Skip to content

ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থান ও বাংলায় হাবশি শাসন- বঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস

    ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থান (১৪৪২-১৪৮৭)

    • ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থানে সর্বপ্রথম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ক্ষমতায় আসেন। তাঁকে অনেকটা জোর করেই ক্ষমতায় বসানো হয়। তাঁর আমলে বঙ্গের পশ্চিম সীমান্তে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় ছিল। তাঁর সেনাপতি খান জাহান আলী যশোর ও খুলনা বিজয় করে ‘খলিফাতাবাদ’ নাম দেন। পরবর্তীতে বরবক শাহ, শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ, সিকান্দর শাহ ও জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ ক্ষমতায় আসেন। তবে পূর্বপুরুষদের হাবশি প্রীতির জন্য জালালুদ্দিন হাবশিদের হাতে নিহত হন। ১৪৪২ সালে ক্রীতদাস নাসির খান আহমদ শাহকে হত্যা করলে আমীররা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। কিন্তু ১৪৮৭ সালে জালালুদ্দিন ক্রীতদাস কর্তৃক নিহত হলে কেউ প্রতিবাদ করেনি। ফলে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটে।

      সুলতানি আমলের ভবন
      সুলতানি আমলের ভবন
    • নাসিরউদ্দিন মাহমুদ-

    • তাঁর রাজত্বকালে বাংলার সাথে দিল্লির যুদ্ধ হয়নি। তিনি রাজ্যের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের দিকে সময় ও মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। এছাড়াও তিনি বাংলার সামরিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। তাঁর রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল মুসলিম উপনিবেশের সম্প্রসারণ এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের বসতি স্থাপন। এই সময় খান জাহান আলী (উলুঘ খান) খুলনা-যশোর জয় করেন। তিনি পশ্চিমে ভাগলপুর, পূর্বে ময়মনসিংহ ও সিলেট, উত্তরে গৌড়-পান্ডুয়া এবং দক্ষিণে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আমলে চীনের সাথে বাংলার সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
      তাঁর নির্মিত মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম ষাটগম্বুজ মসজিদ, মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরে সরফরাজ খানের মসজিদ, ঢাকার বখত বিনত মসজিদ এবং ভাগলপুরে খুরশীদ খানের মসজিদ। ২৪ বছর শান্তিপূর্ণ রাজত্বের পর ১৪৫৯ সালে তিনি মারা যান।

      সুলতানি আমলের মসজিদ
      সুলতানি আমলের মসজিদ
    • রুকনুদ্দীন বারবক শাহ

    • তিনি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র ও বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি ২১ বছর রাজত্ব পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ১৪৫৫-১৪৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাবার সাথে যুক্তভাবে এবং ১৪৭৪-১৪৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর ছেলের সাথে যুক্তভাবে ক্ষমতায় থাকেন। বাংলার অনেক সুলতানই রাজত্বের শেষদিকে ছেলের সাথে যুক্তভাবে রাজত্ব করেছেন। সুলতানের মৃত্যুর পর যাতে ছেলেদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে যেন সংঘর্ষ না হয় তাই এই প্রথা চালু হয়েছিল। তিনি কবি মালাধর বসুকে ‘গুণরাজ খান’ ও তাঁর পুত্রকে ‘সত্যরাজ খান’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। বারবক শাহ অনেক নতুন রাজ্য নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। বাইরে থেকে বাংলায় মুসলমানদের আগমন ও বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া তাঁর আমলেও অব্যাহত ছিল। এরই প্রেক্ষিতে ইসমাইল গাজী বাংলায় আসেন ও পরবর্তীতে তাঁর সেনাপতি হন। কেবল হিন্দু মুসলমান না, তিনি ভিনদেশিদেরও রাজকার্যে নিয়োগ দিতেন। তিনি বাংলায় ৮০০০ হাবশিকে সেনাবাহিনী ও রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন। হাবশিদের এই অনুপ্রবেশ বাংলার ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তিনি আফগানদের সহায়তায় ত্রিহুত আক্রমণ করে হাজীপুর দুর্গ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে উত্তরে বুড়িগন্দক নদী পর্যন্ত তাঁর কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয়।
    • শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ-

    • তিনি ১৪৭৬-৮১ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্ব ছয় বছর স্থায়ী হইয়াছিল। তিনি আইন শৃঙ্খলা কঠোরভাবে পরিচালনা করতেন। তিনি তাঁহার রাজ্যে প্রকাশ্যে মদপন বন্ধ করেন।
    • জলালুদ্দীন ফতেহ শাহ- 

