেপুর সিক্রির মসজিদের প্রধান ইমামকে বিতাড়িত করে নিজে সেই স্থান দখল করে। সে নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান ধর্মগুরু অর্থাৎ ‘ইমাম-ই-আদিল’ বলে ঘোষণা করে। রাষ্ট্র ও ধর্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জন করে।
    গ. তৃতীয় পর্যায় (দ্বীন-ই-ইলাহি) : ১৫৮১ সালে ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ নামে একটি ধর্ম প্রবর্তন করে। পারস্পরিক ধর্ম-বিদ্বেষ দূর করার জন্য এই ধর্মমত প্রবর্তন করে। সব ধর্মের মূল অংশ নিয়ে এই ধর্ম তৈরি করা হয়। এই ধর্মের নীতিগুলো ছিল-
    ১. এই ধর্মের লোকের সালামের পরিবর্তে ‘আল্লাহু আকবার’ ও প্রত্যুত্তরে ‘জাল্লা জাল্লালুহু’ উচ্চারণ করত।
    ২. মৃত্যুর পরের ভোজানুষ্ঠান জীবিত অবস্থাতেই পালন করতে হবে।
    ৩. এই ধর্মের লোকের মাংস ভোজন থেকে দূরে থাকবে।
    ৪. কসাই, ব্যাধ প্রভৃতি নীচু জাতির সাথে এই ধর্মের লোকেরা মিশবে না।
    আইন-ই-আকবরির মতে, দ্বীন-ই-ইলাহীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র আঠারো। শেখ মোবারক, আবুল ফজল, ফৈজী, আজিজ ও রাজা বীরবলের নাম উল্লেখযোগ্য। মূলত সব ধর্মের লোকদের খুশি করার জন্য এমন জগাখিচুড়ি ধরনের ধর্ম প্রবর্তন করে। আকবর নিজেও শেষ বয়সে এই নীতি থেকে ফিরে আসে।
  • আকবরের রাজপুত নীতি

  • ভারতবর্ষে মুগলদের দুই প্রধান বিরোধী শক্তি ছিল আফগানরা ও রাজপুতরা। আকবর রাজপুতদের প্রতি মিলনাত্মক নীতি অনুসরণ করে আফগান প্রাধান্যের অবসান ঘটান। হিন্দু মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির কারণে ভারতবর্ষে উর্দু ভাষার বিকাশ হয়। আকবরের রাজপুত নীতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
    ক. মিলনাত্মক নীতি : এই নীতি অনুসরণ করে রাজপুতদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, তাদেরকে উচ্চপদে নিয়োগ, জিজিয়া রহিত ও হিন্দু সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে মিত্রতা স্থাপন করেন। আকবর নিজে হিন্দু রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। এমনকি তাঁর ছেলের সাথেও হিন্দু মেয়ের বিয়ে দেন। এছাড়াও টোডরমল, রাজ বিহারি মল, ভগবান দাসসহ অনেককে উচ্চপদে আসীন করেন।
    খ. যুদ্ধংদেহী নীতি : যারা মিলনাত্মক নীতি গ্রহণ করেনি তাদের জন্য যুদ্ধের নীতি প্রয়োগ করা হয়। হিন্দুদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও বিরোধিতা সহ্য করেন নি। তিনি চিতোর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। রনথম্ভোর, যোধপুর, বিকানি প্রভৃতি রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
  • আকবরের রাজস্ব নীতি

  • ঐতিহাসিকগণ আকবরের রাজস্ব নীতির প্রশংসা করেছেন। শেরশাহের রাজস্ব-সংস্কার নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে মুজাফফর খান ও টোডরমলের সাহায্যে আকবর রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। তাঁর রাজস্ব নীতির মূল লক্ষ্য ছিল-
    ক. জমির শ্রেণি বিভাগকরণ
    খ. উৎপন্ন শস্যের উপর ভিত্তি করে রাজস্ব নির্ধারণ
    জমি জরিপ করার ক্ষেত্রে রশির পরিবর্তে লোহা বাধানো বাঁশের দণ্ড ব্যবহার করেন। তিনি সমগ্র জমি জরিপ করে উর্বরতা ও কতদিন চাষাবাদ করা যায়- এ সব তথ্যের ভিত্তিতে জমিগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
    ১. পোলাজ জমি : এ সব জমিতে প্রতি বছর চাষ করা হত।
    ২. পরাউতি জমি : এ ধরনের জমি একবার চাষের পর উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কিছুকাল পতিত রাখা হত।
    ৩. চাচর জমি : এসব জমিতে তিন বা চার বছর পর পর চাষ করা হত।
    ৪. বনযার জমি : এ ধরনের জমি পাঁচ বছরের জন্য অনাবাদী ছিল।
    রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিওয়ান আদায়কৃত রাজস্ব থেকে প্রাদেশিক শাসক সুবেদারকে অর্থ প্রদান করতেন এবং উদ্বৃত্ত অর্থ রাজকোষে পাঠাতেন। বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের সময় রাজস্ব আদায় শিথিল করা হত। আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজির সহায়তায় তিনি বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন।

  • মনসবদারি প্রথা কী?

