ভারতবর্ষে মুগলদের ক্ষমতারোহণ
-
মুঘল কারা? কোথা থেকে এসেছে?
- মুঘলদের পরিচয় : মুঘল কথাটি এসেছে ‘মোঙ্গল’ শব্দ থেকে যার অর্থ নির্ভীক। এদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মঙ্গোলিয়ায়। এরা বহু দলে উপদলে বিভক্ত ছিল। মোগল নেতা তেমুচিন সব মুঘলকে একত্র করে তাতার জাতিকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ায় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য তেমুচিনকে পরবর্তীতে ‘চেঙ্গিস খা’ বা ‘অসীম শক্তিশালী’ উপাধি দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার দ্বিতীয় পুত্র চাঘতাই খাঁ মধ্য-এশিয়ার নেতা হন। তার বংশধর তৈমুর লং ১৩৯৮ সালে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে প্রচুর লুটপাট চালায়।
তুর্কির এই চাঘতাই বংশে বাবর জন্মগ্রহণ করেন। পিতার দিক থেকে বাবর ছিলেন তৈমুর লংয়ের বংশধর ও মাতার দিক থেকে তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধর। তবে প্রকৃত অর্থে বাবর মোঘল বংশোদ্ভূত ছিলেন না। বাবর তুজুক-ই-বাবুরিতে নিজেকে চাঘতাই তুর্কি বলে অভিহিত করেছেন।
জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের শাসনামল
- বাবরের প্রাথমিক জীবন : বাবর শব্দের অর্থ সিংহ। ১৪৮৩ সালে মধ্য এশিয়ার ফারগানায় জন্মগ্রহণ করন। শৈশবে বাবার মৃত্যুর পর তিনি ফারগানার ক্ষমতায় বসেন। এরপর তিনি উজবেক নেতা সাইবানির বিরোধিতার সম্মুখীন হন। ১৪৯৭ সালে সমরকন্দ নেতাদের সুযোগে কলহের সুযোগে বাবর তা দখল করে। কিন্তু নিজ রাজ্যে ষড়যন্ত্রের সংবাদ তাকে ফারগানায় ফিরে যেতে বাধ্য করে। ১৫০১ সালে বাবর পুনরায় সমরকন্দ আক্রমণ করেন কিন্তু সাইবানির নিকট পরাজিত হন। এসময় তাকে ফারগানা থেকেও বিতাড়িত করা হয়। ফলে বাবর নিরাশ্রয় যাযাবরের মতো জীবন গ্রহণ করতে হয়।
১৫০৪ সালে কাবুলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে বাবর কাবুল দখল করে পুনরায় রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এর মধ্যে পারস্যের রাজা ইসমাইলের সাথে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং ‘শিয়া’ মত গ্রহণের শর্তে পারস্যে সম্রাট বাবরকে ফারগানা ও সমরকন্দ দখলে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৫১১ সালে বাবর সমরকন্দ দখল করেন। কিন্তু শিয়ামত সমর্থন করায় সমরকন্দের অধিবাসীরা বাবরের প্রতি বিরূপ হন। মাত্র আট মাস সমরকন্দের সিংহাসন রাখতে সমর্থ হন। ১৫১২ সালে বাবর গাজদাওয়ানের যুদ্ধে উজবেকদের কাছে পরাজিত হয়ে কাবুলে ফিরে যান। -
বাবরকে কেন ভারত আক্রমণে আমন্ত্রণ জানানো হয়?
