রেইনকোট
বি. দ্র. গোলাপি রংয়ের লাইনগুলো HSC পাঠ্যবইতে নেই
ভোররাত থেকে বৃষ্টি (স্বস্তির বার্তা)। আহা! বৃষ্টির ঝমঝম বোল। এই বৃষ্টির মেয়াদ আল্লা দিলে পুরো তিনদিন। কারণ শনিতে সাত মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন (খনার বচন)। এটা জেনারেল স্টেটমেন্ট (মূল বচন- পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল, যদ্দিন কুয়া তদ্দিন জল- শনিতে সাত মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন- [অর্থ] পৌষে যতদিন কুয়াশা হবে বৈশাখেও ততদিন হবে। শনিবারে বৃষ্টি শুরু হলে অনবরত সাতদিন বৃষ্টি হবে। মঙ্গলবারে বৃষ্টি শুরু হলে টানা তিনদিন থাকবে।এছাড়া অন্যবারে বৃষ্টি শুরু হলে সেইদিন হয়েই থেমে যাবে)। স্পেসিফিক ক্লাসিফিকেশনও আছে। যেমন, মঙ্গলে ভোররাতে হলে শুরু, তিন দিন মেঘের গুরুগুরু। তারপর, বুধের সকালে নামল জল, বিকেলে মেঘ কয় এবার চল। বৃহস্পতি শুক্র কিছু বাদ নাই। কিন্তু এখন ভুলে গেছে (এই ধরনের প্রবাদের চর্চা)। যেটুকু মনে আছে, পুরু বেড-কভারের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আর একপশলা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য তাই যথেষ্ট। অন্তত তিন দিন ফুটফাট বন্ধ (গুলির আওয়াজ)। বাদলায় বন্দুক-বারুদ কি একটু জিরিয়ে নেবে না? এই ক’টা দিন নিশ্চিন্তে আরাম করো। (তীব্র বৃষ্টিতে বারুদ বন্দুকের ক্ষতি হওয়ায় এখন গোলাগুলির সম্ভাবনা কম)
তা আর হলো কই? ম্যান প্রোপোজেস (গড ডিসপোজেস- মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক)—। এমন চমৎকার বাদলার সকালে দরজায় প্রবল কড়া নাড়া শেষ হেমন্তের শীত শীত পর্দা ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলল। সব ভেস্তে দিল (ঘুমের পরিকল্পনা বাদ)। মিলিটারি। মিলিটারি আজ তার ঘরে। আল্লা গো। আল্লাহুমা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন। —পড়তে পড়তে সে দরজার দিকে এগোয়। এই কয়েকমাসে কত সুরাই সে মুখস্থ করেছে (মুসলমান প্রমাণ করতে)। রাস্তায় বেরুলে পাঁচ কলেমা সবসময় রেডি রাখে ঠোঁটের ওপর। কোনদিক থেকে কখন মিলিটারি ধরে। —তবুও একটা না একটা ভুল হয়ে যায় (আতঙ্কে)। দোয়া মনে হলো ঠিকই কিন্তু টুপিটা মাথায় দিতে ভুলে গেল।
দুটো ছিটকিনি, একটা খিল এবং কাঠের ডাশা দরজার কপাট ফাঁক করতেই বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটার সঙ্গে ঘরে ঢোকে প্রিন্সিপালের পিওন। আলহামদুলিল্লাহ। মিলিটারি নয়। পিওনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে (অপ্রত্যাশিত ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ায়)। কিন্তু লোকটা চিনচিনে গলা গম্ভীর স্বরে হাঁকে ‘স্যার মে সালাম দিয়া’। বলেই ভাঙাচোরা গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লোকটা নিজের বাক্যের কোমল শ্বাসটুকু শুষে নেয় এবং হুকুম ছাড়ে, ‘তলব কিয়া। আভি জানে হোগা’।
কী ব্যাপার?
বেশি কথা বলার সময় নেই— কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে কারা বোমা ফাটিয়ে গেছে (গেরিলা আক্রমণ) গত রাতে।
মানে?
‘মিসকিরিয়ান (দুষ্কৃতিকারী বা মুক্তিযোদ্ধা) লোগ ইলেকটিরি টেরানসফার্মার তোড় দিয়া। অওর ওয়াপস যানে কা টাইম প্রিন্সিপালের সাহেবকা কোঠিমে গেরেনড ফেকা। গেট তোড় গিয়া।’
ভয়াবহ কাণ্ড। ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার তো কলেজের সামনের দেওয়াল ঘেঁষে। দেয়ালের পর বাগান, টেনিস লন। তারপর কলেজ দালান। মস্ত দালান পার হয়ে ফুটবল ক্রিকেট খেলার মাঠ। মাঠ পেরিয়ে একটু বাঁ দিকে প্রিন্সিপালের কোয়ার্টার। এর সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্প। কলেজের জিমন্যাশিয়ামে (ব্যায়ামাগার) এখন মিলিটারি ক্যাম্প। প্রিন্সিপালের বাড়ির গেটে বোমা ফেলা মানে মিলিটারি ক্যাম্প অ্যাটাক করা। (প্রিন্সিপ্যাল পাকিস্তানিদের দোসর বলে)
সামনের দেওয়ালে বোমা মেরে এতটা পথ ক্রস করে গেল কী করে? সে জানতে চায়, ক্যায়সে? (এমন অন্তর্ঘাতের পর আক্রমণকারীরা কীভাবে পালিয়ে গেল)
প্রিন্সিপালের পিয়ন জানবে কী করে? ‘উও আপ হি কহ সাকতা।’ (পিওন নূরুল হুদাকে মিসক্রিয়ান্টদের দোসর মনে করে)
মানে? সে-ই বা বলবে কী করে? পিওন কি তাকে মিসক্রিয়েন্টদের লোক ভাবে নাকি?—তার মাথাটা আপনা আপনি নিচু হলে মুখ দিয়ে পানির মতো গড়িয়ে পড়ে (নরম স্বরে বলে), ‘ইসহাক মিয়া, বৈঠিয়ে। চা-টা খাইয়ে। আমার এই পাঁচ সাত মিনিট লাগেগা।’
‘নেহি।’ নাশতার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে ইসহাক বলে, ‘আব্দুস সাত্তার মিরধাকা ঘর যানে হোগা। আপ আভি আইয়ে। এক কর্নেল সাহাব পঁওছ গিয়া। সব পরফসরকো এত্তেলা দিয়া। ফওরন আইয়ে।’
কর্নেলের নেতৃত্বে মিলিটারির হাতে কলেজটা এবং তাকেও ন্যস্ত করে ইসহাক বেরিয়ে যায়, রাস্তায় ঘড়ঘড় করতে থাকা বেবি ট্যাক্সির গর্জন তুলে সে রওনা হলো জিওগ্রাফির প্রফেসরের বাড়ির দিকে। ইসহাক নিজেই এখন মিলিটারির কর্নেল বললেও চলে (উচ্চপদস্থ কেউ না থাকায়)। তবে ভোরবেলা কলেজের ভেতরে কর্নেল খোদ চলে আসায় সে হয়তো ডেমোটেড হয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেলে (মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দাপট বেড়ে যায়। তবে স্বয়ং কর্নেল চলে আসায় তার ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়)। আরো নিচেও নামতে পারে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের দিকে ঠেলা মুশকিল। মিলিটারি প্রাদুর্ভাবের (উৎপাত) পর থেকে তাকে দেখে (মিলিটারিদের প্রতিনিধি বলে) কলেজের সবাই তটস্থ। এপ্রিলের শুরু থেকে সে বাংলা বলা ছেড়েছে। কোনকালে দাদা না পরদাদার ভায়রার মামু না কে যেন দিল্লিওয়ালা কোন সাহেবের খাস খানসামা (খাবার পরিবেশক) ছিল, সেই সুবাদে দিনরাত এখন উর্দু বলে। (আত্মীয়ের থেকে উর্দু শিখে)
