মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান

ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম আক্রমণ ও মুহাম্মদ বিন কাসিম

  • মুসলিম আক্রমণের সূচনা-

  • ওমর (রা.) শাসনামলে ৬৩৬-৬৩৭ সালে মুসলমানরা প্রথম ভারতে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু এই ধরনের অভিযান অত্যন্ত বিপজ্জনক বিবেচিত হওয়ায় তা নিষেধ করা হয়। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ পরবর্তীতে ভারতে অভিযান পরিচালনা করে। ৬৪৩-৬৪৪ সালে আব্দুল্লাহ বিন আমরের নেতৃত্বে মুসলমানরা সাসানিদ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত কিরমান আক্রমণ করেন। তিনি সিজিস্তান (ইরান) পর্যন্ত অগ্রসর হন। সেখানকার শাসক মুসলমানদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি মাকরান (বেলুচিস্তান উপকূলীয়) আক্রমণ করেন। মাকরান ও সিন্ধুর রাজা যৌথভাবে বাধা দিয়েও মুসলমানদের নিকট পরাজিত হন। মুসলিম সেনাপতি আরও অগ্রসর হতে চাইলে খলিফার অনুমতি না থাকায় তা সম্ভব হয় নি।

    সিজিস্তান সাম্রাজ্য
    ইরানে সিজিস্তান সাম্রাজ্য
  • ভারতবর্ষে আরব বণিকগণ :

  • ব্যাবসায়িক কাজে শ্রীলংকায় অনেক আগে থেকেই আরবরা বসবাস করত। পরবর্তীতে অনেক আরব ইসলাম গ্রহণ করেন। শ্রীলংকার রাজার সাথে মুসলমানদের ভালো সম্পর্ক ছিল। ৭০৭ সালে শ্রীলংকা থেকে একটি জাহাজে করে মুসলমানরা হজ্ব পালনের জন্য সৌদি আরব যাত্রা করেন। এদের মধ্যে আবুল হাসান নামক এক ধনী প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন যিনি লঙ্কা দ্বীপে বাস করতেন। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও ঐ জাহাজ ও যাত্রীদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। ধারণা করা হয় তা জলদস্যু দ্বারা অপহৃত হয়েছে বা সমুদ্রে ডুবে গেছে।

    উমাইয়া খেলাফত
    উমাইয়া খেলাফতের মানচিত্র

    উমাইয়া বংশের প্রথম ওয়ালিদ আরব জাহানের খলিফা থাকা অবস্থায় পূর্বাঞ্চলের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ। খলিফা আল ওয়ালিদ এসব শুনে যুবায়ের নামে একজন প্রতিনিধিকে শ্রীলংকায় পাঠান। যুবায়ের শ্রীলংকায় গিয়ে সকলের সাথে কথা বলে মতামত জানতে চান। অধিকাংশ এতিম ও বিধবা নারী আরবে ফেরত আসতে চায়। কারণ, শ্রীলংকায় তাদের অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাদের সৌদি আরব পাঠানোর জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শ্রীলংকার রাজা খলিফার জন্য জাহাজ পূর্ণ করে উপঢৌকন দেন। অপর একটি জাহাজে মুসলিম নারী ও শিশুদের ওঠানো হয়। কাফেলাটি আম্মান সাগরে প্রবেশ করলে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সিন্ধু রাজা দাহিরের কর্তৃত্বাধীন বর্তমান করাচির অন্তর্গত দেবল বন্দরে ঢুকে পড়ে। এখানে জাহাজগুলো জলদস্যু দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। মুসলমানদের জিম্মী করা হয়।

     

  • হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দৃঢ়তা-

  • অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই সংবাদ হাজ্জাজের কাছে পৌঁছে। হাজ্জাজ দাহিরের নিকট এর বিচার দাবি করলে দাহির তা অস্বীকার করে। জলদস্যুরা তার নিয়ন্ত্রণে নয় বলে পাশ কাটিয়ে যায়।

    উল্লেখ্য, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মাকরানের শাসক মুহাম্মদের মাধ্যমে ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাজা দাহিরের নিকট পাঠান যাতে মুসলিম নারী ও শিশুদের ফেরত দেওয়া হয় এবং অপরাধী জলদস্যুদের বিচার করা হয়। পরবর্তীতে মাকরানের শাসকের নিকট থেকে একটি বার্তা আসে। যেখানে বলা হয়- ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে যে ২০ জনকে দেবলে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র ২ জন জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিল। বাকিদের হত্যা করা হয়েছে।
    সিন্ধু ও মুলতানের সাথে আরব সাম্রাজ্যের সাধারণ সীমান্ত ছিল। আরবের অনেক অপরাধী ভারতের রাজা দাহিরের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

