Tanka movement, Nankar Rebellion & Nachole Uprising
টংক আন্দোলন
- ১৯৪৬-৫০ সালে উত্তর ময়মনসিংহে কৃষকদের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন টংক আন্দোলন নামে পরিচিত। ‘টংক’ মানে ধান ফলনের প্রতিশ্রুত খাজনা। স্থানীয় ভাষায় টংক শব্দটি ‘জমিতে উৎপাদিত ফলনের প্রদেয় খাজনাকে’ বুঝায়। এটা স্থানীয় নাম। টংক দক্ষিণ বাংলার ধান করারির (ধানে পরিশোধ্য খাজনা) মতো।
জমিতে ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা দিতেই হবে। টংক জমির উপর কৃষকদের কোনো মালিকানা ছিল না। এই প্রথা চুক্তিবর্গা, ফুরন নামেও পরিচিত ছিল। ময়মনসিংহের কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, শ্রীবর্দি ইত্যাদি থানায় বিশেষ করে সুসং এলাকায় ভয়ংকর টংক ব্যবস্থা ছিল। এসব স্থানে প্রধানত গারো ও হাজং গোষ্ঠীর লোকেরা চাষাবাদ করত।
প্রথাগতভাবে টংক প্রজারা প্রতি ১.২৫ একর জমির জন্য ১০ থেকে ১৫ মণ ধান খাজনা দিত। ধানের দর ছিল প্রতি মণ সোয়া দুই টাকা। ফলে প্রতি সোয়া একরে খাজনা পড়ত ১৭ টাকা। অথচ একই সময় জোতজমির খাজনা ছিল প্রতি সোয়া একরে ৫ থেকে ৭ টাকা। সুতরাং ধানে খাজনা দিলে টাকার হিসাবে এটি দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।
টংক রায়তরা অন্যান্যদের মতো খাজনা সমন্বয়ের দাবি জানায়। কিন্তু জমিদাররা টংক রায়তদের সাধারণ রায়ত হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিল না। তাদের যুক্তি ছিল, টংক রায়তরা ভূমিদাস না কিন্তু তারা অন্যান্য প্রজাদের মতো নগদ টাকায় খাজনা দেওয়ার অধিকার পেতে পারে না। এই প্রথা শুধু জমিদারদের ছিল তা নয়, মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টংক প্রথায় লাভবান হত।
১৯৩৭-১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলন চলে। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে টংক কৃষকরা ছয়দফা দাবি প্রস্তুত করে। তাদের দাবি ছিল টংক প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, ভূমির মালিকানা প্রদান, নগদ টাকায় দেওয়া হারের নিরীখে খাজনা নির্ধারণ, খাজনার বকেয়া দাবি না করা, জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ইত্যাদি। পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হলে গ্রামবাসীরা তাদের প্রতিরোধ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কিছুকালের জন্য কৃষকদের আন্দোলন স্তিমিত থাকে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের টংক আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে উঠে এবং ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। রাসিমণি হাজং, কুমুদিনি হাজং প্রমুখ ছিলে টংক আন্দোলনের নেত্রী।নানকার আন্দোলন
- ফার্সি শব্দ ‘নান’ এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘রুটি’। নানকার শব্দের অর্থ রুটির বিনিময়ে কেনা গোলাম। সামন্তপ্রভুদের সিলেট অঞ্চলে মিরাসদার বলা হত। জমিদার বা মিরাসদারের নিকট কিছু জায়গার বিনিময়ে যারা বসবাস করত তারাই নানকার প্রজা। জমি থাকলেই জীবিকা নির্বাহ করা যায়, এটিই ছিল তখনকার বিশ্বাস। কিন্তু খোরাকি উৎপাদনে যে শ্রম ব্যয় হত তা ছিল মূল্যহীন। নানকার প্রজাদের ক্ষুদ্র একটি ভিটাসহ দু’চার বিঘা জমি বরাদ্দ করা হত।
নানকার প্রজারা ছিল মূলত ভূমি-মালিকের হুকুমদাস। তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও বংশানুক্রমে ভূমি মালিকের দাস হত। বৃহত্তর সিলেটের এক-দশমাংশ লোক ছিল নানকার। তারা জমিদারদের দেওয়া বাড়িতে থাকত ও সামান্য কৃষি জমি চাষবাস করত। ঐ জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না।
জমিদারদের যেকোনো প্রয়োজনে তারা সশরীরে উপস্থিত থাকতে বাধ্য। এমনকি গভীর রাতেও জমিদারদের ডাকে সাড়া না দিলে নেমে আসত নির্যাতন। এর জন্য তাদের কোনো প্রাপ্য জুটত না। বিনা পয়সার এই পরিশ্রমকে বলা হত হদ বা বেগারি। এগুলোর মধ্যে জঘন্যতম বিষয় ছিল জমিদারদের চরিত্রহীনতা। নানকার মেয়েরা সুরক্ষিত ছিল না। জমিদার তলব করলেই মেয়েদের যেতে হত। নানকার মেয়েরা বিনামূল্যে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য ছিল। -
বিয়ানীবাজারে নানকার বিদ্রোহ-
- ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার থানা। লাউতা বাহাদুরপুর অঞ্চলের জমিদাররা ছিল অতিমাত্রায় অত্যাচারী। লোকমুখে শোনা যায়, বাহাদুরপুর জমিদার বাড়ির সামনের রাস্থায় জুতা পায়ে হাঁটা যেত না। ছাতা টাঙ্গিয়ে চলা ও ঘোড়ায় চড়া ছিল অপরাধ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস কারো ছিল না।