প্রিন্সিপাল গাট্টাগোট্টা বেঁটেখাটো মানুষ, নিজের চাপরাশির সাথে নতুন জাব লবজ করতে গিয়ে গলায় তার রক্ত উঠে যায়। ‘ইসাক মিয়া, দেশতে বহুত মুসিবত্ হো রহা হ্যায়। প্রফেসর লোক আদমিকো হুঁশিয়ার থাকতে বলিয়ে। গুজব বোলনা মানা কর দিজিয়ে। আভি মিলিটারি সাহাবকো মদদ করনা এখন ফরজ কাম হ্যায়।’
‘জরুর।’ দেশালাইয়ের কাঠির মতো রোগা পটকা শরীরের উপর ফিট করা ভিজে বারুদের মতো ছোট্ট মাথা ঝাঁকিয়ে ইসহাক আরো তিনবার সম্মতি দেয় জরুর! জরুর! জরুর। কয়েকদিন আগের ইসহাকের এই জরুর বৃষ্টিতে ভিজে আরও টাটকা হয়ে তার কানে বাজতে না বাজতে কোথায় যেন ফেটে পড়ে দুম করে। এই বৃষ্টিতে কি ফের শুরু হলো নাকি? —না না সে ফ মেঘের গর্জন। বৃষ্টি বোধহয় বাড়ছে। না—। এখন বেরুতেই হয়। আল্লা ভরসা।’
‘যেতেই হবে’? অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে তোমার হাঁপানির টানটা আবার—। বৌয়ের এসব সোহাগের কথা শুনলে কি আর চলবে (স্বামীর প্রতি যত্নশীল মনোভাব)? বৌ প্রিন্সিপালের ধমকের ভাগ নেবে? এর উপর কলেজে কর্নেল এসেছে। কপালে আজ কী আছে আল্লাই জানে (মৃত্যুর শঙ্কা)। ফায়ারিং স্কোয়াডে যদি দাঁড় করিয়েই দেয় তো কর্নেল সাহেবের হাতে পায়ে ধরে ঠিক কপালে গুলি করানোর হুকুম জারি করা যায় না (স্বল্প যন্ত্রণায় মৃত্যু)? প্রিন্সিপাল কি তার জন্যে কর্নেলের কাছে এ তদবিরটুকু করবে না? পাকিস্তানের জন্য প্রিন্সিপাল দিনরাত দোয়া-দরুদ পড়ছে। সময় নেই অসময় নেই আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে (অখণ্ড পাকিস্তানের মঙ্গল কামনায়)) এবং সময় করে কলিগদের গালাগালিও করে (কলিগরা মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করায়)।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রিন্সিপাল মিলিটারির বড় কর্তাদের কাছে সবিনয় নিবেদন করেছিল, পাকিস্তান যদি বাঁচাতে হয় তো সব স্কুল কলেজ থেকে শহীদমিনার হটাও (বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ধ্বংস)। এসব আন অথারাইজড কনস্ট্রাকশন হলো হিন্দুদের শিবলিঙ্গের সামিল, এগুলো হলো পাকিস্তানের শরীরের কাঁটা। পাকিস্তানের পাক সাফ শরীরটাকে নীরোগ করতে হলে এসব কাঁটা উপড়াতে হবে। তা মিলিটারি ডক্টর আফাজ আহমদর পরামর্শ শুনেছে, গ্রামে গঞ্জে যেখানেই গেছে, প্রথমেই কামান তাক করেছে শহীদ মিনারের দিকে। দেশে একটা কলেজেও শহীদ মিনার অক্ষত নেই (জাতির ঐতিহ্য ধ্বংস)। তা প্রিন্সিপাল তাদের এতবড় একটা পরামর্শ দিল, আর সামান্য এক লেকচারারকে গুলি করার সময় শরীরের আলতুফালতু জায়গা বাদ দিয়ে কপালটা টার্গেট করার অনুরোধটা তারা মানবে না? আবার প্রিন্সিপালকে সে এত সার্ভিস দিচ্ছে (তোয়াজ করা ও প্রিন্সিপ্যালের ফরমায়েশ শোনা), তার কলিগের, তওবা, সাব-অর্ডিনেটের জন্যে এতটুকু করবে না? (কপালে গুলি করে মৃত্যুর অনুরোধ)
প্যান্টের ভিতর পা গলিয়ে দিতে দিতে সে শোনে রান্নাঘর থেকে বৌ বলছে ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে মিরপুর ব্রিজের দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছিল। কখন কী হয়।’
এসব কথা বলার দরকার কী (আতঙ্কজনক কথাবার্তা)? —রেডিও টেলিভিশনে হরদম বলছে সিচুয়েশন নরমাল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক (দেশবাসীকে সান্ত্বনা দেওয়া)। দুশমনকে সম্পূর্ণ কব্জা করা গেছে। মিসক্রিয়েন্টরা সব খতম। প্রেসিডেন্ট (ইয়াহইয়া খান) দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিছুদিন বাদে বাদে তার ভাষণ শোনা যায়, আওয়ার আলটিমেট এইম রিমেইনস দা সেম (পূর্ব প্রতিশ্রুতি এখনো বহাল আছে), দ্যাট ইজ টু হ্যান্ডওভার পাওয়ার টু দি ইলেকটেড রিপ্রেজেনটিটিভস অন দ্য পিপল। সবই তো নর্মাল হয়ে আসছে। বাঙ্গালি, আই মিন ইস্ট পাকিস্তান গভর্নর (ডা. আব্দুল মুতালিব মালিক মন্ত্রিসভা), মন্ত্রীরা ইস্ট পাকিস্তানি। সবই তো স্বাভাবিক। এখন বৌ তার এসব বাজে কথা বলে কেন? ইস! আসমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
পরশু রাতে বিছানায় ছটফট করতে করতে বলে কি, রাতে দুই-চারবার গুলিগালাজের আওয়াজ না শুনলে ঘুম হয় না। —এর জন্যই তার ঘরে কখন যে কী মুসিবত নেমে আসে আল্লাই জানে।
এই বৃষ্টিতে শুধু ছাতায় কুলাবে না গো। বৌয়ের আরেক দফা সোহাগ শোনা গেল, তুমি বরং মিন্টুর রেইনকোটটা নিয়ে যাও।
ইস! আবার মিন্টু। বৌয়ের এই ভাইটার জন্যেই তাকে এক্সট্রা তটস্থ হয়ে থাকতে হয় (শালা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ায়)। বাড়ি থেকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মগবাজারের দুই কামরার ফ্লাট থেকেই তো মিন্টু চলে গেল জুন মাসে, জুনের ২৩ তরিখে (গেরিলা যোদ্ধারা এক ঠিকানায় স্থায়ী থাকে না)। জুলাইয়ের পয়লা তারিখ সে বাড়ি শিফট করল। বলা যায় না, ওখানে যদি কেউ আঁচ করে থাকে। ও চলে যাবার তিনদিন পরেই পাশের ফ্লাটের গোলগাল মুখের মহিলা তার বউকে জিজ্ঞেস করেছিল (কৌতূহলবশত), ভাবী, আপনার ভাইকে দেখছি না। ব্যস, এই শুনেই সে বাড়ি বদলাবার জন্যে লেগে গেল হন্যে হয়ে (মিন্টুর ব্যাপারে কেউ সন্দেহ করলে)। মিলিটারি লাগার পর থেকে এই নিয়ে চারবার বাড়ি পালটানো হলো (মুক্তিবাহিনীর সাথে আঁতাত রাখার কথা গোপন রাখতে)। এখানে আসার পর নিচের তলার ভদ্রলোক একদিন বলছিল, আমার ভাইটাকে আর ঢাকায় রাখলাম না (নিরাপত্তাহীনতার কারণে)। যে গোলমাল, বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। শুনে বুকটা তার টিপটিপ করছিল, এবার যদি তার শালার প্রসঙ্গ তোলে? নিরাপত্তার জন্যই সে এখানে এসেছে। কলেজ থেকে দূরে, আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে। শহর থেকেও দূরেই বলা যায়। ভেবেছিল নতুন এলাকা, পুবদিকে জানালা ধরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে বিল আর ধানক্ষেত। তা কী বিপদ! এদিকে নাকি নৌকা করে চলে আসে স্টেনগানওয়ালা ছোকরার দল (মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা)। এদিককার মানুষ চোখে খালি নৌকা দেখে, নৌকাভরা অস্ত্র। এর উপর বৌ যদি মিন্টুর কথা তোলে তো অস্ত্র ঢুকে পড়ে তার ঘরের মধ্যিখানে। মিন্টু যে কোথায় গেছে তা সে-ও জানে তার বৌ-ও জানে (ক্র্যাক প্লাটুন)।
