বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ (মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মত্যাগ)
(অবাক হয়ে) “এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে, (দুঃখে) (আপন চাচা বিশ্বাসঘাতকতা করায়)
“জানিনু (জানলাম) কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল (প্রবেশ করল) (বিভীষণের সহায়তায়)
রক্ষপুরে! হায়, তাত (পিতা/ এখানে চাচা অর্থ), উচিত কি তব (তোমার)
এ কাজ? (বিশ্বাসঘাতকতা) নিকষা সতী (রাবণের মাতা) তোমার জননী!
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ! (রক্ষঃপুরের শ্রেষ্ঠ রাজা) শূলিশম্ভুনিভ (শিবের মতো অস্ত্র/শূল আছে যার)
কুম্ভকর্ণ! ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী! (দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে জয় করেছে/ ইন্দ্রজিৎ)
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে? (নিজের ঘরের পথ চোরকে দেখিয়ে দিলে?)
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে? (নীচু শ্রেণির লোককে রাজার আসনে বসিয়ে দিলে?)
কিন্তু নাহি গঞ্জি (তিরস্কার) তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে, (লক্ষ্মণকে মৃত্যুপুরীতে পাঠাব)
লঙ্কার কলঙ্ক (লক্ষ্মণের প্রবেশ) আজি ভঞ্জিব (দূর করব) আহবে।” (যুদ্ধ করে)
উত্তরিলা (উত্তর দিল) বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা, (অস্ত্র আনার সুযোগ চাওয়া)
ধীমান্। রাঘবদাস (রামের দাস) আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে (তোমার অনুরোধ রাখতে গিয়ে কীভাবে রামের বিরুদ্ধে কাজ করব?)
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;- (মেঘনাদ)
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে! (তোমার কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে)
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে! (এই কথা কীভাবে মুখে আনলে আমাকে বল)
স্থাপিলা বিধুরে (চাঁদ) বিধি (খোদা) স্থাণুর ললাটে; (বিধাতা চাঁদকে আকাশে নিশ্চলভাবে স্থাপন করেছেন)
পড়ি কি ভূতলে শশী (চাঁদ) যান গড়াগড়ি (আকাশের চাঁদ কি মাটিতে গড়াগড়ি খায়?)
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে? (উঁচু বংশে)
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে (পদ্মবনের স্বচ্ছ দীঘিতে রাজহাঁস খেলা করে সে কি কখনো কাদা-শ্যাওলায় যায়?)
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে (সিংহ কি কখনো শিয়ালের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে?)
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত (অজানা) নহে কিছু তোমার চরণে। (নিকট)
ক্ষুদ্রমতি নর, (ছোটমনা লোক) শূর, (শক্তিমান) লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে (যোদ্ধা) কি সে সম্বোধে (আহ্বান) সংগ্রামে? (নিরস্ত্র যোদ্ধাকে যুদ্ধে আহ্বান করতে পারে?)
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা? (বীরের প্রথা)
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি! (সুমিত্রার খারাপ ছেলে/ লক্ষ্মণ) (সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করে)
দৈব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছে, (দেবতা-দৈত্যের সাথে মেঘনাদ যুদ্ধ করেছে যা রাবণ দেখেছে)
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! (লক্ষ্মণের কী আছে) কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগলভে (নির্ভয়ে) পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর (আদেশ কর) দাসে, শাস্তি নরাধমে।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ (প্রবেশ) করে
বনবাসী! (লক্ষ্মণ) হে বিধাতঃ নন্দন-কাননে (স্বর্গের উদ্যানে দৈত্য ভ্রমণ করছে)
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে (ফুটন্ত পদ্মবনে কীটের বাস)
কীটবাস? কহ তাত, সহিব কেমনে?
হেন (এই) অপমান আমি,-ভ্রাতৃ-পুত্র তব? (তোমার ভাতিজা হয়ে এই অপমান আমি কীভাবে সহ্য করব)
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্র-বলে যথা (যেভাবে) নম্রশিরঃ ফণী, (মন্ত্রের কারণে সাপ যেভাবে মাথা নিচু করে থাকে)
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী (মলিন ও লজ্জা মুখে বিভীষণ মেঘনাদকে লক্ষ্য করে উত্তর দিল)
রাবণ-অনুজ (বিভীষণ), লক্ষি (লক্ষ্য করে) রাবণ-আত্মজে; (মেঘনাদ)
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে (শুধু শুধু আমাকে তিরস্কার করছ)
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা (বিপদগ্রস্ত করা)
এ কনক-লঙ্কা (স্বর্গীয় লঙ্কারাজ্য) রাজা, মজিলা আপনি! (বিপদে পড়া)
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে (এখন) (দেবতাদের সর্বদা পাপমুক্ত থাকা উচিত)
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি (মহাপ্রলয়ে পৃথিবী যেভাবে ধ্বংস হয়)
বসুধা (পৃথিবী), ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে! (সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে)
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী (এজন্য আমি রামের আশ্রয় গ্রহণ করেছি)
তেঁই (এজন্য) আমি। পরদোষে (রাবণের দোষে) কে চাহে মজিতে?” (পরের দোষে কে বিপদে পড়তে চায়?) (বিভীষণের নৈতিকতা প্রকাশ)
রুষিলা (রাগান্বিত হওয়া) বাসবত্রাস! গম্ভীরে যেমতি (যেভাবে)
নিশীথে অম্বরে (আকাশ) মন্দ্রে (আওয়াজ) জীমূতেন্দ্র কোপি, (মেঘের গর্জন) (গভীর রাতে আকাশে যেভাবে বজ্রের আওয়াজ হয়)
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,- “ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি;- কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, – এ সকলে দিলা (কোন নীতি অনুসারে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছ?)
জলাঞ্জলি? (বিসর্জন) শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা! (গুণী পরজনের চেয়ে গুণহীন স্বজন অনেক ভালো)
এ শিক্ষা, (সম্পর্ক ছিন্নের শিক্ষা) হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে, (অসৎ সঙ্গের কারণে কেনই বা মন্দ কাজ শিখবে না)
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ (নীচু প্রকৃতির বন্ধু), নীচ সে দুর্মতি।” (অসৎ বুদ্ধির অধিকারী)
- বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এটি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের ‘বধো’ (বধ) নামক ষষ্ঠ সর্গ থেকে নেওয়া হয়েছে।
- কবিতায় বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে ব্যবহৃত বিশেষণ-
রাবণ : রক্ষঃশ্রেষ্ঠ
রাম : রাঘব, অধম
কুম্ভকর্ণ : শূলিশম্ভুনিভ
বিভীষণ : তাত, পিতৃব্য, রক্ষোরথি, বীরকেশরী, মহারথী, রথী, রক্ষোমণি, রাবণ-অনুজ, রক্ষোবর, ধর্মপথগামী, রাক্ষসরাজানুজ
মেঘনাদ : অরিন্দম, বাসববিজয়ী, রাবণি, বাসবত্রাস, ধীমান, দাস, পরাক্রম দাস, বীরেন্দ্র বলী, রাবণ-আত্মজ, অস্ত্রহীন যোধে
লক্ষ্মণ : চণ্ডাল, তস্কর, রামানুজ, ক্ষুদ্রমতি, সৌমিত্রি কুমতি, দম্ভী, বনবাসী, দুরাচার দৈত্য - বিভীষণকে তুলনা দেওয়া হয়েছে : নম্রশিরঃ ফণী, আকাশের চাঁদ, স্বচ্ছ সরোবর, সিংহ
- লক্ষ্মণকে তুলনা দেওয়া হয়েছে : শিয়াল, মাটির চাঁদ, শ্যাওলা
- আরও পড়ুন : নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা