Skip to content

সিরাজউদ্দৌলা নাটক

প্রথম অঙ্ক- প্রথম দৃশ্য

১৭৫৬ সাল; ১৯এ জুন।
প্রথম দৃশ্য

 

সময় : ১৭৫৬ সাল, ১৯এ জুন। স্থান : ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-ক্যাপ্টেন ক্লেটন, ওয়ালি খান, জর্জ, হলওয়েল, উমিচাঁদ, মিরমর্দান, মানিকচাঁদ, সিরাজ, রায়দুর্লভ, ওয়াটস]

(নবাব সৈন্য দুর্গ আক্রমণ করছে। দুর্গের ভেতরে ইংরেজদের অবস্থা শোচনীয়। তবু যুদ্ধ না করে উপায় নেই। তাই ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গ প্রাচীরের এক অংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ (কামান পরিচালক) নিয়ে কামান চালাচ্ছেন। ইংরেজ সৈন্যের মনে কোনো উৎসাহ নেই, তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।)

 

ক্লেটন : প্রাণপণে যুদ্ধ করো সাহসী ব্রিটিশ সৈনিক। যুদ্ধে জয়লাভ অথবা মৃত্যুবরণ, এই আমাদের প্রতিজ্ঞা। Victory or death, Victory or death. 
(গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লেটন একজন বাঙালি গোলন্দাজের দিকে এগিয়ে গেলেন)
ক্লেটন : তোমরা, তোমরাও প্রাণপণে যুদ্ধ করো বাঙালি বীর। বিপদ আসন্ন দেখে কাপুরুষের মতো হাল ছেড়ে দিও না। যুদ্ধ করো, প্রাণপণে যুদ্ধ করো। Victory or death.
(একজন প্রহরীর প্রবেশ)
ওয়ালি খান : যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিন, ক্যাপ্টেন ক্লেটন। নবাব সৈন্য দুর্গের কাছাকাছি এসে পড়েছে।
ক্লেটন : না, না।
ওয়ালি খান : এখুনি যুদ্ধ বন্ধ করুন। নবাব সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে দুর্গের একটি প্রাণিকেও তারা রেহাই দেবে না।
ক্লেটন : চুপ বেইমান। কাপুরুষ বাঙালির (ওয়ালি খান) কাছে যুদ্ধ বন্ধ হবে না।
ওয়ালি খান : ও সব কথা বলবেন না সাহেব। ইংরেজের হয়ে যুদ্ধ করছি কোম্পানির টাকার জন্য। তা বলে বাঙালি কাপুরুষ নয়। যুদ্ধ বন্ধ না করলে নবাব সৈন্য এখুনি তার প্রাণ নেবে।
ক্লেটন : হোয়াট? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?
(ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্যে এগিয়ে গেল। অপর একজন রক্ষীর দ্রুত প্রবেশ)
জর্জ : ক্লেটন, অধিনায়ক এনসাইন পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টের সমস্ত ছাউনি ছারখার করে দিয়ে ভারী ভারী কামান নিয়ে নবাব সৈন্য দুর্গের দিকে এগিয়ে আসছে।
ক্লেটন : কী করে তারা এখানে আসবার রাস্তা খুঁজে পেলো?
জর্জ : উমিচাঁদের গুপ্তচর নবাব ছাউনিতে খবর পাঠিয়েছে (ইংরেজদের দুর্বল প্রতিরক্ষার বিষয়)। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে, আর গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে বন্যাস্রোতের মতো ছুটে আসছে।
ক্লেটন : বাধা দেবার কেউ নেই। (ক্ষিপ্তস্বরে) ক্যাপ্টেন মিনচিন দমদমের রাস্তাটা উড়িয়ে দিতে পারেননি?
জর্জ : ক্যাপ্টেন মিনচিন, কাউন্সিলার ফকল্যান্ড আর ম্যানিংহাম নৌকোয় করে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন।
ক্লেটন : কাপুরুষ, বেইমান। জ্বলন্ত আগুনের মুখে বন্ধুদের ফেলে পালিয়ে যায়। চালাও, গুলি চালাও। নবাব সৈন্যদের দেখিয়ে দাও যে বিপদের মুখে ইংল্যান্ডের বীর সন্তান কতখানি দুর্জয় হয়ে ওঠে।
(জন হলওয়েলের প্রবেশ এবং জর্জের প্রস্থান)
হলওয়েল : এখন গুলি চালিয়ে বিশেষ ফল হবে কি, ক্যাপ্টেন ক্লেটন?
ক্লেটন : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি, সার্জন হলওয়েল?
হলওয়েল : আমার মনে হয় গভর্নর রজার ড্রেকের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এখন যুক্তিসঙ্গত।
ক্লেটন : তাতে কি নবাবের অত্যাচারের হাত থেকে আমরা রেহাই পাব ভেবেছেন।
হলওয়েল : তবু কিছুটা আশা থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ করে টিকে থাকবার কোনো আশা নেই। গোলাগুলি যা আছে তা দিয়ে আজ সন্ধ্যে পর্যন্তও যুদ্ধ করা যাবে না। ডাচদের কাছে, ফরাসিদের কাছে, সবার কাছে আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু সৈন্য তো দূরের কথা এক ছটাক বারুদ পাঠিয়েও কেউ আমাদের সাহায্য করল না।
(বাইরে গোলার আওয়াজ প্রবলতর হয়ে উঠল)
ক্লেটন : তা হলে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।
(ক্লেটনের প্রস্থান। বাইরে থেকে যথারীতি গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। হলওয়েল চিন্তিতভাবে এদিক-ওদিক পায়চারি করছেন।
হলওয়েল : (পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে) এই কে আছ?
(রক্ষীর প্রেবেশ)
জর্জ : ইয়েস, স্যার।
হলওয়েল : উমিচাঁদকে বন্দি করে কোথায় রাখা হয়েছে?
জর্জ : পাশেই একটা ঘরে।
হলওয়েল : তাঁকে এখানে নিয়ে এসো।
জর্জ : রাইট, স্যার
(জর্জ দ্রুত বেরিয়ে চলে যায় এবং প্রায় পর মুহূর্তেই উমিচাঁদকে নিয়ে প্রবেশ করে)
উমিচাঁদ : (প্রবেশ করতে করতে) সুপ্রভাত, সার্জন হলওয়েল।
হলওয়েল : সুপ্রভাত। তাই না উমিচাঁদ? (গোলাগুলির আওয়াজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হলওয়েল বিস্মিতভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন) নবাব সৈন্যের গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন বলুন তো?
উমিচাঁদ : (কান পেতে শুনল) বোধহয় দুপুরের আহারের জন্যে সাময়িক বিরতি (রসিকতা) দেওয়া হয়েছে।
হলওয়েল : এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে উমিচাঁদ। আপনি নবাবের সেনাধ্যক্ষ রাজা মানিকচাঁদের কাছে একখানা পত্র লিখে পাঠান। তাঁকে অনুরোধ করুন নবাব সৈন্য যেন আর যুদ্ধ না করে।
উমিচাঁদ : বন্দির কাছে এ প্রার্থনা কেন সার্জন হলওয়েল? (কঠিন স্বরে) আমি গভর্নর ড্রেকের ধবংস (প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব) দেখতে চাই।
(জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সার্জন হলওয়েল, গভর্নর রাজার ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকা করে পালিয়ে গেছেন।
হলওয়েল : দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন?
জর্জ : গভর্নরকে পালাতে দেখে একজন রক্ষী তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়েছিল, কিন্তু তিনি আহত হননি।
উমিচাঁদ : দুভার্গ্য, পরম দুর্ভাগ্য।
হলওয়েল : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেবেন বলে আধ ঘণ্টা আগেও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ক্যাপ্টেন ক্লেটন। শেষে তিনিও পালিয়ে গেলেন।
উমিচাঁদ : ব্রিটিশ সিংহ (ক্লেটন) ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা।
হলওয়েল : উমিচাঁদ, এখন উপায়?
উমিচাঁদ : আবার কী? ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে গাইস হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেফানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। আপনিই এখন কমান্ডার-ইন-চিফ। (আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে এল)
হলওয়েল : (হতাশার স্বরে) উমিচাঁদ।
উমিচাঁদ : আচ্ছা, আমি রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি। আপনি দুর্গ প্রাকারে (দেওয়াল) সাদা নিশান (সন্ধির নিদর্শন) উড়িয়ে দিন।
(উমিচাঁদের প্রস্থান। হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ শোনা গেল। বেগে (দ্রুততার সাথে) জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সর্বনাশ হয়েছে। একদল ডাচ সৈন্য গঙ্গার দিককার ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়ে নবাবের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী হুড় হুড় করে কেল্লার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
হলওয়েল : সাদা নিশান ওড়াও। দুর্গ তোরণে সাদা নিশান উড়িয়ে দাও।
(জর্জ ছুটে গিয়ে একটি নিশান উড়িয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নবাব সৈন্যের অধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদমিরমর্দানের প্রবেশ)
মিরমর্দান : এই যে দুশমনরা এখানে থেকেই গুলি চালাচ্ছে।
হলওয়েল : আমরা সন্ধির সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছি। যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে-
মিরমর্দান : সন্ধি না আত্মসমর্পণ?
মানিকচাঁদ : সবাই অস্ত্র ত্যাগ কর।
মিরমর্দান : মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।
মাকিনচাঁদ : তুমিও হলওয়েল, তুমিও মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়াও। কেউ একচুল নড়লে প্রাণ যাবে।
(দ্রুতগতিতে নবাব সিরাজের প্রবেশ। সঙ্গে সসৈন্যে সেনাপতি রায়দুর্লভ। বন্দিরা কুর্নিশ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। সিরাজ চারদিকে একবারে ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে হলওয়েলের দিকে এগিয়ে গেলেন।)
সিরাজ : কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার রাতারাতি সেনাধ্যক্ষ হয়ে বসেছে। তোমার কৃতকার্যের উপযুক্ত প্রতিফল নেবার জন্যে তৈরি হও হলওয়েল।
হলওয়েল : আশা করি নবাব আমাদের ওপরে অন্যায় জুলুম করবেন না।
সিরাজ : জুলুম? এ পর্যন্ত তোমরা যে আচরণ করে এসেছ তাতে তোমাদের ওপরে সত্যিকার জুলুম করতে পারলে আমি খুশি হতুম। গভর্নর ড্রেক কোথায়?
হলওয়েল : তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন।
সিরাজ : কলকাতার বাইরে গেছেন, না প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন? আমি সব খবর রাখি, হলওয়েল। নবাব সৈন্য কলকাতা আক্রমণ করবার সঙ্গে সঙ্গে রজার ড্রেক প্রাণভয়ে কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কৈফিয়ত তবু কাউকে দিতেই হবে? বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথা থেকে আমি তার কৈফিয়ত চাই।
হলওয়েল : আমরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। শুধু আত্মরক্ষার জন্যে-
সিরাজ : শুধু আত্মরক্ষার জন্যেই কাশিমবাজার কুঠিতে তোমরা গোপনে অস্ত্র আমদানি করছিলে, তাই না? খবর পেয়ে আমার হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দি করা হয়েছে ওয়াটস আর কলেটকে।
রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
সিরাজ : বন্দি ওয়াটসকে এখানে হাজির করুন।
(কুর্নিশ করে রায়দুর্লভের প্রস্থান)
সিরাজ : তোমরা ভেবেছ তোমাদের অপকীর্তির কোনো খবর আমি রাখি না।
(ওয়াটসসহ রায়দুর্লভের প্রবেশ)
ওয়াটস।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি!
সিরাজ : আমি জানতে চাই তোমাদের অশিষ্ট (উদ্ধত) আচরণের জবাবদিহি কে করবে? কাশিমবাজারে তোমরা গোলাগুলি আমদানি করছ, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তোমরা নিজেদের দখলে আনছ, দুর্গ সংস্কার করে তোমরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে তোমরা আশ্রয় দিয়েছ, বাংলার মসনদে বসবার পর আমাকে তোমরা নজরানা পর্যন্ত পাঠাওনি। তোমরা কি ভেবেছ এইসব অনাচার আমি সহ্য করব?
ওয়াটস : আমরা আপনার অভিযোগের কথা কাউন্সিলের (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ) কাছে পেশ করব।
সিরাজ : তোমাদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তোমাদের বাণিজ্য করবার অধিকার আমি প্রত্যাহার করছি।
ওয়াটস : কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য করবার অনুমতি দিল্লির বাদশাহ আমাদের দিয়েছেন।
সিরাজ : বাদশাকে তোমরা ঘুষের টাকায় বশীভূত করেছ। তিনি তোমাদের অনাচার দেখতে আসেন না।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি নবাব আলিবর্দি আমাদের বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়েছেন।
সিরাজ : আর আমাকে তিনি যে অনুমতি দান করে গেছেন তা তোমাদের অজানা থাকবার কথা নয়। সে খবর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন কিলপ্যাট্রিক, ক্লাইভ সকলেরই জানা আছে। মাদ্রাজে বসে ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটির সঙ্গে যে পত্রালাপ করে তা আমার জানা নেই ভেবেছে? আমি সব জানি। তবু তোমাদের অবাধ বাণিজ্যে এ পর্যন্ত কোনো বিঘ্ন ঘটাইনি। কিন্তু সদ্ব্যবহার তো দূরের কথা তোমাদের জন্যে করুণা প্রকাশ করাও অন্যায়।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি আমাদের সম্বন্ধে ভুল খবর শুনেছেন। আমরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছি। We have come to earn money & not to get into politics. রাজনীতি আমরা কেন করব?
সিরাজ : তোমরা বাণিজ্য কর? তোমরা কর লুট। আর তাতে বাধা দিতে গেলেই তোমরা শাসন ব্যবস্থায় ওলটপালট (রাজনৈতিক অস্থিরতা) আনতে চাও। কর্ণাটকে, দাক্ষিণাত্যে তোমরা কী করেছ? শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে অবাধ লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছ। বাংলাতেও তোমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাও। তা না হলে আমার নিষেধ সত্ত্বেও কলকাতার দুর্গ-সংস্কার তোমরা বন্ধ করনি। কেন?
হলওয়েল : ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে চাই।
সিরাজ : ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজরা অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, কেমন?
ওয়াটস : আমরা অশান্তি চাই না, ইওর এক্সিলেন্সি
সিরাজ : চাও কি না চাও সে বিচার পরে হবে। রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা!
সিরাজ : গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা কামানের গোলায় উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিন। গোটা ফিরিঙ্গি (ইউরোপীয়দের পল্লী) পাড়ায় আগুন ধরিয়ে ঘোষণা করে দিন সমস্ত ইংরেজ যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আশপাশের গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিন তারা যেন কোনো ইংরেজের কাছে কোনো প্রকারের সওদা না বেচে। এই নিষেধ কেউ অগ্রাহ্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : আজ থেকে কলকাতার নাম হলো আলিনগর। রাজা মানিকচাঁদ, আপনাকে আমি আলিনগরের দেওয়ান নিযুক্ত করলাম।
মানিকচাঁদ : জাঁহাপনার অনুগ্রহ।
সিরাজ : আপনি অবিলম্বে কোম্পানির যাবতীয় সম্পত্তি আর প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করুন। কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করবে কোম্পানির প্রতিনিধিরা আর কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখানকার প্রত্যেকটি ইংরেজ।
মানিকচাঁদ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : (উমিচাঁদের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে) আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলো, উমিচাঁদ।
(উমিচাঁদ কৃতজ্ঞতায় নতশির)
আর (মিরমর্দানকে) হ্যাঁ, রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে আমার একটা মিটমাট হয়ে গেছে। কাজেই কৃষ্ণবল্লভকেও মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করুন।
মিরমর্দান : হুকুম জাঁহাপনা।
সিরাজ : হলওয়েল।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি।
সিরাজ : তোমার সৈন্যদের মুক্তি দিচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার বন্দি। (রায়দুর্লভকে) কয়েদি হলওয়েল, ওয়াটস আর কলেটকে আমার সঙ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে আমি তাদের বিচার করব।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
(সিরাজ-বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই মাথা নুইঁয়ে তাঁকে কুর্নিশ করল।)

[দৃশ্যান্তর]

প্রথম অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য
সময় : ১৭৫৬ সাল, তেসরা জুলাই।
স্থান : কলকাতার ভাগীরথী নদীতে

ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ।

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-ড্রেক, হ্যারি, মার্টিন, কিলপ্যাট্রিক, ইংরেজ মহিলা, সৈনিক, হলওয়েল, ওয়াটস, আর্দালি।]
(কলকাতা থেকে তাড়া খেয়ে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং তাদের দলবল এই জাহাজে আশ্রয় নিয়েছে। সকলের চরম দুরাবস্থা। আহার্য দ্রব্য প্রায়ই পাওয়া যায় না। অত্যন্ত গোপনে যৎ-সামান্য চোরাচালান আসে। পরিধেয় বস্ত্র প্রায় নেই বললেই চলে। সকলেরই এক কাপড় সম্বল। এর ভেতরেও নিয়মিত পরামর্শ চলছে কী করে উদ্ধার পাওয়া যায়। জাহাজ থেকে নদীর একদিক দেখা যাবে ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। জাহাজের ডেকে পরামর্শরত ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং আরও দুজন তরুণ ইংরেজ।)
ড্রেক : এই তো কিলপ্যাট্রিক ফিরে এসছেন মাদ্রাজ থেকে। ওঁর কাছেই শোন, প্রয়োজনীয় সাহায্য-
হ্যারি : এসে পড়ল বলে, এই তো বলতে চাইছেন? কিন্তু সে সাহায্য এসে পৌঁছোবার আগেই আমাদের দফা শেষ হবে মি. ড্রেক।
মার্টিন : কিলপ্যাট্রিক সাহেবের সুখবর নিয়ে আসাটা আপাতত আমাদের কাছে মোটেই সুখবর নয় তিনি মাত্র শ-আড়াই সৈন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এই ভরসায় একটা দাঙ্গাও করা যাবে না। যুদ্ধ করে কলকাতা জয় তো দূরের কথা।
ড্রেক : তবুও তো লোকবল কিছুটা বাড়ল।
হ্যারি : লোকবল বাড়ুক আর না বাড়ুক আমাদের অংশীদার বাড়ল তা অবশ্য ঠিক।
ড্রেক : আহার্য কোনো রকমে জোগাড় হবেই।
মার্টিন : কী করে হবে তাই বলুন না মি. ড্রেক। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎটাই তো জানতে চাইছি। এ পর্যন্ত দুবেলা আহার্যের বন্দোবস্ত হয়েছে? ধারেকাছে হাটবাজার নেই। নবাবের হুকুমে প্রকাশ্যে কেউ কোনো জিনিস আমাদের কাছে বেঁচেও না। চারগুন দাম দিয়ে কতদিন গোপনে সওদাপাতি কিনতে হয়। এই অবস্থা কতদিন চলবে সেটা আমাদের জানা দরকার।
কিলপ্যাট্রিক : এত অল্পে অধৈর্য হলে চলবে কেন?
হ্যারি : ধৈর্য ধরব আমরা কীসের আশায় সেটাও তো জানতে হবে।
ড্রেক : যা হয়েছে তা নিয়ে বিবাদ করে কোনো লাভ নেই। দোষ কারো একার নয়।
মার্টিন : যাঁরা এ পর্যন্ত হুকুম দেবার মালিক তাঁদের দোষেই আজ আমরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত বিশেষ করে আপনার হঠকারিতার জন্যেই আজ আমাদের এই দুর্ভোগ।
ড্রেক : আমার হঠকারিতা?
মার্টিন : তা নয়ত কি? অমন উদ্ধত ভাষায় নবাবকে চিঠি দেবার কী প্রয়োজন ছিল? তা ছাড়া নবাবের আদেশ অমান্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দেবারই বা কী কারণ?
ড্রেক : সব ব্যাপারে সকলের মাথা গলানো সাজে না।
হ্যারি : তা তো বটেই। কৃষ্ণবল্লভের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা উৎকোচ নেবেন মি. ড্রেক, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো কেন? কিন্তু এটা বলতে আমাদের কোনো বাধা নেই যে, ঘুষের অঙ্ক বড় বেশি মোটা হবার ফলেই নবাবের ধমকানি সত্ত্বেও কৃষ্ণবল্লভকে ত্যাগ করতে পারেননি মি. ড্রেক।
ড্রেক : আমার রিপোর্ট আমি কাউন্সিলের কাছে দাখিল করেছি।
মার্টিন : রিপোর্টের কথা রেখে দিন। তাতে আর যাই থাক সত্যি কথা বলা হয়নি। (টেবিলের ওপর এক বান্ডিল কাগজ দেখিয়ে) ওই তো রিপোর্ট তৈরি করেছেন কলকাতা যে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছেন তার। ওর ভেতরে একটি বর্ণ সত্যি কথা খুঁজে পাওয়া যাবে?
ড্রেক : (টেবিলে ঘুষি মেরে) That’s none of your business. 
মার্টিন : Of course it is. 
কিলপ্যাট্রিক : তোমরাই বা হঠাৎ এমন সাধুত্বের দাবিদার হলে কীসে?
ড্রেক : তোমাদের দুজনের ব্যাংক ব্যালান্স বিশ হাজারের কম নয় কারোরই। অথচ তোমরা কোম্পানির সত্তর টাকা বেতনের কর্মচারী।
হ্যারি : ব্যক্তিগত উপার্জনের ছাড়পত্র কোম্পানি সকলকেই দিয়েছে। সবাই উপার্জন করছে, আমরাও করছি। কিন্তু আমরা ঘুষ খাইনি।
ড্রেক : আমিও ঘুষ খাইনে।
মার্টিন : অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে খেয়ে ঘুষ কথাটার অর্থই বদলে গেছে আপনার কাছে।
ড্রেক : তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছ। ভুলে যেও না এখনো ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব আমার হাতে।
হ্যারি : ফোর্ট উইলিয়াম?
ড্রেক : ইংরেজের আধিপত্য অত সহজেই মুছে যাবে নাকি? এই জাহাজটাই এখন আমাদের কলকাতার দুর্গ। আর দুর্গ শাসনের ক্ষমতা এখনো আমার অধিকারে। বিপদের সময়ে সকলে একযোগে কাজ করার জন্যেই মন্ত্রণা সভায় তোমাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু দেখছি তোমরা এই মর্যাদার উপযুক্ত নও।
মার্টিন : বড়াই করে কোনো লাভ হবে না, মি. ড্রেক। আমরা আপনার কর্তৃত্ব মানব না (অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে)।
ড্রেক : এত বড় স্পর্ধা? Withdraw, what you have said.  মাফ চাও দ্বিতীয় কথা না বলে। Nothing short of an unconditional apology will save you. মাফ চাও তা না হলে এই মুহূর্তে তোমাদের কয়েদ করবার হুকুম দিয়ে দেব।
(জনৈক ইংরেজ মহিলা দড়ির ওপর একটা ছেঁড়া গাউন মেলতে আসছিলেন। তিনি হঠাৎ ড্রেকের কথায় রুখে উঠলেন। ছুটে গেলেন বচসারত পুরুষদের কাছে।)
ইংরেজ মহিলা : তবু যদি মেয়েদের নৌকোয় করে কলকাতা থেকে না পালাতেন তা হলেও না হয় এই দম্ভ সহ্য করা যেত। (কাপুরুষের মতো পালিয়ে দম্ভ মানায় না)
ড্রেক : We are in the council session, Madam. এখানে মহিলাদের কোনো কাজ নেই।
ইংরেজ মহিলা : ড্যাম ইওর কাউন্সিল, প্রাণ বাঁচাবে কী করে তার ব্যবস্থা নেই, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন সব।
ড্রেক : সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে।
ইংরেজ মহিলা : ছাই হচ্ছে। রোজই শুনছি কিছু একটা হচ্ছে। যা হচ্ছে সে তো নিজেদের ভেতরে ঝগড়া। এদিকে দিনের পর দিন এক বেলা খেয়ে, প্রায়ই না খেয়ে, অহোরাত্র এক কাপড় পড়ে মানুষের মনুষ্যত্ব ঘুচে যাবার জোগাড়।
ড্রেক : But you see-
ইংরেজ মহিলা : I do not see alone, You can also see every night. এক প্রস্থ জামা-কাপড় সম্বল। ছেলে-বুড়ো সকলকেই তা খুলে রেখে রাত্রে ঘুমুতে হয়। কোনো আড়াল নেই আব্রু নেই। Anybody can see that pitiable anatomic exhibition. এর চেয়ে বেশি আর কী দেখতে চান?
(হাতের ভিজে গাউনটা ড্রেকের মুখে ছুড়ে দিতে যাচ্ছেলেন মহিলাটি, এমন সময় জনৈক গোরা সৈনিকের দ্রুত প্রবেশ।)
সৈনিক : মি. হলওয়েল আর মি. ওয়াটস।
(প্রায়ই সঙ্গে সঙ্গে হলওয়েল আর ওয়াটস ঢুকল)
কিলপ্যাট্রিক : God gracious. 
হলওয়েল : (সকলের উদ্দেশে) Good morning to you. 
(সকলের সঙ্গে করমর্দন। ওয়াট্স কোনো কথা না বলে সকলের সঙ্গে করমর্দন করল। মহিলাটি একটু ইতস্তত করে অন্য দিকে চলে গেলেন।)
ড্রেক : বল, খবর বল হলওয়েল। উৎকণ্ঠায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল যে।
হলওয়েল : মুর্শিদাবাদে ফিরেই নবাব আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। অবশ্য নানা রকম ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে-কানে খৎ দিতে হয়েছে এই যা।
ড্রেক : কলকাতায় ফেরা যাবে?
হলওয়েল : না।
ওয়াটস : আপাতত নয়, কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ত একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কিলপ্যাট্রিক : কী রকম ব্যবস্থা?
ওয়াটস : অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে কিছু উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ড্রেক : তার জন্যে কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কে জানে?
হলওয়েল : একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নবাব ইংরেজের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করতে চান না। তা চাইলে এভাবে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারতেন না।
ড্রেক : তাহলে নবাবের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হয়।
হলওয়েল : কিছুটা করেই এসেছি। তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
ড্রেক : হুররে।
ওয়াটস : মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ এঁরাও আস্তে আস্তে নবাবের কানে কথাটা তুলবেন।
ড্রেক : (হ্যারি ও মার্টিনকে) আশা করি তোমাদের মেজাজ এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। আমাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে।
হ্যারি : আমরা তো ঝগড়া করতে চাইনে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জানতে চাই।
মার্টিন : যেমন হোক একটা নিশ্চিত ফল দেখতে চাই।
(উভয়ের প্রস্থান)
ড্রেক : (উচ্চকণ্ঠে) Patience is the keyword. young men. 
হলওয়েল : (পায়ে চাপড় মেরে) উঃ, কী মশা। সিরাজউদ্দৌলা মসকিউটো ব্রিগেড মবিলাইজ করে দিয়েছে নাকি?
ড্রেক : যা বলছ ম্যালেরিয়া আর ডিসেন্ট্রিতে ভুগে কয়েকজন এর ভেতরে মারাও গেছে।
ওয়াটস : বড় ভয়ানক জায়গায় আস্তানা গেড়েছেন আপনারা।
ড্রেক : But it is important from military point of view. সমুদ্র কাছেই। কলকাতাও চল্লিশ মাইলের ভেতরে। প্রয়োজন হলে যে কোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে।
কিলপ্যাট্রিক : দ্যাটস ট্রু। কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল। সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। বিপদ যদি আসেই তাহলে তা আসবে কলকাতার দিক দিয়ে গঙ্গার স্রোতে ভেসে। কাজেই সতর্ক হবার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে।
হলওয়েল : কলকাতার দিক থেকে আপাতত কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তার অনুমতি পেলেই জঙ্গল কেটে আমরা এখানে হাট-বাজার বসিয়ে দেব।
ড্রেক : অফকোর্স নেটিভরা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু ফৌজদারের ভয়েই তা পারছে না।
(প্রহরী সৈনিকের প্রবেশ। সে ড্রেকের হাতে এক টুকরো কাগজ দিল। ড্রেক কাগজ পড়ে চেঁচিয়ে উঠল)
উমিচাঁদের লোক এই চিঠি এনেছে।
সকলে : হোয়াট? এত তাড়াতাড়ি। (চা-সহ প্রহরীর প্রবেশ। অভিবাদনান্তে ড্রেকের হাতে পত্র দিল আগন্তুক। ড্রেক ইঙ্গিত করতেই তারা আবার বেরিয়ে গেল)
ড্রেক : (মাঝে মাঝে উচ্চৈঃস্বরে পত্র পড়তে লাগল)’– আমি চিরকালই ইংরেজের বন্ধু। মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব আমি বজায় রাখিব।- মানিকচাঁদকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হইয়াছে, সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করিবার অনুমতি দিয়াছে। এর জন্যে তাহাকে বারো হাজার টাকা নজরানা দিতে হইয়াছে। টাকাটা নিজের তহবিল হইতে দিয়া দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করিয়া পত্রবাহক মারফত পাঠাইলাম। এই টাকা এবং আমার পারিশ্রমিক ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যাহা ন্যায্য বিবেচিত হয় তাহা পত্রবাহকের হাতে পাঠাইলেই আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। বলা বাহুল্য, পারিশ্রমিক বাবদ আমি পাঁচ হাজার টাকা পাইবার আশা করি। অবশ্য ড্রেক সাহেবের বিবেচনায় তাহা গ্রাহ্য না হইলে দুই চারি শত টাকা কম লইতেও আমার আপত্তি নাই কোম্পানি আমার উপর ষোলো আনা বিশ্বাস রাখিতে পারেন। সুদূর লাহোর হইতে আমি বাংলাদেশে আসিয়াছি অর্থ উপার্জনের জন্য, যেমন আসিয়াছেন কোম্পানির লোকেরা। কাজেই উদ্দেশ্যের দিক দিয়া বিচার করিলে আমি আপনাদেরই সমগোত্রীয়।’ (চিঠি ভাঁজ করতে করতে)
পারফেক্ট স্কাউন্ড্রেল ইজ দিস ওঁমিচাঁদ।
হলওয়েল : কিন্তু উমিচাঁদের সাহায্য তো হাতছাড়া করা যাচ্ছে না।
ওয়াটস : Even when it is too costly. 
ড্রেক : সেই তো মুশকিল। ওর লোভের অন্ত নেই। মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্যে সতেরো হাজার টাকা দাবি করেছে। আমি হলপ করে বলতে পারি দুহাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না। বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে।
হলওয়েল : কিন্তু কিছুই করবার নেই। উপযুক্ত অবস্থার সুযোগ পেয়ে সে ছাড়বে কেন?
ড্রেক : দেখি, টাকাটা দিয়ে ওর লোকটাকে বিদায় করি। (বেরিয়ে গেল)
ওয়াটস : শুধু উমিচাঁদের দোষ দিয়ে কী লাভ? মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মানিকচাঁদ কে হাত পেতে নেই?
কিলপ্যাট্রিক : দশদিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করলে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।
হলওয়েল : কিছু না, কিছু না। হাজার হাতে হাজার হাজার হাত থেকে নিয়ে দশ হাত বোঝাই করতে আর কতটুকু সময় লাগে? বিপদ সেখানে নয়। বিপদ হলো বখরা নিয়ে মতান্তর ঘটলে। (ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মতানৈক্য লাগলে আসল ষড়যন্ত্র ফাঁস হতে পারে)
(ড্রেকের প্রবেশ)
ড্রেক : (উমিচাঁদের চিঠি বার করে) আর একটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। শওকতজঙ্গের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার লেগে গেল বলে। এই সুযোগ নেবে মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠের দল। তারা শওকত জঙ্গকে সমর্থন করবে।
ওয়াটস : খুব স্বাভাবিক। শওকতজঙ্গ নবাব হলে সকলের উদ্দেশ্যেই হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নাচওয়ালিদের নিয়ে সারাক্ষণ সে পড়ে থাকবে আর উজির ফৌজদাররা যার যা খুশি তাই করতে পারবে।
ড্রেক : আগেভাগেই তার কাছে আমাদের ভেট (উপহার) পাঠানো উচিত বলে আমার মনে হয়।
কিলপ্যাট্রিক : I send you. 
ওয়াটস : তা পাঠান। কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে গেল যে! এখানে একটা বাতি দেবে না?
ড্রেক : অর্ডারলি, বাত্তি লে আও।
হলওয়েল : নবাবের কয়েদখানায় থেকে এ দুদিনে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছি। আপনাদের অবস্থা কি ততটাই খারাপ?
ড্রেক : নট সো ব্যাড, আই হোপ।
(আর্দালি একটা বাতি রাখল)
ড্রেক : পেগ লাগাও।
(দূরে থেকে কণ্ঠস্বর)
নেপথ্যে : জাহাজ-জাহাজ আসছে।
চারজনে সমস্বরে : কোথায়? From which side? 
নেপথ্যে : সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিনখানা, চারখানা, পাঁচখানা। পাঁচখানা জাহাজ। কোম্পানির জাহাজ! (আর্দালি বোতল আর গ্লাস রাখল টেবিলে)
ড্রেক : কোম্পানির জাহাজ? মাস্ট বি ফ্রম ম্যাড্রাস। লেট আস সেলিব্রেট। হিপ হিপ হুররে।
সমস্বরে : হুররে।
(সবাই গ্লাসে মদ ঢেলে নিল)

[দৃশ্যান্তর]

প্রথম অঙ্ক-তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল, ১০ই অক্টোবর।
স্থান : ঘসেটি বেগমের বাড়ি।

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ঘসেটি বেগম, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রাইসুল জুহালা, রায়দুর্লভ, প্রহরী, সিরাজ, মোহনলাল, নর্তকী, বাদকগণ।]

 

(পৌঢ়া বেগম জাঁকজমকপূর্ণ জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, বাদক এবং নর্তকী। সুসজ্জিত খানসামা তাম্বুল এবং তাম্রকূট পরিবেশন করছে। একজন বিচিত্রবেশী অতিথির সঙ্গে আসরে প্রবেশ করল উমিচাঁদ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ের নাচ শেষ হলো। সকলের হাততালি।)

 

ঘসেটি : বসুন, উমিচাঁদজি। সঙ্গের মেহমানটি আমাদের অচেনা বলেই মনে হচ্ছে।
উমিচাঁদ : (যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে) মাফ করবেন বেগম সাহেবা, ইনি একজন জবরদস্ত শিল্পী। আমার সঙ্গে অল্পদিনের পরিচয় কিন্তু তাতেই আমি এঁর কেরামতিতে একেবারে মুগ্ধ। আজকের জলসা সরগরম করে তুলতে পারবেন আশা করে এঁকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
রাজবল্লভ : তাহলেও এখানে একজন অপরিচিত মেহমান-
উমিচাঁদ : না, না, সে সব কিছু ভাবতে হবে না। দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ান।
জগৎশেঠ : তাহলে আরম্ভ করুন ওস্তাদজি। দেখি নাচওয়ালিদের ঘুঙুর (ঝুমকার মালা) এবং ঘাগরা (এক ধরনের পোশাক) বাদ দিয়ে আপনার কাজের তারিফ করা যায় কিনা।
(ঘসেটি রাজবল্লভের দৃষ্টি বিনিময়। আগন্তুক আসরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজির নামটা-
আগন্তক : রাইসুল জুহালা।
(সকলের উচ্চহাসি) (নামের অর্থ মূর্খদের প্রধান)
রাজদুলর্ভ : জাহেলদের রইস। এই নামের গৌরবেই আপনি উমিচাঁদজিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন নাকি?
(আবার সকলের হাসি)
উমিচাঁদ : (ইষৎ রুষ্ট) আমি তো বেশক জাহেল। তা না হলে আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই। (আপনারা ষড়যন্ত্র করেও নিরাপদে থাকেন আর আমি কিছু না করেও ধরা খেয়ে যাই)
ঘসেটি : আপনারা বড় বেশি কথা কাটাকাটি করেন। শুরু করুন, ওস্তাদজি।
জুহালা : য্যায়সা হুকুম। আমি নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের আদব-কায়দা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। আপাতত আমি আপনাদের একটা নাচ দেখব। পক্ষীকুলের একটি বিশেষ শ্রেণি, ধার্মিক হিসেবে যার জবরদস্ত নাম (বক), সেই পাখির নৃত্যকলা আপনারা দেখবেন। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এই বিশেষ নৃত্যটি আমি জনপ্রিয় করতে চাই। (দেশে বর্তমানে বকধার্মিক তথা ভণ্ডদের প্রভাব ‍বুঝাতে এই নৃত্য জনপ্রিয় করছি) (তবলচিকে) একটু ঠেকা দিয়ে দিন।
(তাল বলে দিল। নৃত্য চলাকালে ঘসেটি এবং রাজবল্লভ নিচুস্বরে পরামর্শ করলেন। পরে উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভও কিছু আলোচনা করলেন। নাচ শেষ হলে সকলে হর্ষ প্রকাশ।)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজি জবরদস্ত লোক মনে হচ্ছে। ওঁকে আরও কিছু কেরামতি (গোয়েন্দার কাজ) দেখাবার দায়িত্ব দিলে কেমন হয়?
(উমিচাঁদ রাইসুল জুহালাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কিছু বলল। তারপর নিজের আসনে ফিরে এল)
উমিচাঁদ : উনি রাজি আছেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে কলাকৌশল দেখাবার ফাঁকে ফাঁকে দু-চারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতে ওঁর আপত্তি নেই।
রাজবল্লভ : তাহলে এখন ওঁকে বিদায় দিন। পরে দরকার মতো কাজে লাগানো হবে।
রাইসুল জুহালা : বহুত আচ্ছা, হুজুর।
(সবাইকে সালাম করে কালোয়াতি (সংগীত দক্ষতা) করতে করতে বেরিয়ে গেল)
ঘসেটি : তাহলে আবার নাচ শুরু হোক?
রাজবল্লভ : আমার মনে হয় নাচওয়ালিদের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে কাজের কথা সেরে নেওয়াই ভালো।
ঘসেটি : তাই হোক।
(ইঙ্গিত করতেই দলবলসহ নাচওয়ালিদের প্রস্থান)
রাজদুর্লভ : বেগম সাহেবাই আরম্ভ করুন।
ঘসেটি : আপনারা তো সব জানেন। এখন খোলাখুলিভাবে যার যা বলার আছে বলুন। (দাবি দাওয়া পেশ করুন)
জগৎশেঠ : সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে আমরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছি। কিন্তু শওকতজঙ্গ নবাব হলে আমি কি পাব তা আমাকে পরিষ্কার করে বলুন।
ঘসেটি : শওকতজঙ্গ আপনাদেরই ছেলে। সে নবাবি পেলে প্রকারান্তরে আপনারাই তো দেশের মালিক হয়ে বসবেন।
রাজদুর্লভ : এটা কোনো কথা হলো না। (স্পষ্ট কোনো চুক্তি হল না) যিনি নবাব হবেন-
জগৎশেঠ : আমার কথা আগে শেষ হোক দুর্লভরাম।
রাজদুর্লভ : বেশ, আপনার কথাই শেষ করুন। কিন্তু মনে রাখবেন কথা শেষ হবার পর আর কোনো কথা উঠবে না।
জগৎশেঠ : সে আবার কী কথা?
রাজবল্লভ : আপনারা তর্কের ভেতর যাচ্ছেন আলোচনা শুরু করার আগেই। খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের আলোচনা (ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা) দীর্ঘ করা বিপজ্জনক।
জগৎশেঠ : কথা ঠিক। কিন্তু নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে যাওয়াটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মাফ করবেন বেগম সাহেবা, আমি খোলাখুলি বলছি। অস্বীকার করে লাভ নেই যে, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাংয়ের গেলাস এবং নাচওয়ালি ছাড়া আর কিছুই জানে না। কাজেই শওকতজঙ্গ নবাব হবে নামমাত্র। আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার এবং পরোক্ষে তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজবল্লভ।
রায়দুর্লভ : ঠিক এই ধরনের একটা সম্ভাবনার উল্লেখ করার ফলেই হোসেন কুলি খাঁকে (ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে) প্রাণ দিতে হয়েছে।
জগৎশেঠ : আমি তা বলছিনে। তা ছাড়া এখানে সে কথা অবান্তর। আমি বলতে চাইছি যে, শওকতজঙ্গ নবাবি পেলে বেগম সাহেবা এবং রাজা রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে আমাদের তেমন আশা নেই। কাজেই আমাদের পক্ষে নগদ কারবারই ভালো।
ঘসেটি : ধনকুবের জগৎশেঠকে নগদ অর্থ দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খরচ চলবে কী করে?
জগৎশেঠ : না, না, আমি নগদ টাকা চাইছিনে। যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা আমি দেব, অবশ্য আমার সাধ্য। কিন্তু আসল এবং লাভ মিলিয়ে আমাকে একটা কর্জনামা সই করে দিলেই আমি নিশ্চিত হতে পারি।
রাংদুর্লভ : আমাকেও পদাধিকারের একটা একবারনামা সই করে দিতে হবে। (প্রহরীর প্রবেশ। ঘসেটি বেগমের হাতে পত্র দান)
ঘসেটি : (চিঠি খুলতে খুলতে) সিপাহসালার মিরজাফরের পত্র। (পড়তে পড়তে) তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজবল্লভ : বহুত খুব।
উমিচাঁদ : আমার তো কোনো বিষয়ে কোনো দাবিদাওয়া নেই, আমি সকলের খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই নিই। কাজেই এতক্ষণ আমি চুপ করেই আছি।
ঘসেটি : আপনারও যদি কিছু বলার থাকে এখুনি বলে ফেলুন।
উমিচাঁদ : নিজের সম্বন্ধে কিছু নয়। তবে সিপাহসালারের প্রস্তুতি আমার পছন্দ হয়েছে তাই বলছি। ইংরেজ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছে। সিরাজউদ্দৌলার পতনই তাদের কাম্য। শওকতজঙ্গ এখুনি যদি আঘাত হানতে পারেন, তিনি ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাবেন। ফলে জয় তাঁর অবধারিত।
ঘসেটি : সিরাজের পতন কে না চায়?
উমিচাঁদ : অন্তত আমরা চাই। কারণ সিরাজউদ্দৌলার নবাবিতে নির্বিঘ্ন হতে পারলে আমাদের সকলের স্বার্থই রাহুগ্রস্ত হবে।
ঘসেটি : সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের বড় বেশি আশঙ্কা।
উমিচাঁদ : কিছুমাত্র নয় বেগম সাহেবা। দওলত আমার কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়। আমি দওলতের পূজারী। তা না হলে সিরাজউদ্দৌলাকে বাতিল করে শওকতজঙ্গকে চাইব কেন? আমি কাজ কতদূর এগিয়ে এসেছি এই দেখুন তার প্রামণ।
(পকেট থেকে চিঠি বার করে ঘসেটি বেগমের হাতে দিল)
ঘসেটি : (চিঠির নিচে স্বাক্ষর দেখে উল্লসিত হয়ে) এ যে ড্রেক সাহেবের চিঠি!
উমিচাঁদ : আমার প্রস্তাব অনুমোদন করে তিনি জবাব দিয়েছেন।
ঘসেটি : (পত্র পড়তে পড়তে) লিখেছেন শওকতজঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে। তাহলে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
রাজবল্লভ : আমাদের বন্ধু সিপাহসালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছে করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।
(হঠাৎ বাইরে তুমুল কোলাহল। সকলেই সচকিত। ঘসেটি বেগম কোলাহলের কারণ জানবার জন্যে যেতেই রাজবল্লভ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নাচওয়ালিদের ডেকে পাঠালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তারা সদলবলে কামরায় এল।)
রাজবল্লভ : আরম্ভ কর জলদি। (ঘুঙুরের আওয়াজ উঠবার পর পরই সবেগে কামরায় ঢুকলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পেছনে মোহনলাল। সবাই তড়িৎ-বেগে দাঁড়ালো। নাচওয়ালিদের নাচ থেমে গেল।)
ঘসেটি : (ভীতিরুদ্ধ কণ্ঠে) নবাব!
সিরাজ : কি ব্যাপার খালাআম্মা, বড়ো ভারী জলসা বসিয়েছেন?
ঘসেটি : (আত্মস্থ হয়ে) এ রকম জলসা এই নতুন নয়।
সিরাজ : তা নয়, তবে বাংলাদেশের সেরা লোকেরাই শুধু শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
ঘসেটি : নবাব কি নাচগানের মজলিস মানা করে দিয়েছেন?
সিরাজ : নাচগানের মহফিলের জন্যে দেউড়িতে (প্রধান দরজা) কড়া পাহারা বসিয়ে রেখেছেন খালাআম্মা। তারা তো আমার ওপরে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিল প্রায়। দেহরক্ষী ফৌজ সঙ্গে না থাকলে এই জলসায় এতক্ষণে মর্সিয়া শুরু করতে হতো। (হঠাৎ কণ্ঠস্বরে অবিচল তীব্রতা ঢেলে)
রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, আপনারা এখন যেতে পারেন। মতিঝিলের জলসা আমি চিরকালের মতো ভেঙে দিলাম। (ঘসেটি বেগমকে) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মার পক্ষে প্রাসাদের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
ঘসেটি : (রোষে চিৎকার করে) তুমি আমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছ? তোমার এতখানি স্পর্ধা?
সিরাজ : এতে ক্রুদ্ধ হবার কি আছে? আম্মা আছেন, আপনিও তাঁর সঙ্গেই প্রাসাদে থাকবেন।
ঘসেটি : মতিঝিল ছেড়ে আমি এক পা নড়ব না। তোমার প্রাসাদে যাব? তোমার প্রাসাদ বাজ পড়ে খান খান হয়ে যাবে। (সহসা কাঁদতে আরম্ভ করলেন)
সিরাজ : (অবিচলিত) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মা। আপনাকে আমি নিয়ে যাব।
ঘসেটি : (মাতম করতে করতে) রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ বিধবার ওপরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?
রাজবল্লভ : (একটু ইতস্তত করে) জাঁহাপনা কি সত্যিই-
সিরাজ : (উত্তপ্ত) আপনাদের চলে যেতে বলেছি রাজা রাজবল্লভ। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল। আশা করি অপ্রিয় ঘটনার ভেতর দিয়ে তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।
(রাজবল্লভ প্রভৃতি প্রস্থানোদ্যত) হ্যাঁ, শুনুন রায়দুর্লভ, শওকতজঙ্গকে আমি বিদ্রোহী ঘোষণা করেছি। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আপনি তৈরি থাকবেন। প্রয়োজন হলে আপনাকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা। (তারা নিষ্ক্রান্ত হলো। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন।)
সিরাজ : মোহনলাল আপনাকে নিয়ে আসবে, খালাআম্মা। আপনার কোনো রকম অমর্যাদা হবে না। (বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন)
ঘসেটি : তোমার ক্ষমতা ধবংস হবে, সিরাজ। নবাবি? নবাবি করতে হবে না বেশিদিন। কেয়ামত নাজেল হবে। আমি তা দেখব-দেখব।