আবার দেখো নিজের ভাইয়ের গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে আসমা ছেলেদের কী বলছে, তারা পর্যন্ত বলে, ছোট মামা গেছে খানসেনাদের মারতে। কোন কথায় কী বিপদ হয়, কেউ বলতে পারে? তো আসমার যদি এতই সাহস তো সেও ভাইয়ের সঙ্গে কোমর বাঁধলো না কেন? —মুখে বলা যায় না, কিন্তু বলার জন্য তার জিব কাঁপে। মিন্টুর কথা ভুলে যাও আসমা, ভুলে যাও। আমাদের সঙ্গে কেউ নাই, কেউ নাই।
কিসিনজার সাহেব (তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেছে, এসব হলো পাকিস্তানের ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার (পরাশক্তিধর দেশগুলোর দায়িত্বহীন আচরণ)।—মানুষ মেরে সাফ করে দেয়, বাড়িঘর, গ্রাম, বাজারহাট জ্বালিয়ে দিচ্ছে,—কারো কোনো মাথাব্যথা নেই (মানুষের প্রতি কোনো দরদ নেই)। এসব হলো ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার।—না, না, এ ধরনের ভাবনা (প্রতিবাদী মনোভাব) ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া ঠিক না। নিচের ফ্ল্যাটে থাকে এক ওয়েলডিং ওয়ার্কশপের মালিক, তার শ্বশুর নিশ্চয় সর্দার গোছের রাজাকার। সপ্তাহে দুইদিন-তিনদিন মেয়ের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর, টেপ রেকর্ডার, দামি দামি সোফাসেট, ফ্যান, খাট-পালং সব চালান পাঠায় (অপরের মাল লুট করে)।
একদিন এমনকি হিন্দুদের কোন দেবতার মূর্তি পর্যন্ত এসেছিল, সোনার কি-না কে জানে। ট্রাক ট্রাক মাল আসে, আবার চলেও যায়। রাজাকার এসব পায় কোথায়? লোকটা যদি টের পায় তার জামাইয়ের ওপরতলার প্রফেসরের শালা হলো মিসক্রিয়েন্ট, মিলিটারি খতম করার নিয়ত করে সে চলে গেছে এই বোনের ঘর থেকেই, তাহলে গোলাগুলি চলবে এই বাড়িতেই, এই ঘরের মধ্যে। সেই গুলির বোলে আসমাকে ঘুম পাড়তে হবে সারা জীবের জন্যে।—এখানে কথাবার্তা বলার সময় হুঁশ ঠিক রাখা দরকার।
‘দেখি তো, ফিট করে কি-না’? আসমা এগিয়ে এসে তার গায়ে রেইনকোট চড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ‘মিন্টু তো আমার অনেক লম্বা। তোমার গায়ে হবে তো?’—দেখো, ফের মিন্টুর দৈর্ঘ্যের তুলনা করে তার সঙ্গে। এই ভাইকে নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করাটা কি আসমার ঠিক হচ্ছে? ভালোই হলো। তোমার গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। পায়েও বৃষ্টি লাগবে না। এখানেই আসমার শেষ নয়। রেইনকোটের সঙ্গেকার টুপি এনে চড়িয়ে দেয় তার মাথায়।
মিন্টুটার কাজ! শালা তার আবার কী মহৎ কীর্তি স্থাপন করল। নাহ, এবার তার কীর্তি অন্যরকম। কী? না, আলনায় ঝুলিয়ে গেছে রেইনকোট, টুপিটা রেখে গেছে ওয়ার্ডরোবের মাথায়। কাল কোরান শরিফ নামাতে গিয়ে দেখি ওটা পড়ে আছে। আর কিছু রাখেনি তো? নিজের চোখে দেখতে সে ওয়ার্ডরোবের ওপরটায় ভালো করে চোখ বোলায়। মগবাজারে এক বাড়িতে মিলিটারি ঢুকে খাটের নিচে চাইনিজ রাইফেল পেয়েছিল তিনটে। অথচ বাড়ির বাসিন্দা, গোবেচারি ডাক্তার এর কিছুই জানত না। ঘরের জিনিসপত্র রোজ রোজ দেখে রাখা ভালো।
‘আব্বু ছোটমামা হয়েছে। আব্বু ছোটমামা হয়েছে।’ আড়াই বছরের মেয়ের সদ্য-ঘুম-ভাঙা গলায় ভাঙা ভাঙা বুলি শুনে সে চমকে ওঠে, মিন্টু কি ঢুকে পড়লো অস্ত্রশস্ত্র হাতে, এর মানে ওর পিছে পিছে ঢুকছে মিলিটারি। তার মানে—। না, দরজার ছিটকিনি ও খিল সব বন্ধ। আড়াই বছরের কন্যা বিছানায় বসে বসেই হাততালি দেয়, আব্বু ছোটমামা, আব্বু ছোটমামা।
তাকে কি মিন্টুর মতো দেখাচ্ছে? মিলিটারি আবার ভুল করে বসবে না তো? এর মধ্যে তার পাঁচ বছরের ছেলেটা গম্ভীর চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে রায় দেয়, আব্বুকে ছোট মামার মতো দেখাচ্ছে। আব্বু তাহলে মুক্তিবাহিনী। তা-ই না? এ তো ভাবনার কথা (মুক্তিবাহিনীর মতো দেখানো)। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নতুন রূপে সে ভ্যাবাচ্যাকা খায়।
রঙ খাকি নয়, আবার জলপাই রঙও নয়। মাটির মতো রঙটা একটু জ্বলে গেছে, তবে তাতে জেল্লা কমেনি। দেখতে একটু মিলিটারি মিলিটারি লাগছে। মিলিটারির মতো দেখা নিরাপদ নয়। রেইনকোট পরাকে মিলিটারির ছদ্মবেশ বলে গণ্য করলে মিলিটারি তাকে ধরে সোজা পাঠিয়ে দেবে ক্যান্টনমেন্টে। না—।
খামাখা ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে রেইনকোট গায়ে দেয়াটা অপরাধ হবে কেন? মিলিটারির কি আর বিবেচনাবোধ নাই। প্রিন্সিপাল ড. আফাজ আহমদ ঠিকই বলে, শোনেন, মিলিটারি যাদের ধরে, মিছেমিছি ধরে না। সাবভার্সিভ অ্যাকটিভিটিজের সঙ্গে তারা সামহাউ অর আদার ইনভলভড (পাকিস্তানিদের অন্যায়কে সমর্থন)। তা সে তো বাপু এসব থেকে শত হাত দূরে। শালা তার বর্ডার ক্রস করল, ফিরে এসে দেশের ভিতর দমাদম (নির্বিচারে) মিলিটারি মারে। তাতে আর দুলাভাইয়ের দোষটা কোথায় (দুলাভাই শালার এমন কর্মকাণ্ড সমর্থন করে)? এই যে মিলিটারি প্রত্যেকদিন এই ঢাকা শহরের বাজার পোড়ায়, বস্তিতে আগুন লাগিয়ে টপাটপ মানুষ মারে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়,—সে কখনও এসব নিয়ে টু শব্দটি (প্রতিবাদ) করেছে? কলেজের দেয়াল ঘেঁষে প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারের পাশে মিলিটারি ক্যাম্প, ক্লাসটাস সব বন্ধ (যুদ্ধের আতংকে)। ছেলেরা কেউ আসে না। মাস্টারদের হাজিরা দিতে হয় (চাকরি রক্ষার্থে), তাও বহু টিচার গা ঢাকা দিয়েছে (আত্মগোপনে থাকা) কবে থেকে। সে তো রোজ টাইমলি যায়। (যাতে কেউ সন্দেহ না করে) স্টাফরুমে কলিগরা ফিসফিস করে, কোথায় কোন ব্রিজ উড়ে গেল, কোথায় সাত মিলিটারির লাশ পড়েছে ছেলেদের গুলিতে, এই কলেজের কোন কোন ছেলে ফ্রন্টে গেছে (মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে),— কই সে তো এসব আলাপের মধ্যে কখনও থাকে না। এসব কথা (মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা) শুরু হলেই আলগোছে (নীরবে) উঠে সে চলে যায় প্রিন্সিপালের কামরায়। ড. আফাজ আহমদ খ্যাসখ্যাস গলায় হিন্দুস্থান ও মিসক্রিয়েন্টদের আশু ও অবশ্যম্ভাবী পতন সন্বন্ধে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী শোনে। ঐ ঘরে আজকাল সহজে কেউ ঘেঁষে না (মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথা বলায়)। উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদকে প্রিন্সিপাল আজকাল তোয়াজ করে (উর্দু ভাষা জানায়)।
তো ঐ সাজিদ আবার স্যারকে আমল দেয় না। বরং মাঝে মাঝে ‘আপকা তবিয়ত ভালো হ্যায়?’ বলে প্রিন্সিপালের উর্দুচর্চা নিয়ে ঠাট্টা করে। ড. আফাজ আহমদ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন থাকে বলে কিংবা জবাব দেওয়ার জন্য ঠিকঠাক উর্দু বাক্য গঠন করতে পারে না বলে চুপ করে থাকে। আবার কথার জবাব না পেয়ে সাজিদ পাছে রাগ করে এই ভেবে হো হো করে, জি হ্যাঁ আপনার মেহেরবানি। সাজিদ হাসে আমার মেহেরবানি? আমি মেহেরবানি করার কে? বলিয়ে জেনারেল সাহেবকা মেহেরবানি। এরপর কথা বলতে গেলে উর্দু জবাবে আর কুলাবে না বলে প্রিন্সিপাল খামোস মেরে যায়। উর্দুর প্রফেসরকে নিয়ে লোকটা মুসকিলে পড়েছে। কোনটা তার ঠাট্টা আর কোনটা অ্যাপ্রিসিয়েশন বোঝা দিনদিন শক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি মিলিটারির তৎপরতায় অভিভূত প্রিন্সিপালের যুদ্ধ সম্বন্ধে বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে সাজিদ একদিন ‘আপনি মিলিটারি সায়েন্সের উপর ডক্টরেট করে ফেলেন স্যার। মোহাম্মদপুরের এক এলএমএফ ডাক্তার আজকাল হোমিওপ্যাথি শুরু করেছে, অ্যালোপ্যাথি ভি ছাড়ল না। তো মহল্লার মানুষ ওর নাম দিল ডবল ডক্টর। তা আপনি ডবল ডক্টর হয়ে যান।’ বলতে বলতে হো হো করে হাসলে ড. আফাজ আহমদকে তার সিঙ্গেল ডক্টরেট নিয়েই হেঁ হেঁ করতে হয়। কলিগরা পড়ে বিপদে। এই অসময়ে কোন রসিকতায় হাসাটা নিরাপদ তারা ঠিক ঠাওর করতে পারে না।
মিন্টুর ফেলে যাওয়া নাকি রেখে যাওয়া রেইনকোটে ঢোকার পর তার পা শিরশির করছে (দেশপ্রেমের উত্তেজনায়), আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। প্রিন্সিপাল তাকে ডেকে পাঠিয়েছে সেই কখন!
রাস্তায় একটা রিকশা নাই। তা রিকশার পরোয়া সে এখন করছে না (রেইনকোট পরায়)। রেইনকোটের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে যেতে তার কোনো অসুবিধা হবে না। রেইনকোটের ওপর বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। কী মজা, তার গায়ে লাগে না একটি ফোঁটা। টুপির বারান্দা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা সে চেটে দেখে। ঠিক পানসে স্বাদ নয়, টুপির তেজ (মুক্তিযোদ্ধার সাহসের সঞ্চার) কি পানিতেও লাগল নাকি? তাকে কি মিলিটারির মতো দেখাচ্ছে? পাঞ্জাব আর্টিলারি, না বেলুচ রেজিমেন্ট, না কম্যান্ডো ফোর্স, নাকি প্যারা মিলিটারি, নাকি মিলিটারি পুলিশ, —ওদের তো একেক গুষ্টির একেক নাম, একেক সুরত। তার রেইনকোটে তাকে নতুন কোনো বাহিনীর লোক বলে মনে হচ্ছে? হোক। সে বেশ হনহন করে হাঁটে। শেষ হেমন্তের বৃষ্টিতে বেশ শীত শীত ভাব। কিন্তু রেইনকোটের ভিতরে কী সুন্দর ওম। মিন্টুটা এই রেইনকোট রেখে গিয়ে কী ভালোই যে করেছে।
এটা নিতে ছোঁড়াটা যে কবে ফেরে! —আহা, এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটা কোথায় কোন নদীর তীরে ওৎ পেতে বসে রয়েছে। হয়তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক প্লাটুন গ্রাম জ্বালিয়ে শ-দুয়েক মানুষ মেরে লাশগুলোকে ফেলে জিপে করে নিয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত জোয়ান মেয়েদের, মিন্টুর স্টেনগান নিশ্চয় তাক করে রয়েছে ঐ মিলিটারিগুলোর দিকে। ‘মিলিটারি সব ক-টাকে খতম করে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারবে তো? পারবে না? —বড়ো রাস্তায় মিলিটারির লরি দেখে তার চৈতন্যোদয় ঘটে। মিন্টুকে নিয়ে এতক্ষণের ভাবনা আড়াল করতে নিজের চোখ জোড়ায় পুরু করে ভক্তি মাখিয়ে সে তাকিয়ে থাকে লরির দিকে। না বাবা, ওদের সঙ্গে চোখাচোখি না হওয়াই ভালো। লরি চলে যায় উত্তরে, তাকে তাই তাকাতে হয় দক্ষিণের দিকে। কিন্তু লরির বৃষ্টি ভেজা আওয়াজ মুছে ফেলা কি এতই সোজা? মিরপুর ব্রিজ থেকে আসমা কাল রাতে গোলাগুলির আওয়াজ পেয়েছে, লরি কি ওদিকেই গেল? —আরে কোথায় কী হয়, আর আসমা নিত্য শোনে গুলির শব্দ। এসব স্রেফ গুজব। প্রিন্সিপাল বলে, গুজব ছড়ানো আর গুজবে কান দেওয়া সমান অপরাধ। ঐ যে পদ্য আছে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে—। এটা হিন্দুর লেখা বলে কিংবা পরের কথাগুলা মনে নাই বলে প্রিন্সিপাল ঐ পর্যন্ত বলেই থেমে যায়। বরং উর্দুতে বলে, সাজিদ সাহেব, গুজব সব গজব হোতা। সাজিদ সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ লাগায়, গুজব জো থা ওহি সব আজ হজব হো চুকা হ্যায়। প্রিন্সিপাল ভক্তিগদগদ হয়ে ঘর্ঘর গলায় বলে, ইকবালের নাকি দাঁড়ান লিখে নেই। আকবর সাজিদ বাধা দেয়, তওবা ইকবালের কেন হবে। গুজব তো বাংলা কথা হলো। উর্দুমে ইসকো—প্রিন্সিপালের তর সয় না, এটাই ভালো। আপনি বলেন আমি লিখে নেই। অনুপ্রাসটি রাখার খাতিরে সাজিদ গুজবের উর্দু প্রতিশব্দ ব্যবহার করে না। এর সঙ্গে সে আবৃত্তি করে পরের লাইনটি, আমির কে আরমান পুরে হো চুকে হ্যায়।
মানে?
