বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ)

  • ১২০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বলা হয়।
    ১২০১-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়।
    ১৪৮৭-১৪৯৩ সাল হাবশি শাসনকে বাংলার রাজনীতিতে অন্ধকার যুগ বলা হয়।

  • বাংলা ভাষায় এক লাইন না লিখেও বাংলার বিখ্যাত কবি : বিদ্যাপতি।
    বাংলা ভাষায় এক লাইন না লিখেও বাংলা সাহিত্যে তার নামে যুগ আছে : শ্রীচৈতন্য।

  • বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন : চর্যাপদ।
    সর্বজনবিদিত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম নিদর্শন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।

  • অন্ধকার যুগে রচিত গ্রন্থাদি-
    **প্রাকৃত পৈঙ্গল (শ্রীহর্ষ) : প্রাকৃত ভাষায় রচিত গীতিকবিতা। এটি অন্ধকার যুগের প্রথম নিদর্শন। মূলত এটি প্রাকৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ। যদিও এতে প্রাকৃতের পাশাপাশি অপভ্রংশের কিছু পদ পাওয়া যায়।
    **শূন্যপুরাণ (রামাই পণ্ডিত) : এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থ। এতে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে। নিরঞ্জনের রুম্মা নামক একটি কবিতায় বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও মুসলিম কর্তৃক তাদের উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। এটি গদ্যপদ্য মিশ্রিত একটি চম্পুকাব্য। ভাষাগত কারণে অনেক পণ্ডিতই একে অন্ধকার যুগের গ্রন্থ বলে মনে করেন না।
    **সেক শুভোদয়া (হলায়ুধ মিশ্র) : সংস্কৃত গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। সেখের শুভোদয় অর্থ শেখের গৌরব ব্যাখ্যা। গ্রন্থটিতে রাজা লক্ষ্মণ সেন ও শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজির আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় অবলম্বনে রচিত। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে সুকুমার সেনের সম্পাদনায় গ্রন্থটি প্রথম মুদ্রিত হয়। প্রচুর পরিমাণে ভুল সংস্কৃত থাকায় ড. সুনীতিকুমার একে Dog Sankrit বলেছেন। হলায়ূধ মিশ্র লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। গ্রন্থটিতে প্রাচীন বাংলার অনেক নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। পীরমাহাত্ম্য ছাড়াও এতে বাংলা ছড়া, খনার বচন, ভাটিয়ালি রাগের প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।
  • অন্ধকার যুগ নিয়ে বিতর্ক : অন্ধকার যুগের জন্য কেবল তুর্কি আক্রমণকে দায়ী করা যায় না। কারণ, তুর্কি আক্রমণ যেখানে হয়নি সেখানেও সাহিত্য খুব বেশি সৃষ্টি হয়নি। এছাড়াও তুর্কি আক্রমণের ফলে এমনটা হলে পরবর্তী সাহিত্যে তা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হত। চর্যাপদ, সেক শুভোদয়া, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এগুলোর একটি করে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। যদি এই নমুনাগুলো না পাওয়া যেত তবে এগুলোও আড়ালে রয়ে যেত। অনেক গবেষকের মতে এই সময়ে অন্যান্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে।
  • সৈয়দ আলী আহসান এ সময়কালকে ‘প্রায় শূন্যতার যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তুর্কি আক্রমণের ভয়ে বৌদ্ধ কবিগণ বঙ্গদেশ থেকে নেপালে চলে গিয়েছিলেন বলে বাংলা সাহিত্য জগতে শূন্যতা দেখা দেয়।
  • ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. এনামুল হক, ড. সুকুমার সেন প্রমুখ অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
  • মধ্যযুগে ধর্মনির্ভর সাহিত্য প্রচলিত ছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল লোকসাহিত্য (এটি মানবকেন্দ্রিক রচনা)। মধ্যযুগের কাব্য সম্পর্কিত প্রবাদবাক্য : কানু (কৃষ্ণ) ছাড়া গীত নাই।
  • মধ্যযুগের শেষ কবি ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি : ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭৬০)। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনার পর নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁকে রায়গুণাকর উপাধি দেন।
  • বাংলা লোকসাহিত্যের উপর প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচনা করেন : অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য। তাঁর গ্রন্থের নাম বাংলার লোকসাহিত্য (১৯৫৪)।
  • বাংলা লোকসাহিত্য উজ্জীবনের সার্থক স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
  • বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোকঐতিহ্য বইটির লেখক : ড. আশরাফ সিদ্দিকী।
  • মধ্যযুগের সাহিত্য ধারা-