দ্বিতীয় অঙ্ক- প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ১০ই মার্চ।
স্থান : নবাবের দরবার।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- নকিব (ঘোষণা প্রদানকারী), সিরাজ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উৎপীড়িত ব্যক্তি, প্রহরী, ওয়াটস, মোহনলাল।]

(দরবারে উপস্থিত- মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ এবং ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াটস। মোহনলাল, মিরমর্দান, সাঁফ্রে অস্ত্রসজ্জিত বেশে দণ্ডায়মান। নকিবের কণ্ঠে দরবারে নবাবের আগমন ঘোষিত হলো।)

 

নকিব : নবাব মনসুর-উল-মূলুক সিরাজউদ্দৌলা শাহকুলি খাঁ মির্জা মুহম্মদ হায়বতজঙ্গ বাহাদুর। বা-আদাব আগাহ বাশেদ।
(সবাই আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল দৃঢ় পদক্ষেপে নবাব ঢুকলেন। সবাই নতশিরে শ্রদ্ধা জানালো।)
সিরাজ : (সিংহাসনে আসীন হয়ে) আজকের এই দরবারে আপনাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্যে।
রাজবল্লভ : বেয়াদবি মাফ করবেন জাঁহাপনা। দরবারে এ পর্যন্ত তেমন কোনো জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি (দরবারের গুরুত্বহীনতা)। তাই আমরা তেমন-
সিরাজ : গুরুতর কোনো বিষয়ের মীমাংসা হয়নি এই জন্যে যে, গুরুতর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এমন আশঙ্কা আমার ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, সিপাহসালার মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকবেন। আমার পথ বিঘ্নসঙ্কুল হয়ে উঠবে না (রাজ্যে বিশৃঙ্খলা হবে না)। অন্তত নবাব আলিবর্দির অনুরাগভাজনদের কাছ থেকে আমি তাই আশা করেছিলাম।
মিরজাফর : জাঁহাপনা কি আমাদের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ করছেন?
সিরাজ : আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার কোনো বাসনা আমার নেই। আমার নালিশ আজ আমার নিজের বিরুদ্ধে (আত্মসমালোচনা)। বিচারক আপনারা। বাংলার প্রজা সাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে পারিনি বলে আমি তাদের কাছে অপরাধী। আজ সেই অপরাধের জন্যে আপনাদের কাছে আমি বিচারপ্রার্থী।
জগৎশেঠ : আপনার অপরাধ!
সিরাজ : পরিহাস বলে মনে হচ্ছে শেঠজি? চেয়ে দেখুন এই লোকটার দিকে (ইঙ্গিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী একজন হতশ্রী ব্যক্তিকে দরবারে হাজির করল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল)
রায়দুর্লভ : একি! (করুণ অবস্থা দেখে) এর এই অবস্থা কে করলে? (তরবারি নিষ্কাশন)
সিরাজ : তরবারি কোষাবদ্ধ করুন রায়দুর্লভ! এর এই অবস্থার জন্যে দায়ী সিরাজের দুর্বল শাসন।
উৎপীড়িত ব্যক্তি : আমাকে শেষ করে দিয়েছে হুজুর।
মিরজাফর : আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছি না, জাঁহাপনা।
উৎপীড়িত ব্যক্তি : লবণ বিক্রি করিনি বলে কুঠির সাহেবদের লোকজন আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। (ক্রন্দন)
সিরাজ : (সিংহাসনের হাতলে ঘুষি মেরে) কেঁদো না। শুকনো খটখটে গলায় (কান্না থামিয়ে) বলো আর কি হয়েছে। আমি দেখতে চাই, আমার রাজত্বে হৃদয়হীন জালিমের বিরুদ্ধে অসহায় মজলুম কঠিনতর জালিম হয়ে উঠেছে (অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ পরায়ণ মনোভাব)।
উৎপীড়িত ব্যক্তি : লবণ বিক্রি করিনি বলে কুঠির সাহেবদের লোকজন আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। ষণ্ডা ষণ্ডা (বিশাল দেহ) পাঁচজনে মিলে আমার পোয়াতি বউটাকে- ওহ্ হো হো (কান্না)- আমি দেখতে চাইনি। কিন্তু চোখ বুজলেই- ওদের আর একজন আমার নখের ভেতরে খেজুরকাঁটা ফুটিয়েছে। আমার বউকে ওরা খুন করে ফেলেছে হুজুর। (কান্নায় ভেঙে পড়ল)
সিরাজ : (হঠাৎ আসন ত্যাগ করে ওয়াটসের কাছে গিয়ে প্রবল কণ্ঠে) ওয়াটস!
ওয়াট্স : (ভয়ে বিবর্ণ) Your Excellency.
সিরাজ : আমার নিরীহ প্রজাটির এই দুরবস্থার জন্যে কে দায়ী?
ওয়াটস : How can I know that? Your excellency. 
সিরাজ : তুমি কী করে জানবে? তোমাদের অপকীর্তির কোনো খবর আমার কাছে পৌঁছায় না ভেবেছ? কুঠিয়াল ইংরেজরা এমনি করে দৈনিক কতগুলো নিরীহ প্রজার ওপর অত্যাচার করে তার হিসেব দাও।
ওয়াটস : আপনি আমায় অপমান করছেন ইওর এক্সিলেন্সি। দেশের কোথায় কী হচ্ছে সে কৈফিয়ত আমি দেবো কী করে? আমি তো আপনার দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি।
সিরাজ : তুমি প্রতিনিধি? ড্রেক এবং তোমার পরিচয় জানি না ভেবেছ? দুশ্চরিত্র এবং উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে দেশ থেকে নির্বাসিত না করে ভারতের বাণিজ্যের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তাই এদেশে বাণিজ্য করতে এসে দুর্নীতি এবং অনাচারের পথ তোমরা ত্যাগ করতে পারনি। কৈফিয়ত দাও আমার নিরীহ প্রজাদের ওপর এই জুলুমে কেনো?
ওয়াটস : আপনার প্রজাদের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক। আমরা ট্যাক্স দিয়ে শান্তিতে বাণিজ্য করি।
সিরাজ : ট্যাক্স দিয়ে বাণিজ্য কর বলে আমার নিরীহ প্রজার ওপরে অত্যাচার করবার অধিকার তোমরা পাওনি।
(সমবেত সকলকে উদ্দেশ করে)
এই লোকটি লবণ প্রস্তুতকারক। লবণের ইজারাদার কুঠিয়াল ইংরেজ। স্থানীয় লোকদের তৈরি যাবতীয় লবণ তারা তিন চার আনা মণ দরে পাইকারি হিসেবে কিনে নেয়। তারপর এখানে বসেই এখানকার লোকের কাছে সেই লবণ বিক্রি করে দুটাকা আড়াই টাকা মণ দরে।
মিরজাফর : এ তো ডাকাতি।
সিরাজ : আপনাদের পরামর্শেই আমি কোম্পানিকে লবণের ইজারাদারি দিয়েছি। আপনারা আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাজস্বের পরিমাণ বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কি তার প্রমাণ? এই লোকটি কুঠিয়াল ইংরেজদের কাছে পাইকারি দরে লবণ বিক্রি করতে চায়নি বলে তার এই অবস্থা। বলুন শেঠজি, বলুন রাজবল্লভ, ব্যক্তিগত অর্থলালসায় বিচারবুদ্ধি হারিয়ে আমি এই কুঠিয়ালদের প্রশয় দিয়েছি কি না? বলুন সিপাহসালার, বলুন রায়দুর্লভ, আমি এই অনাচারীদের বিরুদ্ধে শাসন- শক্তি প্রয়োগ করবার সদিচ্ছা দেখিয়েছি কি-না? বিচার করুন। আপনাদের কাছে আজ আমি আমার অপরাধের বিচারপ্রার্থী।
(প্রহরী উৎপীড়িত লোকটিকে বাইরে নিয়ে গেল)
রাজবল্লভ : জাঁহাপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু প্রকাশ্য দরবারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনায় আমাদের অপমান না করলেও চলত।
জগৎশেঠ : নবাবের কাছে আমাদের পদমর্যাদার কোনো মূল্যই নেই। তাই-
সিরাজ : আপনারাও সবাই মিলে নবাবের মর্যাদা যে কোনো মূল্যে বিক্রি করে দিতে চান, এই তো?
মিরজাফর : একথা বলে নবাব আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনতে চাইছেন। এই অযথা দুর্ব্যবহার আমরা হৃষ্ট মনে গ্রহণ (নবাবের অপমান সহ্য করা) করতে পারব কি না সন্দেহ।
সিরাজ : বাংলার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন সিপাহসালার? দরবারে বসে নবাবের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা বিধেয় তাও আপনার স্মরণ নেই? এই মুহূর্তে আপনাকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আমি নিজে গ্রহণ করতে পারি। আপনি, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ সবাইকে কয়েদখানায় আটক রাখতে পারি। হ্যাঁ, কোনো দুর্বলতা নয়। শত্রুর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে আমাকে তাই করতে হবে। মোহনলাল!
(মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করল)
সিরাজ : (হাতের ইঙ্গিতে মোহনলালকে নিরস্ত করে শান্তভাবে) না, আমি তা করব না। ধৈর্য ধরে থাকব। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা এবং শাঠ্যের (প্রতারণা) ওপর আমাদের মৌলিক সম্প্রীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ সন্দেহেরও কোনো অবকাশ রাখব না।
মিরজাফর : আমাদের প্রতি নবাবের সন্দিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের কল্যাণের কথা ভেবে আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠব। (জীবনের শঙ্কা)
সিরাজ : ওই একটি পথ সিপাহসালার-দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণ। শুধু ওই একটি পথেই আবার আমরা উভয়ে উভয়ের কাছাকাছি আসতে পারি। আমি জানতে চাই, সেই পথে আপনারা আমার সহযাত্রী হবেন কি না?
রাজবল্লভ : জাঁহাপনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট জানা দরকার।
সিরাজ : আমার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধি খেলাপ করে, আমার আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখুনি এর প্রতিবিধান (শাস্তি দেওয়া) করতে না পারলে ওরা একদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হস্তক্ষেপ করবে।
মিরজাফর : জাঁহাপনা, আমাদের হুকুম করুন।
সিরাজ : আমি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়েই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। তবু বলছি- আপনারা ইচ্ছে করলে আমাকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক একাই তা বইবার চেষ্টা করব। শুধু আপনাদের কাছে আমার একমাত্র অনুরোধ যে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আপনারা আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না।
মিরজাফর : দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে আমরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।
সিরাজ : আমি জানতাম দেশের প্রয়োজনকে আপনারা কখনো তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না।
(সিরাজের ইঙ্গিতে প্রহরী তাঁর হাতে কোরান শরিফ দিল। সিরাজ দুহাতে সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে বুকের সঙ্গে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর মিরজাফরের দিকে এগিয়ে দিলেন। মিরজাফর নতজানু হয়ে দুহাতে কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন।
মিরজাফর : আমি আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে ওয়াদা করছি, আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।
(সিরাজ প্রহরীর হাতে কোরান শরিফ সমর্পণ করলেন এবং অপর প্রহরীর হাত থেকে তামা, তুলসী, গঙ্গাজলের পাত্র গ্রহণ করলেন। তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে একে একে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ উমিচাঁদ উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ নিজের নিজের প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে গেলেন।)
রাজবল্লভ : আমি রাজবল্লভ, তামাতুলসী, গঙ্গাজল ছুঁয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ করছি, আমার জীবন নবাবের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত।
রায়দুর্লভ : ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করছি, সর্বশক্তি নিয়ে চিরকালের জন্যে আমি নবাবের অনুগামী।
উমিচাঁদ : রামজি কি কসম, ম্যায় কোরবান হুঁ নওয়াবকে লিয়ে। (প্রহরী গঙ্গাজলের পাত্র নিয়ে চলে গেল।)
সিরাজ : (ওয়াটসকে) ওয়াটস।
ওয়াটস : Your Excellency.
সিরাজ : আলিনগরের সন্ধির শর্ত অনুসারে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে দরবারে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সেই সম্মানের অপব্যবহার করে এখানে বসে তুমি গুপ্তচরের কাজ করছ। তোমাকে সাজা না দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে যাও দরবার থেকে। ক্লাইভ আর ওয়াটসকে গিয়ে সংবাদ দাও যে, তাদের আমি উপযুক্ত শিক্ষা দেব। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেইমান নন্দকুমার ঘুষ খাইয়ে তারা চন্দননগর ধবংস করেছে। এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি তাদের যথাযোগ্য ভাবেই দেওয়া হবে।
ওয়াটস : Your Excellency.
(কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল)

[দৃশ্যান্তর]

দ্বিতীয় অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ১৯এ মে। স্থান : মিরজাফরের আবাস।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- জগৎশেঠ, মিরজাফর, রাজবল্লভ, রাইসুল, প্রহরী।]

(মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত, মিরজাফর, রাজবল্লভ, রাজদুর্লভ, জগৎশেঠ)

 

জগৎশেঠ : সিপাহসালার বড় বেশি হতাশ হয়েছেন।
মিরজাফর : না শেঠজি, হতাশ হবার প্রশ্ন নয়। আমি নিস্তব্ধ হয়েছি আগ্নেয়গিরির মতো প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়বার জন্যে (তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ) তৈরি হচ্ছি। বুকের ভেতর আকাঙ্ক্ষার আর অধিকারের লাভা (রাজত্বের তীব্র লোভ) টগবগ করে ফুটে উঠছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য উত্তাপে। এবার আমি আঘাত হানবই।
রাজবল্লভ : শুধু অপমান! প্রাণের আশঙ্কায় সে আমাদের আতঙ্কিত করে তোলেনি? পদস্থ কেউ হলে মানীর মর্যাদা বুঝত (সিরাজ তাদের সম্মান দিতে জানে না)। কিন্তু মোহনলালের মতো সামান্য একটা সিপাই যখন তলোয়ার খুলে সামনে দাঁড়াল তখন আমার চোখে কেয়ামতের ছবি ভেসে উঠেছিল।
রায়দুর্লভ : সিপাহসালারের অপমানটাই আমার বেশি বেজেছে। (মীর জাফরকে উসকানি)
মিরজাফর : এখন আপনারা সবাই আশা করি বুঝতে পারছেন যে, সিরাজ আমাদের শাস্তি দেবে না। (সিরাজের অদূরদর্শীতা)
জগৎশেঠ : তা দেবে না। চতুর্দিকে বিপদ, তা সত্ত্বেও সে আমাদের বন্দি করতে চায়। এরপর সিংহাসনে স্থির হতে পারলে তো কথাই নেই।
রাজবল্লভ : আমাদের অস্তিত্বই সে লোপ করে দেবে। আমাদের সম্বন্ধে যতটুকু সন্দেহ নবাবের বাইরের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পায়নি তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। শওকতজঙ্গের ব্যাপারে নবাব আমাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি। শুধু মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিনাশ করেছে। এতে আমাদের নিশ্চিত হবার কিছুই নেই।
জগৎশেঠ : তার প্রমাণ তো রয়েছে হাতের কাছে। আমাদের গ্রেফতার করতে গিয়েও করেনি। কিন্তু রাজা মানিকচাঁদকে তো ছাড়ল না। তাকে কয়েদখানায় যেতে হলো। শেষ পর্যন্ত দশ লক্ষ টাকা খেসারত দিয়ে তবে তার মুক্তি। আমি দেখতে পাচ্ছি নন্দকুমারের অদৃষ্টেও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।
মিরজাফর : আমাদের কারও অদৃষ্ট মেঘমুক্ত থাকবে না শেঠজি। (বিপদ কেটে যাবে)
রাজবল্লভ : আমি ভাবছি তেমন দুঃসময় যদি আসে, আর মূল্য দিয়ে মুক্তি কিনবার পথটাও যদি খোলা থাকে, তা হলেও সে মূল্যের পরিমাণ এত বিপুল হবে যে আমরা তা বইতে পারব কিনা সন্দেহ। মানিকচাঁদের মুক্তিমূল্য পঞ্চাশ কোটি টাকার কম হবে না।
জগৎশেঠ : ওরে বাবা! তার চেয়ে গলায় পা দিয়ে বুকের ভেতর থেকে কলজেটাই টেনে বার করে আনুক। পঞ্চাশ কোটি? আমার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করলেও এক কোটি টাকা হবে না। ধরতে গেলে মাসের খরচটাই তো ওঠে না। নবাবের হাত থেকে ধন-সম্পত্তি রক্ষার জন্যে মাসে মাসে অজস্র টাকা খরচ করে সেনাপতি ইয়ার লুৎফ খাঁয়ের অধীনে দুহাজার অশ্বারোহী পুষতে হচ্ছে। (নবাব যেন তার অবৈধ সম্পত্তির কথা না জানে)
মিরজাফর : কাজেই আর কালক্ষেপ নয়।
রাজবল্লভ : আমরা প্রস্তুত। কর্মপন্থা আপনিই নির্দেশ করুন। আমরা একবাক্যে আপনাকেই নেতৃত্ব দিলাম।
মিরজাফর : আমার ওপরে আপনাদের আন্তরিক ভরসা আছে তা আমি জানি। তবু আজ একটা বিষয় খোলাসা করে নেওয়া উচিত। আজ আমরা সবাই সন্দেহ-দোলায় দুলছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিনে। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে পাকাপাকি করে নেওয়াই আমার প্রস্তাব।
জগৎশেঠ : আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
রায়দুর্লভ : এতে আপত্তির কি থাকতে পারে?
(নেপথ্যে কণ্ঠস্বর)
নেপথ্যে (দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছে) : ওরে বাবা কতবার দেখতে হবে? দেউড়ি থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত মোট একুশবার দেখিয়েছি। এই দেখ বাবা, আর একটিবার দেখ। হলো তো?
(রাইসুল জুহালা কামরায় ঢুকল)
কী গেরোরে বাবা। (কী বিপদ)
মিরজাফর : কী হয়েছে?
রাইস : সালাম হুজুর। ওই পাহারাওয়ালা হুজুর। সবাই হাত বাড়িয়ে আঙুল নাচিয়ে বলে, দেখলাও। দেরি করলে তলোয়ারে হাত দেয়। আমি বলি, আছে বাবা, আছে। খোদ নবাবের পাঞ্জা- (অনুমতিপত্র)
মিরজাফর : (সন্ত্রস্ত) নবাবের পাঞ্জা?
রাইস : আলবত হুজুর। কেন নয়? (আবার কুর্নিশ করে) হুজুরের নবাব হতে আর বাকি কি?
মিরজাফর : (প্রসন্ন হাসি হেসে) সে যাক! খবর কী তাই বলো!
রাইস : প্রায় শেষ খবর নিয়ে এসেছিলাম (মৃত্যুর সংবাদ) হুজুর। তলোয়ারের খাড়া এক কোপ। একেবারে গর্দান সমেত-
রাজবল্লভ : (বিরক্ত) আবোল তাবোল বকে বড় বেশি সময় নষ্ট করছ রাইস মিয়া।
রাইস : (ক্ষুদ্ধ) আবোল তাবোল কি হুজুর, বলছি তো তলোয়ারের খাড়া এক কোপ। লাফিয়ে সরে দাঁড়িয়ে তাই রক্ষে। তবু এই দেখুন (পকেট থেকে দ্বিখণ্ডিত মূলার নিম্নাংশ বার করল।) একটু নুন জোগাড় হলেই কাঁচা খাব বলে মুলোটা হাতে নিয়েই ঘুরছিলাম। ক্লাইভ সাহেবের তলোয়ারের কোপে সেটাই দুখ-।
জগৎশেঠ : এ যে দেখি ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোরালো করে তুলছে। ক্লাইভ সাহেব তোমাকে তলোয়ারের কোপ মারতে গেল কেন?
রাইস : গেরো হুজুর। কপালের গেরো। উমিচাঁদজির চিঠি নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি চিঠি না পড়ে কটমট করে আমার দিকে চাইতে লাগলেন। তারপর ওঁর কামানের মতো গলা দিয়ে একতাল কথার গোলা ছুটে বার হলো: Are you a spy? এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রশ্নই বাংলায়-তুমি গুপ্তচর? এমন এক অদ্ভুত উচ্চরণ করলেন, আমি শুনলাম তুমি ঘুফুৎচোর? চোর কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে উঠল। তা ছাড়া ঘুফুৎচোর? গামছা চোর বদনা চোর, জুতো চোর, গরু চোর, সিঁধেল চোর, কাফন চোর আমাদের আপনাদের ভেতরে হুজুর কত রকমারি চোরের নাম যে শুনেছি আর তাদের চেহারা চিনেছি তার আর হিসাব নেই। কিন্তু ঘুফুৎচোর আর আমি স্বয়ং। হিতাহিত বিচার না করেই হুজুর মুখের ওপরেই বলে ফেললাম, -(মৃদু হাসি) একটু ইংরেজিও তো জানি, ইংরেজিতেই বললাম, ইউ শাট আপ। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারের এক কোপ। (হেসে উঠে) অহংকার করব না হুজুর, লাফটা যা দিয়েছিলাম একবারে মাপা। তাই আমার গর্দানের বদলে ক্লাইভ সাহেবের ভাগ্যে জুটছে মুলোর মাথাটা।
মিরজাফর : কথা থামাবে রাইস মিয়া।
রাইস : হুজুর।
মিরজাফর : এখন তুমি কার কাছ থেকে আসছ?
রাইস : উমিচাঁদজির কাছ থেকে। এই যে চিঠি। (পত্র দিল)
মিরজাফর : (পত্র পড়ে রাজবল্লভের দিকে এগিয়ে দিলেন) ক্লাইভ সাহেবের ওখানে কাকে দেখলে?
রাইস : অনেকগুলো সাহেব মেমসাহেব হুজুর। ভূত ভূত চেহারা সব। (অত্যধিক ফর্সা)
মিরজাফর : কারো নাম জানো না?
রাইস : সবতো বিদেশি নাম। এদেশি হলে পুরুষগুলো বলা যেত- বেম্মোদত্যি, জটাধারী, মামদো, পেঁচো, চোয়ালে পেঁচো, গলায় দড়ে, এক ঠেংগে, কন্দকাটা ইত্যাদি। মেয়েগুলোকে বলতে পারতাম; শাঁকচুন্নি, উলকামুখী, আঁষটেপেতি, কানি পিশাচি এই সব আর কি।
জগৎশেঠ : রাইস মিয়ার মুখে কথার খই ফুটছে।
রাইস : রাত-বেরাতে চলাফেরা করি ভূত পেত্নীর সঙ্গেও যোগ রাখতে হয় হুজুর। (চিঠিখানা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ এবং রায়দুর্লভের হাত ঘুরে আবার মিরাজফরের হাতে এল)
মিরজাফর : একে তাহলে বিদায় দেওয়া যাক?
রাজবল্লভ : চিঠির জবাব দেবেন না? (রাইস এই জবাব সিরাজের কাছে দিবে)
মিরজাফর : চিঠিপত্র যত কম দেওয়া যায় ততই ভালো কে জানে কোথায় সিরাজের গুপ্তচর ওৎ পেতে বসে আছে।
জগৎশেঠ : তাছাড়া আমাদের গুপ্তচরদেরই বা বিশ্বাস কী? তারা মূল চিঠি হয়ত আসল জায়গায় পৌঁছচ্ছে; কিন্তু একখানা করে তার নকল যথা সময়ে নবাবের লোকের হাতে পাচার করে দিচ্ছে।
রাইস : সন্দেহ করাটা অবশ্য বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু বেশি সন্দেহে বুদ্ধি ঘুলিয়ে যেতে পারে। একটা কথা মনে রাখবেন হুজুর, গুপ্তচররাও যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। তাদের বিপদের ঝুঁকিও কম নয়।
জগৎশেঠ : কিছু মনে করো না। তোমার সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করিনি।
মিরজাফর : তুমি তাহলে এখন এস। উমিচাঁদজিকে আমার এই সাংকেতিক মোহরটা দিও। তাহলেই তিনি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন। তাঁকে বলো দুনম্বর জায়গায় আগামী মাসের ৮ তারিখে সব কিছু লেখাপড়া হবে।
রাইস : হুজুর। (সাংকেতিক মোহরটা নিয়ে বেরিয়ে গেল)
মিরজাফর : রাইসুল জুহালা খুবই চালাক। সে উমিচাঁদের বিশ্বাসী লোক। ওর সামনে শেঠজির ওকথা বলা ঠিক হয়নি।
জগৎশেঠ : আমি শুধু বলেছি কি হতে পারে।
মিরজাফর : কত কিছুই হতে পারে শেঠজি। আমরাই কি দিনকে রাত করে তুলছিনে (পরিস্থিতি ঘোলাটে করা)? নবাবের মির মুন্সি আসল চিঠি গায়েব করে নকল চিঠি পাঠাচ্ছে কোম্পানির কাছে। তাতেই তো ওদের এত সহজে ক্ষেপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বুদ্ধিটা অবশ্য রাজবল্লভের। কিন্তু ভাবুন তো কতখানি দায়িত্ব এবং বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে নবাবের বিশ্বাসী মির মুন্সি।
জগৎশেঠ : তা তো বটেই। গুপ্তচরের সহায়তা ছাড়া আমরা এক পাও এগোতে পারতাম না।
মিরজাফর : প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন আমি ভাবছি ইংরেজদের ওপরে পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে কি না? (ইংরেজদের প্রতি অবিশ্বাস)
রাজবল্লভ : তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওরা বেনিয়ার (ব্যবসায়ী) জাত। পয়সা ছাড়া কিছু বোঝে না। ওরা জানে সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধার আশা নেই। কাজেই সিপাহসালারকে ওরা সাহায্য দেবে নগদ মূল্যের বিনিময়ে।
জগৎশেঠ : অবশ্য টাকা ছাড়া। কারণ সিরাজকে গদিচ্যুত করা ওদের প্রয়োজন হলেও সিপাহসালারকে সিংহাসনে বসবার জন্যে ওরা সব রকমের সাহায্য দেবে।
রাজবল্লভ : সেটাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে কি না তা তো বুঝতে পারছিনে। আমি যতদূর শুনেছি ওদের দাবি দুকোটি টাকার ওপরে যাবে। কিন্তু এত টাকা সিরাজউদ্দৌলার তহবিল থেকে কোনোক্রমেই পাওয়া যাবে না।
মিরজাফর : আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি রাজা রাজবল্লভ। ও কথা আর এখন ভাবলে চলবে না। সকলের স্বার্থের খাতিরে ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। (বিভোর কণ্ঠে) সফল করতে হবে আমার স্বপ্ন। বাংলার মসনদ-নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধত সিরাজের আমলে মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আমি এই কথাই শুধু ভেবেছি, একটা দিন, মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম।

