আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কি সত্য নাকি মিথ্যা?
- ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাংলার ইতিহাসের গতি মামলার কারণে পরিবর্তন হয়ে যায়। মামলাটি নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে বিতর্ক আছে। প্রচলিত কথা অনুসারে এটি ছিল মিথ্যা মামলা। এমন কথাই চলে আসছে। তবে অনেকের মতে মামলার বিষয়বস্তু সত্য ছিল। দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা এমনটি করেছেন। এমনকি বর্তমানে কর্নেল শওকত আলী এই বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। যার নাম- সত্য মামলা আগরতলা।
-
আগরতলা ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত-
- আগরতলা ষড়যন্ত্রের ইতিবৃত্ত : পাকিস্তান নৌবাহিনীর কিছু বাঙালি সদস্য গোপনে একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেন। ১৯৬২ সালে করাচির মনরো দ্বীপে তাঁরা একটি গোপন সভায় মিলিত হন। যেখানে লে. কমান্ডারমোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানসহ অনেক সদস্য ছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করবেন। পরবর্তী সময়ে আস্থাভাজন আরও অনেককে তাঁরা দলভুক্ত করেন। দলে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের সদস্য ছিল। লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন দলটির মুখপাত্র হন।
রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বিপ্লবী দলের সাক্ষাৎ-
- স্বাধীনতাকামী দলটি সমর্থনের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা ভাষানি, শেখ মুজিবুর রহমান ও মুজাফফর আহমদ। ১৯৬৪ সালে করাচিতে শেখ মুজিবের সাথে দলটির সাক্ষাত হয় এবং তাদের পরিকল্পনা শুনেন। তিনি তখন আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি দলটিকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে এগুতে থাকেন। - ১৯৬৬ সালের জুনে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে এক বাসায় মিটিংয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মূলত এই বৈঠকে সমাজতান্ত্রিক বাংলার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। যথা-
ক. নতুন রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ। সভায় সোনালি-সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা দেখানো হয়।
খ. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
গ. যে কাজ করবে না, সে খাবে না।
ঘ. ব্যক্তিগত সম্পদ রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আনা।
ঙ. কলকারখানা জাতীয়করণ।
চ. সকল নাগরিকের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা। - অস্ত্র জোগাড়ের জন্য দলের সদস্য মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনারের সচিব পিএন ওঝাকে অস্ত্রের তালিকা দেওয়া হয়। এগুলো নিয়ে কয়েকটি মিটিং বসে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয় যে বিপ্লবীদের প্রতিনিধিরা আগরতলায় যাবে। ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই প্রতিনিধিদলের স্টুয়ার্ড মুজিবুর ও আলী রেজা আগরতলায় যান। এখানে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সাক্ষাত করার কথা ছিল। কিন্তু বিপ্লবী দলের সদস্যরা নিম্নপদস্থ হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে মিটিং করে নি।
এই পরিস্থিতিতে মোয়াজ্জেম নিজেই আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বৈঠকের সময় ঠিক করা হয়। কিন্তু একটি ঘটনার কারণে এই বৈঠক আর হয় নি। - ১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি কর্মসূচি ছিল। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল। বিপ্লবীরা তাদের গ্রেফতার করে সেনানিবাস দখল করার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু বিপ্লবী পরিষদের দলত্যাগী কোষাধ্যক্ষ কর্পোরল আমির হোসেন এই পরিকল্পনা ফাঁস করে দেন। ফলে চট্টগ্রামের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় এবং বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়।
- ১৯৬৮ সালের ২ জানুয়ারি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র দপ্তর এই ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার কথা প্রথমবারের মতো ঘোষণা করে। ৬ জানুয়ারি ভারতীয় হাইকমিশনারের সচিব পিএন ওঝাকে পাকিস্তান সরকার বহিষ্কার করে। এর জবাবে ভারত সরকার দিল্লী হাইকমিশন থেকে দুই পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে।
- শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ‘ডিফেন্স আইনে’ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে তাঁকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেনামে মামলা করা হয়। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলায় ৩৫ জন অভিযুক্ত ও ২৩২ জন সাক্ষীর তালিকা দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জন ক্ষমা পেয়ে রাজসাক্ষী হন।
- অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ছদ্মনাম ব্যবহার করে তৎপরতা চালাত। যেমন- শেখ মুজিবুর রহমান (পরশ), লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন (আলো), আমির হোসেন (উল্কা), স্টুয়ার্ট মুজিবুর (মুরাদ) ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গণমাধ্যমে এটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বলে পরিচিতি পায়।
-
মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ-
- ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে আইয়ুব খান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। বাঙালি ছাত্ররা সেখানে বিক্ষোভ করে। তারা যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা আইনজীবী টমাস উইলিয়াম কিউসিকে ঢাকায় অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবীদের সাথে যোগদেওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের পক্ষে মামলার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি নিযুক্ত হন আব্দুস সালাম খান। মামলার বিস্তারিত বিবরণ, অভিযুক্তদের জবানবন্দি ইত্যাদি বিবরণ পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ধীরে ধীরে জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।
- একপর্যায়ে অভিযুক্তরা জাতীয় বীরে পরিণত হয়। মামলাটি পাকিস্তান সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শেখ মুজিব মাওলানা ভাষানির সাথে যোগাযোগ করেন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় ভাষানি মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। এর সমর্থনে তিনদিন হরতাল পালন করা হয়। যা ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে চারটি ছাত্রসংগঠন ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। তারা ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে। - ২৪ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো গণ-আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে মতিউর, আসাদ, মকবুলসহ অনেকেই মারা যান। বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। মামলার রাজসাক্ষীদের বাসায় আক্রমণ করে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন। তিনি সব রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন। - সরকার ঘোষণা দেয়, ১৭ ফেব্রুয়ারি জরুরি আইন প্রত্যাহার করা হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি জহরুল হকের লাশ নিয়ে মিছিল হয়। সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো গণ-বিস্ফোরণ দেখা দেয়। প্রশাসনিক বড় বড় কর্মকর্তাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগদানের ব্যবস্থা করা হয়। কেননা, এই মামলায় জামিনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু প্যারোলে মুক্তির মাধ্যমে বৈঠকের কথা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা এটিকে সমঝোতা মনে করে। ফলে শেখ মুজিব বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। - মুজিববিহীন গোলটেবিল বৈঠকে ফলপ্রসূ কিছু হবে না ভেবে আইয়ুব খান ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি এক ঘোষণায় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সব অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়। একই দিনে বিগ্রেডিয়ার রাও ফরমান আলী সেনানিবাস থেকে শেখ মুজিবকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতায় পরিণত হন।
-
আরও জানুনঃ ছয় দফা আন্দোলনের ইতিহাস
অনেক উপকারী একটা ওয়েবসাইট।