দিল্লি সালতানাতের পতন
- সুদীর্ঘ ৩২০ বছরের দিল্লী সুলতানদের মধ্যে একমাত্র লোদীরাই আফগানি ছিল। বাহলুল লোদির দাদা বাহরাম লোদি ফিরোজ শাহের আমলে আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসে। বাহলুলের বাবা খোক্করদের বিদ্রোহ দমনে কৃতিত্ব দেখান। তার চাচা খিজির খানের সময় সরহিন্দের শাসক ছিলেন। চাচার মৃত্যুর পর বাহলুল সরহিন্দের ক্ষমতায় বসেন। লোদী বংশের প্রতিষ্ঠাতা বহলুল লোদী। মালবের বিদ্রোহ দমনে বহলুল মুহম্মদ শাহকে সাহায্য করেন। এজন্য তাঁকে ‘খান-ই-খানান’ উপাধি দেওয়া হয়। আলম শাহের প্রধানমন্ত্রী হামিদ খান সুলতানকে অপসারণে নেতৃত্ব দেয়। বহলুল তখন বীরত্বের জন্য খ্যাত ছিলেন। হামিদ খান তাঁকে সিংহাসন দখল করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বাহলুল সসৈন্যে দিল্লীতে যান। তাঁকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি আলম শাহের ছিল না। ফলে তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন।
বাহলুল লোদি কীভাবে ক্ষমতায় বসে?
- বহলুল লোদী : ১৪৫১-১৪৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দেশ পরিচালনা করেন। সিংহাসনে বসেই তিনি হামিদ খানকে কারারুদ্ধ করেন। ফলে অন্য আমিররা সাবধান হয়ে যায়। তিনি দিল্লী সালতানাতের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এই সময়ে অধিকাংশ আমিরই ছিল স্বাধীনচেতা পাঠান। তিনি পাঠানদের অহংকারে আঘাত করেন নি। তিনি তাদের সাথে মিলে চলেন। আবার তিনি এটাও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন যে তিনি তাদের একজন হলেও তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জৌনপুরের শার্কি বংশ এই সময় খুব শক্তিশালী ছিল। শার্কি বংশের শাসককে পরাজিত করে তিনি রাজ্যসীমা পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করেন। তাঁর বড় ছেলে বরবক শাহকে জৌনপুরের শাসক নিযুক্ত করেন। মেওয়াট ও দোয়াব অঞ্চলের বিদ্রোহ করলে তিনি কঠোরভাবে দমন করেন। এই সময় পাঞ্জাবেও তাঁর নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। গোয়ালিয়র দখল করে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের পথে অসুস্থ হয়ে ১৪৮৯ সালে মারা যান।
- সিকান্দার শাহ লোদী : বহলুল লোদীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নিজাম ‘সিকান্দার শাহ লোদী’ নামধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ২৮ বছর রাজত্ব করেন। প্রথমেই তাঁকে বড় ভাই বরবক শাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। জৌনপুরের শাসক ছিলেন বরবক শাহ। তিনি সিকান্দরের শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি মনে করেন সিংহাসনের প্রকৃত হকদার তিনিই। এ ব্যাপারে তিনি কিছু আমির তাকে সমর্থন দেয়। সিকান্দর শাহ তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করেন। অবশ্য তাঁকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। জৌনপুরের পূর্বাংশ তখনও শার্কি বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৫৯৪ সালে তিনি শার্কি বংশের শেষ সুলতান হুসেন শাহকে পরাজিত করেন। ফলে সমগ্র জৌনপুরে তাঁর শাসনাধীনে আসে।
তিনি বিহারের একাংশ দখল করেন। অন্য অংশ বাংলার সুলতান আলাউদ্দন হুসেন শাহ দখল করে। ফলে তাঁর সাথে সিকান্দারের সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে একে অপরকে আক্রমণ করবে না এবং পরস্পরের শত্রুকে আশ্রয় দিবে না বলে সম্মত হয়। তিনি রাজপুত জাতিকে নিয়ন্ত্রণে আনেন। চান্দেরির রাজ্যকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
সিকান্দার শাহ ছিলেন লোদী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি দিল্লী থেকে আগ্রায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পুনর্বিন্যস্ত করেন। তিনি আফগানদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ব্যবসার সুবিধার্থে আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক হ্রাস করেন। শান্তি বজায় রাখতে কোতয়াল ব্যর্থ হলে তাকে শাস্তি পেতে হত। বিচারকরা ছিল স্বাধীন। তিনি ‘গুলরুখ’ ছদ্মনামে ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখতেন। ১৫১৭ সালে তিনি মারা যান। - ইব্রাহিম লোদী : ইব্রাহিম খুব সহজেই সিংহাসন লাভ করতে পারে নি। আফগান নেতাদের একটি দল তাঁর ছোট ভাই জালাল খানকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করে। ইব্রাহিম তাদের পরাজিত করে ও জালাল খানের শিরশ্ছেদ করা হয়। বিদ্রোহী আমিরদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাকেই সন্দেহ করা হত তাকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনো সিদ্ধান্ত সে অনায়াসে নিতে পারত। কিন্তু তাঁর বাস্তবজ্ঞানের অভাব ছিল। আফগানদের ব্যাপারে পূর্বসূরীদের পথ সে অনুসরণ করে নি। আমিররা ইব্রাহিমের শাসন থেকে মুক্তিলাভের উপায় খুঁজতে থাকে।
বাবরকে কেন ভারতে আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়?
- বাবুরকে ভারত আক্রমণে নিমন্ত্রণ : পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খান লোদী ইব্রাহিম লোদীর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। সুলতানের চাচা আলম খান লোদি ক্ষমতায় বসতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা কাবুলের শাসক বাবুরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ মনে করেন যে বাবুর পূর্বপুরুষের মতো ভারত আক্রমণ করে ধনরত্ন নিয়ে চলে যাবে। ফলে আফগানরা দুর্বল হয়ে পড়বে। এই সুযোগে রানা সংগ্রাম রাজত্ব স্থাপন করতে পারবে। ভারতে রাজত্ব কায়েমের ইচ্ছা ছিল বাবরের ছিল। তিনি আফগানদের এই আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করেন।
১৫২৪ সালে বাবুর পাঞ্জাব দখল করে। কিন্তু দৌলত খানের বিরোধিতার জন্য সে বছর বাবর ফিরে যায়। ১৫২৫ সালে বাবর আবার ভারতে আক্রমণ করে। এবার ১২ হাজার সুশিক্ষিত সৈন্য ছিল তাঁর সাথে। তিনি সহজেই পাঞ্জাব দখল করে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন। দিল্লী থেকে প্রায় ৫৩ মাইল উত্তর-পশ্চিমে পানিপথের প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী সাহসিকতা দেখালেও বাবরের আধুনিক কৌশল ও অস্ত্রশস্ত্রের নিকট পরাজিত হন। ইব্রাহির যুদ্ধের ময়দানেই মারা যান। বাবর প্রথমে দিল্লী ও পরে আগ্রা দখল করেন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে দিল্লী সালতানাদের পতন ঘটে। এর স্থলে নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে। পানিপথের যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবের্ষ ৩২০ বছরের দিল্লী সালাতানাদের গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। - পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : সৈয়দ শাসনামল
- পরবর্তী আলোচনা : বাবরের আক্রমণ