[দৃশ্যান্তর]

 

দ্বিতীয় অঙ্ক-তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ৯ই জুন।
স্থান : মিরনের আবাস।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-নর্তকীগণ, বাদকগণ, মিরন, পরিচারিকা, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, ওয়াটস, ক্লাইভ, রক্ষী, মোহনলাল।]

(ফরাসে তাকিয়া ঠেস দিয়ে অর্ধশায়িত মিরন। পার্শ্বে উপবিষ্টা নর্তকীর হাতে ডান হাত সমর্পিত। অপর নর্তকী নৃত্যরতা। নৃত্যের মাঝে মাঝে সুরামত্ত মিরনের উল্লাসধ্বনি।)

 

মিরন : সাবাস। বহুত খুব। তোমরা আছ বলেই (নর্তকীদের ‍নৃত্য দেখে) বেঁচে থাকতে ভালো লাগে।

(নর্তকী নাচের ফাঁকে এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিল মিরনের দিকে। পরিচারিকা কামরায় এসে চিঠি দিল মিরনের হাতে। সেটা পড়ে বিরক্ত হলো মিরন। তবু পরিচারিকাকে সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করতেই সে বেরিয়ে গেল। পার্শ্বে উপবিষ্টা নর্তকী মিরনের ইঙ্গিতে কামরার অন্যদিকে চলে গেল। অল্প পরেই ছদ্মবেশধারী এক ব্যক্তিকে কামরায় পৌঁছিয়ে দিয়ে পরিচারিকা চলে গেল।)

 

মিরন : সেনাপতি রায়দুর্লভ এ সময়ে এখানে আসবেন তা ভাবিনি।
(নর্তকীদের চলে যেতে ইঙ্গিত করল)
রাযদুর্লভ : আমাকে আপনি নৃত্যগীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত বলেই ধরে নিয়েছেন।
মিরন : তা নয়, তবে আপনি যখন ছদ্মবেশে হঠাৎ এখানে উপস্থিত হয়েছেন তখনি বুঝেছি প্রয়োজন জরুরি। তাই সময় নষ্ট করতে চাইলুম না।
রায়দুর্লভ : দুদণ্ড সময় নষ্ট করে একটু আমোদ-প্রমোদই না হয় হতো। অহরহ অশান্তি আর অব্যবস্থার মধ্য থেকে জীবন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। কিন্তু (একজনকে দেখিয়ে) এ নর্তকীকে আপনি পেলেন কোথায়? একে যেন এর আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। সে যাক। হঠাৎ আপনার এখানে বৈঠকের আয়োজন? তাও খবর পেলাম কিছুক্ষণ আগে।
মিরন : আমার এখানে না করে উপায় কি? মোহনলালের গুপ্তচর জীবনে অসম্ভব করে তুলেছে। আমার বাসগৃহ অনেকটা নিরাপদ। কারণ মোহনলাল জানে যে আমি নাচ-গানে মশগুল থাকতেই ভালোবাসি।
রায়দুর্লভ : কে কে আসছেন এখানে?
মিরন : প্রয়োজনীয় সবাই। তাছাড়া বাইরে থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আসবেন কোম্পানির প্রতিনিধি কেউ একজন।
রায়দুর্লভ : কোম্পানির প্রতিনিধি কলকাতা থেকে এখানে আসছেন?
মিরন : তিনি আসবেন কাশিমবাজার থেকে।
রায়দুর্লভ : সে যা হোক। আলোচনায় আমি থাকতে পারব না। কারণ আমার পক্ষে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কখন কি কাজে নবাব তলব করে বসবেন তার ঠিক নেই। তলবের সঙ্গে সঙ্গে হাজির না পেলে তখুনি সন্দেহ জমে উঠবে। আপনার কাছে তাই আগেভাগে এলাম শুধু আমার সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা হলো জানবার জন্যে।
মিরন : আপনার ব্যবস্থা তো পাকা। সিরাজের পতন হলে আব্বা হবেন মসনদের মালিক। কাজেই সিপাহসালারের পদ আপনার জন্যে একেবারে নির্দিষ্ট।
রায়দুর্লভ : আমার দাবিও তাই। তবে আর একটা কথা। চারিদিককার অবস্থা দেখে যদি বুঝি যে, আপনাদের সাফল্যের কোনো আশা নেই, তাহলে কিন্তু আমার সহায়তা আপনারা আশা করবেন না? (প্রয়োজনে গা বাঁচিয়ে চলা)
মিরন : (ঈষৎ বিস্মিত) কি ব্যাপার? আপনাকে যেন কিছুটা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে।
রায়দুর্লভ : আতঙ্কিত নই। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। চারিদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র। এর ভেতরে কর্তব্য স্থির (সিদ্ধান্ত ঠিক রাখা) করাই দায় হয়ে উঠেছে।
(পরিচারিকার প্রবেশ)
পরিচারিকা : মেহমান।
রায়দুর্লভ : আমি সরে পড়ি।
মিরন : বসেই যান না। মেহমানরা এসে পড়েছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই বৈঠক শুরু হয়ে যাবে।
রায়দুর্লভ : না। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। আমি পালাই। কিন্তু আমার সঙ্গে যে ওয়াদা তার যেন খেলাপ না হয়। (প্রস্থান)
(পরিচারিকাকে ইঙ্গিত করে মিরন কিছুটা প্রস্তুত হয়ে বসল। মিরন সমাদর করে তাদের বসাল।)
মিরন : একটু আগে রায়দুর্লভ এসেছিলেন ব্যক্তিগত কারণে তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না বললেন। কিন্তু তাঁর দাবির কথাটা আমার কাছে তিনি খোলাখুলিই জানিয়ে গেছেন।
জগৎশেঠ : তাঁকে প্রধান সেনাপতির পদ দিতে হবে এই তো?
রায়বল্লভ : সবাই উচ্চাভিলাষী। সবাই সুযোগ খুঁজছে। তা না হলে রায়দুর্লভ মাসে মাসে আমার কাছ থেকে যে বেতন পাচ্ছে তাতেই তার স্বর্গ পাবার কথা।
মিরজাফর : ও সব কথা থাক রাজা। সবাই একজোটে কাজ করতে হবে। সকলের দাবিই মানতে হবে। রায়দুর্লভ ক্ষুদ্র শক্তিধর। তার সাহায্যেই আমরা জিতব এমন কথা নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নবাবের সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্ব আছে বৈ কি!
(পরিচারিকার প্রবেশ)
পরিচারিকা : জানানা সওয়ারি। (মহিলা সওয়ারি)
(সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। মিরজাফর হঠাৎ পকেট থেকে কয়েক টুকরো কাগজ বের করে তাতে মন দিলেন। মিরন লজ্জিত। হঠাৎ আত্মসংবরণ করে ধমকে উঠল)
মিরন : ভাগো হিঁয়াসে, কমবখৎ।
(পরিচারিকার দ্রুত প্রস্থান)
রাজবল্লভ : (ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে) চট করে দেখে এস। আত্মীয়রাই কেউ হবে হয়তো।
(সুযোগটুকু পেয়ে মিরন তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল। অভাবিত পরিবেশ এড়াবার জন্যে জগৎশেঠ নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন)
জগৎশেঠ : (হঠাৎ যেন পরিবেশের খেই ধরতে পেরেছেন) আরে বাপরে একেবারে কালকেউটে (উমিচাঁদ)। তার দাবিই তো সকলের আগে। তা না হলে দণ্ড না পেরোতেই সমস্ত খবর পৌঁছে যাবে নবাবের দরবারে। মনে হয় কলকাতায় বসেই সে চুক্তিতে স্বাক্ষর দেবে।
(দুজন মহিলাসহ উল্লসিত মিরন কামরায় ঢুকলো)
মিরন : এঁরাই জানানা সওয়ারি।
(রমণীর ছদ্মবেশ ত্যাগ করলেন ওয়াটস এবং ক্লাইভ। মিরন বেরিয়ে গেল)
ওয়াটস : Sorry to disappointe you gentlemen. (প্রত্যাশিত নারী না দেখায়)। Are you surprised? 
ইনি রবার্ট ক্লাইভ।
মিরজাফর : (সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে) কর্নেল ক্লাইভ?
ক্লাইভ : Are you surprised? অবাক হলেন?
মিরজাফর : অবাক হবারই কথা। এ সময়ে এভাবে এখানে আসা খুবই বিপজ্জনক।
ক্লাইভ : বিপদ? কার বিপদ জাফর আলি খান? আপনার না আমার?
মিরজাফর : দুজনেরই। তবে আপনার কিছুটা বেশি।
ক্লাইভ : আমার কোনো বিপদ নেই। তা ছাড়া বিপদ ঘটাবে কে?
জগৎশেঠ : নবাবের গুপ্তচরের হাতে তো পড়নি?
ক্লাইভ : নবাবকে আমার কোনো ভয় নেই। কারণ সে আমাদের কিছুই করতে পারবে না।
রাজবল্লভ : কেন পারবে না? গাল ফুলিয়ে বড় বড় কথা বললেই সব হয়ে গেল নাকি! তুমি এখানে একা এসেছ। তোমাকে ধরে বস্তাবন্দি হুলো-বেড়ালের মতো পানাপুকুরে দুচারটে চুবনি দিতে বাদশাহের ফরমান জোগাড় করতে হবে নাকি?
ক্লাইভ : I do not understand your hulu business, But I am sure Nabab can cause no harm to us. 
জগৎশেঠ : ভগবানের দিব্যি কর্নেল সাহেব, তোমরা বড় বেহায়া। এই সেদিন কলকাতায় যা মার খেয়েছো এখনো তার ব্যাথা ভোলার কথা নয় এরি ভেতরে-
ক্লাইভ : দেখো শেঠজি, এক আধবার অমন হয়েই থাকে। তা ছাড়া রবাট ক্লাইভের সঙ্গে এখনো যুদ্ধ হয়নি। যখন হবে তখন তোমরাই তার ফল দেখবে।
রাজবল্লভ : সেটা দেখবার আগেই গলাবাজি করছ কেন?
ক্লাইভ : এই জন্যে যে নবাবের কোনো ক্ষমতা নেই। যার প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক, যার খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির, ওমরাহ সবাই প্রতারক তার কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, আপনারা ইচ্ছা করলে আমাদের ক্ষতি করতে পারেন।
রাজবল্লভ : আমরা?
ক্লাইভ : হোয়াই নট? আপনারা সব পারেন। আজ নবাবকে ডোবাচ্ছেন, কাল আমাদের পথে বসাবেন না তা কি বিশ্বাস করা যায়? আমি বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারি, কিন্তু- (ষড়যন্ত্রকারীকে কেউ বিশ্বাস করে না)
মিরজাফর : এইসব কথার জন্যেই আমরা এখানে হাজির হয়েছি নাকি?
ক্লাইভ : সরি, মিস্টার জাফর আলি খান। হ্যাঁ, একটা জরুরি কথা আগেই সেরে নেওয়া যাক। উমিচাঁদ এ যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। আমাদের প্ল্যানের কথা সে নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। কলকাতা অ্যাটাকের সময়ে তার যা ক্ষতি হয়েছিল নবাব তা কমপেনসেট (ক্ষতিপূরণ) করতে চেয়েছেন। স্ক্রাউন্ডেলটা আবার এক নতুন অফার নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে।
মিরজাফর : আমি শুনেছি সে আরও ত্রিশ লক্ষ টাকা চায়।
ক্লাইভ : এবং তাকে অত টাকা দেবার মতো পজিশন আমাদের নয়। থাকলেও আমরা তা দেবো না। কেন দেবো? হোয়াই? থার্টি লাকস অফ রুপিস ইজ নো জোক।
রাজবল্লভ : কিন্তু উমিচাঁদ যে রকম ধড়িবাজ তাতে সে হয়ত অন্যরকম কিছু ষড়যন্ত্র করতে পারে। আমাদের যাবতীয় গুপ্ত খবর তার জানা।
ক্লাইভ : ডোনট ওরি, রাজা! উমিচাঁদ অনেক বুদ্ধি রাখে। বাট ক্লাইভ ইজ নো লেস। আমি উমিচাঁদকে ঠকাবার ব্যবস্থা করেছি।
মিরজাফর : কী রকম?
ক্লাইভ : দুটো দলিল হবে। আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো রেফারেন্স থাকবে না। নকল দলিলে লেখা থাকবে যে নবাব হেরে গেলে কোম্পানি উমিচাঁদকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দেবে।
রাজবল্লভ : কিন্তু সে যদি কোনো রকমে এ কথা জানতে পারে?
ক্লাইভ : আপনারা না জানালে জানবে না। আর জানলে কারও বুঝতে বাকি থাকবে না যে, আপনারাই তা জানিয়েছেন।
জগৎশেঠ : আমাদের সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
মিরজাফর : দলিল সই করবে কে?
ক্লাইভ : কমিটির সকলেই করেছেন। এখানে আপনি সই করবেন এবং রাজা রাজবল্লভ ও জগৎশেঠ থাকবেন উইটনেস। নকল দলিলটায় অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সই করতে রাজি হননি।
মিরজাফর : উমিচাঁদ মানবে কেন তাহলে?
ক্লাইভ : সে ব্যবস্থা হয়েছে। ওয়াটসনের সই জাল করে দিয়েছে লুসিংটন।
জগৎশেঠ : তাহলে আর দেরি কেন? আমাদের আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়।
ক্লাইভ : অফকোরস। দলিল দুটোই তৈরি আছে। শুধু সই হয়ে গেলেই কাজ মিটে যায়।
(দলিলের কপি মিরজাফরের দিকে এগিয়ে দিল)
মিরজাফর : একটু পড়ে দেখব না?
ক্লাইভ : ড্রাফট (খসড়া) তো আগেই পড়েছেন।
রাজবল্লভ : তাহলেও একবার পড়ে দেখা দরকার।
ক্লাইভ : ইফ ইউ ওয়ান্ট গো অ্যাহেড। পড়ে দেখুন উমিচাঁদের মতো আপনাদেরও ঠকানো হয়েছে কি না। (দলিলটা রাজবল্লভের দিকে এগিয়ে দিয়ে) নিন রাজা আপনিই পড়ুন।
রাজবল্লভ : (পড়তে পড়তে) যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতন হলে কোম্পানি পাবেন এক কোটি টাকা, কলকাতার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণ বাবদ পাবেন সত্তর লক্ষ টাকা, ক্লাইভ সাহেব পাবেন দশ লক্ষ টাকা, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পাবেন-
মিরজাফর : এগুলো দেখে আর লাভ কি?
রাজবল্লভ : এখন আর কিছু লাভ নেই, কিন্তু ভাবছি নবাবের তহবিল দুবার করে লুট করলেও তিন কোটি টাকা পাওয়া যাবে কিনা।
মিরজাফর : বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসুন দস্তখত দিয়ে কাজ শেষ করে ফেলি।
রাজবল্লভ : এই দলিল অনুসারে সিপাহসালার শুধু মসনদে বসবেন কিন্তু রাজ্য চালাবেন কোম্পানি। (বাঁদরের রুটি ভাগ)
ক্লাইভ : (বিরক্ত) ইউ আর থিংকিং লাইক এ ফুল। আমরা কেন রাজ্য চালাবে।
আমরা শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য করবার প্রিভিলেজটুকু সিকিউরড করে নিচ্ছি। তা আমাদের করতেই হবে।
জগৎশেঠ : আপনাদের স্বার্থ রক্ষা করুন। কিন্তু দেশের শাসন ক্ষমতায়, আপনাদের হাত দেবেন এ তো ভালো কথা নয়।
ক্লাইভ : (রীতিমতো ক্রুদ্ধ) দেন হোয়াট ইউ আর গোয়িং টু ডু অ্যাবাউট ইট? দলিল দুটো তাহলে ফিরিয়ে নিয়ে যাই। আপনাদের শর্তাদি জানিয়ে দেবেন। সেইভাবে আবার একটা খসড়া তৈরি করা যাবে।
মিরজাফর : না না, সেকি কথা? এমনিতেই বাজারে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কোনদিন সিরাজউদ্দৌলা সবাইকে গারদে পুরে দেবে তার ঠিক নেই। দিন, আমি দলিল সই করে দিই। শুভকাজে অযথা বিলম্ব করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
(রাজবল্লভের হাত থেকে দলিল নিয়ে সই করতে বসল। কিন্তু একটু ইতস্তত করে-)
মিরজাফর : বুকের ভেতর হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল। বাইরে কোথাও মড়াকান্না শুনতে পাচ্ছেন শেঠজি? (দেশের প্রতি ক্ষুদ্র মমতা)
মিরজাফর : আমি যেন শুনলাম।
ক্লাইভ : (উচ্চহাসি) বিদ্রোহী সেনাপতি, অথচ সো কাউয়ার্ড।
রাজবল্লভ : নানা প্রকারের দুশ্চিন্তায় আপনার শরীর মন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ও কিছু নয়।
মিরজাফর : তাই হয়তো।
(কলম নিয়ে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে আবার ইতস্তত করল)
মিরজাফর : কিন্তু রাজবল্লভ যেমন বললেন, সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?
ক্লাইভ : ওহ্ হোয়াট ননসেন্স! আমি জানতাম কাউয়ার্ডদের ওপর কোনো কাজের জন্যেই ভরসা করা যায় না। তাই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে দলিল সই করাতে নিজেই এসেছি। একা ওয়াটসকে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারিনি। এখন দেখছি আমার অনুমান অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। (মিরজাফরকে) আরে বাংলা আপনাদেরই থাকবে। রাজা হয়ে আমরা কী করব? আমরা চাই টাকা। আপনাদের কোনো ভয় নেই। ইউ আর স্যাক্রিফাইসিং দ্যা নবাব অ্যান্ড নট দ্যা কান্ট্রি, দেশের জন্যে দেশের নবাবকে আপনারা সরিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, সে অত্যাচারী। সে থাকলে দেশের কল্যাণ হবে না।
মিরজাফর : আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা নবাবকে সরিয়ে দিচ্ছি। সে আমাদের সম্মান দেয় না। (দলিলে সই করল। নেপথ্যে করুণ সংগীত চলতে থাকবে। জগৎশেঠ এবং রাজবল্লভও সই করল।)
ক্লাইভ : দ্যাটস অল রাইট। (দলিল ভাঁজ করতে করতে) আমরা এমন কিছু করলাম যা ইতিহাস হবে। ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট থিং-এ গ্রেড থিং। (ক্লাইভ এবং ওয়াটস আবার নারীর ছদ্মবেশ নিল, তারপর সবাই বেরিয়ে গেল। অন্যদিক দিয়ে মিরনের প্রবেশ।)
মিরন : হা হা হা। আর দেরি নেই।
(হাততালি দিতেই পরিচারিকার প্রবেশ) আগামীকাল যুদ্ধ। জানিস আগামী পরশু কী হবে? আগামী পরশু আমি শাহজাদা মিরন। শাহজাদা হা হা হা। তারপর একদিন বাংলার নবাব। (দ্রুত জনৈক রক্ষীর প্রবেশ)
রক্ষী : হুজুর, সেনাপতি মোহনলাল।
মিরন : (আতঙ্কিত) মোহনলাল।
মোহনলাল : শুনলাম আজ এখানে ভারী জলসা হবে। বহু গণ্যমান্য লোক উপস্থিত আছে। তাই খোঁজ নিতে এলাম।
মিরন : সেনাপতি মোহনলাল, আপনার দুঃসাহসের সীমা নেই। আমার প্রাসাদে কার অনুমতিতে আপনি প্রবেশ করেছেন?
মোহনলাল : প্রয়োজন মতো যে কোনো জায়গায় যাবার অনুমতি আমার আছে। সত্য বলুন এখানে গুপ্ত ষড়যন্ত্র হচ্ছিল কি না?
মিরন : মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন সেনাপতি। জানেন এর ফল কী ভয়ানক হতে পারে? নবাবের সঙ্গে আব্বার সমস্ত গোলমাল সেদিন প্রকাশ্যে মিটমাট হয়ে গেল? নবাব তাঁকে বিশ্বাস করে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। আর আপনি এসেছেন আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপবাদ নিয়ে। আমি এখুনি আব্বাকে নিয়ে নবাবের প্রাসাদে যাব। (উঠে দাঁড়াল) এই অপমানের বিচার হওয়া দরকার।
মোহনলাল : প্রতারণার চেষ্টা করবেন না। (তরবারি কোষমুক্ত করল) আমার গুপ্তচর ভুল সংবাদ দেয় না। সত্য বলুন, কী হচ্ছিল এখানে? কে কে ছিল মন্ত্রণাসভায়?
মিরন : মন্ত্রণাসভা হচ্ছিল কিনা, এবং হলে কোথায় হচ্ছিল আমি তার কিছুই জানিনে। ওসব বাজে জিনিসে সময় কাটানো আমার স্বভাব নয়। (পরিচারিকাকে ডেকে মিরন কিছু ইঙ্গিত করল) যখন না-ছোড় হয়েছেন তখন বেয়াদবি না করে আর উপায় কি?
(নর্তকীর প্রবেশ)
এখানে কী হচ্ছিল আশা করি সেনাপতি বুঝতে পেরেছেন?
(একটি মালা নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে নর্তকী মোহনলালের দিকে এগিয়ে গেল। মোহনলাল তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে মালাটি গ্রহণ করে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তরবারির দ্বিতীয় আঘাতে শূন্যেই তা দ্বিখণ্ডিত করে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল)
মিরন : মূর্তিমান বেরসিক হা হা হা…
[দৃশ্যান্তর]