  • আকবরের সিংহাসন আরোহণকালে সারা দেশে জায়গির ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তখন সামরিক ও বেসামরিক প্রয়োজনে সম্রাটকে সাহায্য করার শর্তে বিভিন্ন ব্যক্তি নির্দিষ্ট জায়গির ভোগ করত। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দেয়। সম্রাটের খালিসা জমি কমে যায় এবং সরকার রাজস্বের ঘাটতি দেখা দেয়। অধিকাংশ জায়গিরদারই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা সম্রাটকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। তাদের সেনাদের গুণগত মান ছিল খুবই নিম্নস্তরের। এসব কারণে আকবর মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।
    ‘মনসব’ থেকে ‘মনসবদারি’ শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ পদবি। আকবর সামরিক বিভাগকে মনসবদারি প্রথায় রূপ দেন। ইতঃপূর্বে এটি পারস্যে প্রচলিত ছিল। প্রতিটি মনসবের অধিকারী ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় আদেশ মানতে বাধ্য থাকত। রাষ্ট্রের সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী এই প্রথা মতে পদমর্যাদা পেত। এই প্রথায় ১০ থেকে ১০,০০০ পর্যন্ত বাহিনীর পরিচালকগণ ৩৩টি পদমর্যাদায় বিন্যস্ত ছিল। সাধারণ কর্মকর্তাগণ সর্বোচ্চ ৫০০০ সেনা পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন। ৭০০০ থেকে ১০,০০০ সেনা পরিচালনার দায়িত্ব কেবল শাহজাদারাই পারত। মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি সম্রাটের মর্জির উপর নির্ভরশীল ছিল। তারা বংশানুক্রমে কোনো সুবিধা পেত না। পরবর্তীতে এই প্রথায় সংশোধনে ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ প্রথা চালু করা হয়।
  • আকবরের মৃত্যু : ১৬০৫ সালের ২৭ অক্টোবর আকবর ফহেতপুর সিক্রিতে (আগ্রা) মারা যান। তাকে সেকেন্দ্রায় দাফন করা হয়। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে পুত্র মুরাদ ও দানিয়েল তাঁর জীবদ্দশাতেই মারা যায়। অন্যপুত্র সেলিম ১৬০০ সালে বিদ্রোহ করে। আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম ‘জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসে।
    জাহাঙ্গীর
    জাহাঙ্গীর

    জাহাঙ্গীরের শাসনামল

  • জাহাঙ্গীর : আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম ‘নুরউদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজি’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। ১৬০০ সালে সেলিম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় তার উত্তরাধিকার নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু আকবর সেলিমকে মুত্যুশয্যায় উত্তরাধিকারী মনোনীত করে। তিনি আগ্রা থেকে যমুনা পর্যন্ত ৬০টি ঘন্টাযুক্ত ত্রিশ গজ লম্বা একটি সোনার শিকল ঝুলিয়ে দেন। ফলে যেসব প্রজা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হত তারা শিকলে টান দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। ইতিহাসে এটি Bell of Justice নামে পরিচিত। মুগল সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান, বাংলার বারো ভূঁইয়াদের দমন ও মেবার জয় করেন। পিতার অনেক আইন রহিত করেন এবং নতুন করে ১২টি আইন প্রণয়ন করেন। ভারতবর্ষে পর্তুগীজদের সব রকমের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ইংরেজ বণিকদের ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছিলেন এবং সুরাটে কারখানা নির্মাণের অনুমতি দেন। ক্যাপ্টন হকিন্স ও টমাস রো নামক দুইজন ইংরেজ দূত ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের পত্র নিয়ে তাঁর দরবারে এসেছিলেন। ১৬২৭ সালে জাাহঙ্গীর মারা যান।
  • জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বিস্তার-