    • তিনি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র। বিভিন্ন মুদ্রা থেকে জানা যায় তার অন্য নাম ছিল হোসেন শাহ। বরবক শাহের প্ররোচনায় পাইকরা (প্রাসাদরক্ষী) তাকে হত্যা করে। ফতেহ শাহর মৃত্যুর সাথে সাথেই বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্ব শেষ হয়।

      হাবশি শাসন (১৪৮৭-১৪৯৩)

    • হাবশিরা আফ্রিকা মহাদেশের আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) অধিবাসী। পর্তুগিজ নাবিকরা বাণিজ্যিক পণ্যের সাথে সাথে হাবশিদের ধরে এনে ভারতে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। অবশ্য বেশ কিছু আবিসিনায় স্বেচ্ছায় ভাগ্যোন্নয়নের জন্য উপমহাদেশে হাজির হয়। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনামলে বহু হাবশিকে ক্রীতদাস হিসেবে বঙ্গে আনা হয়। ক্রমেই তারা এদেশীয় রাজাদের সহযোগিতায় শক্তিশালী হয়ে উঠে। হাবশিদের শক্তি বৃদ্ধিতে সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলার ইতিহাসে হাবশি শাসন ছিল মাত্র ছয় বছর। এর মধ্যে চারজন শাসন করেছেন। সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ ব্যতীত সবাই নিহত হয়।
    • বরবক শাহ : জালালউদ্দিন ফতেহ শাহকে হত্যা করে বরবক শাহ ‘সুলতান শাহজাদা’ উপাধি নিয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসে। তিনি জাতিতে হাবশি ছিলেন। এর মাধ্যমে বাংলায় হাবশি শাসন শুরু হয় যা বাংলার ইতিহাসে অন্ধকার যুগ। তিনি ফতেহ শাহের কর্মচারিদের ক্ষমতাচ্যুত করে। ফতেহ শাহের মৃত্যুর সময় সেনাপতি মালিক আন্দিল রাজ্যের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সীমান্তে অবস্থান করে। বরবক শাহ এই মালিক আন্দিলকে ক্ষমতাচ্যুত করে নি। বরং মালিক আন্দিল থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিশ্চিন্তে শাসন করে। কিন্তু মালিক আন্দিল প্রভু হত্যার প্রতিশোধে দৃঢ় ছিল। তিনি পরবর্তীতে বরবক শাহকে হত্যা করে ফতেহ শাহের দুই বছরের শিশুকে ক্ষমতায় বসানোর কথা বলে। কিন্তু ফতেহ শাহের স্ত্রী নাবালগ শিশুকে ক্ষমতায় বসাতে অস্বীকার করে। ফলে সভাসদগণ মালিক আদিলকেই ক্ষমতায় বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়
    • সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ : মালিক আন্দিল ‘সাইফউদ্দিন ফিরোজ’ উপাধি ধারণ করে রাজ্যভার গ্রহণ করে। জনগণ এতে স্বস্তি লাভ করে। সুশাসক, দানশীল ও কর্মঠ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। তিনি হাবশিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শাসক। ইলিয়াস শাহী বংশের লোকজনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য আফগান বা তুর্কি আমিরগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে শাহস পায় নি। ১৪৯০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পর নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ও শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ ক্ষমতায় বসেন। ১৪৯৩ সালে মুজাফফর শাহকে পরাজিত করে আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ বঙ্গের সিংহাসনে বসেন এবং বঙ্গে হুসাইন শাহী বংশের শাসন শুরু হয়। 
    • শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ : তিনি বহু সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করেন। অত্যাচারী রাজা হিসেবে কুখ্যাতি ছিল। পরবর্তীতে তাঁর মন্ত্রী সৈয়দ হোসেন (আলাউদ্দিন হোসেন শাহ) তাকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই বাংলায় হাবশি শাসনের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সিংহাসনে বসে হাবশিদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। রুকনুদ্দীন বরবক শাহের আমলে যারা এদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রথম অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ক্ষমতায় আরোহণ ও তার ঠিক কয়েক বছর পরই সদলবলে বিদায় নাটকীয় ব্যাপার। হাবশীদের চেয়ে অনেক বেশি দুরন্ধর ছিল এদেশীয় পাইকরা।

    • পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : রাজা গণেশের শাসন
      পরবর্তী আলোচনা পড়ুন : আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসন

    Leave a Reply

    You cannot copy content of this page