  • বৈষ্ণব সাহিত্য তিনভাগে বিভক্ত। যথা-
    ক. বৈষ্ণব পদাবলি : শ্রীচৈতন্যদেব ও বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে রচিত সাহিত্যকে পদাবলি বলা হয়। এটি মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ও সমৃদ্ধ রচনা। এতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে যা রাধা কৃষ্ণের আলোকে বর্ণিত। বৈষ্ণব পদাবলি ‘মহাজন পদাবলি’ নামেও পরিচিত ছিল। বৈষ্ণব পদাবলির সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের সময়। তবে ষোড়শ শতকে এই সাহিত্যের বিকাশ হয়। জয়দেব বাঙালি কবি হলেও সংস্কৃত ভাষায় পদ রচনা করেন। ব্রজবুলি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি। পাশ্চাত্য কবি চসারের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়। বিদ্যাপতির পদ প্রথম আবিষ্কার করেন জর্জ গ্রীয়ার্সন।
    খ. বৈষ্ণব শাস্ত্র।
    গ. জীবনী সাহিত্য।
  • বিদ্যাপতি : পঞ্চদশ শতকে মিথিলার রাজা শিবসিংহের সভাকবি ছিলেন। তাঁকে মিথিলার কোকিলকবিকণ্ঠহার বলা হয়। তিনি পদাবলির আদি কবি বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি ভাষায় পদগুলো রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কীর্তিলতা, পুরুষ পরীক্ষা, গোরক্ষ বিজয় ইত্যাদি। তাঁর কাব্যকে রবীন্দ্রনাথ ‘রাজকণ্ঠের মণিমালা’ বলেছেন।
  • ব্রজবুলি ভাষা : এটি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় কাব্যভাষা। সাধারণত ব্রজ অঞ্চলের ভাষাকে ব্রজবুলি ভাষা বলা হয়। এটি মৈথিলি ও বাংলার মিশ্রণে কৃত্রিম মিশ্রভাষা। এটি কখনো মুখের ভাষা ছিল না। এটি ছিল কবিদের কাব্য লেখার ভাষা। এজন্য একে কবিভাষাও বলা হয়। ব্রজবুলি ভাষায় শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি গোবিন্দদাস।
  • চণ্ডীদাস : বৈষ্ণব পদাবলির শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁকে বাংলা কবিভাষার আবিষ্কারক বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেন যে, “চণ্ডীদাস একচ্ছত্র লেখেন ও দশছত্র পাঠকদের দ্বারা লিখিয়ে নেন।” বঙ্কিম তাঁর কবিতাকে ‘রুদ্রাক্ষমালা’ বলেছেন। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম মানবতাবাদী কবি। তাঁর বিখ্যাত কিছু উক্তি-
    **শুনহ মানুষ ভাই; সবার উপর মানুষ বড়, তার উপরে নেই। বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে; দেখা না হইত পরান গেলে।
  • মধ্যযুগের রত্নাকর যারা

  • শাক্ত পদাবলি : এই ধারার মুসলিম কবি আলি রাজা, আকবর আলী, মির্জা হোসেন আলী। আধুনিক যুগে কাজী নজরুল ইসলাম শাক্ত পদাবলি রচনা করেছেন।
  • বাউল পদাবলি : ‘বাউল’ শব্দটি সংস্কৃত বাতুল শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ বাহ্যজ্ঞানহীন। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাউল মতের উদ্ভব ঘটে। ‘বৌদ্ধ সহজিয়া’ মত থেকে বাউল মতের উৎপত্তি। শ্রেষ্ঠ বাউল সাধক লালন শাহ।
  • অনুবাদ সাহিত্য : মধ্যযুগে সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ও হিন্দি ভাষার গ্রন্থের অনুবাদ হয়। সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহের আমলে অনুবাদ শুরু হয়। রামায়ণ, মহাভারতসহ
  • বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়। মধ্যযুগের অনুবাদগুলো দুটো ধারায় বিভক্ত ছিল। যথা-
    ক. সংস্কৃত ভাষা থেকে : এই ধারায় বাল্মীকি (প্রকৃত নাম- রত্নাকর) রচিত রামায়ণ অ
    নুবাদ
    করা হয়। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের নির্দেশে কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন। ১৭ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি ‘চন্দ্রাবতী’ রামায়ণ অনুবাদ করেন।
    **মহাভারত অনুবাদ : ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের অনুবাদ করা হয়। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস।
    **ভগবত গীতা অনুবাদ : বেদব্যাস রচিত ভগবতের অনুবাদ করেন মালাধর বসু। তাঁর উপাধি গুণরাজ খান।
    খ. আরবি-ফার্সি ভাষা থেকে : এই ধারায় মুসলিম সাহিত্যিকগণের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যথা-
  • চৈতন্য যুগ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

