বাংলায় সুবেদারি শাসন
- সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলা মুগল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় (প্রদেশ) পরিণত হলেও তখন বাংলায় মুগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। উত্তর-পশ্চিম বাংলার দুর্গ এলাকায় মুগল শাসন সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার বিখ্যাত জমিদারগণ মুগল শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। যারা বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম খান বাংলায় মুঘল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলায় সুবাদারদের তালিকা-
সুবেদার সময় অবদান মুনিম খান ১৫৭৪-৭৫ বাংলার প্রথম সুবাদার। দাউদ করারনিকে পরাজিত করে। হোসেন কুলি বেগ ১৫৭৫-৭৮ মুজাফফর খান ১৫৭৯-৮০ মির্জা আজিজ কোকা ১৫৮২-৮৩ শাহবাজ খান ১৫৮৩-৮৫ সাদিক খান ১৫৮৫-৮৬ ওয়াজির খান ১৫৮৬-৮৭ সাইদ খান ১৫৮৭-৯৪ মানসিংহ ১৫৯৪-১৬০৬ ঈশা খাঁর সাথে সন্ধি করে কুতুবউদ্দিন ১৬০৬-০৭ জাহাঙ্গীর কুলি বেগ ১৬০৭-০৮ ইসলাম খান চিশতি ১৬০৮-১৬১৩ বারো ভূঁইয়াদের দমন, ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর,
ধোলাই খাল খনন, নৌকা বাইচ প্রচলনকাসিম খান চিশতি ১৬১৩-১৬১৭ ইব্রাহিম খান ১৬১৭-১৬২২ মোহাবত খান ১৬২২-২৫ আমানুল্লাহ খান ১৬২৫ মোকাররম খান ১৬২৫-২৭ ফিদাই খান ১৬২৭-২৮ কাসিম খান জুয়িনি ১৬২৮-৩২ বাংলা থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করেন মুহাম্মদ বাকির ১৬৩২-৩৫ মীর আব্দুস সালাম ১৬৩৫-৩৯ শাহ সুজা ১৬৩৯-১৬৬০ ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যের সুযোগ, বড় কাটারা,
চুড়িহাট্টা মসজিদ, রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর, হোসেনি দালানমীর জুমলা ১৬৬০-৬৩ ঢাকা গেট নির্মাণ, আসাম ও কুচবিহার বিজয় আবু তালিব শায়েস্তা খান ১৬৬৪-১৬৭৬, ১৬৭৯-৮৮ আনকুরা পদ্ধতি ও ক্ষমতা প্রয়োগে ফি রহিত, মগদের থেকে চট্টগ্রাম দখল, ইংরেজদের বিতাড়ন, ছোট কাটারা নির্মাণ ফিদাই খান ১৬৭৬-৭৭ মুহাম্মদ আজম শাহ ১৬৭৮-৭৯ লালবাগ কেল্লা ইব্রাহিম খান ১৬৮৮-৯৭ আজিমুশ শাহ ১৬৯৭-১৭১২ মুর্শিদ কুলি খান ১৭১৭-১৭২৭ -
ইসলাম খান চিশতি-
- প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দীন চিশতি। তাঁর বাবার নাম শেখ বদরউদ্দিন চিশতি। তাঁর দাদা ভারতের ফতেহপুর সিক্রির বিখ্যাত দরবেশ শেখ সেলিম চিশতি। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘ইসলাম খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তাঁকে ১৬০৮ সালে বাংলায় সুবাদার হিসেবে পাঠান। ইতঃপূর্বে তিনি বিহারের সুবাদার ছিলেন। তিনি অনতিবিলম্বে বাংলার তদানীন্তন রাজধানী রাজমহলে চলে আসেন। ১৬১০ সালে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। রাজধানী স্থানান্তরের পরে তিনি ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর । যদিও শেষ পর্যন্ত এই নাম স্থায়ী হয়নি। তবে ঢাকার ইসলামপুর তার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল।
