তেভাগা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস
- তেভাগা আন্দোলন ছিল মূলত শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষ হলেও বেশিরভাগ কৃষক ছিল ভূমিহীন। তারা জমিদার বা জোতদারের অধীনে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত। চাষাবাদ শেষে উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুভাগই দিতে হত জমির মালিকের বা জোতদারের। অবশিষ্ট একভাগ পেত বর্গাচাষীরা। অথচ উৎপাদন ব্যয় সংশ্লিষ্ট সকল খরচ ও কায়িক শ্রম সবটাই দিত চাষীরা। এই একভাগ পরিমাণ ফসল পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন কর।আরও পড়ুন : নীল আন্দোলনের ইতিহাস
- ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : মোঘল আমলে জমির মালিকানা ছিল কৃষকের। তারা তখন উৎপাদিত ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা তার থেকেও কম খাজনা দিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বাংলার কৃষকরা একের পর এক জমির মালিকানা হারাতে থাকে। জমিদাররা ব্রিটিশদের খাজনা দিত জমির পরিমাণ ও উর্বরতার উপর নির্ভর করে। উৎপাদিত ফসলের সাথে খাজনার কোনো সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলেও খাজনা বহাল থাকত। এছাড়াও জমিদার ও কৃষকের মাঝখানে জোতদার নামক মধ্যস্বত্ত্বভোগীর সৃষ্টি হয়। তারা জমিদারদের থেকে জমি ইজারা নিয়ে কৃষকদের চাষ করতে দিত। কৃষকরা পরিণত হয় ভাড়াটে মজুর।
- একসময় ব্রিটিশরা ফসলের বিনিময়ে খাজনা হিসেবে অর্থ নেওয়া শুরু করে (দেখুন- চাকমা বিদ্রোহের ইতিহাস)। কৃষিপণ্যের যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় এই অর্থ জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হলেও খাজনা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। কৃষকের এই দুরবস্থার সুযোগে বর্গার নামে মাত্র একভাগ ফসল চাপিয়ে দেওয়া হয়। ক্রমশ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে চাষীরা। মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবই তেভাগা আন্দোলনের দ্বার উন্মোচন করে।
-
আন্দোলনের পটভূমি-
- ১৯৩৬ সালে কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত কৃষক সভা’। তাদের নীতি ছিল, ‘লাঙল যার জমি তার’। বাংলার ভূমিব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করে ‘ফ্লাউড কমিশন’। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের জমির মালিকানা প্রদান এবং উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুভাগ মালিকানা চাষীদের প্রদান করতে সুপারিশ করে কমিশন।
মালিক ও বর্গাচাষীদের মধ্যে ফলন ভাগ করার প্রচলিত ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। একসময় আধাআধি ভাগ করার প্রথা চালু হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালে আধাআধি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে। তাদের প্রধান দাবি ছিল দুটি। যথা-
প্রথমত অর্ধেক ভাগাভাগির প্রথা থাকবে না। উৎপাদনে যাবতীয় শ্রম এবং অন্যান্য বিনিয়োগ করে বর্গাচাষি, ভূমি মালিকের অংশগ্রহণ থাকে অতি নগণ্য। ফলে মালিকরা পাবে ফসলের এক-তৃতীয়াংশ।
দ্বিতীয়ত উৎপাদিত শস্যের সংগ্রহ মালিকদের খলেনে (শস্য মাড়ানোর জায়গা) রাখা এবং সেখান থেকে সমান সমান খড় ভাগাভাগি করার নিয়ম আর মানা হবে না। ফসল বর্গচাষিদের বাড়িতে থাকবে এবং ভূস্বামী খড়ের কোনো ভাগ পাবে না। তাদের এই তিনভাগের এক ভাগ দাবী থেকেই আন্দোলনের নাম হয়ে উঠে ‘তেভাগা আন্দোলন’। তারা আরও সিদ্ধান্ত নেয় তারা সংঘবদ্ধভাবে ধান কাটবে। এক দল ধান কাটবে, আরেক দল তীর, ধনু, বল্লম নিয়ে পাহারা দিবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ধান কাটা হবে। প্রতিটি তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্রে এভাবে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে খুলনার মৌভোগে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কৃষ্ণবিনোদ রায়। খুলনার কৃষকদের এই সম্মেলনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করার সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়।