  • বৈষ্ণব পদাবলি : বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে রচিত একটি কাব্যধারা। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এর মূল উপজীব্য। বারো শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত জয়দেবের গীতগোবিন্দ এ ধারার প্রথম কাব্য। চতুর্দশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাস (প্রকৃত নাম- অনন্ত) বাংলা ভাষায় রচনা করেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে একটি আখ্যানকাব্য। বাংলা ভাষায় এই ধারার আদিকবি চণ্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলির আদি মুসলিম কবি শেখ কবির।
  • বৈষ্ণব সাহিত্য তিন ভাগে বিভক্ত। যথা-
    ১. বৈষ্ণব পদাবলী
    ২. জীবনী সাহিত্য
    ৩. বৈষ্ণব শাস্ত্র
  • শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) : ভারতের নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র, বাল্য নাম নিমাই, অন্য নাম গৌরাঙ্গ, সন্ন্যাস গ্রহণের পর নাম হয় চৈতন্য। তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক ছিলেন।
  • বাংলায় চৈতন্যজীবনী রচিত হবার পূর্বে কয়েকজন বাঙালি কবি সংস্কৃতে তাঁর জীবনী রচনা করেন। শ্রীচৈতন্যদেবের সহপাঠি মুরারি গুপ্ত ‘শ্রী শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যচরিতামৃতম’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা মুরারিগুপ্তের কড়চা নামে খ্যাত।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটি তুলোট কাগজের উভয় পাশে লেখা। কাব্যে সংস্কৃত শ্লোক আছে ১৬১টি। নাটকীয় সংলাপের কারণে কাব্যটি মূলত নাটগীতি।
  • কাব্যের ১৩টি খণ্ডের মধ্যে ১৩তম খণ্ডে ‘খণ্ড’ শব্দটি যোগ করা হয়নি (রাধাবিরহ)।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা : আদি মধ্য যুগের।
  • বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্য জীবনী রচনা করেন বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘শ্রীগৌরলীলামৃত’।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে গীতিরসের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এটি পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে রাধা ও কৃষ্ণ হচ্ছে জীবাত্মাপরমাত্মার প্রতীক।
  • মধ্যযুগের সাহিত্য ধারাকে বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক শ্রী চৈতন্যের জীবনীকাল অনুসারে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়।
  • কাব্যটি আবিষ্কারের সময় তার কোনো লিখিত নাম ছিল না। তবে ‘কৃষ্ণসন্দর্ভ’ নামে পুঁথিতে পরোক্ষভাবে একটি নাম পাওয়া যায়। বসন্তরঞ্জন রায় (সম্পাদক) এর নাম দেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
  • বড়াইকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের দূতী বলা হয়।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণের সখার নাম : বলভদ্র।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধার স্বামীর নাম : আয়ান ঘোষ।
  • বিমানবিহারী এ কাব্যের নাম দিয়েছেন রাধাকৃষ্ণের ধামালী।
  • কাব্যের মুখবন্ধ লেখেন রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী।
  • কাব্যের পুঁথির লিপিকাল বিষয়ে নিবন্ধ লিখেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • বসন্তরঞ্জন রায়ের উপাধি বিদ্বদ্বল্লভ। ঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য ভূবনমোহন তাঁকে এ উপাধি দেন।
  • চণ্ডীদাস সমস্যা : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কবি। এ নামে চারজন কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা হচ্ছেন; বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। এঁদের রচিত পদের ভণিতায় এ নামগুলি পাওয়া যায়। এ চারজন পরস্পর পৃথক ব্যক্তি, নাকি একজনেরই চারটি নাম; পৃথক হলে কে কখন আবির্ভূত হয়েছিলেন, একজন হলেই বা তাঁর সঠিক সময় কোনটি এসব নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যা ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ নামে পরিচিত।