একে একে তিনি মূসা খানা, রাজা প্রতাপাদিত্য, উসমান খানসহ প্রায় সব বারো ভূঁইয়া নেতাকে পরাজিত করেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলায় মুঘল শাসন প্রতষ্ঠিত হয়। পাঁচ বছর সাফল্যের সাথে বাংলা প্রদেশ শাসন করেন। নগর রক্ষার পরিখা নির্মাণ ও জলপথ হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনি ধোলাই খাল খনন করেন। ১৬১৩ সালে তিনি ঢাকা থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল উত্তরে ভাওয়ালে মারা যান। প্রথমে তাঁকে ঢাকার বাদশাহী বাগে (পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ) সমাধিস্থ করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁর মৃতদেহ ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁর দাদা শেখ সেলিম চিশতির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।
উল্লেখ্য, রমনার একাংশের নাম একসময় তার বংশের নামে মহল্লা চিশতীয়ান বলে পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয় সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের মসজিদটি ইসলাম খাঁ নির্মিত। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল একটি প্রাচীন দুর্গ যা ইসলাম খান পুনর্নির্মাণ করেন। ইসলাম খানের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন সুবাদার বাংলা শাসন করলেও সুবাদার মীর জুমলা ক্ষমতাগ্রহণের আগ পর্যন্ত কোনো সুবেদারই তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। -
কাসিম খান চিশতি-
- কাসিম খান চিশতি ইসলামের খানের ছোট ভাই ছিলেন। তিনি ১৬১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়োগ পান এবং পরের বছর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি শুরুতেই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দিওয়ান মির্জা হুসাইন নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত সুবাদারের ও কোতওয়ালের দায়িত্ব পালন করেন। ইসলাম খানের ন্যায় তিনি রাজনীতিতে পারদর্শী ছিলেন না। ইসলাম খান কোচবিহার ও কামরূপের দুই রাজাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কাসিম খান তা ভঙ্গ করেন। ফলে ঐ দুই রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি মুবারিজ খানকে বিদ্রোহ দমনে পাঠান। মুবারিজ খান সহজেই তাঁদের দমন করেন।
এই সময় দক্ষিণ-পূর্বে আরাকানের রাজা ও সন্দ্বীপের পর্তুগিজ নেতা সেবাস্তিন গঞ্জালেস মিলিতভাবে বাংলায় লুটপাট করতে করতে সোনারগাঁ ও হুগলি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ভুলুয়ার আবদুল ওয়াহিদ বিপদের আশঙ্কা করে ডাকাতিয়া নদীর দিকে চলে যান। কাসিম খান তাঁকে সাহায্য করার জন্য শেখ ফরিদ ও শেখ কামালকে পাঠান। সম্মিলিত মুঘলবাহিনী আরাকান রাজাকে পরাজিত করে। ১৬১৫ সালে আরাকান রাজা পুনর্গঠিত হয়ে ভূষণা দখলের চেষ্টা করলে আবদুল ওয়াহাব ও তাঁর পুত্র তা প্রতিহত করেন; আরাকান রাজা কেবল নিজের জীবনের বিনিময়ে মুঘলদের কাছে সব দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
-
ইব্রাহিম খান-
- ইব্রাহিম খান সম্রাজ্ঞী নূর জাহানের ভাই ছিলেন। ইতঃপূর্বে তিনি বিহারের সুবাদার ছিলেন। তিনি সফল সমরনায়ক রূপে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে বাদশাহর নিকট থেকে ‘মনসব’ পদ ও ‘ফতেহ জঙ্গ’ উপাধি লাভ করেন। শাসক রূপেও তিনি দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।