- ভারতবর্ষে বাবরের প্রাথমিক অভিযানসমূহ : বাবরের আক্রমণের সময় উপমহাদেশের কোনো সার্বভৌম রাজশক্তি ছিল না। এমতাবস্থায় বিদেশি শক্তির পক্ষে ভারত বিজয় সহজ ছিল। বাবর ভারতের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সঠিক সময় বেছে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি।
ভারতে চূড়ান্ত আঘাতের পূর্বে বাবর কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক অভিযান চালায়। ১৫১৯ সালে তিনি ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভেরা দখল করেন। চেনাব নদীর অববাহিকা বিনা বাধায় জয় করেন। ১৫২০ সালে বদখশান জয় করে পুত্র হুমায়ুনকে শাসনে বসান। ১৫২২ সালে কান্দাহার জয় করে পুত্র কামরানকে শাসক করেন। ভারতে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য বাবর উপযুক্ত সময় খুঁজছিলেন। অবশেষে ১৫২৪ সালে পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খান ও ইব্রাহিম লোদীর চাচা আলম খান বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। বাবরের আক্রমণের প্রতি মেবারের রানা সংগ্রামের সমর্থন ছিল।
বাবর প্রথমে লাহোর দখল করেন। এরপর শিয়ালকোট, দিপালপুর ও পাঞ্জাবের অন্যান্য স্থান দখল করেন। পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খান মনে করেছিল যে বাবর তাকে পাঞ্জাবের শাসক করে কাবুলে ফিরে যাবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় তিনি বাবরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে পরাজিত হন। এরপর বাবর পাঞ্জাবকে কয়েকভাগে বিভক্ত করে দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার, ইব্রাহিমের চাচা আলম ও মুঘল আমিরদের মধ্যে বণ্টন করে কাবুলে ফিরে যান। কারণ এই সময় হুমায়ুনের রাজ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। বাবরের অনুপস্থিতিতে দৌলত খান তাদের বিতাড়িত করে পাঞ্জাব পুনরুদ্ধার করে। এমতাবস্থায় আলম খান কোনো উপায় না দেখে কাবুলে গিয়ে বাবরের সাহায্য চায়। বাবর পাঞ্জাবের মুঘল আমিরদের আলম খানকে সাহায্যের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আলম খান ভারতে ফিরে এসেই দৌলত খানের সাথে হাত মেলান। বাবর এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং উভয়কে শাস্তি দেওয়ার জন্য ১৫২৫ সালে ভারত বিজয়ের সংকল্প নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। দৌলত খান বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাঞ্জাব সহজেই বাবরের হস্তগত হয়। দিল্লি প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়। -
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ-
- পানিপথের প্রথম যুদ্ধ : ১৫২৬ সালে বাবর যমুনা নদীর তীর ধরে ঐতিহাসিক পানিপথ প্রান্তরে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে মাত্র ১২০০০ সৈন্য ছিল। অপরদিকে ইব্রাহিম লোদী প্রায় এক লক্ষ পদাতিক ও এক হাজার হস্তীবাহিনী নিয়ে পানিপথে আসেন। উভয় পক্ষ সৈন্য নিয়ে কয়েক মাইল ব্যবধানে ১২-১৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিন অপেক্ষা করে। অবশেষে বাবর সৈন্যদের আক্রমণের নির্দেশ দেন। এই যুদ্ধে তিনি কামান ও বন্দুক ব্যবহার করেন। ফলে আফগানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। স্বয়ং ইব্রাহিম লোদি নিহত হন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সুলতান যিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। বাবর দিল্লি ও আগ্রা দখল করে। ২৭ এপ্রিল মসজিদে বাবরের নামে খুৎবা পাঠ করা হয় এবং বাবর নিজেকে ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে।