অন্যান্য তথ্যাদি
  • মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনীকাব্য বা রোমান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন।
  • রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান মূলত দুটি ধারা অনূদিত হয়েছে। যথা-
    ক. আরবি-ফার্সি ধারা : ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান ইত্যাদি।
    খ. হিন্দি ধারা : পদ্মাবতী, মধুমালতী, গুলেবকাওয়ালি ইত্যাদি।
  • শেখ ফয়জুল্লাহ পাঁচটি গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। যথা- সত্যপীর, গোরক্ষবিজয়, গাজীবিজয়, জয়নবের চৌতিশা ও রাগনামা। রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়।
  • আলাওল আরাকানের প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে থেকে কাব্যচর্চা করেন।
  • পাঁচালি গানের শক্তিশালী কবি : দাশরথি রায়।
  • টপ্পা গানের জনক : রামনিধি গুপ্ত (নিধিবাবু)।
  • শ্রীণ্ডের রঘুনন্দনের শিষ্য কবিরঞ্জন ব্রজবুলি ভাষায় বিদ্যাপতির অনুসরণে পদ রচনা করেন। এজন্য তাঁকে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ নামে অভিহিত করা হয়। অনেকে কবিশেখরকেও ছোট বিদ্যাপতি বলেন।
মঙ্গলকাব্য
  • মঙ্গলকাব্যের প্রধান দেবতারা হচ্ছেন মনসা, চণ্ডী ও ধর্মঠাকুর। এদের মধ্যে মনসা ও চণ্ডী এই দুই স্ত্রীদেবতার প্রাধান্য বেশি। এই তিনজনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্যের ধারা-মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল- গড়ে উঠেছে। কালক্রমে শিবঠাকুরও মঙ্গলকাব্যের বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কাব্যধারার নাম শিবায়ন বা শিবমঙ্গল।
  • মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ কল্যাণ। যে কাব্যে দেবতাদের আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয় এবং যে কাব্য শুনলে মঙ্গল হবে বলে ধারণা করা হয়, তাকে মঙ্গলকাব্য বলে। এ ধরনের কাব্য রচনার মূল উপলক্ষ্য হচ্ছে দেবীকর্তৃক আদেশ লাভ। মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখা তিনটি। যথা-
  • মঙ্গলকাব্য পালা হিসেবে গাওয়া হতো। তবে এতে সুর অপেক্ষা কাহিনীই বেশি প্রাধান্য পেত। মঙ্গলকাব্যের একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- নায়ক-নায়িকারা সাধারণত বণিক সম্প্রদায়ের এবং অন্যান্য চরিত্রগুলো সমাজের নিম্ন শ্রেণির প্রতিনিধি; ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের প্রাধান্য এতে কম।
  • শিবমঙ্গল মৌলিক ধারার কোনো মঙ্গলকাব্য নয়।
  • মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম মনসামঙ্গল। তন্মধ্যে বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণ (১৪৯৪) সর্বাধিক জনপ্রিয়।
  • মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু চারটি অংশে বিভক্ত। যথা-
    ক. বন্দনা : এখানে বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করা হয়।
    খ. আত্মপরিচয় : কবির আত্মপরিচয় ও গ্রন্থ রচনার কারণ।
    গ. দেবখণ্ড : পৌরাণিক দেবতার সাথে লৌকিক দেবতার সম্বন্ধ স্থাপন।
    ঘ. নরখণ্ড ও আখ্যায়িকা। এটিই মঙ্গলকাব্যের প্রধান অংশ। [সূত্র- বাংলাপিডিয়া]
  • মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
  • মুকুন্দরাম সমগ্র মঙ্গলকাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত।
  • জমিদার রঘুনাথ রায়ের অনুরোধে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন
  • চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার কবি দ্বিজ মাধবকে স্বভাব কবি বলা হয়।
  • অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র- ঈশ্বরী পাটনী, হীরামালিনী ও বিদ্যাসুন্দর।
    শায়ের ও কবিওয়ালা
  • পুঁথি সাহিত্য : পুঁথি শব্দের উৎপত্তি পুস্তিকা শব্দ থেকে। এ অর্থে পুঁথি শব্দ দ্বারা যেকোনো গ্রন্থকে বোঝালেও পুঁথি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা বিশেষ অর্থ বহন করে।
    ধনিক শ্রেণির মনোরঞ্জনের জন্য আরবি-ফারসি মিশ্রিত শব্দে মুসলমানরা যে কবিতা ও গান রচনা করতেন তা পুঁথি সাহিত্য বলে খ্যাত। তন্মধ্যে যে পুঁথিগুলো কলকাতার সস্তা ছাপাখানায় ছাপা হত সেগুলোকে ‘বটতলার পুঁথি’ বলা হয়।