বাংলাদেশের সব জেলায় তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়নি। যেসব জেলায় ভাগচাষীদের উপর জুলুম করা হত কেবল সেসব জেলা ছিল সংগ্রামের পীঠস্থান। উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা আন্দোলনের সুতিকাগার। কারণ উত্তরবঙ্গ জোতদার শাসিত এলাকা ছিল। দিনাজপুর ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। ১৯৪৬-৪৭ সালে দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোরসহ দুই বাংলা মিলিয়ে মোট ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলন সংঘটিত উঠে। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁয়ে আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। -
আরও পড়ুন : ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন
- আন্দোলন : কৃষকরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ধান কাটছিল। ঠিক তখনই জোতদারদের লাঠিয়াল বাহিনী কৃষকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কৃষকরা লাঠিয়াল বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। লাঠিয়ালরা রংপুরের কৃষক নেতা তন্নারায়ণকে গুলি করে এবং বাচ্চু মামুদকে গুরুতর জখম করে। এতে তেভাগা আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। কৃষকরা পুলিশের কাছ থেকে তন্নারায়ণের লাশ কেড়ে নিয়ে সারা শহর কাঁপিয়ে তুলে। এর প্রভাব পড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। সরকার তাদের দমনে কঠোর অবস্থান নেয়। গ্রামে গ্রামে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পুলিশের হাতে অনেক আদিবাসী ও কৃষক নিহত হয়।
দিনাজপুরের হাজী মো. দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা এই আন্দোলনের রূপকার ছিলেন। হাজী মো. দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়। তেভাগা আন্দোলনে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা রাখে। আন্দোলনে যার নাম বলতেই হয় তিনি ইলা মিত্র। সাঁওতালদের কাছে তিনি ‘রানিমা’ নামে পরিচিত। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি রোহনপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হন।
- পরিসমাপ্তি : তেভাগা আন্দোলন সফল হওয়ায় ৪০% বর্গাচাষি ভূমিমালিকদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় তেভাগা পান। এ আন্দোলন আবওয়াবের নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ বা সীমিত করে। তবে পূর্ববাংলার জেলাসমূহে আন্দোলনটির সফল্য ছিল সীমিত। ১৯৪৮-৫০ সালের দিকে তেভাগা আন্দোলনে আরেক দফা সংগঠিত হয়। আন্দোলনটি নিশ্চিতভাবেই পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
- তেভাগার ফলাফল : তেভাগা আন্দোলন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে এমন অগ্রসর হয়েছিল, যে কৃষকরা সেসব অঞ্চলকে তেভাগা এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো ছিল-
১. সরকার আন্দোলনের চাপে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিধানসভায় ১৯৪৭ সালে ২২ জানুয়ারি ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’-১৯৪৭ উত্থাপন করে।
২. মহাত্মা গান্ধী তেভাগার ন্যায্যতার পক্ষে দাবি তোলেন। তিনি জোতদারদের তেভাগা দাবি মেনে নিতে পরামর্শ দেন।
৩. আন্দোলনের চাপের মুখে ভূস্বামীগণ প্রায় ৪০% বর্গাচাষীকে স্বেচ্ছায় তেভাগা দেয়।
৪. ভূস্বামীরা আন্দোলনকারীদের সাথে আপোস করে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
৫. আন্দোলনে তীব্রতায় খাজনার নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ বা সীমিত করে।
৬. সর্বোপরি ১৯৫০ সালের ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ বিলের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটে।