Skip to content

সাহিত্যে খেলা

    সাহিত্যে খেলা

    প্রমথ চৌধুরী

    জগৎ-বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রোদ্যাঁ, যিনি নিতান্ত জড় প্রস্তরের দেহ থেকে অসংখ্য জীবিতপ্রায় দেব-দানব কেটে বার করেছেন (সুনিপুণ ভাস্কর্য শিল্প) তিনিও, শুনতে পাই, যখন-তখন হাতে কাদা নিয়ে, আঙুলের টিপে মাটির পুতুল ত’য়ের করে থাকেন (খেলাচ্ছলে শিল্পচর্চা)। এই পুতুল গড়া হচ্ছে তাঁর খেলা (শিল্পচর্চার পন্থা সম্পর্কে ইঙ্গিত)। শুধু রোদ্যাঁ কেন, পৃথিবীর শিল্পীমাত্রেই এই শিল্পের খেলা খেলে থাকেন (শিল্পীর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য)। যিনি গড়তে জানেন, তিনি শিবও গড়তে পারেন বাঁদরও গড়তে পারেন (বড় মাপের শিল্পীদের দক্ষতা)। আমাদের সঙ্গে বড়ো বড়ো শিল্পীদের তফাত এইটুকু যে, তাঁদের হাতে এক করতে আর হয় না (তারা একবারেই সফল হয়, আমরা হই না)। সম্ভবত এই কারণে কলারাজ্যের (শিল্পরাজ্যে) মহাপুরুষদের যা-খুশি-তাই করবার যে অধিকার আছে, ইতর শিল্পীদের সে অধিকার নেই (বড় শিল্পীদের সমালোচনা হয় না কিন্তু আমাদের সমালোচিত হতে হয়)। স্বর্গ হতে দেবতারা মধ্যে মধ্যে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়াতে কেউ আপত্তি করেন না (দেবতাদের অবস্থানগত পতন সমালোচিত হয় না), কিন্তু মর্ত্যবাসীদের (মানুষের জন্য) পক্ষে রসাতলে গমন করাটা বিশেষ নিন্দনীয় (মানুষের সামান্য পতন বিশাল নিন্দনীয়)। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো (উপায়) নেই যে, যখন এ জগতে দশটা দিক আছে তখন সেই-সব দিকেই গতায়াত (যাতায়াত) করবার প্রবৃত্তিটি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক (খেলাচ্ছলে শিল্পচর্চা করার অধিকার)। মন উঁচুতেও উঠতে চায়, নিচুতেও নামতে চায় (কর্মের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট বা খ্যাতি পাওয়ার ইচ্ছা)। বরং সত্য কথা বলতে গেলে সাধারণ লোকের মন স্বভাবতই যেখানে আছে তারই চার পাশে ঘুরে বেড়াতে চায় (খুব বেশি প্রত্যাশা থাকে না), উড়তেও চায় না ডুবতেও চায় না (খুব খ্যাতি বা একেবারে পতন চায় না)। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধারণ লোককে কি ধর্ম, কি নীতি, কি কাব্য, সকল রাজ্যেই অহরহ ডানায় ভর দিয়ে থাকতেই (শূন্যলোকে ভাসা- সতর্ক থাকার পরামর্শ) পরামর্শ দেয়। একটু উঁচুতে না চড়লে আমরা দর্শক এবং শ্রোতৃ-মণ্ডলীর নয়ন-মন আকর্ষণ করতে পারি নে। বেদীতে না বসলে (শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসতে না পারলে) আমাদের উপদেশ কেউ মানে না, রঙ্গমঞ্চে না চড়লে আমাদের অভিনয় কেউ দেখে না, আর কাষ্ঠমঞ্চে না দাঁড়ালে আমাদের বক্তৃতা কেউ শোনে না। সুতরাং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে থাকবার লোভে (খ্যাতি পাওয়ার জন্য) আমরাও অগত্যা চব্বিশ ঘণ্টা টঙে চড়ে থাকতে চাই, কিন্তু পারি নে (আকর্ষণ ধরে রাখতে পারি না)। অনেকের পক্ষে নিজের আয়ত্তের বহির্ভূত উচ্চস্থানে ওঠবার চেষ্টাটাই (সীমিত প্রতিভার কারণে) মহাপতনের কারণ হয়। এ-সব কথা বলবার অর্থ এই যে, কষ্টকর হলেও আমাদের পক্ষে অবশ্য মহাজনদের পথ অনুসরণ করাই কর্তব্য (পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য লাভ)। কিন্তু ডাইনে-বাঁয়ে ছোটোখাটো গলিঘুঁজিতে খেলাচ্ছলে প্রবেশ করবার যে অধিকার তাঁদের আছে (মনের আনন্দের সাহিত্য রচনা করার অধিকার), সে অধিকারে আমরা কেন বঞ্চিত হব? গান করতে গেলেই যে সুর তারায় চড়িয়ে রাখতে হবে (শ্রুতিমধুর গান), কবিতা লিখতে হলেই যে মনের শুধু গভীর ও প্রখর ভাব প্রকাশ করতে হবে (মানসম্মত কবিতা), এমন কোনো নিয়ম থাকা উচিত নয় (শিল্পচর্চা যথার্থভাবেই করতে হবে এমন নিয়ম থাকা উচিত না)। শিল্পরাজ্যে খেলা করবার প্রবৃত্তির ন্যায় অধিকারও বড়ো-ছোটো সকলেরই সমান আছে (সাহিত্য সৃষ্টি করার অধিকার সকলের আছে)। এমন-কি, এ কথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, এ পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্রাহ্মণশূদ্রের প্রভেদ নেই (খেলার মাঠে কোনো বৈষম্য থাকে না)। রাজার ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরও খেলায় যোগ দেবার অধিকার আছে। আমরা যদি একবার সাহস করে কেবলমাত্র খেলা করবার জন্য (কোনো প্রত্যাশা না নিয়ে) সাহিত্যজগতে প্রবেশ করি, তা হলে নির্বিবাদে সে জগতের রাজা-রাজড়ার দলে মিশে যাব (অচিরেই মানসম্মত সাহিত্য রচনার যোগ্যতা)। কোনোরূপ উচ্চ আশা নিয়ে সে ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেই নিম্নশ্রেণিতে পড়ে যেতে হবে (অধিক প্রত্যাশা পতনের কারণ হয়)।