-
বাবরের সাফল্যের কারণ-
পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্য এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাবরের সাফল্যের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ-
১. বাবরের ভারত অভিযানের সময় ভারতবর্ষ পারস্পরিক আত্মকলহে লিপ্ত ছিল। এটি কেবল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাবেশ মাত্র। বিদেশি আক্রমণ মোকাবিলায় এসব রাজ্যসমূহের কোনো ভূমিকাই লক্ষ্য করা যায়নি।
২. ইব্রাহিম লোদির সকল সেনাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। এর অধিকাংশই ছিল অনিয়মিত বেতনভুক্ত সৈন্য।
৩. ভারতবর্ষের সমর ইতিহাসে বাবর সর্বপ্রথম গোলন্দাজ বাহিনী মোতায়েন ও কামানের ব্যবহার করেন। গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের আঘাতে ইব্রাহিম লোদির বিশাল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। -
রাজপুতদের সঙ্গে সংঘর্ষ : খানুয়ার যুদ্ধ ও চান্দেরি দুর্গ দখল
বাবর দিল্লির সিংহাসনে বসলেও ভারতবর্ষের বিরাট অংশ তখনও তার কর্তৃত্বের বাইরে ছিল। এই সময় বাবরের বড় বাধা ছিল মেবারের রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুত শক্তি। দুর্ধর্ষ এই রাজপুত নেতা দিল্লিতে হিন্দুরাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখত। তার উদ্দেশ্য পূরণে সে বাবরকে দিল্লি আক্রমণে আমন্ত্রণ জানায়। তার ধারণা ছিল বাবর তৈমুর লংয়ের মতো ধন-সম্পদ লুট করে ফিরে যাবে। কিন্তু বাবর ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তুললে সংগ্রাম সিংহ তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে।
রানা সংগ্রাম ভিলসা, মারওয়ার, চান্দেরি, মেওয়াট প্রমুখ রাজাদের নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করেন। তিনি ৮০ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০০ হাতি নিয়ে বাবরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। বাবর সিক্রির অদূরে খানুয়া নামক স্থানে সেনা শিবির স্থাপন করেন। প্রতিপক্ষের প্রস্তুতি দেখে বাবরের সেনারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বাবর জিহাদের ঘোষণা দিয়ে সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করেন।
১৫২৭ সালের মার্চে যুদ্ধ শুরু হয়। রাজপুতগণ অসাধারণ পারদর্শিতা দেখানো সত্ত্বেও বাবরের নিকট পরাজিত হয়। কামানের আক্রমণে টিকতে না পেরে রানা সংগ্রামের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বাবর এ যুদ্ধেও তুলঘমা নীতি (উজবেকি ও তুর্কিদের নতুন যুদ্ধ কৌশল) ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। রানা সংগ্রাম আহত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। কিছুদিন পর তার সহযোগিরা তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।
১৫২৮ সালে বাবর চান্দেরি দুর্গ অবরোধ করেন। রাজপুত বাহিনী পরাস্ত হয়। দুর্গে অবস্থানকারী প্রায় সকল রাজপুত মুঘলদের হাতে নিহত হয়। চান্দেরির পতনের পর বাবরকে প্রতিহত করার শক্তি রাজপুতদের ছিল না। খানুয়ার যুদ্ধের পর বাবর বুঝেন যে দিল্লির সিংহাসন তাঁর জন্য নিরাপদ। সেজন্য তিনি কাবুলে ফিরে না গিয়ে রাজধানী কাবুল থেকে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করেন। বাবর এরপর বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। -
আফগানদের সঙ্গে সংঘর্ষ : গোরার যুদ্ধ