  • আকবর সমগ্র রাজপুতনায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও মেবারের রানা প্রতাপসিংহ মুঘলদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেনি। জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসেই পরপর দুইবার মেবারের বিরুদ্ধে সেনা পাঠায়। যদিও উভয় অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৬১৬ সালে পুত্র খুররমের নেতৃত্বে মুঘলরা মেবার আক্রমণ করে। সেনারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে মেবারের রানা অমরসিংহ বাধ্য হয়ে সন্ধি করে। মুঘল ও রাজপুতদের মধ্যে এক সম্মানজনক শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মেবারের রানা এই প্রথম মুঘল বশ্যতা স্বীকার করে। তার আনুগত্য লাভে খুশি হয়ে জাহাঙ্গীর অমরসিংহ ও তাঁর পুত্র কিরণসিংহের মর্মর মূর্তি নির্মাণ করে আগ্রার দুর্গে স্থাপন করে।
  • বাংলা বিজয় ও দাক্ষিণাত্যে অভিযান-

  • জাহাঙ্গীর সুবাদার ইসলাম খানের সহযোগিতায় বারো ভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় মুঘল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তিনি দাক্ষিণাত্যে সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেন। ১৬১৭ সালে শাহজাদা খুররমের নেতৃত্বে মুঘলরা আহম্মদনগর জয় করে যা মালিক অম্বর স্বাধীনভাবে পরিচালনা করত। এই সাফল্যের কারণে খুররমকে ‘শাহজাহান’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যদিও দাক্ষিণাত্যে মুঘল শাসন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মুঘল সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলার সুযোগে মালিক অম্বর পুনরায় তাঁর কর্মতৎপরতা বাড়ায়। শাহজাহানকে পুনরায় দাক্ষিণাত্যে পাঠানো হয়। মালিক অম্বর পুনরায় অধীনতা স্বীকারে বাধ্য হয়।
    ১৬২৩ সালে শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে মালিক অম্বর তাঁর সাথে যোগ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সে শাহজাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কিছুদিন পরেই দাক্ষিণাত্যের মুঘল সেনাদের কান্দাহার পুনর্দখলের জন্য পাঠানো হয়। এভাবে জাহাঙ্গীরের আমলে দাক্ষিণাত্য বিজয় অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
  • কাংরা বিজয় : জাহাঙ্গীরের অন্যতম কৃতিত্ব কাংরা বা নগরকোট দুর্গ জয়। উত্তর পাঞ্জাবের শতদ্রু ও রাভি নদীর মধ্যবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে কাংড়া দুর্গের অবস্থান। প্রথমবার এই অভিযান ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে শাহজাহানের নেতৃত্বে ১৪ মাস অবরুদ্ধ রাখার পর ১৬২০ সালে কাংরা দুর্গ দখল করা হয়।
  • কান্দাহার নিয়ে পারস্যের সঙ্গে সংঘর্ষ : মধ্যযুগে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র ছিল কান্দাহার। কান্দাহারের ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য পারস্যের রাজাদের সাথে মুঘলদের দীর্ঘদিন সংঘর্ষ চলছিল। ১৫৯৫ সালে আকবর কান্দাহার দখল করে। ১৬০৬ সালে পারস্যের শাসক শাহ আব্বাস কান্দাহার দুর্গ অবরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর সে জাহাঙ্গীরের সাথে বন্ধুত্বের ছলনা দেখায়। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ সে বিভিন্ন সময়ে জাহাঙ্গীরের নিকট উপহার পাঠায়। এতে জাহাঙ্গীর প্রীত হয়ে কান্দাহার দুর্গের সুরক্ষার ব্যাপারে অবহেলা দেখায়। এই সুযোগে আব্বাস ১৬২২ সালে অতর্কিত আক্রমণ করে কান্দাহার দখল করে। জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে কান্দাহার পুনর্দখলের নির্দেশ দেয়। কিন্তু এই সময়ে শাহজাহান বিদ্রোহ করলে কান্দাহার মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়।
  • ইউরোপীয়দের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক : আকবরের আমলে সর্বপ্রথম ইউরোপীয় শক্তির সাথে মুঘলদের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে ওলন্দাজ ও ইংরেজরা ভারতে আসে। ১৬০৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে ক্যাপ্টেন হকিন্স জাহাঙ্গীরের দরবারে আসে। জাহাঙ্গীর ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যের কিছু সুবিধা দেন। কিন্তু পর্তুগিজদের প্ররোচণায় ইংরেজরা উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে এডওয়ার্ডস পুনরায় জেমসের পত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে এলেও ব্যর্থ হয়। ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো বাংলায় আসে। পর্তুগিজদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সফল হন। জাহাঙ্গীর ইংরেজ কোম্পানিকে সুরাটে একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেয়।
  • পুত্র খসরুর বিদ্রোহ : তাঁর আমলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো পুত্র খসরুর বিদ্রোহ। তাঁর সিংহাসনে বসার মাত্র পাঁচ মাস পর খসরু কয়েকশ লোক পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হন। মথুরায় হোসেন বেগ ও লাহোরের আবদুর রহিম যোগ দিয়ে খসরুর শক্তি বাড়িয়ে তুলে। জাহাঙ্গীর পুত্রকে দমন করতে বের হয়। খসরু পরাজিত হয়। তাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। ১৬০৭ সালে জাহাঙ্গীরকে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। খসরু এর সাথে যুক্ত ছিলেন সন্দেহ করে তার চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও পরবর্তীতে সম্রাট অনুতপ্ত হয়। কারণ, খসরু এর সাথে যুক্ত ছিল না। ১০ বছর পর অর্ধঅন্ধ খসরুকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬২২ সালে এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তাকে হত্যা করা হয়।
  • নূরজাহানকে বিয়ে ও তার প্রভাব-