    লেখকেরাও অবশ্য দশের কাছে হাততালির প্রত্যাশা রাখেন, বাহবা না পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হন। কেননা তাঁরাই হচ্ছেন যথার্থ সামাজিক জীব, বাদবাকি সকলে কেবলমাত্র পারিবারিক (লেখকরা সমাজ নিয়ে লেখালেখি করেন তাই সমাজের কাছে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করেন)। বিশ্বমানবের মনের সঙ্গে নিত্যনূতন সম্বন্ধ পাতানোই (মানুষের মনকে জাগানো) হচ্ছে কবি-মনের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম (কবিদের দায়িত্ব)। এমনকি কবির আপন মনের গোপন কথাটিও গীতিকবিতাতে (ব্যক্তিগত অনুভূতি  ছন্দোবদ্ধ পদে প্রকাশ) রঙ্গভূমির (আমোদ-প্রমোদের স্থান) স্বগতোক্তি (আপন মনে নিজের কথা) স্বরূপেই উচ্চারিত হয় (কবির ব্যক্তিগত বিষয়ও সমাজের দর্পণস্বরূপ), যাতে করে সেই মর্মকথা হাজার লোকের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু উচ্চমঞ্চে আরোহণ করে উচ্চৈঃস্বরে উচ্চবাচ্য না করলে যে জনসাধারণের নয়ন-মন আকর্ষণ করা যায় না, এমন কোনো কথা নেই (প্রচারণা ছাড়াও জনমন আকৃষ্ট করা যায়)। সাহিত্যজগতে যাঁদের খেলা করবার প্রবৃত্তি (ইচ্ছা) আছে, সাহস আছে ও ক্ষমতা আছে (খেলাচ্ছলে সাহিত্য রচনা করার ধৈর্য), মানুষের নয়ন-মন আকর্ষণ করবার সুযোগ বিশেষ করে তাঁদের কপালেই ঘটে। মানুষে যে খেলা দেখতে ভালোবাসে তার পরিচয় তো আমরা এই জড় সমাজেও (পৃথিবীতে) নিত্যই পাই। টাউনহলে বক্তৃতা শুনতেই বা ক’জন যায় আর গড়ের মাঠে (কলকাতার বিস্তীর্ণ মাঠ) ফুটবল খেলা দেখতেই বা ক’জন যায়। অথচ এ কথাও সত্য যে, টাউনহলের বক্তৃতার উদ্দেশ্য অতি মহৎ, আর গড়ের মাঠের খেলোয়াড়দের ছুটোছুটি দৌড়াদৌড়ি আগাগোড়া অর্থশূন্য এবং উদ্দেশ্যবিহীন। আসল কথা এই যে, মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যহীন (আনন্দই খেলার একমাত্র উদ্দেশ্য- তাই কোনো প্রত্যাশা থাকে না)। মানুষে যখন খেলা করে, তখন সে এক আনন্দ ব্যতীত অপর কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা রাখে না। যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা। এবং যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থাৎ অর্থগত (আর্থিক প্রাপ্তি বা প্রত্যাশা থাকে না) নয়, সে কারণ তা কারো নিজস্ব হতে পারে না। এ আনন্দে সকলেরই অধিকার সমান।