তৃতীয় অঙ্ক- প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ১০ই জুন থেকে ২১এ জুনের মধ্যে যেকোন একদিন।
স্থান : লুৎফুন্নিসার কক্ষ।

[ শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ঘসেটি, লুৎফা, আমিনা, সিরাজ, পরিচারিকা]

(নবাব-জননী আমিনা বেগম ও লুৎফুন্নিসা উপবিষ্টা। ঘসেটি বেগমের প্রবেশ)

 

ঘসেটি : বড় সুখে আছ রাজমাতা আমিনা বেগম।
লুৎফা : আসুন খালাআম্মা।
ঘসেটি : বেঁচে থাক। সুখী এবং সৌভাগ্যবতী হও এমন দোয়া করলে সেটা আমার পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সে দোয়া করতে পারলুম না।
আমিনা : ছিঃ বড় আপা। এস, কাছে এসে বস।
ঘসেটি : বসতে আসিনি। দেখতে এলাম কত সুখে আছ তুমি। পুত্র নবাব, পুত্রবধূ নবাব বেগম, পৌত্রী (নাতিন) শাহজাদি।
আমিনা : সিরাজ তোমারও তো পুত্র। তুমিও তো কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছ।
ঘসেটি : অদৃষ্টের পরিহাস, তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তাহলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ-চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।
লুৎফা : আপনাকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসি। মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করি।
ঘসেটি : থাক! যে সত্যিকার মা তার মহলেই তো চাঁদের হাট (গুণীজনের সমাগম) বসিয়েছ। আমাকে আবার পরিহাস করা কেন? দরিদ্র নারী আমি। নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী (ব্যঙ্গ) নবাব সে অধিকারটুকুও আমাকে দিলেন না।
আমিনা : কী হয়েছে তোমার? পুত্রবধূর সামনে এরকম রূঢ় ব্যবহার করছ কেন?
ঘসেটি : কে পুত্র আর কে পুত্রবধূ? সিরাজ আমার কেউ নয়। সিরাজ বাংলার নবাব-আমি তার প্রজা। ক্ষমতার অহংকারে উন্মত্ত (পাগল) না হলে আমার সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সে সাহস করত না। মতিঝিল থেকে আমাকে সে তাড়িয়ে দিতে পারত না।
লুৎফা : শুনেছি আপনার কাছ থেকে কিছু টাকা তিনি ধার নিয়েছেন। কলকাতা অভিযানের সময়ে টাকার প্রয়োজন হয়েছিল তাই। কিন্তু গোলমাল মিটে গেলে সে টাকা তো আবার আপনি ফেরত পাবেন।
ঘসেটি : নবাব টাকা ফেরত দেবেন!
লুৎফা : কেন দেবেন না? তা ছাড়া সে টাকা তো তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করেননি। দেশের জন্যে-
ঘসেটি : থাম। লম্বা লম্বা বক্তৃতা করো না। সিরাজের বক্তৃতা তবু সহ্য হয়। তাকে বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছি। কিন্তু তোমার মুখে বড় বড় বুলি শুনলে গায়ে যেন জ্বালা ধরে যায়। (উচিত কথা শুনতে তিক্ত লাগে)
আমিনা : সিরাজ তোমার কোনো ক্ষতি করেনি বড় আপা।
ঘসেটি : তার নবাব হওয়াটাই তো আমার মস্ত ক্ষতি।
আমিনা : নবাবি সে কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয়নি। ভূতপূর্ব (পূর্বের) নবাবই তাকে সিংহাসন দিয়ে গেছেন।
ঘসেটি : বৃদ্ধ নবাবকে (আলিবর্দি) ছলনায় ভুলিয়ে তোমরা সিংহাসন দখল করেছ।
আমিনা : আমরা।
ঘসেটি : ভাবছো যে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেই আমি তোমাকে বিশ্বাস করব-কেমন? তোমাকে আমি চিনি। তুমি কম সাপিনী নও।
আমিনা : তুমি অনর্থক বিষ উদ্গার (ক্ষোভ প্রকাশ) করছ বড় আপা। তোমার এই ব্যবহারের অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে।
ঘসেটি : বুঝবে। সে দিন আসছে। আর বেশিদিন এমন সুখে তোমার ছেলেকে নবাবি করতে হবে না। (সিরাজের প্রবেশ)
সিরাজ : সিরাজউদ্দৌলা একটি দিনের জন্যেও সুখে নবাবি করেনি খালাম্মা।
ঘসেটি : এসেছ শয়তান। ধাওয়া করেছ আমার পিছু?
সিরাজ : আপনার সঙ্গে প্রয়োজন আছে।
ঘসেটি : কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
সিরাজ : আমার প্রয়োজন আপনার সম্মতির অপেক্ষা রাখছে না খালাম্মা।
ঘসেটি : তাই বুঝি সেনাপতি পাঠিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়েছ যে, তোমার আরও কিছু টাকার দরকার।
সিরাজ : খবর আপনার অজানা থাকার কথা নয়।
ঘসেটি : অর্থাৎ।
সিরাজ : অর্থাৎ আমি জানি যে, বাংলার ভাগ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার সমস্ত খবরই আপনি রাখেন। আরও স্পষ্ট করে শুনতে চান? আমি জানি যে, সিরাজের বিরুদ্ধে আপনার আক্রোশের কারণ আপনার সম্পত্তিতে সে হস্তক্ষেপ করেছে বলে নয়, রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের আশায় আপনি উন্মাদ। আমি অনুরোধ করছি আপনার সঙ্গে আমাকে যেন কোনো প্রকারের দুর্ব্যবহার করতে বাধ্য করা না হয়।
ঘসেটি : তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
সিরাজ : আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
ঘসেটি : তোমার এই চোখ রাঙাবার স্পর্ধা বেশিদিন থাকবে না নবাব (নবাবি বেশিদিন টিকবে না)। আমিও তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
সিরাজ : আপনার ভবিষ্যৎ ভেবে আপনি উৎকণ্ঠিত হবেন না খালাম্মা। আপনার নিজের সম্বন্ধেই আমি আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। নবাবের মাতৃস্থানীয়া হয়ে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ রাখা বাঞ্চনীয় নয়। অন্তত আমি আপনাকে সে দুর্নামের হাত থেকে রক্ষা করতে চাই।
ঘসেটি : তোমার মতলব বুঝতে পারছি না।
সিরাজ : রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময়ে কোনো ক্ষমতাভিলাষী, স্বার্থপরায়ণ নারীর পক্ষে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর। আমি তাই আপনার গতিবিধির ওপরে লক্ষ্য রাখবার ব্যবস্থা করেছি। আমার প্রাসাদে আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না। তবে লক্ষ্য রাখা হবে যাতে দেশের বর্তমান অশান্তি দূর হবার আগে বাইরের কারো সঙ্গে আপনি কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারেন। (নজরবন্দি করা)
ঘসেটি : (ক্ষিপ্ত) ওর অর্থ আমি বুঝি মহামান্য নবাব। (দ্রুত আমিনার দিকে এগিয়ে এসে) শুনলে তো রাজামাতা, আমাকে বন্দিনী করে রাখা হলো। এইবার বল তো আমি তার মা, সে আমার পুত্র-তাই না? হা হা হা।
(অসহায় ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন)
আমিনা : এসব লক্ষণ ভালো নয়। (উঠে দরজার দিকে এগোতে এগোতে) বড় আপা শুনে যাও, বড় আপা- (বেরিয়ে গেলেন)
লুৎফা : খালাম্মা বড় বেশি অপমান বোধ করেছেন। তাঁর সঙ্গে অমন ব্যবহার করাটা হয়ত উচিত হয়নি।
সিরাজ : আামর ব্যবহারে সবাই অপমান বোধ করছেন লুৎফা। শুধু অপমান নাই আমার।
লুৎফা : ও কথা কেন বলছেন জাঁহাপনা।
সিরাজ : তুমি অন্ধ হলে আর কার কাছে আমি আশ্রয় পাব বল তো লুৎফা (আক্ষেপ)। দেখতে পাচ্ছ না, শুধু আপনার নয় আমাকে ধ্বংস করবার আয়োজনে সবাই কী রকম মেতে উঠেছে।
লুৎফা : কিন্তু খালাম্মা-
সিরাজ : আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খালাম্মা খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি।
লুৎফা : অতটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে ওঁর মন আপনার ওপরে যথেষ্ট বিষিয়ে উঠেছে তা ঠিক। কিন্তু-
সিরাজ : থামলে কেন? বল।
লুৎফা : বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।
সিরাজ : বল।
লুৎফা : বিধবা মেয়েমানুষ, ওঁর সম্পত্তিতে বারবার এমন হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভরসা নষ্ট হবারই কথা।
সিরাজ : লুৎফা, তুমিও আমার বিচার করতে বসলে। কর, আমি আপত্তি করব না। দাদু মরবার পর থেকে এই ক-মাসের ভেতরে আমি এত বদলে গেছি (প্রতিকূলতার কারণে পরিবর্তন) যে আমার নিকটতম তুমিও তা বুঝতে পারবে না।
লুৎফা : জাঁহাপনা।
সিরাজ : মনে পড়ে লুৎফা, দাদুর মৃত্যুশয্যায় আমি কসম খেয়েছিলাম শরাব স্পর্শ করব না। আমি তা করিনি। তুমিও জান লুৎফা আমি তা করিনি।
লুৎফা : আমি ও-সব কোনো কথাই তুলছিনে জাঁহাপনা।
সিরাজ : আমি জানি। সেই জন্যেই বলছি সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার কর।
লুৎফা : আমি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবার জন্যে কোনো কথা বলিনি, জাঁহাপনা। খালাম্মা রাগে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন তাই-
সিরাজ : তাই তোমার মনে হলো ওঁর টাকা-পয়সায় হাত দিয়েছি বলেই উনি আমার ওপর অতখানি বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু তুমি জান না, কতখানি উৎসাহ নিয়ে উনি অজস্র অর্থ ব্যয় করেছেন শওকতজঙ্গের কামিয়াবির জন্যে। শুধু শওকতজঙ্গ কেন, আমার শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যেও ওঁর দান কম নয়।
লুৎফা : আমি মাফ চাইছি জাঁহাপনা, আমার অন্যায় হয়েছে।
সিরাজ : লুৎফা, এত দেয়াল (বাধা) কেন বল তো?
লুৎফা : দেয়াল? কোথায় দেয়াল জাঁহাপনা?
সিরাজ : আমার চারপাশে লুৎফা। আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কেবল যেন দেয়ালের ভিড়। উজির, অমাত্য, সেনাপতিদের এবং আমার মাঝখানে দেয়াল, দেশের নিশ্চিত শাসন ব্যবস্থা এবং আমার মাঝখানে দেয়াল, খালাম্মা আর আমার মাঝখানে, আমার চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে আমার অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল।
লুৎফা : জাঁহাপনা!
সিরাজ : আমি এর কোনোটি ডিঙিয়ে যাচ্ছি, কোনোটি ভেঙে ফেলছি, কিন্তু তবু তো দেয়ালের শেষ হচ্ছে না, লুৎফা।
লুৎফা : আপনি ক্লান্ত হয়েছেন জাঁহাপনা।
সিরাজ : মসনদে বসবার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন দুপায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ক্লান্তি আসাটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে লুৎফা।
লুৎফা : সমস্ত দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাছে দু-একদিন বিশ্রাম করুন।
সিরাজ : কবে যে দুদণ্ড বিশ্রাম পাব তার ঠিক নেই। আবার তো যুদ্ধে যেতে হচ্ছে।
লুৎফা : সে কী!
সিরাজ : আমার বিরুদ্ধে কোম্পানির ইংরেজদের আয়োজন সম্পূর্ণ। আমি এগিয়ে গিয়ে বাধা না দিলে তারা সরাসরি রাজধানী আক্রমণ করবে।
লুৎফা : ইংরেজদের সঙ্গে তো আপনার মিটমাট হয়ে গেল।
সিরাজ : হ্যাঁ, আলিনগরের সন্ধি। কিন্তু সে সন্ধির মর্যাদা একমাস না যেতেই তারা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে।
লুৎফা : কজন বিদেশি বেনিয়ার এত স্পর্ধা কী করে সম্ভব?
সিরাজ : ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব, লুৎফা। শুধু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারিনি, ধর্মের নামে ওয়াদা করে মানুষ তা খেলাফ করে কী করে? নিজের স্বার্থ কি এতই বড়?
লুৎফা : কোনো প্রতিকার করতে পারেননি জাঁহাপনা?
সিরাজ : পারিনি। চেয়েছি, চেষ্টাও করেছি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভরসা পাইনি। রাজবল্লভ, জগৎশেঠকে কয়েদ করলে, মিরজাফরকে ফাঁসি দিলে হয়ত প্রতিকার হতো, কিন্তু সেনাবাহিনী তা বরদাস্ত করত কিনা কে জানে?
লুৎফা : থাক ওসব কথা। আজ আপনি বিশ্রাম করুন।
সিরাজ : আর কাল সকালেই দেশের পথে-ঘাটে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে, যুদ্ধের আয়োজন ফেলে রেখে হারেমের কয়েকশ বেগমের সঙ্গে নবাবের উদ্দাম রাসলীলার কাহিনি।
লুৎফা : মহলে বেগমের তো সত্যিই কোনো অভাব নেই।
সিরাজ : ঠাট্টা করছ লুৎফা? তুমি তো জানোই, মরহুম শওকতজঙ্গের বিশাল হারেম বাধ্য হয়েই আমাকে প্রতিপালন করতে হচ্ছে।
লুৎফা : সে যাক। আজ আপনার বিশ্রাম। শুধু আমার কাছে থাকবেন আপনি। শুধু আমরা দুজন।
সিরাজ : অনেক সময়ে সত্যিই তা ভেবেছি, লুৎফা। তোমার খুব কাছাকাছি বহুদিন আসতে পারিনি। আমাদের মাঝখানে একটি রাজত্বের দেয়াল। মাঝে মাঝে ভেবেছি, এই বাধা যদি দূর হয়ে যেত। নিশ্চিত সাধারণ গৃহস্থের ছোট্ট সাজানো সংসার আমরা পেতাম।
(পরিচারিকার প্রবেশ)
পরিচারিকা : বেগম সাহেবা।
লুৎফা : (তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে) জাঁহাপনা এখন বিশ্রাম করছেন। যাও।
পরিচারিকা : সেনাপতি মোহনলালের কাছ থেকে খবর এসেছে। (পেছোতে লাগল)
লুৎফা : না।
(পরিচারিকার প্রস্থান)
সিরাজ : (এগিয়ে আসতে আসতে) মোহনলালের জরুরি খবরটা শুনতেই দাও, লুৎফা। (লুৎফা সিরাজের গতিরোধ করল)
লুৎফা : (আবেগজড়িত কণ্ঠে) না।
(সিরাজ থামল ক্ষণকালের জন্যে। লুৎফার দিকে মেলে রাখা নীরব দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্নেহসিক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু পর মুহূর্তেই লুৎফার প্রসারিত বাহু ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। লুৎফা চেয়ে রইল সিরাজের চলে যাওয়া পথের দিকে-দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর দুগাল বেয়ে)

[দৃশ্যান্তর]

তৃতীয় অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ২২এ জুন।
স্থান : পলাশিতে সিরাজের শিবির

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-সিরাজ, মোহনলাল, মিরমর্দান, প্রহরী, বন্দি কমর]
(গভীর রাত্রি। শিবিরের ভেতরে নবাব চিন্তাগ্রস্তভাবে পায়চারি করছেন।
দূর থেকে শৃগালের প্রহর ঘোষণার শব্দ ভেসে আসবে।)
সিরাজ : দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হলো। শুধু ঘুম নেই শেয়াল আর সিরাজউদ্দৌলার চোখে। (আবার নীরব পায়চারি) ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই-
(মোহনলালের প্রবেশ। কুর্নিশ করে দাঁড়াতেই)
সিরাজ : সত্যি অবাক হয়ে যাই মোহনলাল, ইংরেজ সভ্য জাতি বলেই শুনেছি। তারা শৃঙ্খলা জানে, শাসন মেনে চলে। কিন্তু এখানে ইংরেজরা যা করছে সে তো স্পষ্ট রাজদ্রোহ। একটি দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরছে। আশ্চর্য!
মোহনলাল : জাঁহাপনা!
সিরাজ : হ্যাঁ, বলো মোহনলাল, কী খবর।
মোহনলাল : ইংরেজের পক্ষে মোট সৈন্য তিন হাজারের বেশি হবে না। অবশ্য তারা অস্ত্র চালনায় সুশিক্ষিত। নবাবের পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। ছোট বড় মিলিয়ে ওদের কামান হবে গোটা দশেক। আমাদের কামান পঞ্চাশটার বেশি।
সিরাজ : এখন প্রশ্ন হলো আমাদের সব সিপাই লড়বে কিনা এবং সব কামান থেকে গোলা ছুটবে কি না।
মোহনলাল : জাঁহাপনা!
সিরাজ : এমন আশঙ্কা কেন করছি তাই জানতে চাইছ তো? মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে, ওরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বে।
মোহনলাল : সিপাহসালারের আরও একখানা গোপন চিঠি ধরা পড়েছে।
(নবাবের হাতে পত্র দান। নবাব সেটা পড়ে হাতের মুঠোয় মুচড়ে ফেললেন)
সিরাজ : বেইমান।
মোহনলাল : ক্লাইভের আরও তিনখানা চিঠি ধরা পড়েছে। সে সিপাহসালারের জবাবের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে মনে হয়।
সিরাজ : সাংঘাতিক লোক এই ক্লাইভ। মতলব হাসিল করার জন্যে যে কোনো অবস্থার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে সব কিছুই যেন বড় রকমের জুয়া খেলা।
(মিরমর্দানের প্রবেশ। যথারীতি কুর্নিশ করে একদিকে দাঁড়াল)
সিরাজ : বল মিরমর্দান।
মিরমর্দান : ইংরেজ সৈন্য লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। ক্লাইভ এবং তার সেনাপতিরা উঠেছে গঙ্গা তীরের ছোট বাড়িটায়। এখান থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে।
সিরাজ : তোমাদের ফৌজ সাজাবার আয়োজন শেষ হয়েছে তো?
মিরমর্দান : (একটা প্রকাণ্ড নকশা নবাবের সামনে মেলে ধরে) আমরা সব গুছিয়ে ফেলেছি। (নকশা দেখাতে দেখাতে) আপনার ছাউনির সামনে গড়বন্দি হয়েছে (সৈন্য সাজানো)। ছাউনির সামনে মোহনলাল, সাঁফ্রে আর আমি। আরও ডানদিকে গঙ্গার ধারে এই টিপিটার উপরে একদল পদাতিক আমার জামাই বদ্রিআলি খাঁর অধীনে যুদ্ধ করবে। তাদের ডান পাশের গঙ্গার দিকে একটু এগিয়ে নৌবে সিং হাজারির বাহিনী। বাঁ দিক দিয়ে লক্ষবাগ পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকারে সেনাবাহিনী সাজিয়েছেন সিপাহসালার, রায়দুর্লভরাম আর ইয়ার লুৎফ খাঁ।
সিরাজ : (নকশার কাছ থেকে সরে এসে একটু পায়চারি করলেন) কত বড় শক্তি, তবু কত তুচ্ছ (একতা না থাকায়)
মিরমর্দান
মিরমর্দান : জাঁহাপনা!
সিরাজ : আমি কি দেখেছি জান? কেমন যেন অঙ্কের হিসেবে ওদের সুবিধের পাল্লা ভারী হয়ে উঠেছে।
মিরমর্দান : ইংরেজদের ঘায়েল করতে সোনাপতি মোহনলাল, সাঁফ্রে আর আমার বাহিনীই যথেষ্ট।
সিরাজ : ঠিক তা নয়, মিরমর্দান। আমি জানি তোমাদের বাহিনীতে পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার আর আট হাজার পদাতিক সেনা রয়েছে। তারা জান দিয়ে পড়বে। কিন্তু সমস্ত অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে, এস তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করি।
মোহনলাল : জাঁহাপনা!
সিরাজ : মিরজাফরের বাহিনী সাজিয়েছে দূরে লক্ষবাগের অর্ধেকটা ঘিরে। যুদ্ধে তোমরা হারতে থাকলে ওরা দুকদম এগিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে মিলবে বিনা বাধায়। যেন নিশ্চেন্তে আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছে।
মিরমর্দান : কিন্তু আমরা হারব কেন?
সিরাজ : না হারলে ওরা যে তোমাদের ওপরেই গুলি চালাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যাক, শিবিরের কাছে ওদের ফৌজ রাখবার কথা আমরাও ভাবি না। কারণ, সামনে তোমরা যুদ্ধ করতে থাকলে, ওরা পেছনে নবাবের শিবির দখল করতে এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
মোহনলাল : ওদের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে না আনলেই বোধ হয়-
সিরাজ : এনেছি চোখে চোখে রাখার জন্যে। পেছনে রেখে এলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দখল করত।
মিরমর্দান : এত চিন্তিত হবার কারণ নেই, জাঁহাপনা। আমাদের প্রাণ থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না।
সিরাজ : আমি জানি, তাই আরও বেশি ভরসা হারিয়ে ফেলছি। তোমাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না, এই চিন্তাটাই আজ বেশি করে পীড়া দিচ্ছে।
মোহানলাল : আমরা জয়ী হব, জাঁহাপনা!
সিরাজ : পরাজিত হবে, আমিই কি তা ভাবছি। আমি শুধু অশুভ সম্ভাবনাগুলো শেষবারের মতো খুঁটিয়ে বিচার করে দেখছি। আগামীকাল তোমরা যুদ্ধ করবে কিন্তু হুকুম দেবে মিরজাফর। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এড়াবার জন্যে যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব সিপাহসালারকে দিতেই হবে। ফল কী হবে কে জানে। আমি কর্তব্য স্থির করতে পারছিনে, কিন্তু কেন যে পারছিনে আশা করি তোমরা বুঝছ।
মিরমর্দান : জাঁহাপনা!
সিরাজ : আজ আমার ভরসা আমার সেনাবাহিনীর শক্তিতে নয়, মোহনলাল। আমার একমাত্র ভরসা আগামীকাল যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফদের মনে যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সেই সম্ভাবনাটুকু।
(কিছুটা কোলাহল শোনা গেল বাইরে। দুজন প্রহরী এক ব্যক্তিকে নিয়ে হাজির হলো)
প্রহরী : হুজুর, একই লোকটা নবাবের ছাউনির দিকে এগোবার চেষ্টা করছিল।
(সঙ্গে সঙ্গে মোহনলাল বন্দির কাছে এগিয়ে এসে নবাবকে একটু যেন আড়াল করে দাঁড়াল। নবাব দুপা এগিয়ে এলেন। অপর দিক দিয়ে মিরমর্দান বন্দির আর এক পাশে দাঁড়াল)
বন্দি : (সকাতর ক্রন্দনে) আমি পলাশি গ্রামের লোক, হুজুর। রৌশনি (আলো) দেখতে এখানে এসেছি।
মোহনলাল ; (প্রহরীকে) তল্লাশি কর।
(প্রহরী তল্লাশি করে কিছুই পেল না)
কিন্তু একে সাধারণ গ্রামবাসী বলে মনে হচ্ছে না, জাঁহাপনা!
মিরমর্দান : (প্রহরীকে) বাইরে নিয়ে যাও। কথা আদায় কর। (হঠাৎ) দেখি দেখি। এ তো কমর বেগ জমাদার। মিরজাফরের গুপ্তচর উমর বেগের ভাই। এও গুপ্তচর।
কমর : (সহসা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে) জাঁহাপনার কাছে বিচারের জন্যে এসেছি। আমাকে আসতে দেয় না, তাই চুরি করে হুজুরের কদম মোবারকে ফরিয়াদ জানাতে আসছিলাম।
সিরাজ : (কাছে এগিয়ে এসে) কি হয়েছে তোমার?
কমর : আমার ভাইকে সেনাপতি মোহনলালের হুকুমে খুন করা হয়েছে, হুজুর।
সিরাজ : মোহনলাল!
মোহনলাল : গুপ্তচর উমর বেগ জমাদার হাতেনাতে ধরা পড়েছিল জাঁহাপনা। ক্লাইভের চিঠি ছিল তার কাছে। প্রহরীদের হতে ধরা পড়বার পর সে পালাবার চেষ্টা করে। ফলে প্রহরীদের তলোয়ারের ঘায়ে সে মারা পড়েছে।
(সিরাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মোহনলালের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন)
মোহনলাল : (যেন দোষ ঢাকবার চেষ্টায়) সে চিঠি জাঁহাপনার কাছে আগেই দাখিল করা হয়েছে।
সিরাজ : (মোহনলালের দিক থেকে দৃষ্টি একটু পায়চারি করে চিন্তিত ভাবে) কথায় কথায় মৃত্যুবিধান করাটাই শাসকের সবচাইতে যোগ্যতার পরিচয় কিনা সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই, মোহনলাল।
কমর : জাঁহাপনা মেহেরবান।
সিরাজ : (প্রহরীদের) একে নিয়ে যাও। কাল যুদ্ধ শেষ হবার পর একে মুক্তি দেবে।
কমর : (রুদ্ধস্বরে) এই কি জাঁহাপনার বিচার?
সিরাজ : আমি জানি, এখানে এ অবস্থায় শুধু ফরিয়াদ জানাতেই আসবে এতটা নির্বোধ তুমি নও। (কঠোর স্বরে প্রহরীদের) নিয়ে যাও।
(বন্দিকে নিয়ে প্রহরীদের প্রস্থান। শৃগালের প্রহর ঘোষণা)
সিরাজ : তোমরাও এখন যেতে পার। আজ রাতে তোমাদের কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল।
(মোহনলাল ও মিরমর্দান বেরিয়ে গেল। সিরাজ পায়চারি করতে লাগলেন। সোরাহি থেকে পানি ঢেলে খেলেন। কোথায় একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। সিরাজ উৎকর্ণ হয়ে তা শুনলেন। কি যেন ভেবে রেহেলে রাখা কোরান শরিফের কাছে গিয়ে জায়নামাজে বসলেন। কোরান শরিফ তুলে ওষ্ঠে ঠেকিয়ে রেহেলের ওপর রেখে পড়তে লাগলেন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এল। সিরাজ কোরান শরিফ মুড়ে রাখলেন। ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম’-এর পর মোনাজাত করলেন। আস্তে আস্তে পাখির ডাক জেগে উঠতে লাগল। হঠাৎ সুতীব্র তূর্যনাদ স্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল।)