কথায় আছে- ‘শত্রুর শেষ রাখতে নেই।’ কিন্তু মুঘলদের নীতি ছিল ভিন্ন। শত্রু নতি স্বীকার করলে তাকে শুধু ক্ষমা নয়, রাজ্যভোগ করার অনুমতি দিতেন। এটি মুঘলদের রাজনৈতিক কৌশল ছিল। এর সুফল-কুফল দুটোই ছিল। সুবাদার কাসিম খান যেসব শত্রুর প্রতি উদারতা প্রকাশ করেছিলেন তারাই পরবর্তীতে বিদ্রোহ করে। তাদের দমন করার জন্য ইব্রাহিম খান অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হন। প্রায় চার বছর বিভিন্ন সংঘর্ষের পর বাংলার অনেক অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।
১৬২৩ সালের নভেম্বর মাসে বাংলার রাজনীতিতে বিদ্রোহী যুবরাজ শাহজাহানের অভ্যুত্থান হলে সুবাদার ইব্রাহিম খান এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বিদ্রোহী শাহজাহান দাক্ষিণাত্য থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথমে উড়িষ্যা দখল করেন এবং মেদিনীপুর ও বর্ধমান হয়ে আগ্রার পথে অগ্রসর হন কিন্তু সেনাপতি মহাবত খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি জাহাঙ্গীর নগরের দিকে যাত্রা করেন। প্রভুপুত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ইব্রাহিম খানের জন্য সংকটের কারণ হলেও প্রভুর প্রতি আনুগত্য অধিক যুক্তিসংগত মনে করে বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়ে অগ্রসর হন।
উড়িষ্যার পলাতক সুবাদারসহ বিভিন্ন সুবাদার তাঁর সহযাত্রী হন। মালদহের আকবরপুর নামক স্থানে বিদ্রোহী রাজসেনারা যাতে গঙ্গানদী পার হতে না পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ইব্রাহিম খান সফল হতে পারেন নি বরং কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধে তাঁর লোকবল হ্রাস পায়। মির্জা আহমদ বেগ আহত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন; সৈয়দ নূরউলাহর প্রতিরক্ষাও ভেঙ্গে পড়ে। ইব্রাহিম খান মাত্র এক হাজার অশ্বসেনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে নিহত হন। (২০ এপ্রিল ১৬২৪)। -
শাহজাহানের বিদ্রোহ ও বাংলায় এর প্রভাব-
- যুবরাজ শাহজাহানের মাতা ছিলেন মালবারের রাজপুত রাজকুমারী জগৎ গোসাইনি। শাহজাহান ছিলেন দিল্লির সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান চান জাহাঙ্গিরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহজাদা শাহরিয়ারকে দিল্লির সিংহাসনে বসাতে। সুদূর দাক্ষিণাত্যে থেকে শাহজাহান তা অনুধাবন করে বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন এবং সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আগ্রা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু মহবত খানের কাছে পরাজিত হয়ে স্বস্থানে ফিরে যান।
শাহজাহান বাংলাকে অধিকতর নিরাপদ ভেবে প্রথমে উড়িষ্যা দখল করেন। উড়িষ্যার সুবাদার মির্জা আহমদ বেগ পালিয়ে মামা ইব্রাহিম খানের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। যদিও ইব্রাহিম খান যুদ্ধে পরাজিত হন।
শাহজাহান মাত্র সাত দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল রাজধানী আগ্রার মসনদ লাভ করা। এরই মধ্যে তিনি বাংলার মুখ্য পদগুলিতে নিয়োগ সম্পন্ন করে ফেলেন। রাজমহলের যুদ্ধে প্রধান নেতৃত্ব দানকারী সেনাপতি দারাব খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। এরপর তিনি বিহার, জৌনপুর, অযোধ্য হয়ে অগ্রসর হলে শোন নদীর তীরে কান্তি নামক স্থানে রাজার সেনাদের নিকট পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে ফিরে আসেন (অক্টোবর ১৬২৪)। অতঃপর পিতার নিকট ক্ষমাভিক্ষা করে নতি স্বীকার করলে রাজদ্রোহিতার অবসান হয়।
সম্রাট জাহাঙ্গির দারাব খানকে অপসারিত করে মহবত খানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন কিন্তু তিনি এক বছর দায়িত্ব পালন করার পর সম্রাটের আদেশ অমান্য করে স্বীয় পুত্র খানাহ্জাদকে প্রতিনিধি করে বাংলা ত্যাগ করেন এবং দাক্ষিণাত্যে শাহজাহানের সাথে যোগ দেন। তরুণ খানাহ্জাদ অযোগ্য ছিলেন। পর্তুগিজ দস্যুরা ঢাকায় লুটপাট করে ও বহু লোককে বন্দি করে নিয়ে যায়। তিনি নদীতে লোহার জাল ফেলে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয়নি। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে অপসারণ করে ইসলাম খান চিশতির জামাতা মুকাররম খানকে সুবাদার নিযুক্ত করেন। তিনি ১৬২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক নৌকাডুবিতে মারা যান। মির্জা হেদায়ত উলাহ ওরফে ফিদাই খান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
-
ফিদাই খান-
- তিনি সুবাদার নিযুক্ত হয়ে নিয়মিত করের অতিরিক্ত পাঁচ লক্ষ টাকা নজরানা জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের জন্য পাঠান যা পরবর্তীকালে বাংলার সুবাদারদের জন্য প্রথায় পরিণত হয়। কিন্তু তাঁর কার্যকালও সংক্ষিপ্ত হয়। ঐ বছর জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর শাহজাহান সিংহাসনে আরোহণ করে ফিদায় খানকে সরিয়ে কাসিম খানকে সুবাদার নিযুক্ত করেন।
-
কাসিম খান জুইনি-
- তিনি ছিলেন মির মুরাদের পুত্র। মির মুরাদ ছিলেন শাহজাহানের ধনুর্বিদ্যা প্রশিক্ষণের গুরু, যিনি পরে লাহোরের বখশি পদে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ইরানের জুইন অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তিনি নূরজাহানের বোন মনিজাহ বেগমকে বিবাহ করেন।**পর্তুগিজদের আস্ফালন : তাঁর শাসনামলে হুগলির পর্তুগিজদের সাথে মুঘলদের সংঘর্ষ বাধে। ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজ বণিকরা প্রথম বাংলায় আসে এবং হোসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম বন্দরের সাথে বাণিজ্য সম্বন্ধ স্থাপন করে। এরা সপ্তগ্রামের তিন মাইল দূরে হুগলীতে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। ভাগীরথী নদীর গতি পরিবর্তনের দরুন যখন সপ্তগ্রাম বন্দরের অবনতি হয়, তখন হুগলি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দরের আসন লাভ করে। ১৫৭৮ সালে সম্রাট আকবর হুগলির পর্তুগিজ প্রধান পেড্রো টেভারিজের সাথে আলাপে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে সেখানে শহর করার অনুমতি দেন। ফলে হুগলী বন্দরে পর্তুগিজদের একটি বড় উপনিবেশ গড়ে ওঠে।
-
কাসিম খান কেন পর্তুগিজদের বিতাড়িত করেন?