মানে হলো আমিরের ইচ্ছা ফুলফিল হয়েছে। বলতে বলতে সাজিদ আরো চরণ তৈরি করে। হাত পা নেড়ে সে পুরো কবিতাটি আবৃত্তি করে,
গুজব জো থা ওহি সব আজ গজব হো চুকা হ্যায়
আমির কে আরমানপুরে হো চুকে হ্যায়
আল্লা এক, রসুল এক, পাকিস্তান ভি এক,
ইসে জিসকো ইমান নেহি উও নালায়ক।
কুচল দো উস গাদ্দারকো জাঁ ভি মিলে,
পাকিস্তানি ফওজ কভি পিছে না হিলে।
স্টাফ রুমে এসে সাজিদ বলে, প্রিন্সিপাল যদি এটা কোনো মেজর কি কর্নেলকে শোনায় তো তার শাস্তি হবে, মিলিটারি বলবে, তুম মজাক করো রহা? তার কলিগরা চুপ করে থাকে। সাজিদের সামনে এখন কেউ এসব নিয়ে কথা বলতে চায় না। এমনকি তার বন্ধু আলী কবিরও একটু এড়িয়েই চলে। ওদিকে নিজের কামরায় বসে খাস পিয়ন ইসহাকের সামনে প্রিন্সিপাল বাংলা হরফে লেখা এই উর্দু পদ্যটি বারবার আবৃত্তি করে এবং কয়েকদিনের মধ্যে এটিকে স্বরচিত বলে ভাবতে শুরু করে। আবৃত্তি করার সময় সুখে ও ভক্তিতে তার চোখ জোড়া বুজে বুজে আসে।
রেইনকোটে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বাজে ঐ কবিতার ছন্দে এবং হঠাৎ করে তার মনে হয়, প্রিন্সিপাল হয়তো কর্নেলকে ওটাই আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে। গুজবের উর্দু প্রতিশব্দ জানতে চেয়ে জবাব না পেয়ে কর্নেল যদি হঠাৎ করে চটে যায়? উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদ সেনাবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে নানা রকম ঠাট্টা-মশকরা করে। জিওগ্রাফির আব্দুস সাত্তার মৃধা ফিসফিস করে বলে, নিজের মাতৃভাষাকে বর্মের মতো ব্যবহার করে লোকটা নিশ্চয়ই মিসক্রিয়েন্টদের হয়ে কাজ করছে। আবার ইংরেজির খোন্দকার একদিন সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়, ওর কথায় সায় দেবেন না। ও আসলে এইসব বলে আপনাদের অ্যাটিচুডটা জানতে চায়। বেটা নির্ঘাত আর্মির লোক। তা আকবর সাজিদ কয়েকদিন হলো একটু চুপচাপই থাকে। স্টাফ রুমে সে বসলে সবাই উসখুস করে, আবার প্রিন্সিপালের কামরায় যেতেও তার ভালো লাগে না। সে নিজেও সাজিদের কাছ থেকে দূরে দূরেই থাকে। দরকার কী? তবে, রেইনকোটের কল্যাণে গায়ে পানি না লাগিয়ে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আকবর সাজিদের সঙ্গে গোপনে কয়েকটা কথা বলার জন্যে প্রাণটা তার আইঢাই করে। এর মানে কী?
না, এসব হাউস ভালো নয়। সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলা কিংবা উর্দুতে ঠাট্টা মশকরা করার ভাবনা থেকে যতটা মুক্ত থাকা যায়।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসের জন্য তাকে তাকাতে হয় উত্তরেই। মিলিটারি লরির লেজটাও (চিহ্ন) দেখা যাচ্ছে না। আবার তার বাসেরও নামগন্ধ নেই। বাসস্ট্যান্ডে জনপ্রাণি বলতে সে একেবারে একা। রাস্তার পাশে পান-বিড়ি-সিগ্রেটের ছোট দোকানটার ঝাঁপ একটুখানি তুলে দোকানদারও তাকিয়ে রয়েছে উত্তরেই, ওদিকে কি কোনো গোলমাল হলো নাকি (এক দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে থাকায়)? দোকানদার ছেলেটা একটু বাচাল টাইপের। বাসস্ট্যান্ডে তাকে দেখলেই ছোঁড়াটা বিড়বিড় করে, কাল শোনেন নাই? মিরপুরের বিল দিয়া দুই নৌকা বোঝাই কইরা আইছিল। একটা জিপ উড়ইয়া দিছে, কমপক্ষে পাঁচটা খানসেনা খতম। বিবিসি কইছে, রংপুর-দিনাজপুরের হাফের বেশি জায়গা স্বাধীন।
কাল চরমপত্র শুনেছেন? এর সামনে সে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। এসব গুজব শোনার সময়ও সে যদি ধরা পড়ে তো! গুজব জো থা ওহি সব আজ গজব হো চুকা হ্যায়। প্রিন্সিপাল বলে গুজবই হলো বাঙ্গালির কাল। গুজবের আকর্ষণ ভারি তীব্র, গুজব মানেই সুস্বাদু। এই যে এখন বৃষ্টির আড়াল পেয়েও হতে পারে, কিংবা রেইনকোটের কল্যাণে বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার স্বস্তির ফলেও হতে পারে, সে এগিয়ে গেল দোকানদারের দিকে। একটা গুজব শোনার হাউশ করে সে জিজ্ঞেস করে, ‘বাস আসেনি কতক্ষণ’?
‘আর বাস! বাস আসবে কৈ থাইকা?’ বলে ছেলেটা তাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে মুখ গুঁজে দিল দোকানের ভেতরে। তার ভাবনা হয়, বাস ডিপোতে কোনো হামলা হয়েছে নাকি? আসমার শোনা ঐ গোলাগুলির শব্দ কি আসছিল বাস ডিপো থেকে? মিলিটারি লরি কি ওদিকেই গেল? বাসডিপোর পেছনে একটা বস্তি আছে, সেখানে মিলিটারি কি আগুন দিতে গেল? জায়গাটা খুব একটা দূরে তো নয়, সে একবার ঘুরেও তো আসতে পারে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। যাবে নাকি একবার? —তার যাওয়া হলো না।
এর মধ্যেই ছিপছিপে বৃষ্টিতে লালচে আভা তুলে এসে পড়ল লাল রঙের স্টেট বাস। বাসে যাত্রী কম। না, না, কন্ডাক্টররা সবসময় যেমন খালি গাড়ি বলে চ্যাঁচায় (লোক থাকলেও খালি বলে), সেরকম নয়। সত্যি সত্যি অর্ধেকের বেশি সিট খালি। সে বাসে উঠলে তার রেইনকোটের পানি পড়তে লাগল বাসের ভিজে মেঝেতে। এজন্য তার একটু খারাপ কথা, অন্তত টিটকিরি শোনার কথা। কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলে না।
বাসে এত খালি সিট। বাঁশবনে ডোম কানা—প্রবাদটি মনে না পড়লেও ঠোঁটে তার একটু হাসি বিছানো থাকে। এই নীরব কিন্তু স্পষ্ট হাসির কারণ কি এই যে, তার রেইনকোটের পানিতে বাস সয়লাব হয়ে গেলেও (লোকেরা তাকে পাকিস্তানি মনে করে ভয় করছে) কেউ টুঁ শব্দটি করছে না? তার পোশাক কি সবাইকে ঘাবড়ে দিল নাকি?