(দৃশ্যান্তর)

তৃতীয় অঙ্ক-তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ২৩এ জুন।
স্থান : পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-সিরাজ, প্রহরী, সৈনিক, দ্বিতীয় সৈনিক, তৃতীয় সৈনিক, সাঁফ্রে, মোহনলাল, রাইসুল জুহালা, ক্লাইভ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, ইংরেজ সৈনিকগণ]
(গোলাগুলির শব্দ, যুদ্ধ, কোলাহল। সিরাজ নিজের তাঁবুতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। সৈনিকের প্রবেশ)
সিরাজ : (উৎকণ্ঠিত) কী খবর সৈনিক?
সৈনিক : যুদ্ধের প্রথম মহড়ায় কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে গিয়ে লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। সিপাহসালার, সেনাপতি রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্য যুদ্ধে যোগ দেয়নি।
সিরাজ : মিরমর্দান, মোহনলাল?
সৈনিক : ওরা শত্রুদের পিছু হটিয়ে লক্ষবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সিরাজ : আচ্ছা, যাও।
(সৈনিকের প্রস্থান। কোলাহল প্রবল হয়ে উঠল। দ্বিতীয় সৈনিকের প্রবেশ।)
দ্বিতীয় সৈনিক : দুঃসংবাদ, জাঁহাপনা। সেনাপতি নৌবে সিং হাজারি (প্রথম মৃত্যু) ঘায়েল হয়েছেন।
সিরাজ : (কঠোর স্বরে) যাও।
(প্রস্থান : একটু পরে তৃতীয় সৈনিকের প্রবেশ।)
তৃতীয় সৈনিক : কিছুক্ষণ আগে যে বৃষ্টি হলো তাতে ভিজে আমাদের বারুদ অকেজো হয়েছে, জাঁহাপনা।
সিরাজ : (ভীত স্বরে) বারুদ ভিজে গেছে?
তৃতীয় সৈনিক : সেনাপতি মিরমর্দান তাই কামানের অপেক্ষা না করে হাতাহাতি লড়বার জন্যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন।
সিরাজ : আর কোম্পানির ফৌজ যখন কামান ছুঁড়বে?
তৃতীয় সৈনিক : শত্রুদের সময় দিতে চান না বলেই সেনাপতি মিরমর্দান শুধু তলোয়ার নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।
(দ্রুত প্রথম সৈনিকের প্রবেশ)
প্রথম সৈনিক : সেনাপতি বদ্রিআলি খাঁ নিহত, জাঁহাপনা। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ।
সিরাজ : না। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ হয় না বদ্রিআলি ঘায়েল হলে। মিরমর্দান, মোহনলাল আছে। কোনো ভয় নেই, যাও।
(প্রথম ও তৃতীয় সৈনিকের প্রস্থান। হঠাৎ যুদ্ধ কোলাহল কেমন যেন আর্ত চিৎকারে (অশুভ শঙ্কা) পরিণত হলো)
সিরাজ : কি হলো? (টুলের ওপর দাঁড়িয়ে দুরবিন দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখবার চেষ্টা)
(ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রের প্রবেশ)
সিরাজ : (দ্রুত এগিয়ে এসো) কি খবর সাঁফ্রে (ফরাসি সৈনিক)? আমাদের পরাজয় হয়েছে?
সাঁফ্রে : (কুর্নিশ করে) এখনো হয়নি, ইওর একসেলেন্সি। কিন্তু যুদ্ধের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠেছে।
সিরাজ : শক্তিমান বীর সেনাপতি, তোমরা থাকতে যুদ্ধে হার হবে কেন? যাও, যুদ্ধে যাও, সাঁফ্রে। জয়লাভ কর।
সাঁফ্রে : আমি তো ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছি জাঁহাপনা। দরকার হলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমি প্রাণ দেব। কিন্তু আপনার বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডিং লাইক পিলার্স।
সিরাজ : মিরজাফর, রায়দুর্লভকে বাদ দিয়েও তোমরা লড়াইয়ে জিতবে। আমি জানি তোমরা জিতবেই।
সাঁফ্রে : আমাদের গোলার আঘাতে কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময়ে এল বৃষ্টি। হঠাৎ জাফর আলি খান আদেশ দিলেন এখন যুদ্ধ হবে না। মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলেন না। কিন্তু সিপাহসালারের আদেশ পেয়ে টায়ার্ড সোলজারস যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরতে লাগল। সুযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিলপ্যাট্রিক আমাদের আক্রমণ করছে। মিরমর্দান তাদের বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। তাঁকে এগোতে হচ্ছে কামান ছাড়া। অ্যান্ড দ্যাট ইজ ডেনজারস।
(দ্বিতীয় সৈনিকের প্রবেশ। কিছু না বলে চুপ করে)
সিরাজ : কী সংবাদ!
(কিছু বলবার চেষ্টা করেও পারল না)
সিরাজ : (অধৈর্য হয়ে কাছে এসে প্রহরীকে ঝাঁকুনি দিয়ে) কী খবর, বল কী খবর?
দ্বিতীয় সৈনিক : সেনাপতি মিরমর্দানের পতন হয়েছে, জাঁহাপনা।
সাঁফ্রে : হোয়াট? মিরমর্দান কিলড?
সিরাজ : (যেন আচ্ছন্ন) মিরমর্দান শহিদ হয়েছেন?
সাঁফ্রে : দি ব্রেভেস্ট সোলজার ইজ ডেড।
আমি যাই, ইওর একসিলেন্সি। আপনাকে কথা দিয়ে যাচ্ছি, ফরাসিরা প্রাণপণে লড়বে।
(প্রস্থান)
সিরাজ : ঠিক বলেছ সাঁফ্রে, শ্রেষ্ঠ বাঙালি বীর যুদ্ধে শহিদ হয়েছে। এখন তাহলে কি করতে হবে? সাঁফ্রে, মোহনলাল-
দ্বিতীয় সৈনিক : সেনাপতি মোহনলালকে খবর দিতে হবে, জাঁহাপনা?
সিরাজ : মোহনলাল? না। নৌবে সিং, বদ্রিআলি, মিরমর্দান সবাই নিহত। এখন কী করতে হবে। (পায়চারি করতে করতে হঠাৎ) হ্যাঁ, আলিবর্দির সঙ্গে যুদ্ধ থেকে যুদ্ধে আমিই তো ঘুরেছি। বাংলার সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক সে তো আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আমি উপস্থিত নেই বলেই পরাজয় গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। (সৈনিককে উদ্দেশ করে) আমার হাতিয়ার নিয়ে এস। আমি যুদ্ধে যাব। আমার এতদিনের ভুল সংশোধন করার এই শেষ সুযোগ আমাকে নিতে হবে।
(মোহনলালের প্রবেশ)
মোহনলাল : না, জাঁহাপনা।
(সৈনিক বেরিয়ে গেল)
সিরাজ : মোহনলাল।
মোহনলাল : পলাশিতে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, জাঁহাপনা। এখন আর আত্মাভিমানের সময় নেই। আপনাকে অবিলম্বে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে।
সিরাজ : মিরজাফরের কাছে একবার কৈফিয়ত চাইব না?
মোহনলাল : মিরজাফর ক্লাইভের সঙ্গে যোগ দিল বলে। আর একটি মুহূর্তও নষ্ট করবেন না জাঁহাপনা। মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে আপনাকে নতুন করে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।
সিরাজ : আমি একাই ফিরে যাব?
মোহনলাল : আমার শেষ যুদ্ধ পলাশিতেই। আমি যাই, জাঁহাপনা। সাঁফ্রে আর আমার যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।
(নতজানু হয়ে নবাবের পদস্পর্শ করল। তারপর দ্বিতীয় কথা না বলে বেরিয়ে গেল)
সিরাজ : (আত্মাগতভাবে) যাও, মোহনলাল। আর দেখা হবে না। আর কেউ রইল না। শুধু আমি রইলাম-নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে, মোহনলাল বলে গেল।
(দ্বিতীয় সৈনিকের প্রবেশ)
সৈনিক : দেহরক্ষী অশ্বারোহীরা প্রস্তুত, জাঁহাপানা। আপনার হাতিও তৈরি।
সিরাজ : চল।
(যেতে যেতে কী যেন মনে করে দাঁড়ালেন)
সিরাজ : সেনাপতি মোহনলালকে খবর পাঠাও। কয়েকজন ঘোড়সওয়ারের হেফাজতে মিরমর্দানের লাশ যেন এক্ষুনি মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। উপযুক্ত মর্যাদায় মিরমর্দানের লাশ দাফন করতে হবে।
(বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুজন প্রহরী নবাব শিবিরের জিনসপত্র গোছাতে লাগল। রাইসুল জুহালার প্রবেশ)
রাইস : জাঁহাপনা তাহলে চলে গেছেন? রক্ষা।
প্রহরী : আমরা সবাই চলে যাচ্ছি।
রাইস : মিরজাফর-ক্লাইভের দলবল এসে পড়ল বলে।
প্রহরী : তা হলে আর দেরি নয়, চল সরে পড়া যাক।
(বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করতেই সশস্ত্র সৈন্যদের হাতে তারা বন্দি হলো। সৈন্যদের সঙ্গে এল ক্লাইভ, মিরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ।)
ক্লাইভ : হি হ্যাজ ফ্লেড অ্যাওয়ে, আগেই পালিয়েছে। (বন্দিদের কাছে এসে) কোথায় গেছে নবাব? (বন্দিরা নিরুত্তর)
ক্লাইভ : (রাইসুল জুহালাকে বুটের লাথি মারল) কোথায় গেছে নবাব? সে কুইকলি ইফ ইউ ওয়ান্ট টু লাইভ। বাঁচতে হলে জলদি করে বল।
রাইস : (হেসে উঠে মিরজাফরকে দেখিয়ে) ইনি বুঝি বাংলার সিপাহসালার? যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় হয়েছে তো হুজুর?
রাজবল্লভ : যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে লোকটাকে?
ক্লাইভ : নো টাইম ফর ফান, কাম অন সে, হোয়ার ইজ সিরাজ?
(আবার লাথি মারল)
রাইস : নবাব সিরাজউদ্দৌলা এখনো জীবিত। এর বেশি আর কিছু জানিনে।
রাজবল্লভ : চিনেছি , এ তো সেই রাইসুল জুহালা।
ক্লাইভ : হি মাস্ট বি এ স্পাই।
(টান মেরে পরচুলা খুলে ফেলল)
মিরজাফর : নারান সিং। সিরাজউদ্দৌলার প্রধান গুপ্তচর।
ক্লাইভ : গুলি কর ওকে হেয়ার অ্যান্ড নাও।
(দুজন গোরা সৈন্য নবাবের পরিত্যক্ত আসনের সঙ্গে পিঠমোড়া করে নারান সিংকে বাঁধতে লাগল।)
ক্লাইভ : (মিরজাফরকে) এখনই মুর্শিদাবাদের দিকে মার্চ করুন। বিশ্রাম করা চলবে না। সিরাজউদ্দৌলা যেন শক্তি সঞ্চয়ের সময় না পায়।
(ক্লাইভ কথা বলছে, পিছনে গোরা সৈন্য দুজন নারান সিংহকে গুলি করল। মিরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, নিদারুণ শঙ্কিত। ক্লাইভ অবিচল। গুলিবিদ্ধ নারান সিংয়ের দিকে তাকিয়ে সহজ কণ্ঠে বললো)
ক্লাইভ : গুপ্তচরকে এইভাবেই সাজা দিতে হয়।
নারান : (মৃত্যুস্তিমিত কণ্ঠে) এ দেশে থেকে এ দেশকে ভালোবেসেছি। গুপ্তচরের কাজ করেছি দেশের স্বাধীনতার খাতিরে। সে কি বেইমানির চেয়ে খারাপ? মোনাফেকির চেয়ে খারাপ? ঝিমিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ একটু সতেজ হয়ে) তবু ভয় নেই; সিরাজউদ্দৌলা বেঁচে আছে।
ক্লাইভ : (গোরা সৈন্য দুটিকে) হাউ ডু ইউ কিল? ইডিয়টস। যখন মারবে শুট স্ট্রেইট ইনটু হার্ট, এমন করে মারবে যেন সঙ্গে সঙ্গে মরে।
(পিস্তল বার করল)
নারান : ভগবান সিরাজউদ্দৌলাকে রক্ষা-
(ক্লাইভ নিজে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে নারান সিংয়ের মৃত্যু হলো।)

[দৃশ্যান্তর]

 

তৃতীয় অঙ্ক-চতুর্থ দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ২৫এ জুন।
স্থান ; মুর্শিদাবাদ নবাব দরবার।