নানা কারণে জনসাধারণ পর্তুগিজদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয় এবং সুবাদার কাসিম খানের সময়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।
প্রথমত পর্তুগিজরা বাণিজ্য না করে জলদস্যুতা করত এবং আরাকানের মগ দস্যুদের সাথে মিলে বাংলার নদী অঞ্চলে লুটতরাজ করত।
দ্বিতীয়ত পর্তুগিজরা জোর জবরদস্তি করে এদেশের লোকদেরকে খ্রিস্টান বানাত।
তৃতীয়ত হুগলীতে পর্তুগিজদের সংখ্যা ও সামরিক শক্তি বেড়ে চলছিল। তাদের গোলাবারুদ ও নৌবাহিনীর শক্তি ছিল। তাছাড়া শাহজাহান যখন বাংলায় এসেছিলেন, তখন হুগলীর পর্তুগিজদের আচরণে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পর্তুগিজ নেতা ম্যানুয়েল টেভারিজ ও মিগোয়েল রডরিগিজ তাঁদের নৌবহর নিয়ে শাহজাহানের সঙ্গে যোগ দিয়ে এলাহাবাদের অভিযানে অংশ নেয় কিন্তু তাঁরা পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে। ফলে শাহজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেয়। শাহজাহানের ফেরার পথে পর্তুগিজরা পাটনা থেকে মমতাজমহল বেগমের দুইজন পরিচালিকা নিয়ে যায় এবং তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। এই সব কারণে শাহজাহান হুগলীর পর্তুগিজদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সুবাদার কাসিম খানকে নির্দেশ দেন।
কাসিম খানের প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলায় পর্তুগিজদের দমন করা। পর্তুগিজরা ক্ষিপ্রগামী জালিয়া নৌকা ব্যবহার করে দেশের অভ্যন্তরে লুটতরাজ করত। কাসিম খান ত্রিমুখী অভিযান পরিচালনা করেন। সেনাপতি বাহাদুর কাম্বুর নেতৃত্বে প্রথম দল মকসুদাবাদে, পুত্র ইনায়েতুলাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় দল বর্ধমানে এবং খাজা শের ও মাসুম খানের নেতৃত্বে তৃতীয় দল সরাসরি হুগলিতে প্রেরণ করেন (জুন ১৬৩২)। তাঁরা নৌকা দ্বারা ব্রিজ তৈরি করে তিন মাস পর্তুগিজদের অবরোধ করে রাখে। স্থলপথের দুই সেনাদল অগ্রসর হয়ে সংকরাইল নামক স্থানে নৌবাহিনীর সাথে মিলিত হন। এমতাবস্থায় পর্তুগিজরা প্রথমে সন্ধির প্রস্তাব দেয় কিন্তু মুঘলদের আরোপিত বশ্যতা স্বীকারের শর্ত না মানায় তা কার্যকর হয়নি। হুগলি ত্যাগ করে পালাবার সময় তারা মুঘল সেনাদের কবলে পড়ে বহু ক্ষতির স্বীকার হয়; অল্পসংখ্যক পর্তুগিজ পালাতে সক্ষম হয়। পর্তুগিজরা গোয়া ও অন্যান্য স্থানের পর্তুগিজদের নিকট থেকে সাহায্যের আশা করেছি কিন্তু কোনো সাহায্য না আসায় এরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। পর্তুগিজরা গোপনে নদীপথে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মুঘলদের গোলাগুলির আঘাতে তারা অনেকে ডুবে মারা যায়। কিছু সংখ্যক নৌকা সাগর দ্বীপে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। সেখান থেকে পর্তুগিজরা জাহাজে গোয়ায় চলে যায়। ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহোরি লিখেন যে, হুগলীর যুদ্ধে দশ হাজার পর্তুগিজ নরনারী মারা যায় এবং এক হাজার মুঘল সেনা নিহত হয়। হুগলি বিজয়ের কিছুদিন পরেই কাসিম খান মৃত্যুবরণ করলে আজম খান বাংলা সুবাদার নিযুক্ত হন। -
আজম খান-
- প্রকৃত নাম মির মুহাম্মদ বাকির। তিনি ইরাকের অধিবাসী ছিলেন। জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে আগমন করেন এবং যোগ্যতাবলে সম্রাট কর্তৃক প্রথমে রাজপরিবারের ‘খান-ই-সামান’ ও পরে কাশ্মীরের ‘সুবাদার’ পদে নিয়োগ লাভ করেন। শাহজাহান তাঁকে রাজসভার উজিরপদে নিয়োদ দেন এবং ‘খান-ই-আজম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পারস্য থেকে আগত কিছু দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা প্রশাসনকে সাজানো ছাড়া তিন বছরের শাসনামলে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের নমুনা নেই। তিনি উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অহোম রাজার উৎপাত বন্ধের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। সম্রাট তাঁকে অপসারণ করে ইসলাম খান মাশহাদিকে বাংলার নতুন সুবাদার নিযুক্ত করেন।
- পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : আওরঙ্গজেবের শাসনামল
- পরবর্তী আলোচনা : বাংলায় সুবাদারি শাসন- ২য় পর্ব