খালি রাস্তা পেয়ে বাস চলে খুব জোরে। কিন্তু তার আসনটি সে নির্বাচন করতে পারছে না (অনেক আসন থাকায়)। টলতে টলতে একবার এই সিট দেখে, পছন্দ হয় না বলে ফের ঐ সিটের দিকে যায়। এমন সময় পেছনের দিক থেকে দুজন যাত্রী উঠে পড়ে তাড়াহুড়া করে। রাখো রাখো বলতে বলতে ঝুঁকি নিয়ে তারা নেমে পড়ে চলন্ত বাস থেকে। সে তাদের দিকে তাকায় এবং বুঝতে পারে, এরা পালালো ঠিক তাকে দেখেই। লোক দুটো নিশ্চয় ক্রিমিনাল। একটা চোর আর একটা পকেটমার। নামবার মুহূর্তে দুটোর মধ্যে সর্দার টাইপেরটা তার দিকে পেছন ফিরে তাকাল। সেই চোখভরা ভয়, কেবল ভয়।
জুৎসই (উপযুক্ত) সিট বেছে নিয়ে সে ধপাস করে বসতেই ফোমে ফস করে আওয়াজ হয় এবং তাইতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সামনের সিটে বসা তিনজন যাত্রী। তা এদেরও সে ঠিক চোর অথবা পকেটমার বলে ঠিক শনাক্ত করে ফেলে। ডাকাতও হতে পারে। কিংবা মিলিটারি কোনো বস্তিতে আগুন লাগিয়ে চলে এলে এরা ছোটে সেখানে লুটপাট করতে। অথবা মিলিটারি কোথাও লুটপাট করলে এরা গিয়ে উচ্ছিষ্ট কুড়ায়। তিনটেই পরের স্টপেজে নামার জন্যে অনেক আগেই ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায় এবং বাস থামার সঙ্গে-সঙ্গে নেমে পড়ে ঝটপট পায়ে। তিনটি ক্রিমিনালের একটাও তার দিকে ফিরেও তাকায় না। তার মানে তাকে বেশ ভয় পেয়েছে বলেই তার সঙ্গে চোখাচোখি এড়াতে এদের এত কসরত।
যাক, মিন্টুর রেইনকোটে তার কাজ হচ্ছে। চোর ছ্যাঁচোড় পকেটমাররা কেটে পড়ছে। ভালো মানুষেরা থাক। সে বেশ সৎসঙ্গে চলে যাবে কলেজ পর্যন্ত।
আসাদ গেট বাস স্টপেজে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বেশ কয়েকজন মানুষ। ছাতা হাতে কেউ-কেউ নিজ-নিজ ছাতার নিচে আবার ছাতা ছাড়া অনেকেই অন্যের ছাতার নিচে মাথার অন্তত খানিকটা পেতে দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট থেকে আত্মরক্ষা করতে শরীরগুলোকে আঁকাবাঁকা করছিল। বাস থামলে সে দেখল, একে একে নয়জন প্যাসেঞ্জার বাসে উঠল। সে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাইকে দেখে। তো তার দিকে তাকিয়ে নয়জনের তিনজন আরে রাখো-রাখো এবং একজন রোখো-রোখো বলতে বলতে নেমে পড়ল ধড়ফড় করে। শেষের জন বোধ হয় এমনই অর্ডিনারি চোর, ছিঁচকে চোর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর প্রথম তিনটে কোথাও সুন্দরী মেয়েমানুষ দেখলে মিলিটারিকে খবর দেয় (অন্যদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা) কিংবা মিলিটারির কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে মহল্লায়-মহল্লায় ঘোরে আর সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে পৌঁছে দেয় মিলিটারি ক্যাম্পে। এগুলো হলো রাজাকার।
ফের নতুন করে অপরাধীমুক্ত বাসে যেতে এখন ভালো লাগছে। জানালার বাইরে বৃষ্টির আঁশ উড়ছে। ঠান্ডা হাওয়ায়, গাছপালা ও লোকজন ও দোকানপাট ও বাড়িঘরের ওপর ট্রান্সপারেন্ট আবরণ দেখে তার এক্সট্রা ভালো লাগে।
সমস্ত ভালো লাগাটা চিড় খায় বাস হঠাৎ করে ব্রেক কষলে। তখন তাকে তাকাতে হয় বাঁয়ে, চোখে পড়ে নির্মীয়মাণ মসজিদের ছাদের দিকে। দরজা থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে তার মুখে এবং নাকের ভিতর দিয়ে সেই হাওয়া ঢুকে পড়ে বুকে, সেখানে ধাক্কা লাগে; ক্রাক-ডাউনের রাত (২৫ মার্চের রাত) কেটে ভোর হলে মিলিটারির গুলিতে এই মসজিদের ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল মোয়াজ্জিন সাহেব। ঠান্ডা হাওয়ার ধাক্কা রেইনকোটের তাপে এতটাই গরম (আতংকে) হয়ে ওঠে যে, মনে হয় ভেতরে বুঝি আগুন ধরে গেল। মসজিদের উল্টোদিকের বাড়িতে তিনতলায় থাকত তখন তারা। রাতভর ট্যাঙ্কের হুঙ্কার আর মেশিনগান আর স্টেনগানের ঘেউঘেউ (কটাক্ষ করা) আর মানুষের কাতরানিতে তাদের কারো ঘুম হয়নি সে রাতে। ছেলমেয়েদের নিয়ে ছেলেমেয়ের মায়ের সঙ্গে সে শুয়েছিল খাটের নিচে (মিলিটারিদের ভয়ে)। ভোরবেলা মিলিটারি মানুষ মারায় একটু বিরতি দিলে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ে এবং বন্ধ জানালার পর্দা একটু তুলে সে রাস্তা দেখতে থাকে। রাস্তার ওপারে মসজিদের ছাদে মোয়াজ্জিন সাহেব দাঁড়িয়ে ছিল আজান দিতে। সাধারণত জুমার নামাজটা সে নিয়মিত পড়ে। তবে সেই ভোরে তার আজান শুনতে ইচ্ছা করছিল খুব (ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় মানুষ ধর্মের কথা বেশি মনে করে)। মোয়াজ্জিনের আজান দেওয়াটা সম্পূর্ণ দেখবে বলে সে জানালার ধার থেকে সরে না। সারা এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নষ্ট, মসজিদের মাইক্রোফোন অকেজো। মোয়াজ্জিন সাহেব গমগমে (গম্ভীর গলা) গলায় যতটা পারে জোর দিয়ে বলে উঠল আল্লাহু আকবার। দ্বিতীয়বার আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করার সুযোগ তার আর মেলেনি, এর আগেই সম্পূর্ণ অন্যরকম ধ্বনি (মৃত্যুর গোঙানি) করে লোকটা পড়ে যায় রাস্তার ওপর। সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল না। আজ বৃষ্টির সকালে মিলিটারি কি ঐ দৃশ্যের পুনর্ঘটনের পাঁয়তারা করছে? এখন তো কোনো নামাজের ওয়াক্ত নেই, আজান দেওয়াবে কী করে? এরা বোধহয় যেকোনো সময়কেই নামাজের ওয়াক্ত ঘোষণা করে নতুন হুকুম জারি করেছে।