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-সিরাজ, ব্যক্তি, সৈনিক, অপর সৈনিক, বার্তাবাহক, দ্বিতীয় বার্তা বাহক, জনতা ও লুৎফা।]
(দরবারে গণ্যমান্য লোকের সংখ্যা কম। বিভিন্ন শ্রেণির সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। স্তিমিত আলোয় সিরাজ বক্তৃতা করছেন। ধীরে ধীরে আলো উজ্জ্বল হবে।)
সিরাজ : পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে-কথা গোপন করে এখন আর কোনো লাভ নেই। কিন্তু-
ব্যক্তি : প্রাণের ভয়ে কে না পালায় হুজুর? (ব্যঙ্গ প্রকাশ)
সিরাজ : আপনাদের কি তাই বিশ্বাস যে প্রাণের ভয়ে আমি পালিয়ে এসেছি? (জনতা নীরব)
সিরাজ : না, প্রাণের ভয়ে আমি পালাইনি। সেনাপতিদের পরামর্শে যুদ্ধের বিধি অনুসারেই আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করিনি। ফিরে এসেছি রাজধানীতে স্বাধীনতা বজায় রাখবার শেষ চেষ্টা করব বলে।
ব্যক্তি : কিন্তু রাজধানী খালি করে তো সবাই পালাচ্ছে জাঁহাপনা।
সিরাজ : আমি অনুরোধ করছি, কেউ যেন তা না করেন। এখনো আশা আছে। এখনো আমরা একত্রে রুখে দাঁড়াতে পারলে শত্রু মুর্শিদাবাদে ঢুকতে পারবে না।
ব্যক্তি : তা কী করে হবে হুজুর? অত বড় সেনাবাহিনী যখন ছারখার হয়ে গেল।
সিরাজ : তারা যুদ্ধ করেনি। তারা দেশবাসীর সঙ্গে, দেশের মাটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কিন্তু যারা নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতে শিখেছিল, মুষ্টিমেয় সেই কজনই শুধু যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে গেছে। এই প্রাণদান আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।
ব্যক্তি : পরাজয়ের খবর বাতাসের বেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, জাঁহাপনা। ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছে। বিজয়ী সৈন্যের অত্যাচার এবং লুটতরাজের ভয়ে নগরের অধিকাংশ লোকজন তাদের দামি জিনসপত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে যে কোনো দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ : আপনারা ওদের বাধা দিন। ওদের অভয় দিন।। শত্রুসৈন্যদের হাতে পড়বার আগেই সাধারণ চোর-ডাকাত ওদের সর্বস্ব কেড়ে নেবে।
ব্যক্তি : কেউ শোনে না, হুজুর। সবাই প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে।
সিরাজ : কোথায় পালাবে? পেছন থেকে আক্রমণ করবার সুযোগ দিলে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো যায় না। আপনারা কেউ অধৈর্য হবেন না। সবাইকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বলুন। এই আমাদের শেষ সুযোগ, এ কথা বারবার করে বলছি। ক্লাইভের হাতে রাজধানীর পতন হলে এ দেশের স্বাধীনতা চিরকালের মতো লুপ্ত হয়ে যাবে।
ব্যক্তি : জাঁহাপনা, কোথায় বা পাওয়া যাবে তত বেশি সৈন্য আর কোথায় বা তার ব্যয়-ব্যবস্থা।
সিরাজ : দু-এক দিনের ভেতরেই বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে যথেষ্ট সৈন্য সাহায্য আসবে। অর্থের অভাব নেই। সেনাবাহিনীর খরচের জন্যে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা বলুন কার কী প্রয়োজন।
সৈনিক : ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্যদলে রোজ বেতনে আমি জমাদারের কাজ করি জাঁহাপনা। আমার অধীনে ২০০ সিপাই। আমরা হুজুরের জন্যে প্রাণপণে লড়তে প্রস্তুত।
সিরাজ : বেশ, খাজাঞ্চির কাছ থেকে টাকা নিয়ে যান। আপনার সিপাইদের তৈরি হতে আদেশ দিন। মুর্শিদাবাদে এই মুহূর্তে অন্তত দশ হাজার সৈন্য সংগ্রহ হবে। জমিদারের কাছ থেকে সাহায্য আসবার আগে এই বাহিনী নিয়েই আমরা শত্রুর মোকাবিলা করতে পারব।
অপর সৈনিক : আমি রাজা রাজবল্লভের অশ্বারোহী বাহিনীতে ঠিকা হারে কাজ করি। আমার মতো এমন আরও শতাধিক লোক রাজবল্লভের বাহিনীতে কাজ করে। জাঁহাপনার হুকুম হলে আমরা একটা ফৌজ অল্প সময়ের ভেতরেই খাড়া করতে পারি।
সিরাজ : এখুনি চলে যান। খাজাঞ্চির কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিন যত দরকার।
(বার্তাবাহকের প্রবেশ)
বার্তাবাহক : শহরে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, জাঁহাপনা। মুহম্মদ ইরিচ খাঁ সাহেব এই মাত্র সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেলেন।
সিরাজ : (বিস্ময়ের বিমূঢ়) ইরিচ খাঁ পালিয়ে গেলেন! সিরাজউদ্দৌলার শ্বশুর ইরিচ খাঁ?
বার্তাবাহক : জাঁহাপনা!
সিরাজ : আশ্চর্য! এই কিছুক্ষণ আগে তিনি আমার কাছ থেকে অজস্র টাকা নিয়ে গেলেন সেনাবাহিনী সংগঠনের জন্যে।
ব্যক্তি : তাহলে আর আশা কোথায়!
সিরাজ : তাহলেও আশা আছে।
(দ্বিতীয় বার্তাবাহকের প্রবেশ)
দ্বিতীয় বার্তা : জাঁহাপনার কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের অনেকেই নিজেদের লোকজন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ : তাহলেও আশা! ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়। কিন্তু তাতে বীরের মনোবল ক্ষুণ্ন হয় না। এমনি করে পালাতে পারতেন মিরমর্দান, মোহনলাল, বদ্রিআলি, নৌবে সিং। তার বদলে তাঁরা পেতেন শত্রুর অনুগ্রহ, প্রভূত সম্পদ এবং সম্মান। কিন্তু তা তাঁরা করেননি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশবাসীর মর্যাদার জন্যে, তাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন। স্বার্থান্ধ প্রতারকের কাপুরুষতা বীরের সংকল্প টলাতে পারেনি। এই আদর্শ যেন লাঞ্ছিত না হয়। দেশপ্রেমিকের রক্ত যেন আবর্জনার স্তুপে চাপা না পড়ে।
(জনতা নীরব। সিরাজের অস্থির পদচারণা)
সিরাজ : সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে আপনারা ভেবে দেখুন, কে বেশি শক্তিমান? একদিকে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষ-অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিদ্রোহী। তাদের হাতে অস্ত্র আছে, আর আছে ছলনা এবং শাঠ্য। অস্ত্র আমাদেরও আছে, কিন্তু তার চেয়ে যা বড়, সবচেয়ে যা বড় আামদের আছে সেই দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্প। এই অস্ত্র নিয়ে আমরা কাপুরুষ দেশদ্রোহীদের অবশ্যই দমন করতে পারব।
ব্যক্তি : সাধারণ মানুষ তো যুদ্ধ কৌশল জানে না, হুজুর।
সিরাজ : তবু তাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। হাজার মানুষ একযোগে রুখে দাঁড়াতে পারলে কৌশলের প্রয়োজন হবে না। বিক্রম দিয়েই আমরা শত্রুকে হতবল করতে পারব। তা না হলে, ভবিষ্যতে বছরের পর বছর, দেশের সাধারণ মানুষ দেশদ্রোহী এবং বিদেশি দস্যুর হাতে যে ভাবে উৎপীড়িত হবে তা অনুমান করাও কষ্টকর। আপনারা ভেবে দেখুন, কেন এই যুদ্ধ? মুসলমান মিরজাফর, ব্রাহ্মণ রাজবল্লভ, কায়স্থ রায়দুর্লভ, জৈন মহাতাব চাঁদ শেঠ, শিখ উমিচাঁদ, ফিরিঙ্গি খ্রিষ্টান ওয়াটস ক্লাইভ আজ একজোট হয়েছে কিসের জন্যে? সিরাজউদ্দৌলাকে ধবংস করবার প্রয়োজন তাদের কেন এত বেশি? তারা চায় মসনদের অধিকার। কারণ, তা না হলে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা হয় না। দেশের উপরে অবাধ লুঠতরাজের একচেটিয়া অধিকার তারা পেতে পারে না সিরাজউদ্দৌলা বর্তমান থাকতে। একবার সে সুযোগ পেতে তাদের আসল চেহারা আপনারা দেখতে পাবেন। বাংলার ঘরে ঘরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দেবে মিরজাফর-ক্লাইভের লুণ্ঠন অত্যাচার। কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই সময় থাকতে একযোগে মাথা তুলে দাঁড়ান। আপনারা অবশ্যই জয়লাভ করবেন। (উদ্দীপনা দানের চেষ্টা)
ব্যক্তি : কিন্তু জাঁহাপনা, সৈন্য পরিচালনার যোগ্য সেনাপতিও তো আমাদের নেই।
সিরাজ : আছে। সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হননি। তিনি অবিলম্বে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। তাছাড়া আমি আছি। মরহুম আলিবর্দীর আমল থেকে এ পর্যন্ত কোন যুদ্ধে আমি শরিক হইনি? পরাজিত হয়েছি একমাত্র পলাশিতে। কারণ সেখানে যুদ্ধ হয়নি, হয়েছে যুদ্ধের অভিনয়। আবার যুদ্ধ হবে, আর সৈন্য পরিচালনা করব আমি নিজে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন বিহার থেকে রামনারায়ণ, পাটনা থেকে ফরাসি বীর মসিয়েল।
(বার্তাবাহকের প্রবেশ)
বার্তা : সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন, জাঁহাপনা।
সিরাজ : (কিছুটা হতাশ) মোহনলাল বন্দি হয়েছে?
জনতা : তাহলে আর কোনো আশা নেই। কোনো আশা নেই।
(জনতা দরবার কক্ষ ত্যাগ করতে লাগল)
সিরাজ : মোহনলাল বন্দি? (কতকটা যেন আত্মা-সংবরণ করে) তাহলেও কোনো ভয় নেই। আপনারা হাল ছেড়ে দেবেন না।
(সিরাজ হাত তুলে পলায়নপর জনতাকে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। জনতা তাতে কান না দিয়ে পালাতেই লাগল।)
সিরাজ : আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা শত্রুকে অবশ্যই রুখব।
(সবাই বেরিয়ে গেল। অবসন্ন সিরাজ আসনে বসে পড়লেন। দুহাতে মুখ ঢাকলেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল। লুৎফার প্রবেশ। মাথায় হাত রেখে ডাকলেন)
লুৎফা : নবাব।
সিরাজ : (চমকে উঠে) লুৎফা! তুমি এই প্রকাশ্য দরবারে কেন, লুৎফা?
লুৎফা : অন্ধকারের ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই নবাব।
সিরাজ : (রুদ্ধ কণ্ঠে)। কেউ নেই, কেউ আমার সঙ্গে দাঁড়াল না, লুৎফা। দরবার ফাঁকা হয়ে গেল।
লুৎফা ; (কাঁধে হাত রেখে) তবু ভেঙে পড়া চলবে না, জাঁহাপনা। এখান থেকে যখন হলো না তখন যেখানে আপনার বন্ধুরা আছেন, সেখান থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার আয়োজন করতে হবে।
সিরাজ : যেখানে আমার বন্ধুরা আছেন? হ্যাঁ, আপাতত পাটনায় যেতে পারলে একটা কিছু করা যাবে।
লুৎফা : তাহলে আর বিলম্ব নয়, জাঁহাপনা। এখুনি প্রাসাদ ত্যাগ করা দরকার।
সিরাজ : হ্যাঁ, তাই যাই।
লুৎফা : আমি তার আয়োজন করে ফেলেছি।
সিরাজ : কী আর আয়োজন লুৎফা। দু তিন জন বিশ্বাসী খাদেম সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। তোমরা প্রাসাদেই থাক। আবার যদি ফিরি, দেখা হবে।
লুৎফা ; না, আমি যাব আপনার সঙ্গে।
সিরাজ : মানুষের দৃষ্টি থেকে চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে আমাকে পথ চলতে হবে। সে-কষ্ট তুমি সইতে পারবে না লুৎফা।
লুৎফা : পারব। আমাকে পারতেই হবে। বাংলার নবাব যখন পরের সাহায্যের আশায় লালায়িত তখন আমার কিসের অহংকার? মৃত্যু যখন আমার স্বামীকে কুকুরের মতো তাড়া করে ফিরছে তখন আমার কিসের কষ্ট? আমি যাব আমি সঙ্গে যাব।
(কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সিরাজ তাঁকে দুহাতে গ্রহণ করলেন।)
[দৃশ্যান্তর]

চতুর্থ অঙ্ক- প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ২৯এ জুন।
স্থান : মিরজাফরের দরবার।

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, নকিব, মিরজাফর, ক্লাইভ, ওয়াটস, কিলপ্যাট্রিক, উমিচাঁদ, প্রহরী, মিরন, মোহাম্মদি বেগ।]

 

(রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভসহ অন্যান্য আমির ওমরাহরা দরবারে আসীন। দরবার কক্ষ এমনআনন্দ-কোলাহলে মুখর যে সেটাকে রাজদরবারের পরিবর্তে নাচ-গানের মজিলস বলেও ভেবে নেওয়া যেতে পারে।)

 

রাজবল্লভ : কই আসর জুড়িয়ে গেল যে। নতুন নবাব সাহেবের (মীর জাফর) দরবারে আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
জগৎশেঠ : ঢাল-তলোয়ার ছেড়ে নবাবি লেবাস নিচ্ছেন খাঁ সাহেব, একটু দেরি তো হবেই। তাছাড়া চুলের নতুন খেজাব, চোখে সুর্মা, দাড়িতে আতর এ সব তাড়াহুড়ার কাজ নয়।
রাজবল্লভ : দর্জি নতুন পোশাকটা নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছে কি না কে জানে।
জগৎশেঠ : না না, সে ভাবনা নেই। নবাব আলিবর্দী ইন্তেকাল করার আগের দিন থেকেই পোশাকটি তৈরি। আমি ভাবছি সিংহাসনে বসবার আগেই খাঁ সাহেব সিরাজউদ্দৌলার হারেমে ঢুকে পড়লেন কি না।
রাজবল্লভ : তবেই হয়েছে। বেশুমার হুর-গেলমানদের বিচিত্র ওড়নার গোলকধাঁধা এড়িয়ে বার হয়ে আসতে খাঁ সাহেবের বাকি জীবনটাই না খতম হয়ে যায়।
(নকীবের ঘোষণা)
নকীব : সুবে বাংলার নবাব, দেশবাসীর ধন-দৌলত, জান-সালামতের জিম্মাদার মির মুহম্মদ জাফর আলি খান দরবারে তশরিফ আনছেন। হুঁশিয়ার… (মিরজাফরের প্রবেশ, সঙ্গে মিরন। সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। মিরজাফর ধীরে ধীরে সিংহাসনের কাছে গেলেন। একবার আড়াআড়িভাবে সিংহাসনটা প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর একপাশে গিয়ে একটা হাতল ধরে দাঁড়ালেন। দরবারের সবাই কিছুটা বিস্মিত।)
রাজবল্লভ : (সিংহাসনের দিকে ইঙ্গিত করে) আসন গ্রহণ করুন সুবে বাংলার নবাব। দরবার আপনাকে কুর্নিশ করবার জন্যে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে।
মিরজাফর : (চারিদিকে তাকিয়ে) কর্নেল সাহেব এসে পড়লেন বলে।
জগৎশেঠ : কর্নেল সাহেব এসে কোম্পানির পক্ষ থেকে নজরানা দেবেন সে তো দরবারের নিয়ম।
মিরজাফর : হ্যাঁ, উনি এখুনি আসবেন।
রাজবল্লভ : (ঈষৎ অসহিষ্ণু) কর্নেল ক্লাইভ আসা অবধি দেশের নবাব সিংহাসনের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?
(নাকীবের ঘোষণা)
নকীব : মহামান্য কোম্পানির প্রতিনিধি কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ বাহাদুর, দরবার হুশিয়ার…
(ক্লাইভের প্রবেশ। সঙ্গে ওয়াটস কিলপ্যাট্রিক। গোটা দরবার সন্ত্রস্ত। মিরজাফরের মুখ আনন্দে ভরে উঠল।)
ক্লাইভ : লং লিভ জাফর আলি খান। বাট হোয়াট ইজ দিস? নবাব মসনদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ইনি কি নবাব না ফকির?
মিরজাফর : (বিনয়ের সঙ্গে) কর্নেল সাহেব হাত ধরে তুলে না দিলে আমি মসনদে বসবো না।
ক্লাইভ : (প্রচণ্ড বিস্ময়ে) হোয়াট? দিস ইজ ফ্যান্টাসটিক আই মাস্ট সে। আপনি নবাব, এ মসনদ আপনার। আমি তো আপনার রাইয়াৎ (প্রজা) -আপনাকে নজরানা দেব।
মিরজাফর : মিরজাফর বেইমান নয়, কর্নেল ক্লাইভ। বাংলার মসনদের জন্যে আমি আপনার কাছে ঋণী। সে মসনদে বসতে হলে আপনার হাত ধরেই বসব, তা না হলে নয়।
ক্লাইভ : (ওয়াটস নিচু স্বরে) নো ক্লাউন উইল এভার বিট হিম। (দরবারের উদ্দেশে) আমাকে লজ্জায় ফেলেছেন নবাব জাফর আলি খান। আই এম কমপ্লিটলি ওভারহোয়েলমড। বুঝতে পারছিনে কী করা দরকার। (এগিয়ে গিয়ে মিরজাফরের হাত ধরল। তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে দিতে) জেন্টেলমেন, আই প্রেজেন্ট ইউ দ্যা নিউ নবাব, হিজ এক্সিলেন্সি জাফর আলি খান। আপনাদের নতুন নবাব জাফর আলি খানকে আমি মসনদে বসিয়ে দিলাম। মে গড হেল্প হিম এ্যান্ড হেল্প ইউ এ্যান্ড ওয়েল।
ওয়াটস ও কিলপ্যাট্রিক : হিপ হিপ হুররে।
(মিরজাফর মসনদে বসলেন। দরবারের সবাই কুর্নিশ করল।)
ক্লাইভ : আপনাদের দেশে আবার শান্তি আসল।
(কিলপ্যাট্রিকের কাছ থেকে একটি সুদৃশ্য তোড়া নিয়ে নবাবের পায়ের কাছে রাখল)
ক্লাইভ : কোম্পানির তরফ থেকে আমি নবাবের নজরানা দিলাম।
ওয়াট্স ও কিলপ্যাট্রিক : লং লিভ জাফর আলি খান।
(একে একে অন্যেরা নজরানা দিয়ে কুর্নিশ করতে লাগল। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে উমিচাঁদের প্রবেশ। দৌড়ে ক্লাইভের কাছে গিয়ে)
উমিচাঁদ : আমাকে খুন করে ফেলো- আমাকে খুন করে ফেল। (ক্লাইভের তলোয়ারের খাপ টেনে নিয়ে নিজের বুকে ঠুকতে ঠুকতে) খুন কর, আমাকে খুন কর।
মিরজাফর : কী হয়েছে? ব্যাপার কী?
উমিচাঁদ : ওহ সব বেইমান-বেইমান! না, আমি আত্মহত্যা করব। (নিজের গলা সবলে চেপে ধরল। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরুতে লাগল। ক্লাইভ সবলে তার হাত ছাড়িয়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে)
ক্লাইভ : হাউ ইউ গন ম্যাড?
উমিচাঁদ : ম্যাড বানিয়েছ। এখন খুন করে ফেল। দয়া করে খুন কর কর্নেল সাহেব।
ক্লাইভ : ডোন্ট বি সিলি। কী হয়েছে তা তো বলবে?
উমিচাঁদ : আমার টাকা কোথায়?
ক্লাইভ : কীসের টাকা?
উমিচাঁদ : দলিলে সই করে দিয়েছিলে, সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলে আমাকে বিশ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।
ক্লাইভ : কোথায় সে দলিল?
উমিচাঁদ : তোমরা জাল করেছ। (দৌড়ে সিংহাসনের কাছে গিয়ে) আপনি বিচার করুন। আপনি নবাব সুবিচার করুন।
ক্লাইভ : আমি এর কিছুই জানিনে।
উমিচাঁদ : তা জানবে কেন সাহেব। নবাবের রাজকোষ বাঁটোয়ারা করে তোমার ভাগে পড়েছে একুশ লাখ টাকা। সকলের ভাগেই অংশ মতো কিছু না কিছু পড়েছে। শুধু আমার বেলাতে…
(ক্রন্দন)
ক্লাইভ : (সবলে উমিচাঁদের বাহু আকর্ষণ করে) ইউ আর ড্রিমিং উমিচাঁদ, তুমি খোয়াব দেখছ।
উমিচাঁদ : খোয়াব দেখছি? দলিলে পরিষ্কার লেখা বিশ লক্ষ টাকা পাব। তুমি নিজে সই করেছ।
ক্লাইভ : আমি সই করলে আমার মনে থাকত। তোমার বয়স হয়েছে- মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে এখন তুমি কিছুদিন তীর্থ কর- ঈশ্বরকে ডাক। মন ভালো হবে। (উমিচাঁদকে কিলপ্যাট্রিকের হাতে দিয়ে দিল। সে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে গেল। উমিচাঁদ চিৎকার করতে লাগল; আমার টাকা, আমার টাকা।)
ক্লাইভ : উমিচাঁদের মাথা খারাপ হয়েছে। ইওর এক্সিলেন্সি, মে ফরগিভ আস।
জগৎশেঠ : এমন শুভ দিনটা থমথমে করে দিয়ে গেল।
ক্লাইভ : ভুলে যান। ও কিছু নয়। (নবাবের দিকে ফিরে) আমার মনে হয় আজ প্রথম দরবারে নবাবের কিছু বলা উচিত।
রাজবল্লভ : নিশ্চয়ই। প্রজাসাধারণ আশ্বাসে আবার নতুন করে বুক বাঁধবে। রাজকার্য পরিচালনায় কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে তাও মোটামুটি তাদেরকে জানানো দরকার।
মিরজাফর : (ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে-পাগড়ি ঠিক করে) আজকের এই দরবারে আমরা সরকারি কাজ আরম্ভ করার আগে কর্নেল ক্লাইভকে শুকরিয়া জানাচ্ছি তাঁর আন্তরিক সহায়তার জন্যে। বিনিময়ে আমি তাকে ইনাম দিচ্ছি বার্ষিক চার লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারি চব্বিশ পরগণার স্থায়ী মালিকানা।
(ওয়াটস ও কিলপ্যাট্রিক এক সঙ্গে : হুররে। ক্লাইভ হাসিমুখে মাথা নোয়ালো।)
মিরজাফর : দেশবাসীকে আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে, তাঁদের দুর্ভোগের অবসান হয়েছে। সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচারের হাত থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি পেয়েছেন। এখন থেকে কারও শান্তিতে আর কোনো রকম বিঘ্ন ঘটবে না।
(প্রহরীর প্রবেশ)
প্রহরী : সেনাপতি মির কাশেমের দূত।
মিরজাফর : হাজির কর।
(বসলেন। দূতের প্রবেশ। মিরন দ্রুত তার কাছে এগিয়ে এল। মিরনের হাতে পত্র প্রদান।
মিরন পত্র খুলেই উল্লসিত হয়ে উঠল।)
মিরন : পলাতক সিরাজউদ্দৌলা মির কাশেমের সৈন্যদের হাতে ভগবানগোলায় বন্দি হয়েছে। তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে।
(মিরজাফরের হাতে পত্র প্রদান)
ক্লাইভ : ভালো খবর। ইউ ক্যান রিয়েলি সেফ নাও।
মিরজাফর : কিন্তু তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসবার কী দরকার? বাইরে যে কোনো জায়গায় আটকে রাখলেই তো চলত।
ক্লাইভ : (রুখে উঠল) নো, ইওর অনার। এখন আপনাকে শক্ত হতে হবে। শাসন চালাতে হলে মনে দুর্বলতা রাখলে চলবে না। আপনি যে শাসন করতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, দেশের লোকের মনে সে কথা জাগিযে রাখতে হবে এভরি মোমেন্ট। কাজেই সিরাজউদ্দৌলা শিকল-বাঁধা অবস্থায় পায়ে হেঁটে সবার চোখের সামনে দিয়ে আসবে জাফরগঞ্জের কয়েদখানায়। কোনো লোক তার জন্যে এতটুকু দয়া দেখালে তার গর্দান যাবে। এখন মসনদের মালিক নবাব জাফর আলি খান। সিরাজউদ্দৌলা এখন কয়েদি, ওয়ার ক্রিমিন্যাল। তার জন্যে যে সিমপ্যাথি দেখাবে সে ট্রেটার। আর আইনে ট্রেটারের শাস্তি মৃত্যু। অ্যান্ড দ্যাট ইজ হাউ ইউ মাস্ট রুল।
মিরজাফর ; আপনারা সবাই শুনেছেন আশা করি। সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে। যথাসময়ে তার বিচার হবে। আমি আশা করি কেউ তার জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের বিপদ টেনে আনবেন না।
ক্লাইভ : ইয়েস। তাছাড়া মুর্শিদাবাদের রাজপথ দিয়ে যখন তাকে সোলজাররা টানতে টানতে নিয়ে যাবে তখন রাস্তার দুধার তেকে অর্ডিনারি পাবলিক তার মুখে থুথু দেবে- দে মাস্ট স্পিট অন হিজ ফেস।
মিরজাফর : অতটা কেন?
ক্লাইভ : আমি জান হি ইজ এ ডেড হর্স। কিন্তু এটা না করলে লোকে আপনার ক্ষমতা দেখে ভয় পাবে কেন? পাবলিকের মনে টেরর জাগিয়ে রাখতে পারাটাই শাসন ক্ষমতার গ্রানাইট ফাউন্ডেশন। (আতঙ্ক সৃষ্টি করা)
(মিরজাফর মসনদ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দরবারে কাজ শেষ হলো। নবাব দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রধান অমাত্যরা এবং তার পেছনে অন্য সকলে। মঞ্চের আলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল: কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার। ধীরে ধীরে মঞ্চে অনুজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। কথা বলতে বলতে ক্লাইভ এবং মিরনের প্রবেশ।)
ক্লাইভ : আজ রাত্রেই কাজ সারতে হবে। এসব ব্যাপারে চান্স নেওয়া চলে না।
মিরন : কিন্তু হুকুম দেবে কে? আব্বা রাজি হলেন না।
ক্লাইভ : রাজবল্লভকে বল।
মিরন : তিনি নাকি অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে দেখাই করা গেল না।
ক্লাইভ : দেন?
মিরন : রায়দুর্লভ ইয়ার লুৎফ খাঁ-ওঁরাও রাজি হলেন না।
ক্লাইভ : তাহলে তোমাকে সেটা করতে হবে।
মিরন : প্রহরীরা আমার হুকুম শুনবে কেন?
ক্লাইভ : তোমার নিজের হাতেই সিরাজউদ্দৌলাকে মারতে হবে ইন ইওর ওন ইনটারেস্ট। সে বেঁচে থাকতে তোমার কোনো আশা নেই। নবাবি মসনদ তো পরের কথা, আপাতত হোয়াট অ্যাবাউট দ্যা লাভলি প্রিন্সেস? লুৎফুন্নিসা তোমার কাছে ধরা দেবে কেন সিরাজউদ্দৌলা জীবিত থাকতে?
মিরন : আমি একজন লোক ব্যবস্থা করেছি। সে কাজ করবে, কিন্তু তোমার হুকুম চাই।
ক্লাইভ : হোয়াট এ পিটি, হায়ার্ড কিলাররা পর্যন্ত তোমার কথায় বিশ্বাস করে না। এনি ওয়ে, ডাক তাকে।
(মিরন বেরিয়ে গেল এবং মোহাম্মদি বেগকে নিয়ে ফিরে এল।)
মিরন : মোহাম্মদি বেগ।
ক্লাইভ : তুমি রাজি আছ?
মোহাম্মদি বেগ : দশ হাজার টাকা দিতে হবে। পাঁচ হাজার অগ্রিম।
ক্লাইভ : এগ্রিড (মিরনকে) ওকে টাকাটা এখুনি দিয়ে দাও।
(মিরন এবং মোহাম্মদি বেগ বেরুবার উপক্রম করল)
ক্লাইভ : দেয়ার মে বি ট্রাবল, অবস্থা বুঝে কাজ কর, বি কেয়ারফুল। কাজ ফতে হলেই আামকে খবর দেবে, যাও।
(ওরা বেরিয়ে গেল। ক্লাইভের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের মুঠো দিয়ে আঘাত করে বললো)
ইট ইজ এ মাস্ট।

