ছয় দফা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত
- বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি ঘটনা বেশ গুরুত্ব বহন করে। যথা-
১. লাহোর প্রস্তাব : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোরে অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। যার মুখ্য রচিয়তা ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও উত্থাপক ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। যার মূল কথা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা। যদিও ১৯৪৬ সালে প্রস্তাবটির আংশিক সংশোধন করা হয়।
২. ছয় দফা দাবি : যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলা হয়।
- ম্যাগনাকার্টা : ইংল্যান্ডের রাজা জন তার হারানো সম্পত্তি ফিরে পেতে অন্যায়ভাবে সম্পত্তি জবর দখল, নতুন নতুন কর চালু ইত্যাদি অন্যায়মূলক পদক্ষেপ নেন। এগুলো আদায়ের দায়িত্ব ছিল ব্যারনদের (তৎকালীন ব্রিটেনের অভিজাত জমিদাররা)। যার ফলে ব্যারনরা রাজার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং রাজাকে তাদের শান্তি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। রাজা প্রথমে চুক্তি মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না কিন্তু সকল সামন্ত মিলে রাজাকে লন্ডনের একটি দ্বীপে বন্দি করে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। ১২১৫ সালের ১৫ জুন ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে প্রথম রাজার ক্ষমতা খর্ব করে জনগণের ক্ষমতা (সামন্ত) বাড়ানো হয়।
- ছয় দফা দাবির প্রেক্ষাপট : ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৭ দিন ব্যাপী এই যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানের পক্ষে অসম্ভব সাহসিকতা দেখায়। তবে পূর্ব পাকিস্তান তখন সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অতঃপর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে উভয়পক্ষ যুদ্ধ বিরতি দেয় এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুরের রাশিয়ার (বর্তমান উজবেকিস্তান) তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে (১০ জানুয়ারি. ১৯৬৬) তার সমাপ্তি ঘটে। - ছয় দফা ঘোষণা : তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা লাহোরে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর পৌঁছান।
পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রিকাগুলো শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপে চিত্রায়িত করায় তিনি ৬ তারিখের সম্মেলন বর্জন করেন। -
ছয় দফা কি আসলেই ছয় দফা ছিল?
- ছয় দফা দাবি প্রণয়নের ইতিহাস : ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পরই শেখ মুজিবের নির্দেশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের পরিচালক হিসেবে কর্মরত রুহুল কুদ্দুসসহ ইনার সার্কেলের অন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ অবসানের লক্ষ্যে স্বায়ত্বশাসন ভিত্তিক একটি দলিল তৈরি করেন। তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ছয় দফা দবি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রথমে ৭টি দফা থাকলেও পরবর্তীতে ৭ম পয়েন্টটি বাদ দিয়ে ‘প্রাদেশিক গভর্নরকে নির্বাচিত হতে হবে’– ছয় দফা প্রণয়ন করা হয়। ছয় দফা লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী রচিত হয়।
-
ছয় দফা কতবার ঘোষণা করা হয়?
- ছয় দফা দাবি মোট তিনবার ঘোষণা করা হয়-
১ম বার- ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬
২য় বার- ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ (বিরোধী দলের সম্মেলন)
৩য় বার- ২৩ মার্চ, ১৯৬৬ লাহোর (আনুষ্ঠানিকভাবে) {শেখ মুজিবুর রহমান}
প্রতিবারই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। - ছয় দফা দিবস : ৭ জুন। (ছয় দফা দাবি ও বাংলার স্বাধিকার আদায়ের জন্য হরতাল পালিত হয়)
- ছয় দফা অনুমোদন পায় : ১৮ মার্চ, ১৯৬৬ সালে, আওয়ামি লীগের বার্ষিক সম্মেলনে।
- ছয় দফা যে শিরোনামে পুস্তিকাকারে বের হয় : আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি (১৮ মার্চ, ১৯৬৬)
- ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য হরতাল হয় : ৭ জুন, ১৯৬৬ সাল। এই আন্দোলনে মনু মিয়া মারা যান।
- ছয় দফার প্রথম দফা : পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন।
-
ছয় দফার দাবিগুলো হচ্ছে-
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়। যথা- প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক– আর অপর বিষয়াবলি ফেডারেশনে অন্তর্ভূক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে। একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসেব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে।
৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।