মৌর্য বংশের ইতিহাস

ভারতবর্ষে মৌর্য শাসনের ইতিহাস

       ইরান-ভারত সম্পর্ক

  • পারস্যের সাথে ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বহু পুরোনো। ইন্দো-আর্যদের আদিবাস ছিল মধ্য এশিয়ায়। ভারতে প্রবেশের পূর্বে এরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি গোষ্ঠী পারস্যে প্রবেশ করে যারা ইন্দো-পারসিক নামে পরিচিত। অন্য দল ভারতে প্রবেশ করে যারা আর্য নামেই পরিচিতি লাভ করে। মগধ যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করছিল তখন ইরানে আকিমেনীয় বংশের শাসন চলছিল।
  • ইরানের সাম্রাজ্য বিস্তার : আনুমানিক ৫৫৮ খ্রিস্টপূর্বে সাইরাস ইরানের সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে রাজ্যটির দ্রুত উন্নতি হয়। সমগ্র ইরান সাইরাসের পদানত হয়। এছাড়াও লাইডিয়া, ব্যাবিলন, ব্যাকট্রিয়া প্রভৃতি অঞ্চল একে একে তার অধিকারে চলে এল। তিনি পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে আরব সাগর এবং উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর হতে দক্ষিণে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত সীমার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারত দুইবার বিদেশিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।
    প্রথমবার এই আক্রমণের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন পারস্যের সম্রাটগণ।
    দ্বিতীয়বার গ্রিক বীর আলেকজান্ডার। ভারতের সঙ্গে পারস্যের সম্পর্ক প্রায় দুইশত বছর স্থায়ী ছিল। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে পারসিক আক্রমণের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই। কারণ, পারসিক অভিযান সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডে।
  • গ্রিক সভ্যতা : গ্রিক সভ্যতা দুটি স্তর ছিল। যথা- হেলেনিক সভ্যতা ও হেলেনিস্টিক সভ্যতা। গ্রিকরা তাদের হেলাস বলত তাই গ্রিক সভ্যতার উন্মেষকে হেলেনিক যুগ বলা হয়। কেবল গ্রিক উপদ্বীপ কেন্দ্রিক এই সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এথেন্স। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-৩৩৬ পর্যন্ত এই সভ্যতা ছিল। অতঃপর রাজা ফিলিপস কর্তৃক মেসিডোনিয়া কেন্দ্রিক নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে। তাঁর পুত্র আলেকজান্ডার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। গ্রিক শিক্ষা সংস্কৃতির সাথে বাইরের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে পরবর্তীতে হেলেনিস্টিক সভ্যতা গড়ে ওঠে।
  • ব্যাকট্রিয় গ্রিক : যারা মূলত গ্রিসের তবে অন্য জাতির সাথে মিশে নিজেদের মৌলিকত্ব হারিয়েছে। এদের সাথে মৌর্য বংশের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শুঙ্গ বংশীয় রাজারা যখন রাজত্ব করছিল তখন ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতার সুযোগে ব্যাকট্রিয় গ্রিকরা ভারতের বিশাল অঞ্চল দখল করে। উত্তর আফগানিস্তানের বলখ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ব্যাকট্রিয় রাজ্য ছিল। আলেকজান্ডার ব্যাকট্রিয় ম্যাসিডোনিয়ান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

                                                               ষোড়শ জনপদের বিবরণ

    জনপদ

    রাজধানী

    বর্তমান অবস্থান

    1. কাশী

    বারানসি বেনারস

     2.  অবন্তী

    উজ্জয়িনী ও মাহেশ্মতী

    মালয়

      3.  গান্ধার

    তক্ষশীলা

    পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডি

    4.  চেদি

    শুকতিমতি

    যমুনা ও নর্মদান মধ্যবর্তী স্থান

    5. কুরু ইন্দ্রপ্রস্থ

    থানেশ্বর, দিল্লী ও মিরাট

       6. কোশল

    শ্রাবন্তী

    লখনৌ ফৈজাবাদ ও গোন্ডা

    7. অঙ্গ

    চম্পা

    পূর্ব বিহার ও ভাগলপুর

       8. কম্বোজ

    রাজপুর

    দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মির

    9. অশ্মক

    পোটানা/ পোটালি

    গোদাবরী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল

    10. শূরসেন

    মথুরা

    যমুনা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল

    11. পাঞ্চাল অহিছত্র ও কাম্পিল্য

    রোহিলখন্ড ও দোয়াবের মধ্যভাগ

    12. বৃজি

    বৈশালী

    মোজাফফরপুর

    13. বৎস

    কৌশাম্বী এলাহাবাদ

    14. মল্ল

    কুশিনারা/ পাবা

    গোরক্ষপুর

    15. মগধ রাজগৃহ/ পাটালিপুত্র

    পাটনা ও গয়া

    16. মৎস্য

    বিরাটনগর

    জয়পুর, আলোয়ার ও ভরতপুর

  • খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা ১৬টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল যা ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে মগধের উত্থান পর্যন্ত সময়কে ‘ষোড়শ মহাজনপদের যুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাজ্যগুলো হচ্ছে- কম্বোজ, গান্ধার, কুরু, কোশল, শূরসেন, পাঞ্চাল, মল্ল, বজ্জি, মৎস্য, চেদী, বৎস, কাশী, অঙ্গ, অবন্তী, অশ্বক ও মগধ। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী প্রায় একহাজার বছরের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজ্যগুলো দখল করে চারটি বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজ্যগুলো হচ্ছে- কোশল, অবন্তী, বৎস ও মগধ। মগধের এই অগ্রযাত্রা থেকেই শুরু হয় উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের ভিত্তি।