    হুগলির কবি ফকির গরীবুল্লাহ ‘আমীর হামজা’ রচনা করে এ কাব্যধারার সূত্রপাত করেন। আমীর হামজা গ্রন্থটি জঙ্গনামা বা যুদ্ধ বিষয়ক কাব্য। গরীবুল্লাহ নিজে এবং তাঁর শিষ্য সৈয়দ হামজা এ ধারার আরও কয়েকটি কাব্য রচনা করেন।
    গরীবুল্লাহর প্রথম কাব্য ইউসুফ-জুলেখা সাধু বাংলায় রচিত। এছাড়াও তিনি সোনাভান, সত্যপীরের পুথি, জঙ্গনামা ও আমীর হামজা রচনা করেন। সৈয়দ হামজার প্রথম কাব্য মধুমালতী সাধু বাংলায় রচিত। এরপর তিনি জৈগুনের পুথি ও হাতেম তাই কাব্যদুটি রচনা করেন।
  • আমীর হামজা গ্রন্থটি ফকীর গরীবুল্লাহ শুরু করেন ও সৈয়দ হামজা তা সমাপ্ত করেন।
  • কবিওয়ালা-শায়ের : ধনিক শ্রেণির মনোরঞ্জনের জন্য যারা মানুষের দ্বারে দ্বারে নিম্নরুচির সাহিত্য সরবরাহ করতেন, তাদেরকেই কবিওয়ালা ও শায়ের (মুসলমান) বলা হয়।
  • দো-ভাষী পুঁথি : কয়েকটি ভাষার শব্দ ব্যবহার করে মিশ্রিত ভাষায় রচিত পুঁথি।
    এই সাহিত্যের প্রথম ও সার্থক কবি : ফকির গরীবুল্লাহ।
  • কবিওয়ালাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গোঁজলা গুই।
  • গোঁজলা গুইয়ের শিষ্যের নাম : কেষ্টা মুচি।
  • এছাড়াও বিভিন্ন কবিওয়ালা হচ্ছেন : অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রাসু, নৃসিংহ প্রমুখ।
  • অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (প্রকৃত নাম : হ্যান্সম্যান এনইট) জাতিতে পর্তুগীজ ছিলেন। তাঁর বাবা পর্তুগীজ ও মা বাঙালি ছিলেন। এক বাঙালি বিধবাকে বিয়ে করে তিনি কবিয়াল ও কালীসাধক হয়ে যান। উত্তর কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়ি ‘ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি’ নামে পরিচিত।
  • নাথ সাহিত্য : মধ্যযুগে উদ্ভাবিত নাথ ধর্মের কাহিনী অবলম্বনে রচিত সাহিত্যকে নাথ সাহিত্য বলে। নাথ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য রচনা গোরক্ষ বিজয় (শেখ ফয়জুল্লাহ)। নাথ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মীননাথ।
  • জর্জ গ্রিয়ার্সন ছিলেন একজন ইউরোপীয় ভারততত্ত্ববিদ। ১৮৫১ সালে আয়ারল্যান্ডে তাঁর জন্ম। ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে সিভিল সার্ভেন্ট পদে যোগদান করেন। এ পদে নিযুক্ত হয়েই তিনি এ দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যে বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন।
  • কবিগান রচিয়তাদের জীবনী সংগ্রহ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত।
  • মর্সিয়া সাহিত্য : এক ধরনের শোককাব্য বা বিলাপসঙ্গীতকে মর্সিয়া সাহিত্য বলা হয়। মর্সিয়া সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি ও কাব্যের নাম-
  • মধ্যযুুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মর্সিয়া কাব্য ‘মক্তুল হোসেন’। কাব্যটির রচিয়তা চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামের অধিবাসী মুহম্মদ খান।
    বিশিষ্ট মর্সিয়া সাহিত্য গবেষক ড. গোলাম সাকলায়নের মতে মোঘল শাসনামলকে বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী রাধাচরণ গোপ মর্সিয়া কাব্য রচনা করেন। তাঁর রচিত ইমাম হোসেনের কেচ্ছা আফৎনামা কাব্য দুটি মর্সিয়া সাহিত্যের বিশেষ নিদর্শন। আধুনিক যুগের মর্সিয়া সাহিত্য ধারার কবি মীর মশাররফ হোসেন কায়কোবাদ
  • খনার বচন : কৃষি ও আবহাওয়া বিষয়ক কথা পাওয়া যায়। খনা সম্পর্কে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। যথা-
    ক. খনা ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ও গণিত পারদর্শী এক প্রাচীন কিংবদন্তি মহিলা।
    খ. তিব্বতী ভাষায় খনা অর্থ বোবা। জিহ্বা কর্তনের পর লীলাবতীর নাম হয় খনা।
    গ. সিংহল রাজ্যের কন্যা।
  • খনার বচনগুলো চার ধরনের। যথা-
    কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার কৃষিকাজ ও ফলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান
    আবহাওয়া জ্ঞান ও শস্যের যত্ন সম্পর্কিত জ্যোতিষ ও ভূতত্ত্বভেদে শস্যের ক্ষয়ক্ষতি ও ফলন
  • খনার বচন-
    *ষোল চাষে মুলা, তার অর্থেক তুলা, তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।
    *কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
    *ব্যাঙে ডাকে ঘন ঘন, তরা হবে বৃষ্টি জান।
    *গরু ছাগলের মুখে বিষ, চারা না খায় রাখিস দিস।