মিলিটারি এখন যাবতীয় গাড়ি থামাচ্ছে। গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের দাঁড় করিয়ে দেয় রাস্তার উপর। আরেকদল মিলিটারি স্টেনগান তাক করিয়ে রেখেছে এই মানুষের সারির উপর। অন্য একটি দল ফের ঐ সব লোকের জামাকাপড় ও শরীরের গোপন জায়গাগুলো তল্লাশি করে। মিলিটারি যাদের পছন্দ করছে (সন্দেহ করছে) তাদের ঠেলে দিচ্ছে পেছনে দাঁড়ানো একটা লরির দিকে। তাদের বাসটিতে এসে উঠল লম্বা ও খুব ফর্সা এক মিলিটারি।
এখন বাসের ভিতর কোনো আওয়াজ নেই। যাত্রীদের বুকের টিপটিপ শব্দ এই নীরবতার সুযোগে বাড়ে এবং এটাই তার মাথায় বাজে দ্রাম-দ্রাম করে। বারান্দাওয়ালা টুপির নিচে শব্দের ঘষায় ঘষায় আগুন জ্বলে এবং তার হলকা (গরম বাতাসের ঝাপটা) বেরোয় তার চোখ দিয়ে। তবে একটু নড়ে বসলে মাথা ও বুকের ধ্বনি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এসবকে পরোয়া না করে সে সরাসরি তাকাল মিলিটারির মুখের দিকে। মিলিটারির চোখ ছুঁচালো হয়ে আসে এবং ছুঁচালো চোখের মণি কাঁটার মতো বিঁধে যায় তার মুখে। সেও তার চোখের ভোঁতা কিন্তু গরম চাউনিটাকে স্থির করে আলগোছে বিছিয়ে দেয় মিলিটারির খাড়া নাকে, ছুঁচালো চোখে, গোঁফের নিচে, নাক, গোঁফ ও চোখের আশেপাশের ও নিচের লালচে চামড়ায়। এতে কাজ হলো। মিলিটারির চোখা চোখ সরে যায় তার মুখ থেকে, নেমে পড়ে তার রেইনকোটের উপর। মনে হয় রেইনকোটের পানির ফোঁটাগুলো লোকটা গুণে গুণে দেখছে।
ভেতরের তাপে এই সব পানির ফোঁটা দেখে মিলিটারির এত থ বনে যাবার কী হলো? লোকটা কি এগুলোতে রক্তের চিহ্ন দেখে? রেইনকোটের বৃষ্টির ফোঁটা গোণাগুণতি সেরে মিলিটারি হঠাৎ বলে ‘আগে বাড়ো’। বাস হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে কয়েক পা লাফিয়ে আগে বাড়ে এবং যাত্রীদের স্বস্তির নিঃশ্বাসের ধাক্কায় অতিরিক্ত বেগে ছুটে পার হয়ে যায় ঢাকা কলেজের গেট। নিউ মার্কেটের সামনে এসে পড়লে সে উঠে দাঁড়ায় এবং হুকুম করে, রাখেন নামবো। বাস একটু স্লো হলে তার রেইনকোটের জমানো পানি গড়িয়ে পড়তে দিয়ে অপরাধীমুক্ত বাস থেকে নামতে নামতে সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট বাঁকায় (ব্যঙ্গাত্মক হাসি), এতে তার সামনের সারির দাঁতও বেরিয়ে পড়ে। যারা দেখছে তারা তার সেই ভঙ্গিটিকে ঠিক হাসি বলে শনাক্ত করতে পেরেছিল বলে তার ধারণা হয়।
প্রিন্সিপালের কামরায় প্রিন্সিপালের সিংহাসন মার্কা চেয়ারে বসে আছেন জাঁদরেল টাইপের এক মিলিটারি পান্ডা। তার ভারিক্কি মুখ থেকে অনুমান করা যায় পান্ডাটি কর্নেল কিংবা মেজর জেনারেল, অথবা মেজর বা ব্রিগেডিয়ার। তাকে দেখে (নূরুল হুদাকে দেখে) প্রিন্সিপালের কালো মুখ বেগুনি হয় (মিলিটারির সামনে জবাবদিহিতার ভয়ে। যেহেতু সে প্রিন্সিপ্যালের অধীন কর্মচারী)। ড. আফাজ আহমদ এম এস সি, পিএইচ ডি, ই পি এস ই এস (স্বাভাবিক) হওয়ার চেষ্টা করতে করতে স্যার বলে, হি ইজ প্রফেসর হুদা।
কিন্তু ড. আফাজ আহমদ এম এস সি, পিএইচ ডি নিজের ভুল সংশোধন (লেকচারারকে প্রফেসর বলা) না করে পারেন না, সরি হি ইজ নট এ প্রফেসর। এ লেকচারার ইন কেমিস্ট্রি।
শাট আপ।
এবার প্রিন্সিপাল থামে।
তাকে এবং আবদুস সাত্তার মৃধাকে নিয়ে মিলিটারি জিপে তোলার আগে জাঁদরেল কর্নেল না ব্রিগেডিয়ার প্রিন্সিপালকে কড়া গলায় বলে, সেনাবহিনীকে নিয়ে মজা করে শায়েরি করা (সেনাদের ব্যঙ্গ করে কবিতা লেখা) খুব বড়ো অপরাধ। এবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তবে কড়া ওয়াচে (নজরদারি) রাখা হবে। উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদের দোহাই (কবিতার ব্যাপারে সাজিদকে দায়ী করা) পড়ে প্রিন্সিপালের সুবিধা হয় না। নুরুল উদ্বিগ্ন হয়, সাজিদ সাহেব যদি পালিয়ে না থাকে তো তার কপালে যে কী আছে তা জানে এক আল্লা আর জানে এই মিলিটারি।
তাদের দুজনের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, জিপ চলছিল এঁকেবেঁকে। মস্ত উঁচু একটা ঘরে (মোট তিনটি ঘরে পাঠানো হয়) তাদের এনে ফেলা হলো। চোখ খুলে দিলে সে আবদুস সাত্তার মৃধাকে দেখতে পায় না। জায়গাটাও একেবারে অচেনা। একটা ডেক-চেয়ারে সে যে কতক্ষণ বসে থাকল তার কোনো হিসাব নেই। তার সামনে একটা চেয়ারে এসে বসল এক মিলিটারি। তাকে ইংরেজিতে নানান প্রশ্ন করে, সে জবাব দেয়। লোকটা চলে গেলে তাকে অন্য ঘরে নিয়ে ফের অন্য একটা লোক এসে তাকে প্রশ্ন করে এবং সে জবাব দেয়। প্রশ্নগুলো প্রায় একই রকম এবং তার উত্তরেরও হেরফের হয় না। যেমন, কিছুদিন আগে তাদের কলেজে কয়েকটা লোহার আলমারি কেনা হয়েছে। ওগুলো বয়ে নিয়ে এসেছিল কারা?
সে জবাব দেয়, ঠিক। অফিসের জন্য তিনটে, বোটানি হিস্ট্রি জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের জন্য দুটো করে এবং ইংরেজির জন্য একটা, সর্বমোট দশটি আলমারি কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে।
এত কথা বলার দরকার নেই তার। ঐ আলমারি নিয়ে আসা হয় কয়েকটা ঠেলাগাড়ি করে। ঠেলাগাড়িওয়ালাদের সে তো ভালো করেই চেনে।
নুরুল হুদা জবাব দেয়, তাদের সে চিনবে কোত্থেকে? তারা হলো কুলি, সে একজন লেকচারার।তাহলে সে তাদের সঙ্গে এত কথা বলছিল কেন?