     

  • হাজ্জাজের নির্দেশে মুসলমানগণ ৭১১-৭১২ সালে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিযান চালায়। হাজ্জাজ ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে পরপর দুটি অভিযান পরিচালনা করেন কিন্তু দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইল নিহত হন। অবশেষে হাজ্জাজ ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করেন যা সফল হয়।

    মারকান বন্দর
    মাকরান, সিন্ধু ও দেবল বন্দর

    মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হন। মাকরানের শাসক তাঁকে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করেন। রাজা দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জাঠ ও মেডগণ মুসলমানদের পক্ষে যোগ দেয়। মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য হাজ্জাজ জলপথেও একটি বাহিনী পাঠান। বলিস্ত নামক এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয় যা দিয়ে ভারি পাথর দূর নিক্ষেপ করে আঘাত করা যেত।

    তিনি প্রথমে দেবল বন্দর অবরোধ করেন। ব্রাহ্মণ ও রাজপুতগণ দেবল রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। দেবলের প্রধান মন্দিরের চূড়ায় একটি লাল নিশানা উড়ানো ছিল। মুহাম্মদ বলিস্ত দিয়ে পাথর ছুড়ে নিশানাটি নামিয়ে দেন। ফলে হিন্দুদের মনোবল ভেঙে যায়। তাদের ধারণা ছিল মন্দিরের চূড়ায় যতক্ষণ নিশান উড়বে ততক্ষণ বাইরের কোনো শত্রু তা দখল করতে পারবে না

    এরপর তিনি নিরুন, সিওয়ান ও সিসাম দখল করেন। এগুলো দখল করতে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। কিন্তু রাওয়ার দুর্গ দখল করতে তাঁকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। রাজা দাহির এখানে বিশাল সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটান। যুদ্ধে রাজা দাহির পরাজিত হয়ে মারা যায়। তার মৃত্যুতে সেনারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। অন্তঃপুরের নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জহরব্রত পালন করে। এরপর তিনি উত্তরে অগ্রসর হয়ে মুলতান দখল করে। কিন্তু মুহাম্মদ ভারতবর্ষে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারেন নি। খলিফা সোলাইমান তাঁকে দামেস্কে নিয়ে হত্যা করে।

  • উল্লেখ্য, রাজা দাহিরের উপর স্থানীয় বৌদ্ধ, জেঠ ও মেঠদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। মুহাম্মদের এই অভিযানে তারা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে। তারা মুসলমানদের দলে যোগ দেয়। আবার অনেক হিন্দু সেনাও রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলমানদের সাথে যোগ দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হয় বাবুল ইসলাম বা ইসলামের প্রবেশপথ। যদিও মুহাম্মদের বিজিত অঞ্চল মাত্র ৫০ বছর মুসলমানদের অধিকারে ছিল তবে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
  • ভারতে তৎকালীন ধর্ম-

  • প্রাচীন ভারতে তিনটি ধর্ম অধিক প্রচলিত ছিল। যথা- হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন। এদের মধ্যে জৈন ধর্ম খুব বেশি প্রচলিত ছিল না। বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে এসেছিল। সাম্প্রদায়িক কলহ ও ধর্মীয় কোন্দল লেগেই থাকত। অধিকাংশ রাজা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম বেশ সংকটের মধ্যে পড়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনর্জাগরণ ও এর আক্রমণাত্মক মনোভাব বৌদ্ধদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করেছিল। বৌদ্ধরা হিন্দু শাসকদের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেতে সিন্ধু আক্রমণকারী আরবদের স্বাগত জানায়।
  • প্রাচীন আমলে ভারতবর্ষ : আফগানিস্তান, কনৌজ, কাশ্মীর, দিল্লী ও আজমির, সিন্ধু, গুজরাট, নেপাল ও আসাম। 
  • ইউটিউবে এই সংক্রান্ত আলোচনা দেখতে এখানে ক্লিক করুন-
    পরবর্তী আলোচনা দেখুন- মাহমুদ গযনভির ভারত অভিযান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top