পরবর্তীতে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রাহ শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যায় খাজনা দেওয়া- এমনকি জমিদারদের হাট-বাজারের কেনাকাটা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। জমিদার ও তার লোকজনদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ভীত জমিদাররা পাকিস্তান সরকারের নিকট ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করে। জমিদারদের প্ররোচনায় পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ইপিআর বাহিনী ও জমিদারের লোকজন সানেশ্বরে আক্রমণ করে। লোকজন পালিয়ে পার্শ্ববর্তী উলুউরিতে আশ্রয় নেয়। গ্রামের সবাই জমিদার বাহিনীকে রুখে দেয়। কিন্তু ইপিআরের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি কৃষকরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬ জন। এজন্য ১৮ আগস্ট নানকার দিবস পালন করা হয়। বন্দি হন নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল প্রমুখ। পরবর্তীতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে এই ঘৃণ্য প্রথা দেশ থেকে উঠে যায়।আরও পড়ুন : তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস
নাচোল বিদ্রোহ
- নাচোল বিদ্রোহ ১৯৪৯-৫০ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত নাচোল উপজেলার সাঁওতাল কৃষকদের বিদ্রোহ। তখনকার তেভাগা, নানকার ও টংক আন্দোলনের মতোই এটি একটি কৃষক আন্দোলন ছিল।
এক সময় সাঁওতালরা জন্মসূত্রে পাওয়া জমিকে তারা নিজেদের জমি হিসেবে জানত। নিজেরাই সেখানে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। বহিরাগত কেউ সে ফসলে ভাগ বসাতে পারত না। একসময় নতুন নিয়ম আসে। একই জমি বংশপরম্পরায় চাষাবাদ করা সত্ত্বেও সাঁওতালের ঐ জমির ওপর কোনো মালিকানা স্বীকৃত হয়নি। সরকার, জমিদার, জোতদার কাগজপত্র দেখিয়ে সেই জমি দখল করে। এতদিন যারা জমির মালিক ছিল তারাই এখন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
তারা সেই জমিতে কাজ করলে তার একটা অংশ মালিকদের পৌঁছে দিতে হবে।জোতদাররা ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায় করত। স্থানীয় প্রথা অনুসারে ফসল কাটার সময় প্রতিটি সাঁওতাল কৃষক ২০ কেজি ফসল কাটার বিনিময়ে ৩ কেজি ধান পেত, যা নিজেরা পরে মাড়াই করে নিত। আধিয়ার (ভাগ চাষি) উপজাতিসহ তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক জোতদারদের দিতে হত।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মালদহ জেলার ৫টি থানা রাজশাহী জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। যথা- নবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, নাচোল ও গোমস্তাপুর। এই অঞ্চলের আধিয়ার বর্গাচাষীদের মধ্যে সংঘটিত বিদ্রোহই ‘নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর অনেক সাঁওতাল মালদহ, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় আশ্রয় নেয়।
১৯৪৮ সালে নাচোলের কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে রামু সরকার। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নাচোল থানার চন্ডীপুর গ্রাম। এই গ্রামেই সাঁওতাল নেতা মাতলা সর্দার বসবাস করতেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে আন্দোলন পরিচালিত হয়। গ্রামটি ছিল কৃষক সমিতির মূল কেন্দ্র।
১৯৫০ সালে নাচোল উপজেলার ঘাসুরা, চন্ডীপুর, কেন্দুয়া, ইত্যাদি গ্রামের চাষিরা জোতদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি ছিল, তিন কেজি ধানের পরিবর্তে তাদেরকে সাত কেজি ধান দিতে হবে এবং আধিয়ারদের মতো জমিচাষের জন্য ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দিতে হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। বহু পুলিশ নিহত হয় এবং জোতদারদের ঘরবাড়ি লুট হয়। কৃষক সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইলা মিত্র, আজহার শেখ, বৃন্দাবন সাহা প্রমুখ ছিলেন। তাঁদের সকলকেই গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি সাজা দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে ইলা মিত্রসহ অনেকে রাজনৈতিক কারণে মুক্তি পান। ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সাঁওতাল চাষিদের জমির উপর অধিকার দেওয়া হয় এবং তারা অন্যান্যদের মতো প্রচলিত হারে নগদে খাজনা পরিশোধের অধিকার লাভ করে। - আরও পড়ুন : সাঁওতাল বিদ্রোহ