আফগানরা পুনরায় জৌনপুরের শাসক মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। বাবর তখন পুত্র আসকারিকে মাহমুদ লোদির বিরুদ্ধে পাঠায় এবং বিহারসহ অনেক এলাকা দখল করে। এই সময় অনেক আফগান সর্দার মাহমুদ লোদির পক্ষ ত্যাগ করে বাবরের অধীনতা মেনে নেয়। মাহমুদ লোদি হতাশ হয়ে বাংলার সুলতান নসরত শাহের আশ্রয় নেয়। বাবর বাংলার দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। ১৫২৯ সালে গোগরার যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়।
নসরত শাহের বাবরের সাথে নসরত শাহের এক সন্ধি হয় যেখানে নসরত শাহ মোগল আফগান যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে বাবর নসরত শাহের রাজ্যসীমা মেনে নেয় এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করে। এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে বাবরের বিজয় অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। এভাবে পানিপথ, খানুয়া ও গোগরা তিনটি যুদ্ধে সাফল্যের ফলে আমুদরিয়া থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়া পর্যন্ত প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত বাবরের দখলে আসে। ১৫৩০ সালে বাবর আগ্রায় ইন্তেকাল করেন। তুর্কি ভাষায় রচিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুযুক-ই-বাবরি’।
নাসিরুদ্দিন হুমায়ুনের শাসনামল
- হুমায়ুন : ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাবর মারা যান। ২৯ ডিসেম্বর আগ্রাতে ২২ বছর বয়সী নাসিরুদ্দিন হুমায়ুনের অভিষেক হয়। তাঁর সৎভাই মির্জা কামরান কাবুল ও কান্দাহারের শাসক হয়। হুমায়ুনের শাসনামলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায় ১৫৩০-১৫৪০ সাল
দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫৫৫-১৫৫৬ সাল। মাঝের ১৫ বছর তিনি পারস্যে প্রবাস জীবন যাপন করেন। বাবার মতো সেও রাজত্ব হারিয়ে রাজত্ব ফিরে পায়।
শাসনের শুরু থেকেই তাঁকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়। আফগান, বাহাদুর শাহ ও কামরান বিদ্রোহ করে। কাবুল-কান্দাহার ও পাঞ্জাবে স্বাধীন শাসন শুরু হয়। হুমায়ুনের নিষ্ক্রীয়তার সুযোগে গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ মেবারের রানার সাহায্যে মালব দখল করে। এমনকি সে পর্তুগিজদের কর প্রদানে বাধ্য করে। বাহাদুর শাহ বিদ্রোহী মুঘল আমিরদের আশ্রয় দিলে হুমায়ুন ক্ষুব্ধ হয়। ১৫৩৪ সালে হুমায়ুন চিতোর দখল করেন। একই বছর হুমায়ুন গুজরাট দখল করে। ভাই মীর্জা আসকারিকে গুজরাটের শাসক করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাহাদুর শাহ তা পুনর্দখল করে। বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গঠিত মোগল সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। - তাঁর শাসনামল তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. সংগ্রাম (১৫৩০-১৫৪০) :
১৫৩১ সালে হুমায়ুন কালিঞ্জর দুর্গ জয় করেন। ১৫৩২ সালে মাহমুদ লোদিকে দৌরার যুদ্ধে পরাজিত করে চুনার দুর্গ জয় করার চেষ্টা করলে শেরশাহ হুমায়ুনের অধীনতা স্বীকার করে চুনার দুর্গ রক্ষা করে। ১৫৩৩ সালে দিল্লির নিকট ‘দিনপানাহ’ নামে একটি শহর নির্মাণ করেন। -
শেরখানের সাথে বিরোধ-
- শেরখান ছিলেন পূর্বাঞ্চলে বিহার প্রদেশের আফগান নেতা। ১৫৩১ সালে হুমায়ুন চুনার দুর্গ অবরোধ করলে শেরখান আনুগত্য স্বীকার করে। বিহারের শাসক জামাল খান বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহের সাহায্যে শেরখানের কর্তৃত্ব লোপ করার চেষ্টা করে। শেরখান এই সম্মিলিত বাহিনীকে সুরজগড়ের যুদ্ধে পরাজিত করে বিহারের একচ্ছত্র অধিপতি হন। অতঃপর শেরশাহ বাংলার দুইবার আক্রমণ করে বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রান্তে উপনীত হন।
শেরশাহের এই শক্তিবৃদ্ধিতে হুমায়ুন শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১৫৩৭ সালে তাকে দমন করার জন্য সসৈন্যে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন। হুমায়ুন চুনার দুর্গ দখল করে। গৌড়ের সৌন্দর্য দেখে হুমায়ুন বিমোহিত হন। তিনি এর নাম দেন জান্নাতাবাদ। দীর্ঘ ছয় মাস হুমায়ুন গৌড়ে অবস্থান করেন। এই সুযোগে শেরশাহ বানারস, জৌনপুর দখল করেন। তিনি দিল্লীর সাথে বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেন। হুমায়ুন এমন অবরোধে আতংকিত হয়ে আগ্রার দিকে যাত্রা করে। তিনি ভাইদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেও কেউ তাঁকে সাহায্য করে নি। অবশেষে ১৫৩৯ সালে সংঘটিত চৌসারের যুদ্ধে হুমায়ুন শেরশাহের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। হুমায়ুন কোনোভাবে কিস্তির সাহায্যে গঙ্গা পার হয়ে জীবন রক্ষা করে। এই যুদ্ধের ফলে বাংলা, বিহার, জৈনপুর, কনৌজ শেরশাহের হস্তগত হয়। তিনি বাংলার রাজধানী গৌড়ে গিয়ে ‘শেরশাহ’ উপাধি ধারণ করেন।চৌসারের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে হুমায়ুন পুনরায় ভাইদের নিকট সৈন্য প্রার্থনা করলেও ব্যর্থ হয়। তাই তিনি ৪০ হাজার সেনার এক বাহিনী নিয়ে শেরশাহকে প্রতিরোধ করতে কনৌজের পথে অগ্রসর হন। শেরশাহের সৈন্য ছিল মাত্র ১৫ হাজার। ১৫৪০ সালে কনৌজের অদূরে বিলগ্রামে দুজনের মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ হুমায়ুন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আগ্রার পথে পালিয়ে যায়। শেরশাহ দ্রুত দিল্লী, আগ্রা দখল করলে হুমায়ুন পারস্যে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ভারতে সাময়িকভাবে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং শেরশাহের নেতৃত্বে আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. নির্বাসন (১৫৪০-১৫৪৫) :
- বিলগ্রামের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন লাহোরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলে কামরানের ভয়ে পালিয়ে যান। তিনি অমরকোটের রাজা রানা বীরশালের নিকট আশ্রয় নেন। এই অমরকোটেই ১৫৪২ সালে আকবর জন্মগ্রহণ করেন। সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি ১৫৪৩ সালে আফগানিস্তানের মাধ্যমে পারস্যে যান। পারস্যের বাদশাহ তহমাস্প তাঁকে আশ্রয় দেন। শিয়া মত গ্রহণ ও কান্দাহর পারস্যের শাহকে প্রদান করবেন এই শর্তে পারস্যরাজ ভারত জয়ের জন্য সাহায্য করেন। ১৫৪৫ সালে তার সহযোগিতায় হুমায়ুন কান্দাহার দখল করেন।৩. রাজ্য পুনরুদ্ধার (১৫৪৪-১৫৫৬) : বৈরাম খাঁকে কান্দাহারের শাসক করে হুমায়ুন কাবুলে যাত্রা করেন। ছোটভাই হিন্দাল তাঁকে সাহায্য করে। কামরান ভয়ে পালিয়ে যায়। ১৫৪৬ সালে হুমায়ুন কাবুলে প্রবেশ করেন। ১৫৫১ সালে হুমায়ুন ভাই আসকারিকে মক্কায় পাঠান। ছোটভাই হিন্দাল তাঁর সাথে যুদ্ধে নিহত হয়। ১৫৫৩ সালে কামরানকে বন্দী করে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। পর্যায়ক্রমে ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই হুমায়ুন সদর্পে দিল্লি প্রবেশ করে আগ্রা জয় করে ১৫ বছরের ভ্রাম্যমাণ জীবনের অবসান ঘটান।
রাজ্য ফিরে পেলেও তা বেশিদিন উপভোগ করতে পারেন নি। ১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি দিল্লীর দিনপানাহ গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৬ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর ১৭ দিন গোপন রাখা হয়। এই ১৭ দিন হুমায়ুনের মতো দেখতে মোল্লা বখশি নামে এক ব্যক্তি রাজত্ব পরিচালনা করে।
- অনুশীলন সিরিজের বাংলাদেশ বিষয়াবলি বইতে তথ্যগুলো পাবেন।
- আরও পড়ুন- বাংলায় সুবেদারি শাসন