    ষোড়শ জনপদ
    ষোড়শ জনপদ
  • মগধের বিবরণ : বর্তমান সময়ের পাটনা গয়া প্রাচীনকালে মগধ নামে পরিচিত ছিল। পাটালিপুত্র ছিল এর রাজধানী। মগধের ভৌগোলিক অবস্থান এর শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। অবস্থানগত সুবিধার কারণে মগধ অন্য রাজ্য আক্রমণ করলেও তাকে আক্রমণের শিকার হতে হয় নি। মৌর্যদের পূর্বে দুটি বিখ্যাত রাজবংশ- হর্ষঙ্ক শৈশুনাগ ও নন্দমগধে রাজত্ব করে। হর্ষঙ্ক-শৈশুনাগ বংশের বিম্বিসার ও অজাতশত্রু ‘সম্প্রসারণ নীতি’ অনুসরণ করে মগধের সীমানা বাড়িয়ে তোলে। পরবর্তীতে নন্দবংশের শাসনে সাম্রাজ্য আরও দৃঢ় হয়। ধননন্দ ছিল নন্দ বংশের শেষ রাজা। সে বেশ অত্যাচারী ছিল। ফলে তার শাসনামলে প্রজাবিদ্রোহ দেখা দেয়। চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন ধননন্দের সৎ ভাই। ধননন্দের বিরুদ্ধে গ্রিকদের সাহায্য চেয়ে চন্দ্রগুপ্ত ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চাণক্যের সহায়তায় এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে। প্রথম দুইবার ধননন্দের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলেও তৃতীয়বার চন্দ্রগুপ্ত পাটালিপুত্র দখল করে। এভাবেই নন্দ বংশের উচ্ছেদ করে মৌর্য বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

    মৌর্য শাসক
    মৌর্য শাসক

  • চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই প্রাচীন ভারতের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী পুরুষ ছিলেন। তিনি ‘অখণ্ড ভারতের’ প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রচার বাড়তে থাকে। তিনি ভারত থেকে গ্রিকদের বিতাড়নে উৎসাহী ছিলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি সেলুকাস খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে গ্রিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এ সময় চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলুকাসের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তের বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে গ্রিক শক্তির উত্থান চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে গ্রিকদের বন্ধুত্ব অর্জনে তিনি সক্ষম হন যা তিন পুরুষ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন কৌটিল্য। তাঁর বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক গ্রন্থ।
  • বিন্দুসার : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পর বিন্দুসার ক্ষমতায় আসেন। তবে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতো দক্ষ ছিলেন না। তাঁর আমলে তক্ষশীলায় দুইবার বিদ্রোহ হলেও তিনি তা দমন করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে অশোক এই বিদ্রোহ দমন করেন।

    চাণক্য
                   চাণক্য
  • অশোক : তক্ষশীলা বিদ্রোহ দমনের পর অশোক তাঁর ভাইদের হত্যা করে মগধের ক্ষমতায় আসেন। এই নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ‘চণ্ডাশোক’ বলা হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত অশোক বৈদিক রীতিনীতির অনুসারী ছিলেন। সিংহাসন লাভের পর অশোক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। এরই প্রেক্ষিতে তিনি তখনকার সমৃদ্ধ রাজ্য ‘কলিঙ্গ রাজ্যে’ আক্রমণ করেন। দয়া নদীর তীরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে অশোক বিজয়ী হলেও যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনুতপ্ত হন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে যুদ্ধবিরোধী নীতিতে মনোযোগী হন।
    অশোকের মৃত্যুর পরই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। পরবর্তী ৫০ বছরে ৬ জন শাসক শাসন করলেও কারো শাসন স্থায়ী হয় নি। মৌর্য বংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিজ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতে নিহত হন। ফলে মগধে শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে।
  • মৌর্য যুগের পর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে আবারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির প্রাধান্য দেখা দেয়। মগধের সিংহাসনে শুঙ্গ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতে সাতবাহন বংশের শাসন স্থাপিত হয়। কলিঙ্গ চেত বংশের শাসন শুরু হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজনৈতিক অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে গ্রিক ব্যাকট্রিয়রা আক্রমণ করে। একই সময় শক, পার্থিয়ান ও কুষাণ প্রমুখ বৈদেশিক শক্তি ভারতে আক্রমণ চালায়। এই বৈদেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে কুষাণদের ভূমিকা সর্বাপেক্ষা গৌরবোজ্জ্বল। কুষাণ আমলে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মযাজকরা চীনে গিয়ে চীনা ভাষায় বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থাদি অনুবাদ করান। কুষাণরা বিখ্যাত সিল্করুট দিয়ে মধ্য ইরান ও রোমে বাণিজ্য করত।
  • প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে কনিষ্ক একজন প্রসিদ্ধ নরপতি। তিনি ‘কুষাণ শ্রেষ্ঠ’ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত। তিনি ‘শকাব্দ’ নামে একটি নতুন সন চালু করেন। কনিষ্কের পর কোনো বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক ভারত শাসিত হয় নি। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১৫০ বছর ভারতবর্ষ এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে গুপ্ত নামধারী রাজবংশের হাতেই প্রাচীন ভারতের সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়। ৩২০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গুপ্তরা ভারত শাসন করে।
  • আরও পড়ুন : ভারতবর্ষে আলকজান্ডারের আক্রমণ
  • অনুশীলন সিরিজের বাংলাদেশ বিষয়াবলি বইতে তথ্যগুলো পাবেন। অর্ডার করুন-

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top