    সুতরাং সাহিত্যে খেলা করবার অধিকার যে আমাদের আছে, শুধু তাই নয়, স্বার্থ (নিজের স্বার্থ রক্ষা) এবং পরার্থ (অপরের উপকার করা) এ দুয়ের যুগপৎ সাধনের (সমন্বয় সাধন) জন্য মনোজগতে খেলা করাই হচ্ছে আমাদের পক্ষে সর্বপ্রধান কর্তব্য। যে লেখক সাহিত্যক্ষেত্রে ফলের চাষ (প্রত্যাশা নিয়ে লেখা) করতে ব্রতী হন, যিনি কোনোরূপ কার্য-উদ্ধারের অভিপ্রায়ে লেখনী ধারণ করেন, তিনি গীতের মর্মও বোঝেন না, গীতার ধর্মও বোঝেন না (পরিস্থিতি অনুসারে চলতে পারেন না)। কেননা খেলা হচ্ছে জীবজগতে একমাত্র নিষ্কাম কর্ম, অতএব মোক্ষলাভের (আনন্দ/ আত্মার মুক্তি লাভ) একমাত্র উপায়। স্বয়ং ভগবান বলেছেন, যদিচ তাঁর কোনোই অভাব নেই তবুও তিনি এই বিশ্ব সৃজন করেছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি তাঁর লীলামাত্র। কবির সৃষ্টিও এই বিশ্বসৃষ্টির অনুরূপ, সে সৃজনের মূলে কোনো অভাব দূর করবার অভিপ্রায় নেই—সে সৃষ্টির মূল অন্তরাত্মার স্ফূর্তি এবং তার ফল আনন্দ। এক কথায় সাহিত্যসৃষ্টি জীবাত্মার (মানুষের) লীলামাত্র, এবং সে লীলা বিশ্বলীলার (বিশ্বসৃষ্টির মতো সাহিত্য সৃষ্টিও কেবল আনন্দের জন্য) অন্তর্ভূত; কেননা জীবাত্মা পরমাত্মার অঙ্গ এবং অংশ (মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি ও তার কর্ম অনুসরণ করে)।

    সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ (বিস্তর ব্যবধান) আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্যে খেলনা তৈরি করতে বসেন (নিজের আনন্দ দূরে সরিয়ে দিয়ে অপরের থেকে কিছু প্রত্যাশায় লিখা)।

    সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত (উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে) হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙা লাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, নীতির টিনের ভেঁপু এবং ধর্মের জয়ঢাক- এই-সব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে (বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সাহিত্য রচিত হচ্ছে)। সাহিত্যরাজ্যে খেলনা পেয়ে পাঠকের মনতুষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা গড়ে লেখকের মনতুষ্টি হতে পারে না। কারণ পাঠকসমাজ যে-খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙে ফেলে (পাঠকরা সর্বদা সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারে না)—সে প্রাচ্যই হোক আর পাশ্চাত্যই হোক, কাশীরই হোক আর জার্মানিরই হোক, দুদিন ধরে তা কারো মনোরঞ্জন করতে পারে না। আমি জানি যে, পাঠকসমাজকে আনন্দ দিতে গেলে তাঁরা প্রায়শই বেদনাবোধ করে থাকেন (প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায়)। কিন্তু এতে ভয় পাবার কিছুই নেই; কেননা কাব্যজগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম বেদনা। (প্রত্যাশা থাকলেই কষ্ট থাকবে)