    *কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।
    *চোরের মার বড় গলা, লাফ দিয়ে খায় গাছের কলা।

    * নদীর জল ঘোলাও ভাল, জাতের মেয়ে কালাও ভালো।
  • ডাকের বচন : ডাকের বচনে জ্যোতিষ ও মানবচরিত্রের কথা পাওয়া যায়।
    তিব্বতি ভাষায় ‘ডাক’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞাবান বা বৌদ্ধিক তান্ত্রিক সাধক।
  • ডাকের বচন-
    *আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে জঙ্গল ভালো।
    *ভিক্ষা চাই না মা, তোর কুত্তা সামলা।

    *পুরান পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের আমদানি।
    *উচিত কথায় বন্ধু বেজার, গরম ভাতে বিলাই বেজার।

    *সারা রাইত মারলাম সাপ, জাইগ্যা দেখি দড়ি।
    *বাড়ির গরু কোলার ঘাস খায় না।
লোকসাহিত্য
  • লোকমুখে প্রচলিত গাঁথা কাহিনি, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদিকে লোকসাহিত্য বলে। লোকসাহিত্যের ধারক পল্লী অঞ্চলের নিরক্ষর জনগণ। লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম সৃষ্টি ছড়া, প্রবচন (ডাক ও খনা) ও ধাঁধা।
  • লোকসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গবেষক ড. মযহারুল ইসলাম। তিনিই প্রথম একে Folklore নামকরণ করেন।
  • লোকসাহিত্যের প্রধান শাখাগুলো- ছড়া, গান, গীতিকা, রূপকথা, উপকথা, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি।
  • ছড়াগুলোতে মূলত ছন্দরসের প্রাধান্য পায়। ধাঁধার মাধ্যমে বুদ্ধিচর্চা করা হয়।
  • গীতিকা : এক ধরনের আখ্যানমূলক লোকগীতিকে গীতিকা বলা হয়। জনশ্রুতিমূলক বিষয়াদি গীতিকার মূল ভিত্তি। তবে নাথ গীতিকা ঐতিহাসিক গীতিকা বলে পরিচিত।
আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য-
  • ১৭ শতকে আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। আরাকানকে সংস্কৃত ভাষায় ‘রোসাঙ্গ’ বলা হয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা সাধারণত মগ নামে পরিচিত। আরাকান রাজসভার সাহিত্যকর্ম-
  • আরও পড়ুন : চর্যাপদের ইতিবৃত্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top