  • ১৬১১ সালে জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে বিয়ে করে। তার প্রকৃত নাম মেহেরুন্নিসা। তাকে প্রধান বেগমের মর্যাদা দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে শিল্পকলার যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে তা প্রধানত নূরজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভব হয়েছিল। রাজ্য শাসনে জাহাঙ্গীর ক্রমশ নূরজাহানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নূরজাহান জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ ছেলে শাহরিয়ারের সাথে প্রথম ঘরের মেয়ে লাভলির বিয়ে দিলে খুররম (শাজাহান) তার স্নেহদৃষ্টি থেকে দূরে সরে যায়। নূরজাহান তার জামাতাকে পরবর্তী শাসক ভাবতে শুরু করে। অন্যদিকে নূরজাহানের ভাইয়ের মেয়ের সাথে খুররমের বিয়ে হওয়ায় ভাই আসিফ খুররমকে পরবর্তী শাসক হিসেবে পরিকল্পনা করে।
  • শাহজাহানের বিদ্রোহ : অতিরিক্ত মদ ও আফিমের ফলে জাহাঙ্গীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। নূরজাহানই তখন রাজ্য শাসন করে। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। নূরজাহান হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। জাহাঙ্গীরের চার পুত্রের মধ্যে- খসরু, পারভেজ, খুররম ও শাহরিয়ার- খুররমই (শাহজাহান) যোগ্যতম ছিলেন। ইতোমধ্যে শাহজাহানের ষড়যন্ত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরু মারা যায়। নূরজাহান শাহরিয়ারকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। পারস্যের শাসক কান্দাহার দখল করলে জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে কান্দাহার অভিযানের নির্দেশ দেয়। কিন্তু শাহজাহান আদেশ অমান্য করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে মালিক অম্বরের সাহায্য লাভের জন্য যান। সেখানে কোনো সাহায্য না পেয়ে তিনি উড়িষ্যার পথে বাংলায় এসে রাজমহল অবরোধ করে বিহার দখল করেন। কিন্তু পরবর্তীতে শাহজাহান জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মহব্বত খাঁর বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। বাবার কাছে ক্ষমা চায়। জাহাঙ্গীর তাঁকে মাফ করে দেয়।
  • সেনাপতি মহব্বত খাঁর বিদ্রোহ : শাহজাহানের বিদ্রোহ দমনে মহব্বত খাঁর কৃতিত্বে নূরজাহান শঙ্কিত হয়। নুরজাহান তাঁকে পারভেজের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য বাংলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। নুরজাহানের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে মহব্বত খাঁ বিদ্রোহ করে। নুরজাহান ও জাহাঙ্গীর কাশ্মির বেড়াতে যাওয়ার পথে ঝিলাম নদীর তীরে সম্রাটের শিবিরে হানা দিয়ে মহব্বত তাদের বন্দি করে। কিন্তু কৌশলে তারা মুক্তি পায়। রোটাস নামক স্থানে জাহাঙ্গীর সেনা সংগ্রহ করেন। মহব্বত খাঁ দক্ষিণাত্যে অবস্থানরত শাহজাহানের নিকট আশ্রয় নেন। ইতোমধ্যে মদ্যপানের ফলে শাহজাদা পারভেজ মারা যায়। ১৬২৭ সালে কাশ্মির থেকে ফেরার পথে জাহাঙ্গীর মারা যান।
  • পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : বাবর হুমায়ুনের শাসন
  • পরবর্তী আলোচনা :  শাহজাহান ও আলমগিরের শাসন

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page