প্রিন্সিপালের আদেশে সে আলমারিগুলোর স্টিলের পাতের ঘনত্ব, দেরাজের (ড্রয়ার) সংখ্যা ও আকার, তালাচাবির মান, রঙের মান প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখছিল, তার দায়িত্ব ছিল—।
মিলিটারি শান্ত গলায় তথ্য সরবরাহ করার (নূরুল হুদা থেকে কথা বের করতে) ভঙ্গিতে বলে, মিসক্রিয়েন্টরা কলেজে ঢুকেছিল কুলির বেশে। এটা তার চেয়ে আর ভালো জানে কে? তারা আজ ধরা পড়ে নুরুল হুদার নাম বলেছে। তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়মিত, সে গ্যাঙের (গোপন ষড়যন্ত্রকারী দল) একজন নিয়মিত সদস্য।
‘আমার নাম? সত্যি বলেছে? আমার নাম বলেছে?’ নুরুল হুদার হঠাৎ চিৎকারে মিলিটারি বিরক্ত হয় না, বরং উৎসাহ পায় (অপরাধী চিহ্নিত করতে পারায়)। উৎসাহিত মিলিটারি ফের বলে, কুলিরা ছিল ছদ্মবেশী মিসক্রিয়েন্ট। তারা কলেজের টিচারদের মধ্যে নুরুল হুদার নামই বলেছে।
নুরুল হুদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে (কুলিরা তার নাম বলায়)। তারা কি তাকে চেনে? কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে আলমারি সাজিয়ে রাখার সময় এক কুলি দাঁড়িয়েছিল তার গাঁ ঘেঁষে। তখন তো ঘোরতর বর্ষাকাল, ঢাকায় এবার বৃষ্টিও হয়েছে খুব। রাতদিন এই বৃষ্টি নিয়ে সে কী যেন বলেছিল, তাতে কুলিটা বিড়বিড় করে ওঠে, বর্ষাকালেই তো জুৎ।’ (আক্রমণের উপযুক্ত সময়) কথাটা দু’বার বলেছিল। এর মানে কী? স্টাফরুমে কে একজন একদিন না দু’দিন ফিসফিস করছিল, বাংলার বর্ষা তো শালারা জানে না (বর্ষার ভয়াবহতা)। রাশিয়ায় ছিল জেনারেল উইনটার, আমাদের জেনারেল মনসুন (প্রতিকূল আবহাওয়া)।—ঐ ছদ্মবেশী ছেলেটা কি এই কথাই বুঝিয়েছিল? তার ওপর তাদের এত আস্থা?—উৎসাহে (দেশের জন্য অবদান রাখায়) নুরুল হুদা এদিক-ওদিক তাকায়। তার মৌনতা মিলিটারিকে আরেকটু নিশ্চিত করে (মৌনতা সম্মতির লক্ষণ)।
কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ পর সে বুঝতে পারে না, মিলিটারি তাকে ফের একই প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে প্রবল বেগে দুটো ঘুসি লাগায় তার মুখে। প্রথম ঘুসিতে সে কাত হয়, দ্বিতীয় ঘুসিতে পড়ে যায় মেঝেতে। মেঝে থেকে তুলে তাকে মিলিটারি ফের জিজ্ঞেস করে, ‘ওদের আস্তানা (গেরিলাদের আস্তানা) কোথায় সে খবর তার তো ভালোভাবেই জানা আছে।’ সে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ!’
ঐ ঠিকানাটা বলে দিলেই তাকে সসম্মানে ছেড়ে দেয়া হবে এই নিশ্চয়তা দিয়ে তাকে পাউরুটি আর দুধ খাওয়ানো হয়। তাকে ভাবতে সময় (মানসিক নির্যাতন) দিয়ে মিলিটারি চলে যায়। কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ সে জানে না, মিলিটারি ফিরে এসে ফের বলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তো তার জানা আছে। সে ফের জবাব দেয় হ্যাঁ! কিন্তু পরের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মিলিটারি তাকে নিয়ে যায় অন্য একটি ঘরে। তার বেঁটেখাটো শরীরটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ছাদে-লাগানো একটা আংটার সঙ্গে। তার পাছায় চাবুকের বাড়ি পড়ে সপাৎ সপাৎ করে। তবে বাড়িগুলো বিরতিহীন পড়তে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যে সেগুলো নুরুল হুদার কাছে মনে হয় স্রেফ উৎপাত বলে (আঘাত উপলব্ধি না করা)। মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর। রেইনকোটটা এরা খুলে ফেলেছে, কোথায় রাখল কে জানে। কিন্তু তার ওম (মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোটের অনুভূতি) তার শরীরে এখনো লেগেই রয়েছে। বৃষ্টির মতো চাবুকের বাড়ি পড়ে তার রেইনকোটের মতো চামড়ায় আর সে অবিরাম বলেই চলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তার জানা আছে। শুধু তার শালার নয়, তার ঠিকানা জানার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই (শালা তার কাছেই থাকে), সে ছদ্মবেশী কুলিদের আস্তানাও চেনে। তারাও তাকে চেনে এবং তার উপর তাদের আস্থাও কম নয়। তাদের সঙ্গে তার আঁতাতের অভিযোগ ও তাদের সঙ্গে তার আঁতাত রাখার উত্তেজনায় (দেশের জন্য অবদান রাখার উত্তেজনায়) নুরুল হুদার ঝুলন্ত শরীর এতটাই কাঁপে যে চাবুকের বাড়ির দিকে তার আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না (সাহস, উষ্ণতা ও দেশপ্রেমবোধের উজ্জীবিত হওয়ায়)।
- রেইনকোট গল্পটি ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। এটি লেখকের ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৭) গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পের পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র-১ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ের ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে গল্পটি রচিত। মিন্টুর রেইনকোট পরে ভীতু নুরুল হুদার মনে যে দেশপ্রেমবোধ ও সাহস ফুটে উঠেছে তা তুলে ধরা হয়েছে।
- গল্পের চরিত্র-
**নুরুল হুদা- প্রকৃতিগতভাবে ভীতু, প্রিন্সিপ্যালকে তোয়াজ করে, পরোক্ষ মুক্তিযোদ্ধা, গল্পের কথক, রসায়নের লেকচারার
**মিন্টু- নুরুল হুদার শালা। ২৩ জুন বাসা ত্যাগ করে। গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করে। তার জন্য নুরুল হুদা এক্সট্রা ভয়ে থাকে।
**ইসহাক- রাজাকার শ্রেণির প্রতিনিধি। এপ্রিলের শুরু থেকে বাংলা বলা ছেড়ে দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যালের পিওন, ভাঙাচোরা গাল। তাকে এখন কর্নেল বলা যায়। মিলিটারি আসার পর তাকে দেখে সবাই তটস্থ।
**ড. আফাজ- এপ্রিলের মাঝামাঝি শহিদ মিনার ভাঙার পরামর্শ দেয়। পাকিস্তানের জন্য দিনরাত দোয়া পড়ে। তার মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পতনের কথা শোনা যায়। পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রতিনিধি।
**আব্দুস সাত্তার মৃধা- জিওগ্রাফির প্রফেসর। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের কারণে নুরুল হুদার সাথে তাকেও সন্দেহ করা হয়।
**আকবর সাজিদ- উর্দুর প্রফেসর। প্রিন্সিপ্যাল তাকে তোয়াজ করে। সেনাবাহিনীকে কবিতা লেখায় প্রিন্সিপ্যাল তাকে দায়ী করে।
**আসমা- নুরুল হুদার স্ত্রী। গল্পের মমতাময়ী চরিত্র।
**গোলগাল মুখের ভাবি- মিন্টুর সন্ধান করে।
**ওয়ার্কশপ মালিকের শ্বশুর- সর্দারগোছের রাজাকার। সপ্তাহে দুই-তিনবার বিভিন্ন জিনিস পাঠায়। - আরও পড়ুন- মানব কল্যাণ প্রবন্ধের বিশ্লেষণ
GOOD
ধন্যবাদ
কি চমৎকার ব্যাখ্যা 😍
বই থেকে দুইবার পরার পরেও যেটার আগামাথা কিছুই বুঝিনি, এখানে একবার পড়েই সবটা ক্লিয়ার
ধন্যবাদ আপনাকে