Skip to content

বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ- অনুধাবনমূলক প্রশ্ন

বিদ্রোহী কবিতার বিশ্লেষণ

বল বীর –
বল উন্নত মম শির! (আপন তেজ, বীরত্ব ও ত্যাগের মহিমায়)
শির নেহারি’ (দেখে) আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির (হিমালয়ের চূড়া)! (প্রবল আত্মবিশ্বাস প্রকাশ)
আমি চিরদুর্দম (দমন করা যায় না), দুর্বিনীত (বিনয়ী নয়), নৃশংস, (শত্রুবধে প্রয়োজনে হিংস্র)
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ (শিব) (চেতনাশক্তির তীব্রতা/ নৃত্যের ছন্দে সব ধ্বংস করা),
(সব অপশক্তিকে ধ্বংস করে শিবের মতো নৃত্য করবে)
আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
[সাইক্লোন (দক্ষিণ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর), টাইফুন (উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর), হারিকেন (উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর) সবগুলোই গ্রীষ্মকালীন ঝড়]
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার, (সহজে প্রতিরোধ করা যায় না)
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
(পরাধীন জাতির আত্মোপলব্ধি জাগাতে বিদ্রোহী চেতনার সঞ্চার)
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! (অনিয়ম অসাম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ)
আমি মানি না কো কোন আইন, (শোষকের অন্যায়ের অবসানের জন্য)
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি,
আমি টর্পেডো, আমি ভীম (দ্বিতীয় পাণ্ডব) ভাসমান মাইন। (শিব ও কালবৈশাখি ঝড়ের মতো সব ধ্বংস)

আমি ধূর্জটি (শিবের জটা চুল), আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর! (বিশ্ব বিধাতার বিদ্রোহী পুত্র)

আরও পড়ুন- মানব কল্যাণ, অপরিচিতা, আঠারো বছর বয়স, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!
আমি (মুক্তিপাগল প্রতিটি মানুষ) সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, (শোষিতের লোকালয় ও শোষকের শ্মশান)
আমি অবসান, নিশাবসান। (রাতের অবসান)
আমি ইন্দ্রাণী-সুত (ইন্দ্রাণী বা শচী। তার পুত্র জয়ন্ত) হাতে চাঁদ ভালে (কপাল) সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য; (বিদ্রোহী ও প্রেমের দ্বৈতসত্তা)

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! (আত্মশক্তির উপর প্রবল বিশ্বাস)
আমি বজ্র (বাজ), আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, (উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বাদ্যযন্ত্রের ওঙ্কার ধ্বনি)
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার, (বিধ্বংসী রূপ উন্মোচন)
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, (শিবের হাতের ডুগডুগি) ধর্মরাজের দণ্ড, (ন্যায়বিচারকের হাতের লাঠি)
আমি চক্র (বিধ্বংসী ক্ষমতার প্রতীক) ও মহা শঙ্খ (মঙ্গলের প্রতীক), (বিষ্ণু দেবতার চার হাত)
আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড! (অপশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান)

আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা (রাগী এক ঋষি। মহর্ষি অত্রি ও অনুসূয়া তারা মা বাবা), বিশ্বামিত্র-শিষ্য, (ক্রোধের স্বরূপ উন্মোচন)
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস (একমাত্র অবলম্বন), হা হুতাশ আমি হুতাশীর। (বিধবা ও হতাশ লোকদের দুঃখ অনুভব। পীড়িত মানুষের প্রতি কবির সমবেদনা প্রকাশ)
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, (উদ্বাস্তুদের মনঃকষ্ট অনুভব করতে পারি)
আমি অবমানিতের (অপমানিত) মরম বেদনা, বিষ–জ্বালা,
প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের (লাঞ্ছিতদের বুকে আশা জাগাই ও তাদের অধিকার আবার ফিরিয়ে দিই)

আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল (পশ্চিম পর্বতের বাতাস) উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিনী (বাউলের গানের সুর), বেণু-বীণে গান গাওয়া। (বাঁশের বাঁশিতে গান)
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা (গ্রীষ্মের তীব্র তৃষ্ণা), আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর (মরুর ঝরনাধারা), আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! (সবুজ গাছপালার সমারোহ)
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, (বাঙালি জাতিকে বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্রে জাগাতে)
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম (উত্তাল সমুদ্রকে শান্ত করে দেয়)
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম (অকৃত্রিম ভালোবাসায় সমস্ত পৃথিবীকে নিশ্চুপ করে দেয়)
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’ (ভুলে যায়)
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। (কোমল ও প্রেমময় রূপ)

আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল (পৃথিবী) ব্যাপিয়া! (সমগ্র বিশ্বে বিদ্রোহের বার্তা বহন করে)
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার (বীরত্বের ধরন ও সংগ্রামী চেতনার স্বরূপ) (পরশুরাম বিষ্ণুর ৬ষ্ঠ অবতার। সে কুঠার দিয়ে মাতৃহত্যা করে। ২১ বার ক্ষত্রিয়দের নিধন করেছিল)
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! (বিশ্ব থেকে যুদ্ধ দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনা)
আমি হল (লাঙল) বলরাম-স্কন্ধে (নিজের শক্তিমত্তা ও বিদ্রোহী চেতনার গুরুত্ব)
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না – (বঞ্চিতদের প্রতি ভালোবাসা)
অত্যাচারীর খড়গ (বলির অস্ত্র) কৃপাণ (তরবারি) ভীম রণ-ভূমে রণিবে না–
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি চির-বিদ্রোহী বীর–
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির! (অন্যায় অবসানে একাই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে)

  • কবিতায় আমি কে? 

  • কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে বিদ্রোহ উপস্থিত করেছেন এবং ‘আমি’ বলে যে শক্তিকে মূর্ত করে তুলেছেন তার প্রকৃতি সম্বন্ধে বিরোধী ব্যাখ্যাই কবিতাটি সম্পর্কে এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ।
    ‘আমি’ বলতে শুধুই ব্যক্তিগতভাবে কবিকে মনে করা ঠিক হবে না—এ ‘আমি’ কোনো বিশেষ ‘আমি’ নয়, এর পরিচয় আরও বিস্তৃত। কবি এখানে নতুন যুগের মানুষের চিত্তজাগরণের অগ্রদূত, তিনি শুধু নিজের মুক্তিই অনুভব করেননি—তাঁর মনে প্রাণে জেগেছে নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করার নেশা। কবি কেবলমাত্র নিজে স্বাধীন, একথা উচ্চারণ করেননি, তিনি সদ্য জাগ্রত মানুষের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে তাদেরও চিত্তজাগরণের মন্ত্রপাঠ করিয়েছেন।

  • বিদ্রোহী মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত হলেও সর্বত্র পূর্ব ও মাত্রাসংখ্যা সমভাবে সুরক্ষিত হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একশ ছেচল্লিশ বার ব্যবহৃত ‘ আমি’র অধিকাংশ ‘ আমি’ই অতিপর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা সর্বত্রই দুই মাত্রা কিন্তু প্রতি পঙ্ক্তির শেষ অপূর্ণ পর্বটি সর্বত্র সমমাত্রাসম্পন্ন নয়। সর্বোপরি, অতিপর্ব, অপূর্ণ পর্ব এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কবিতাটি ২ + ৬ + ৪ পূর্ণমাত্রাকারে সুবিন্যস্ত।
  • বানান সতর্কতা : কুর্নিশ, পিনাক, শিঙা, বেদুইন, ধূর্জটি, দুর্বিনীত, হিমাদ্রি ইত্যাদি।

  • কবি নিজেকে প্রকাশ করেছেন-
    ইস্রাফিলের শিঙার মহাহুঙ্কার
    পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশূল
    ধর্মরাজের দণ্ড
    বিশ্বামিত্রের শিষ্য
    বিধবার বুকের ক্রন্দন-শ্বাস
    গৃহহারা পথিকের বঞ্চিত ব্যথা
    অবমানিতের মরম বেদনা
    পথিক কবির গভীর রাগিণী
    অর্ফিয়াস ও শ্যামের হাতের বাঁশরি
    পরশুরারামের কঠোর কুঠার
    বলরামের কাঁদের লাঙল

 

 

14 thoughts on “বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ- অনুধাবনমূলক প্রশ্ন”

  1. স্যার আপনার ওয়েবপেজ কেন আগে খুজে পাই নাই ।এখন আপসোস হচ্ছে

  2. মোঃ শহিদুল ইসলাম যশোরী

    অনেক দিনের জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page