পাল বংশের শাসন-Pala Dynasty

পাল সাম্রাজ্যের ইতিবৃত্ত

পাল রাজত্ব
                     পাল রাজত্ব
  • মাৎসান্যায় :  শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত গৌড়কে অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় কাটাতে হয়। একদিকে বিদেশি আক্রমণ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ-বিদ্রোহ। এমন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির সময়কে সংস্কৃতে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলা হয়। পুকুরের বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে সেভাবে শক্তিশালী রাজা দুর্বল রাজাদের এই সময়ে গ্রাস করে ফেলত এজন্য একে মাৎস্যন্যায় বলা হয়। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক বৌদ্ধগ্রন্থে এই অরাজক অবস্থাকে ‘গৌড়তন্ত্র’ বলা হয়েছে।
    এই অরাজক পরিস্থিতি দূর করার জন্য প্রধান কর্মচারীগণ সমবেত হয়ে গোপালকে রাজা নির্বাচন করে। তখন থেকেই পাল বংশের সূচনা ঘটে। বরেন্দ্রভূমি ছিল পালরাজাদের পিতৃভূমি। বাংলার দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ পাল বংশ। পাল রাজাদের চারশ বছরব্যাপী রাজত্বকাল বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ।

    পাল বংশের শাসকদের তালিকা
    পাল বংশের শাসকগণ

     পাল রাজাদের ক্ষমতারোহণ

  • গোপালের ক্ষমতারোহণ : গোপাল ছিলেন বাংলার প্রথম নির্বাচিত রাজা। তিনি ‘পরম সৌগত’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তিব্বতীয় পণ্ডিত লামা তারানাথের মতে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিহার প্রদেশে ওদন্তপুরি মহাবিহারের ভিত্তি স্থাপন করেন যা নালন্দা মহাবিহার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে অবস্থিত। একে প্রাচীন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাবিদ্যালয় বলে চিহ্নিত করা হয়।

    পাল শাসকদের অবদান
    পাল শাসকদের অবদান
  • ধর্মপাল : গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে ধর্মপাল একজন বিখ্যাত রাজা। ধর্মপাল ক্ষমতায় আসার পর ‘আর্যাবর্তের’ (হিমালয় থেকে দক্ষিণের নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল) দিকে দৃষ্টি দেন।

    কনৌজের যুদ্ধ
    কনৌজের যুদ্ধ

    **কনৌজের যুদ্ধ (পাল-প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট) : এই সময় উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপন নিয়ে রাষ্ট্রকূটপ্রতিহার রাজবংশের মধ্যে লড়াই চলছিল। ধর্মপালও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই দীর্ঘস্থায়ী ত্রিশক্তির সংঘর্ষ (the Kannauj Triangle) শুরু হয়।
    প্রতিহারদের আক্রমণে ধর্মপাল পরাজিত হন। পরবর্তীতে প্রতিহাররা রাষ্ট্রকূটদের নিকট পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রকূটরা দাক্ষিণাত্যে ফিরে যায়। এই সুযোগে ধর্মপাল কনৌজের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে ধর্মপাল চক্রায়ুধকে বসায়।

    অন্যদিকে নাগভট্ট প্রতিহারের সিংহাসনে আরোহণ করলে পুনরায় পাল-প্রতিহার সংঘর্ষ শুরু হয়। নাগভট্ট প্রথমে চক্রায়ুধকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন। অতঃপর মুঙ্গেরে এক যুদ্ধে ধর্মপালকেও পরাজিত করেন। ঠিক একই সময় রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতে উপস্থিত হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। নাগভট্ট রাষ্ট্রকূটরাজের নিকট পরাজিত হয়ে স্বরাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ তৃতীয় গোবিন্দের কাছে নতি স্বীকার করে মিত্রতা লাভ করেন। অতঃপর রাষ্ট্রকূট দাক্ষিণাত্যে চলে গেলে ধর্মপাল উত্তর ভারতের কর্তৃত্ব ফিরে পান।

    আর্যাবর্ত দখলের পর তাঁর জন্য এক বিশাল রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করা হয় যেখানে তাঁকে পরমেশ্বর, পরমভট্টারকমহরাজাধিরাজ উপাধি দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি বিক্রমশীল উপাধি নিয়েছিলেন। এজন্য মগধে ধর্মপাল নির্মিত বৌদ্ধমঠটি ‘বিক্রমশীল বিহার’ নামে পরিচিতি পায়।
    (তবে ধর্মপালের মৃত্যুর পর কনৌজ নিয়ে সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট পুনরায় কনৌজের দখল নেন। এমনকি তিনি কনৌজকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। এবার রাষ্ট্রকূটরা প্রতিহারদের প্রতিহত করতে আসেনি। কারণ রাষ্ট্রকূটরা তখন নিজেরাই অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যস্ত ছিল। দেবপাল এই সময় কনৌজের দিকে আর নজর দেননি।)

    সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ধর্মপাল এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হলেও বঙ্গবিহার ছাড়া আর কোথাও তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। পরাজিত রাজাগণ তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে স্ব স্ব রাজ্য শাসন করতেন। তিনি ছিলেন পালবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। ধর্মপালই বঙ্গদেশকে ভারতীয় ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে স্থান দান করেন। তিনি সোমপুর বিহারসহ বিভিন্ন বিহার নির্মাণ করেন।

  • দেবপাল : ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল রাজা হন। তিনি পিতার ন্যায় যোগ্য, বিচক্ষণ ও শক্তিমান সম্রাট ছিলেন। কেদার মিশ্র ছিলেন দেবপালের মন্ত্রী। প্রায় ৪০ বছর দেবপাল শাসন করেন। তিনি মুঙ্গেরে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর খ্যাতি কেবল ভারতেই নয়, ভারতের বাইরে সুবর্ণদ্বীপ অর্থাৎ সুমাত্রা, যবদ্বীপ, মালয় দ্বীপ পর্যন্ত তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জাভা ও সুমাত্রার শৈলেন্দ্র বংশীয় রাজা দেব নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য দেবপালের কাছে পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষা করলে তিনি তা মঞ্জুর করেন। আরব পর্যটক সুলেমান দেবপালের সময় বাংলায় আসেন এবং পাল বংশকে তিনি ‘রুমি’ বলে অভিহিত করেন। এ সময়ে তাঁর খ্যাতি ভারতবর্ষের বাইরেও বিস্তৃত হয়। দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হয়। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের আমলে এই সাম্রাজ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। এমনকি নিজ রাজ্যেও পালরাজাগণ কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন।

  • প্রথম মহীপাল : প্রথম মহীপাল হৃত পাল সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তাঁকে পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। কম্বোজ জাতির বিতাড়ন তাঁর রাজত্বকালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এর মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে অভিযান পরিচালনা করেন। তবে এ সময় চোলরাজ রাজেন্দ্র চোল গঙ্গাজলের জন্য গৌড় আক্রমণ করে। প্রথম মহীপাল রণাঙ্গন ত্যাগ করেন। ফলে বাংলার জনগণের উপর চোলরাজ কর্তৃক দুর্দশা বেড়ে যায়। তারপরও মহীপাল রাজেন্দ্র চোল ও গাঙ্গেয় দেবের মতো প্রবল শক্তিমান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখেন।
  • মহীপাল কীভাবে হৃত সাম্রাজ্য দখল করে?

  • তাঁর রাজত্বকালে আর্যাবর্তের পশ্চিমভাগে মুসলিম আক্রমণের সূচনা হয়। সুলতান মাহমুদ এ সময় উপর্যপুরি অভিযানের মাধ্যমে ভারতরাজদের তটস্থ করে তোলেন। সমবেতভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আর্যাবর্তের রাজারা ঐক্যবদ্ধ হলেও তিনি এই জোটে সামিল হননি। তিনি তখন হৃত পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারেই ব্যস্ত ছিলেন এবং হৃত সাম্রাজ্যের অনেকাংশ দখল করে নেন।
    তাঁর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের অবনতি পুনরায় শুরু হয়। একমাত্র রামপাল ছাড়া আর কেউ উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেন নি। তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলে বাংলায় কয়েকটি স্বাধীন রাজবংশের সূচনা হয়। যেমন- বর্ধমানে ঈশ্বরঘোষ একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরেকুমিল্লায় দুটি স্বাধীন রাজ্যের কথা জানা যায়। বিক্রমপুরে প্রথমে চন্দ্রবংশ ও পরে বর্মবংশ স্বাধীনভাবে রাজত্ব করে।
  • দ্বিতীয় মহীপাল : আনুমানিক ১০৭০ সালে দ্বিতীয় মহীপাল সিংহাসনে বসেন। বরেন্দ্রে সামন্ত বিদ্রোহ মহীপালের রাজত্বকালে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পালরাজাদের দুর্বলতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে বরেন্দ্রে সামন্তরা প্রকাশ্যে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কৈবর্ত নায়ক দিব্য ছিলেন এ বিদ্রোহের নেতা। মহীপাল বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বিদ্রোহীরা বরেন্দ্র দখল করে সেখানে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে। কৈবর্ত বিদ্রোহকে ফরাসি বিপ্লবের সাথে তুলনা দেওয়া হয়।

    দিব্য উত্তর বাংলায় স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেও শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেন নি। তবে বিভিন্ন রাজার আক্রমণ সত্ত্বেও তিনি স্বীয় রাজ্য অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিলেন। জাতবর্মা, রামপাল দিব্যকে আক্রমণ করলেও তাঁকে পরাজিত করতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পরও কিছুদিন দিব্যের উত্তরাধিকারদের শাসন অক্ষুণ্ন ছিল।
  • কৈবর্ত বিদ্রোহ : পাল রাজারা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধধর্ম অনুসারে জীবহত্যা মহাপাপ। অন্যদিকে কৈবর্তরা ছিল মূলত কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়। দ্বিতীয় মহীপালের আমলে মাছ-মাংস খাওয়ার কারণে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়াও পাল বংশের উত্তরাধিকার নিয়েও ভ্রাতৃকলহ দেখা দেয়। ফলে রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় মহীপাল তাঁর দুই ভাই রামপাল ও শূরপালকে বন্দি করে। যদিও অনেক সামন্তরাজা তাদের সমর্থন দিচ্ছিল।
    এই ধরনের অরাজকতা থেকে রক্ষা পেতে আনুমানিক ১০৮০ সালে পাল কর্মচারী দিব্যের নেতৃত্বে কৈবর্ত জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা পাল রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি বরেন্দ্র বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। মহীপাল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।  বরেন্দ্রে দিব্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
    মহীপালের মৃত্যুর পর শূরপাল ও রামপাল কারামুক্তি লাভ করেন। এই সময় দ্বিতীয় শূরপাল ক্ষমতায় আসেন। তাঁর মৃত্যুর পর রামপাল ক্ষমতায় আসেন। তখনও বরেন্দ্র অঞ্চলে কৈবর্ত শাসন বিদ্যমান ছিল।
    রামপাল প্রথমদিকে বরেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর বেশ কিছু সময় পর তিনি অভিযানে নামেন। এই সময় দিব্য তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে রামপাল রাজকীয় সম্মান ভুলে নিজ শক্তি বৃদ্ধির জন্য সামন্তদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। প্রচুর সম্পদ ও ভূমি দিয়ে তিনি রাঢ়, অঙ্গ, অটবি প্রভৃতি প্রদেশের সামন্তদের সহায়তা লাভ করতে সমর্থ হন। বরেন্দ্রের এই বিদ্রোহ মগধেও ছড়িয়ে পড়লে রামপাল বিদ্রোহী নেতা দেবরক্ষিতকে যুদ্ধে পরাজিত করে নিজ কন্যার সাথে বিয়ে দিয়ে মিত্রতা স্থাপন করেন।
    রামপাল যখন শক্তি সঞ্চয় করছিল বরেন্দ্রে তখন দিব্যের ভাতিজা ভীম শাসন করছিল। রামপাল বরেন্দ্র আক্রমণ করলে ভীম তা প্রতিরোধ করেন। কিন্তু হাতির পিঠে যুদ্ধরত অবস্থায় ভীম বন্দি হয়ে গেলে ভীমের বাহিনীতের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই সময়ে ভীমের বন্ধু হরি এগিয়ে আসেন। রামপাল তাকের প্রচুর অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই বশে নিয়ে আসে। রামপাল বিজয়ী হন। ভীম ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে কৈবর্ত শাসনের সমাপ্তি ঘটে। কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় দিবর দিঘিতে কৈবর্ত স্তম্ভ এখনো বিদ্যমান আছে।

    কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ
            নওগাঁর পত্নীতলায় কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ
  • রামপাল : রামপালকে পালবংশের শেষ মুকুটমণি বলা হয়। তিনি সামন্তরাজদের সহায়তায় স্বীয় সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছিলেন। বরেন্দ্রে অভিযান পরিচালনা করে সফল হন। তিনি বরেন্দ্রে কৃষির উন্নতির দিকে দৃষ্টি দেন ও জনগণের করভার লাঘব করেন। এ সময় বিক্রমপুর, কামরূপ, উড়িষ্যাতেও পাল শাসন ফিরে আসে। তিনি রামাবতী নামে নতুন একটি রাজধানী স্থাপন করেন।
    তাঁর মৃত্যুর পরই পাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিরোধ ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। এই সুযোগে পূর্ববঙ্গে বর্মণ রাজারা স্বাধীন হন। কর্ণাটক থেকে আগত সেনরাজবংশ রাঢ়দেশে প্রতিপত্তি অর্জনে সমর্থ হয়। বিজয় সেন এ সময়ে দক্ষিণ বঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

  • মদনপাল : তিনি ছিলেন পাল বংশের শেষ রাজা। রাজ্য রক্ষার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেও খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেন নি। বিভিন্ন রাজাদের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে রাজ্য ভেঙে পড়ে। তাঁরই মাধ্যমে পালবংশের গৌরবময় অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পাল সাম্রাজ্য এ সময় বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যেমন- কুমিল্লার ময়নামতিতে দেব রাজবংশ, দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে চন্দ্রবংশ, বঙ্গদেশে বর্মবংশের শাসন শুরু হয়।
                                              
                                       পাল শাসনামলে অন্যান্য রাজবংশ

    পাল যুগের বেশির ভাগ সময়ই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা স্বাধীন ছিল। তখন এই অঞ্চলটি বঙ্গ জনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বেশ কিছু রাজা কখনো পাল রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, কখনো স্বাধীনভাবে আবার কখনো পাল রাজাদের অধীনতা মেনে দেশ পরিচালনা করতেন। যথা-

  • খড়গ বংশ : ৭ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মগধ ও গৌড়ে পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজারা প্রভুত্ব স্থাপন করে। এই সময় খড়গ বংশের রাজারা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি করেন। তাঁদের রাজধানী ছিল ‘কর্মান্ত বাসক’। কুমিল্লা জেলার বড় কামতার প্রাচীন নামই সম্ভবত কর্মান্ত বাসক। খড়গরা ত্রিপুরা ও নোয়াখালী অঞ্চলে রাজত্ব স্থাপন করে।
  • দেববংশ : খড়গ বংশের শাসনের পর একই অঞ্চলে দেব রাজবংশের উত্থান ঘটে। এই বংশের চারজন রাজার নাম পাওয়া যায়। যথা- শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব ও ভবদেব। দেব রাজারা নামের সাথে বড় বড় উপাধি ধারণ করত। কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতিতে অবস্থিত ‘দেবপর্বত’ ছিল তাদের রাজধানী। সমগ্র সমতট অঞ্চলে দেব রাজারা শাসন করে। আনুমানিক ৭৪০-৮০০ সাল পর্যন্ত দেব রাজারা শাসন করেন।
    দেবরাজ আনন্দদেব ‘আনন্দবিহার’ নামে একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর শাসনামলকে উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগ বলেছেন। দেবরাজ ভবদের ময়নামতিতে শালবন বিহার নির্মাণ করেন। ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ মূলত দেব রাজবংশের সময় উপস্থাপন করে।
  • কান্তিদেব : নবম শতাব্দীতে দক্ষিণ পূর্ব বাংলার হরিকেলে রাজা কান্তিদেবের উত্থান ঘটে। বর্তমান সিলেট তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। বর্ধমানপুর ছিল এর রাজধানী। বর্তমানে এই নামে কোনো অঞ্চলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
  • চন্দ্রবংশ : দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশ ছিল চন্দ্র বংশ। দশম শতাব্দীর শুরু থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই বংশের রাজারা শাসন করেন। রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র এই বংশের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় নিজ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। লালমাই পাহাড় ছিল চন্দ্র রাজাদের মূল কেন্দ্র যা প্রাচীনকালে রোহিতগিরি নামে পরিচিত।
    তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র শ্রীচন্দ্র রাজত্বে পরিসীমা আরও বৃদ্ধি করে। তাঁর শাসনামলে চন্দ্র বংশের প্রতিপত্তি উন্নতি চরম শিখরে পৌঁছে। তিনি ছিলেন চন্দ্র বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব কামরূপ ও উত্তরে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমান বিক্রমপুরে তিনি রাজধানী গড়ে তোলেন। তিনি প্রায় ৪৫ বছর দেশ শাসন করেন।
    তাঁর মৃত্যুর পরও কিছুদিন চন্দ্র বংশের গৌরব অক্ষুণ্ন ছিল। পরবর্তীতে চোলরাজ রাজেন্দ্র চোল ও কালচুরিরাজ কর্ণের আক্রমণে চন্দ্র বংশের পতন ঘটে।
  • বর্ম রাজবংশ : একাদশ শতাব্দীরে শেষভাগে পাল রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা বর্ম রাজবংশের উত্থান ঘটে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা জাতবর্মা। বিক্রমপুর ছিল বর্মদের রাজধানী। জাতবর্মার ছেলে হরিবর্মা ৪৬ বছর শাসন করেন। তিনি পাল রাজাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। তিনি নাগাভূমি ও আসাম পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। ভোজবর্মা ছিলেন এই বংশের শেষ রাজা। তাঁর পর এই বংশ সম্পর্কে আর তেমন কিছু পাওয়া যায় নি।
  • পাল রাজারা নিজেদেরে সূর্যবংশীয় বলে দাবি করেছেন। পাল আমলে খোল নামে এক শ্রেণির কর্মচারীরা গুপ্তচরের দায়িত্ব পালন করত। এই সময় পাঁচ ধরনের রাজস্ব প্রচলিত ছিল। যথা- ভোগ, ভাগ, কর, হিরণ্য ও উপরিকর। 
  • পূর্বের ইতিহাস পড়ুন : গুপ্ত বংশ ও সম্রাট অশোকের ইতিহাস
  • পরবর্তী আলোচনা পড়ুন : সেন বংশের শাসন
  • অনুশীলন সিরিজের বইগুলোতে তথ্যগুলো আপডেট আকারে পাবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top