    অপরপক্ষে এ যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, সুতরাং তাঁদের মনোরঞ্জন করতে হলে আমাদের অতি সস্তা খেলনা (মানসম্মতহীন সাহিত্য) গড়তে হবে, নইলে তা বাজারে কাটবে না (বাজারে চলবে না)। এবং সস্তা করার অর্থ খেলো করা। বৈশ্য (যারা সবকিছুতে ব্যবসা বা স্বার্থ দেখে) লেখকের পক্ষেই শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সংগত (নিম্নশ্রেণির লোকের মনোরঞ্জনের জন্য মানহীন সাহিত্য প্রয়োজন)। অতএব সাহিত্যে আর যাই কর-না-কেন, পাঠকসমাজের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টা করে না

    তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষা দেওয়া?—অবশ্য নয়। কেননা কবির মতিগতি শিক্ষকের মতিগতির সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুল না বন্ধ হলে যে খেলার সময় আসে না, এ তো সকলেরই জানা কথা (স্কুল আনন্দের স্থান না, বাধ্য হয়ে পড়ার স্থান)। কিন্তু সাহিত্যরচনা যে আত্মার লীলা (মনের আনন্দের সাথে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই), এ কথা শিক্ষকেরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। সুতরাং শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্ম কর্ম যে এক নয়, এ সত্যটি একটু স্পষ্ট করে (প্রমাণ দিয়ে দেখানো) দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। প্রথমত শিক্ষা হচ্ছে সেই বস্তু যা লোকে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, অপরপক্ষে কাব্যরস লোকে শুধু স্বেচ্ছায় নয় সানন্দে পান করে (কাব্য মানুষ আনন্দের জন্য পড়ে); কেননা শাস্ত্রমতে সে রস অমৃত (আত্মার খোরাক জোগায়)। দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো; কাব্য যে সংবাদপত্র নয়, এ কথা সকলেই জানেন। তৃতীয়ত অপরের মনের অভাব পূর্ণ করবার উদ্দেশ্যেই শিক্ষকের হস্তে শিক্ষা জন্মলাভ করেছে, কিন্তু কবির নিজের মনের পরিপূর্ণতা হতেই সাহিত্যের উৎপত্তি। সাহিত্যের উদ্দেশ্য যে আনন্দদান করা, শিক্ষাদান করা নয়, একটি উদাহরণের সাহায্যে তার অকাট্য প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।

    বাল্মীকি (রামায়ণ প্রণেতা) আদিতে মুনিঋষিদের জন্য রামায়ণ রচনা করেছিলেন, জনগণের জন্য নয়। এ কথা বলা বাহুল্য যে, বড় বড় মুনিঋষিদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু রামায়ণ শ্রবণ করে মহর্ষিরাও (মহা মনীষী) যে কতদূর আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁরা কুশীলবকে (রামচন্দ্রের দুই ছেলে কুশ ও লব- অভিনেতা) তাঁদের যথাসর্বস্ব, এমন-কি, কৌপীন পর্যন্ত পেলা (উপহার) দিয়েছিলেন (রামায়ণ শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পোশাক ‍উপহার দেয়)। রামায়ণ কাব্য হিসাবে যে অমর এবং জনসাধারণ আজও যে তার শ্রবণে-পঠনে আনন্দ উপভোগ করে তার একমাত্র কারণ, আনন্দের ধর্মই এই যে তা সংক্রামক (আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয়)। অপরপক্ষে লাখে একজনও যে যোগবশিষ্ঠ রামায়ণের (বশিষ্ঠ মুনির উপদেশ সংবলিত রামায়ণ) ছায়া মাড়ান না তার কারণ, সে বস্তু লোককে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল, আনন্দ দেবার জন্যে নয়। আসল কথা এই যে, সাহিত্য কস্মিনকালেও স্কুলমাস্টারির ভার নেয় নি। এতে দুঃখ করবার কোনো কারণ নেই। দুঃখের বিষয় এই যে, স্কুল মাস্টারেরা একালে সাহিত্যের ভার নিয়েছেন।

    কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে, তার জন্য দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাস্টার। কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুলমাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক এবং পাঠকের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দণ্ডায়মান (মধ্যস্থতাকারী)। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে যাক (কবিতা উপলব্ধি করা যায় না), চার চক্ষুর মিলনও ঘটে না। স্কুলঘরে আমরা কাব্যের রূপ দেখতে পাই নে, শুধু তার গুণ শুনি। টীকা-ভাষ্যের প্রসাদে আমরা কাব্য সম্বন্ধে সকল নিগূঢ় তত্ত্ব জানি, কিন্তু সে যে কি বস্তু তা চিনি নে (কাব্যের বর্ণনা শুনি কিন্তু কাব্যের আনন্দ অনুভব করতে পারি না)। আমাদের শিক্ষকদের প্রসাদে (বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা) আমাদের এ জ্ঞান লাভ হয়েছে যে, পাথুরে-কয়লা হীরার সবর্ণ না হলেও সগোত্র; (দেখতে ভিন্ন হলেও মূল সত্তা এক হতে পারে) অপরপক্ষে হীরক ও কাচ যমজ হলেও সহোদর নয় (দেখতে অভিন্ন হলেও মানের দিক দিয়ে বিস্তর ব্যবধান থাকতে পারে)। এর একের জন্ম পৃথিবীর গর্ভে (হীরা), অপরটির মানুষের হাতে (কাচ); এবং এ উভয়ের ভিতর এক দা-কুমড়ার সম্বন্ধ ব্যতীত অপর কোনো সম্বন্ধ নেই (হীরা দিয়ে কাচ কাটা হয়- অথচ দেখতে অভিন্ন)। অথচ এত জ্ঞান সত্ত্বেও আমরা সাহিত্যে কাচকে হীরা এবং হীরাকে কাচ বলে নিত্য ভুল করি (যথাযথ মূল্যায়ন না করা), এবং হীরা ও কয়লাকে একশ্রেণীভুক্ত করতে তিলমাত্রও দ্বিধা করি নে (সব সাহিত্যকে একই মানের মনে করা), কেননা ওরূপ করা যে সংগত তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের মুখস্থ আছে। সাহিত্য শিক্ষার ভার নেয় না, কেননা মনোজগতে শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কবির কাজের ঠিক উলটো। কারণ কবির কাজ হচ্ছে কাব্য সৃষ্টি করা, আর শিক্ষকের কাজ হচ্ছে প্রথমে তা বধ করা তার পরে তার শবচ্ছেদ করা (নানাবিধ ব্যাখ্যা-তত্ত্ব বের করা) এবং ঐ উপায়ে তার তত্ত্ব আবিষ্কার করা ও প্রচার করা। এই-সব কারণে নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, কারো মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয় (এতে সাহিত্যের আনন্দ বিনষ্ট হয়)। সাহিত্য ছেলের হাতের খেলনাও নয়, গুরুর হাতের বেতও নয় (একবারে সহজ বা খুব কঠিন না)। বিচারের সাহায্যে এই মাত্রই প্রমাণ করা যায়। তবে বস্তু (সাহিত্য) যে কি, তার জ্ঞান অনুভূতিসাপেক্ষ, তর্কসাপেক্ষ নয় (সাহিত্য অনুভব করা যায়, প্রমাণ করা যায় না)। সাহিত্যে মানবাত্মা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করে। এ কথার অর্থ যদি স্পষ্ট না হয় তা হলে কোনো সুদীর্ঘ ব্যাখ্যার দ্বারা তা স্পষ্টতর করা আমার অসাধ্য।

    এই-সব কথা শুনে আমার জনৈক শিক্ষাভক্ত বন্ধু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সাহিত্য খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেয়। 

    Leave a Reply