[দৃশ্যান্তর]

চতুর্থ অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য

সময় : দোসরা জুলাই।
স্থান : জাফরাগঞ্জের কয়েদখানা

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-কারা প্রহরী, সিরাজ, মিরন, মোহাম্মদি বেগ]

(প্রায়-অন্ধকার কারাকক্ষে সিরাজউদ্দৌলা। এক কোণে একটি নিরাবরণ দড়ির খাটিয়া, অন্য প্রান্তে একটি সোরাহি এবং পাত্র। সিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন আর বসছেন। কারাকক্ষের বাইরে প্রহরারত শান্ত্রী। মিরন এবং তার পেছনে মোহাম্মদি বেগের প্রবেশ। তার দুহাত বুকে বাঁধা। ডান হাতে নাতিদীর্ঘ মোটা লাঠি। প্রহরী দরজা খুলতেই কামরায় একটুখানি আলো প্রতিফলিত হলো।)

 

সিরাজ : (খাটিয়ায় উপবিষ্ট-আলো দেখে চমকে উঠে) কোথা থেকে আলো আসছে। বুঝি প্রভাত হয়ে এল।
(খাটিয়া থেকে উঠে মঞ্চের সামনে এগিয়ে এল। মঞ্চের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল মিরন এবং তার পেছনে মোহাম্মদি বেগ।)
সিরাজ : (মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে) এ প্রভাত শুভ হোক তোমার জন্যে, লুৎফা। শুভ হোক আমার বাংলার জন্যে। নিশ্চিত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারী। আলহামদুলিল্লাহ।
মিরন : আল্লাহর কাছে মাফ-চেয়ে নাও শয়তান।
সিরাজ: (চমকে উঠে) মিরন! তুমি এ সময়ে এখানে? আমাকে অনুগ্রহ দেখাতে এসেছ, না পীড়ন করতে?
মিরন : তোমার অপরাধের জন্য নবাবের দণ্ডাজ্ঞা শোনাতে এসেছি।
সিরাজ : নবাবের দণ্ডাজ্ঞা?
মিরন : বাংলার প্রজাসাধারণকে পীড়নের জন্যে, দরবারের পদস্থ আমির ওমরাহদের মর্যাদাহানির জন্যে, বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসঙ্গত বাণিজ্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করবার জন্যে, অশান্তি এবং বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে তুমি অপরাধী। নবাব জাফর আলি খান এই অপরাধের জন্য তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
সিরাজ : মৃত্যুদণ্ড? জাফর আলি খান স্বাক্ষর করেছেন? কই দেখি।
মিরন : আসামির সে অধিকার থাকে নাকি? (পেছনে ফিরে) মোহাম্মদি বেগ।
মোহাম্মদি বেগ : জনাব।
মিরন : নবাবের হুকুম তামিল কর।
(সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল। মোহাম্মদি বেগ লাঠিটা মুঠো করে ধরে সিরাজের দিকে এগোতে লাগল)
সিরাজ : প্রথমে মিরন তারপর মোহাম্মদি বেগ। মিরন তবু মিরজাফরের পুত্র, কিন্তু তুমি মোহাম্মদি বেগ, তুমি আসছ আমাকে খুন করতে?
(মোহাম্মদি বেগ তেমনি এগোতে লাগল। সিরাজ হঠাৎ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে।)
সিরাজ : আমি মৃত্যুর জন্যে তৈরি। কিন্তু তুমি এ কাজ কোরো না মোহাম্মদি বেগ।
(মোহাম্মদি বেগ তবু এগোচ্ছে। সিরাজ আরও ভীত)
সিরাজ : তুমি এ কাজ করো না মোহাম্মদি বেগ। অতীতের দিকে চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ। আমার আব্বা-আম্মা পুত্র স্নেহে তোমাকে পালন করেছেন। তাঁদেরই সন্তানের রক্তে স্নেহের ঋণ আঃ…
(লাঠি দিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করল। সিরাজ লুটিয়ে পড়ল। মোহাম্মদি বেগ স্থির দৃষ্টিতে দেখতে লাগল মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বার হচ্ছে। ডান হাতের কনুই এবং বাঁ হাতের তালুতে ভর দিয়ে সিরাজ কিছুটা মাথা তুললেন)
সিরাজ : (স্থলিত কণ্ঠে) লুৎফা, খোদার কাছে শুকরিয়া, এ পীড়ন তুমি দেখলে না।
(মোহাম্মদি বেগ লাঠি ফেলে খাপ থেকে ছোরা খুলে সিরাজের লুণ্ঠিত দেহের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার পিঠে পর পর কয়েকবার ছোরার আঘাত করল। সিরাজের দেহে মৃত্যুর আকুঞ্চন। মোহাম্মদি বেগ উঠে দাঁড়াল)
সিরাজ : (ঈষৎ মাথা নাড়বার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু-নিস্তেজ কণ্ঠে) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…
(মোহাম্মদি বেগ লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের জীবন শেষ হলো। শুধু মৃত্যুর আক্ষেপে তার হাত দুটো মাটি আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিরকালের মতো নিস্পন্দ হয়ে গেল।)
মোহাম্মদি
বেগ : (উল্লাসের সঙ্গে) হা হা হা….
———————-

টীকা ও চরিত্র-পরিচিতি।

———————
  • আলিবর্দি (মির্জা মুহম্মদ আলিবর্দি খাঁ) : (১৬৭৬-১০.০৪.১৭৫৬ খ্রি.)। প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলি। তিনি ১৭৪০ সাল থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। আলিবর্দি খাঁর বাবা ছিলেন আরব দেশীয় এবং মা তুর্কি। ইরানের (পারস্য) এই সামান্য সৈনিক ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। চাকরির উদ্দেশ্যে দিল্লিতে এসে সুবিধা করতে না পেরে তিনি বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা সুজাউদ্দিনের দরবারের পারিষদ ও পরে একটি জেলার ফৌজদার নিযুক্ত হন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর তিনি ও তাঁর অগ্রজ হাজি আহমদের বুদ্ধিতে সুজাউদ্দিন বাংলার মসনদে বসেন। খুশি হয়ে সুজাউদ্দিন তাঁকে ‘আলিবর্দি’ উপাধি দিয়ে রাজ্যের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলে তিনি বিহারের নায়েব সুবা পদে অভিষিক্ত হন। ১৭৩৯ খ্রিস্টব্দে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর নবাব হন তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ। কিন্তু বিহারের সুবেদার আলিবর্দী খাঁ তখন অপরিসীম শক্তি ও সামর্থ্যর অধিকারী। অমাত্যবর্গও তাঁর অনুগত। অবশেষে ১৭৪০ সালের ৯ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদের কাছে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খাঁকে পরাজিত করে আলিবর্দি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত হন।
    আলিবর্দি খাঁ ছিলেন অত্যন্ত সুদক্ষ শাসক। তিনি শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেন। বর্গীদের অত্যাচারে দেশের মানুষ যখন অতিষ্ট তখন তিনি কঠিন হাতে তাদের দমন করেন। বর্গি প্রধান ভাস্কর পণ্ডিতসহ তেইশজন নেতাকে তিনি কৌশলে হত্যা করেন এবং বর্গিদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। একইভাবে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় রেখে ইউরোপীয় বণিকদের উচ্ছেদ না করে কৌশলে তাদের দমিয়ে রাখেন। এভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
    আলিবর্দি খাঁর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তিন কন্যা ঘসেটি বেগম (মেহেরউননেসা), শাহ বেগম আমিনা বেগমকে তিনি তাঁর ভাই হাজি মুহম্মদের তিন পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন। আশি বছর বয়সে বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি ১০ই এপ্রিল ১৭৫৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত হন। সিরাজ ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। আলিবর্দির ইচ্ছা অনুযায়ী সিরাজ নবাব হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
  • মিরজাফর : প্রকৃত নাম মির জাফর আলি খাঁন পারস্য (ইরান) থেকে নিঃস্ব অবস্থায় ভারতবর্ষে আসেন। উচ্চ বংশীয় যুবক হওয়ায় নবাব আলিবর্দি খাঁন তাকে স্নেহ করতেন এবং বৈমাত্রেয় ভগ্নী শাহ খানমের সঙ্গে মিরজাফরের বিয়ে দেন। আলিবর্দি তাকে সরকারের উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন। তিনি কূটকৌশল ও চাতুর্যের মাধ্যমে নবাবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন এবং সেনাপতি ও বকশির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার মেধা, বুদ্ধি ও কৌশলের মূলে ছিল ক্ষমতালিপ্সা। ফলে আলিবর্দিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে একাধিকবার ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন নবাব। আবার বার বার ক্ষমা পাওয়া সত্ত্বেও তার চরিত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
    নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর পর যুবক সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলে চারদিকে ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইংরেজদের সীমাহীন লোভ ও স্বার্থপরতার ষড়যন্ত্রে অনেক রাজ অমাত্যের সঙ্গে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মিরজাফর। ইংরেজদের প্রলোভনে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি তখন নীতি-নৈতিকতাহীন এক উন্মদে পরিণত হন। তাই পলাশির যুদ্ধে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েও এবং পবিত্র কোরান ছুঁয়ে নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করার শপথ গ্রহণ করলেও তিনি বিশ্বাসঘাতকতার পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেননি। বরং পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতনকে ত্বরান্বিত করার জন্য দেশপ্রেমিক সৈনিকদের যুদ্ধ করার সুযোগ দেননি। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতনের পর ক্লাইভের গাধা বলে পরিচিত মিরজাফর ১৭৫৭ সালের ২৯এ জুন ক্লাইভের হাত ধরে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। কিন্তু ইংরেজদের স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনায় তাকে গদিচ্যুত করে তার জামাতা মিরকাসিমকে বাংলার মসনদে বসান। ১৭৬৪ সালে পুনরায় তাকে সিংহাসনে বসানো হয়। ইংরেজদের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া এই বিশ্বাসঘাতক মানুষটি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৭৬৫ সালে মারা যান। বাংলার ইতিহাসে মিরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক, নিকৃষ্ট মানুষের প্রতীক। ফলে মিরজাফর মানেই হলো বিশ্বাসঘাতক।
  • ক্লাইভ : পিতা-মাতার অত্যন্ত উচ্ছ্বঙ্খল সন্তান ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। তার দৌরাত্ম্যে অস্থির হয়ে বাবা-মা তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেন। তখন তার বয়স মাত্র সতেরো বছর। কোম্পানির ব্যবসার মাল ওজন আর কাপড় বাছাই করতে করতে বিরক্ত হয়ে ক্লাইভ দুবার পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গুলি চলেনি বলে বেঁচে যান ভাগ্যবান ক্লাইভ।
    ফরাসিরা এদেশে বাণিজ্য বিস্তার ও রাজ্যজয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বাজার দখল ও রাজ্য জয়কে কেন্দ্র করে তখন ফরাসিদের বিরুদ্ধে চলছিল ইংরেজ বণিকদের যুদ্ধ। সেইসব চোটখাটো যুদ্ধে সৈনিক ক্লাইভ একটার পর একটা কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। বোম্বাই এর মারাঠা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে কর্নেল পদবি লাভ করেন এবং মাদ্রাজের ডেপুটি গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন।

    সে সময় সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজদের ফোর্ট উইলয়াম দুর্গ দখল করে নেন। ইংরেজ পক্ষের গভর্নর ড্রেক পালিয়ে যান। কিন্তু কর্নেল ক্লাইভ অধিক সংখ্যক সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় এসে দুর্গ দখল করে নেন।
    তারপর চলল মুর্শিদাবাদে নবাবের সঙ্গে দরকষাকষি। ক্লাইভ ছিলেন যেমন ধূর্ত তেমনি সাহসী; আবার যেমন মিথ্যাবাদী তেমনি কৌশলী। চারদিক থেকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে তিনি তরুণ নবাবকে বিভ্রান্ত ও বিব্রত করার জন্য চেষ্টা করেন। নবাবের অধিকাংশ লোভী, স্বার্থপর, শঠ ও বিশ্বাসঘাতক অমাত্য ও সেনাপতিদের উৎকোচ ও প্রলোভন দিয়ে নিজের দলে ভিড়িয়ে নেন। অবশেষে তার নেতৃত্বে চন্দননগরে ফরাসি কুঠি আক্রমণ করা হয়। ফরাসিরা পালিয়ে যান। এবার ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩এ জুন পলাশি প্রান্তরে ক্লাইভের নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ শঠতার ও বিশ্বাসঘাতকতার। সিরাজউদ্দৌলার অধিকাংশ সেনাপতি যু্দ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। ফলে খুব সহজেই ক্লাইভের সৈন্য জয়লাভ করে।
    ক্লাইভ বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসান। কিন্তু প্রকৃত শাসনকর্তা হন তিনি নিজেই। মিরজাফর তার অনুগ্রহে নামেমাত্র রাজ্য পরিচালনা করতেন। ১৭৬০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে মহাবিত্তশালী, বিজয়ী ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এ সময় তার বার্ষিক আয় ৪ লক্ষ টাকা।
    ১৭৬৪ সালের জুন মাসে ক্লাইভ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অসীম ক্ষমতা নিয়ে আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ১৭৬৭ সালের জুলাই মাসে যখন তিনি চির দিনের জন্য লন্ডনে ফিরে যান তখন তিনি হতোদ্যম, অপমানিত ও লজ্জিত। ভারত লুণ্ঠনের বিপুল অর্থ ব্রিটিশ কোষাগারে না-রেখে আত্মসাৎ করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানো হয় তিনি লজ্জায় ও অপমানে বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত হন এবং ১৭৭৪ সালে ২২এ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন।
  • উমিচাঁদ : উমিচাঁদ লাহোরের অধিবাসী শিখ সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। কলকাতায় এসে প্রথমে তিনি গোমস্তার কাজ করতেন। পরে ইংরেজদের ব্যবসার দালালি করতে শুরু করেন। মাল কেনা-বেচার জন্য দালালদের তখন বেশ প্রয়োজন ছিল। দালালি ব্যবসা করে উমিচাঁদ কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। কখনো কখনো নবাবের প্রয়োজনে উচ্চ সুদে টাকা ধার দিয়ে নবাবের দরবারে যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে উছেছিলেন। প্রচুর টাকার অথিকারী হয়ে উমিচাঁদ দেশের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ শুরু করেন। উমিচাঁদ বড় ধুরন্ধর ব্যক্তি ছিলেন। ইংরেজদের কথা নবাবের কাছে এবং নবাবের কথা ইংরেজদের কাছে বলে দুপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। গভর্নর রোজার ড্রেক তাকে একবার বন্দি করে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে রেখেছিলেন। উমিচাঁদ মিরজাফর প্রমুখদের নবাব বিরোধী চক্রান্ত ও শলাপরামর্শের সহযোগী ছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে অন্যদের যে ১৫ দফা গোপন চুক্তি হয় তাতে উমিচাঁদ গো ধরে লিখিয়ে নিয়েছিলেন, ইংরেজরা জয়ী হলে তাকে কুড়ি লক্ষ টাকা দেবে। কিন্তু ক্লাইভ ছিলেন বিস্ময়কর কূটকৌশলী মানুষ। তিনি সাদা ও লাল দুরকম দলিল করে জাল দলিলটা উমিচাঁদকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সাদা দলিলটা ছিল ক্লাইভের কাছে এবং তাতে উমিচাঁদের দাবির কথা উল্লেখ ছিল না।
    যুদ্ধ জয়ের পরে উমিচাঁদ ক্লাইভের এই ভাঁওতা বুঝতে পেরে টাকার শোকে পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরেছেন এবং অকালে মারা গেছেন। এদেশের ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের পেছনে উমিচাঁদের ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা অনেকাংশে দায়ী।
  • ওয়াটস : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাশিম বাজার কুঠিরের পরিচালক ছিলেন উইলিয়াম ওয়াটসন। ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে নবাবের দরবারে ইংরেজ প্রতিনিধি হিসেবে প্রবেশাধিকার ছিল তার নাদুসনুদুস মোটাসোটা এবং দেখতে সহজ-সরল এই লোকটি ছিলেন আদর্শ ও নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ। সর্বপ্রকার মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণে তার জুড়ি ছিল না। মিরজাফরসহ অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে তিনি সর্বদা যোগাযোগ রাখতেন এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান সহায়ক ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। নারীর ছদ্মবেশে ষড়যন্ত্রের সভায় উপস্থিত হয়ে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর, রাজা রাজবল্লভ প্রমুখদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। নবাব একবার তাকে বন্দি করেছিলেন আর একাধিকবার তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু রাজবল্লভদের পরামর্শে নবাব তাকে ক্ষমা করেন। হতোদ্যম ওয়াটস দেশে ফিরে যান এবং অকালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ওয়াটসের স্ত্রী এদেশের অন্য একজন ইংরেজ যুবককে বিয়ে করে থেকে যান।
  • ওয়াটসন (অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন) : ইংরেজ পক্ষের নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। ওয়াটসন ছিলেন ব্রিটিশ রাজের কমিশন পাওয়া অ্যাডমিরাল। ১৭৫৬ সালের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখে মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসামন্তসহ পাঁচখানি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে তিনি কলকাতার দিকে রওনা হন। কলকাতা তখন ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার দখলে। আর ইংরেজরা ফলতা অঞ্চলে পালিয়ে যান। ইংরেজদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হন ওয়াটসন। ১৫ই ডিসেম্বর ক্লাইভ ও ওয়াটসনের সেনাবাহিনী কলকাতায় পৌঁছায়। নবাবের ফৌজদার মানিকচাঁদকে তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজরা কলকাতা দখল করেন। ওয়াটসন হলেন কোম্পানির সিলেক্ট কমিটির মেম্বর। ওয়াটসন মনে মনে ক্লাইভের ক্ষমতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। উমিচাঁদকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যে জাল দলিলে ক্লাইভ ও মিরজাফর প্রমুখেরা সই করেছিলেন তাতে ওয়াটসন সই দেননি। তার সই নকল করা হয়েছিল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নৌবাহিনীর নেতৃত্বের জন্য ইংরেজরা অতি সহজে চন্দনগরের ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পলাশির যুদ্ধের দুমাস পরেই অসুস্থ হয়ে কলকাতায় মারা যান। সেন্ট জোন্স গোরস্থানে তাঁর কবর আছে।
  • হলওয়েল : লন্ডনের গাইস হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাস করে হলওয়েল কোম্পানির চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন। পাটনা ও ঢাকার অফিসে কিছুকাল চাকরি করে ১৭৩২ সালে তিনি সার্জন হয়ে কলকাতায় আসেন। তখন তার মাইনে ছিল পঞ্চাশ টাকা মাত্র। সুতরাং অবৈধভাবে বিপুল অর্থ-ঐশ্বর্য লাভের আশায় তিনি সিভিল সার্ভিসে চাকরি নেন। ১৭৫২ সালে তিনি চব্বিশ পরগনার জমিদারের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের সময় তিনি ফোর্টের অস্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত হন।
    সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে কোম্পানির গভর্নর ড্রেক, সৈন্যাধ্যক্ষ মিনসিনসহ সবাই নৌকায় চড়ে পালিয়ে যান। তখন ডা. হলওয়েল কলকাতার সৈন্যাধ্যক্ষ ও গভর্নর হন। কিন্তু সিরাজের আক্রমণের কাছে টিকতে পারননি। সিরাজের বাহিনী হলওয়েলকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন।

    মিথ্যা বলে অতিরঞ্জিত করে অসত্য ও অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এবং তাঁর শাসনামলকে কলঙ্কিত করা ছিল হলওয়েলের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি অন্ধকূপ হত্যা কাহিনি (Black Hole Tragedy) বানিয়েছিলেন।
    তার বানানো গল্পটি হলো : নবাব দুর্গ জয় করে ১৮ ফুট লম্বা এবং ১৫ ফুট চওড়া একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখেন-যে ঘরের চারদিক ছিল বন্ধ। সকালে দেখা গেল ১২৩ জন ইংরেজ মারা গেছেন। অথচ দুর্গে তখন ১৪৬ জন ইংরেজ ছিলেনই না। আর এমন ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন মানুষ কিছুতেই সংকুলান হওয়া সম্ভব নয়। অথচ তার হিসাব-নিকাশ বোধ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছিল। আর এই মিথ্যাকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য তিনি কলকাতায় ব্লাক হোল মনুমেন্ট নির্মাণ করেছিলেন। পরে গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংস এই মনুমেন্ট সরিয়ে দেন।
  • ঘসেটি বেগম : নবাব আলিবর্দি খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম তথা মেহেরুন্নেসা। আলিবর্দি খানের বড় ভাই হাজি আহমদের বড় ছেলে নওয়াজিস মোহাম্মদ শাহমৎ জঙ্গের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাদের কোনো সন্তান ছিল না তাই তিনি ছোট বোন আমিনা বেগমের ছেলে অর্থাৎ সিরাজউদ্দৌলার ভাই একরামউদ্দৌলাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রত্যাশা ছিল যে, একরামউদ্দৌলা নবাব হলে নবাব মাতা হিসেবে রাজকার্য পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু একরামউদ্দৌলা বসন্ত রোগে অক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলে ঘসেটি বেগম নৈরাশ্যে অক্রান্ত হন।
    ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজিস মোহাম্মদ ছিলেন ভগ্ন-স্বাস্থ্য ও দুর্বল চিত্তের অধিকারী ব্যক্তি। তিনি নিজে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারতেন না। শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তার সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁ। এই হোসেন কুলি খাঁয়ের সঙ্গে ঘসেটি বেগমের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান করা হয়। ফলে আলিবর্দি খানের নির্দেশে সিরাজউদ্দৌলা হোসেন কুলী খাঁকে হত্যা করেন। ঘসেটি বেগম এই হত্যাকাণ্ডকে কখনই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি সিরাজউদ্দৌলার প্রতি সর্বদাই ছিলেন প্রতিশোধ পরায়ণ।
    বিক্রমপুরের অধিবাসী রাজা রাজবল্লভ ঢাকায় নওয়াজেস মোহাম্মদের দেওয়ান ছিলেন। ঘসেটি বেগম রাজবল্লভের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা যথাসময়ে এই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যান এবং ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। খালা ঘসেটি বেগমকে তিনি মুর্শিদাবাদের সুরম্য মতিঝিল প্রাসাদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রায় বন্দি অবস্থায় রাখেন এবং তার সমস্ত টাকাকড়ি, গয়নাগাটি ও সোনাদানা বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তিনি নানা কৌশলে নবাব সিরাজের বিশ্বাসঘাতক আমাত্য ও ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ঘসেটি বেগম ও তার দলবলের বিজয় হলেও আর দশজন বিশ্বাসঘাতকের মতো তার পরিণতিও ছিল বেদনাবহ। প্রথমে তাকে ঢাকায় অন্তরীণ করা হয়। পরে মিরনের চক্রান্তে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষার সন্ধিস্থলে ফেলে দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
  • ড্রেক : রোজার ড্রেক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতার গভর্নর। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। নবাবের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে প্রাণ ভয়ে সঙ্গ-সাথিদের ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে ফেলে তিনি নৌকায় চড়ে কলকাতা ছেড়ে ফলতায় পালিয়ে যান।
    পুনরায় ক্লাইভ কলকাতা অধিকার করলে ড্রেক গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের পর কোম্পানি ড্রেকের পরিবর্তে রবার্ট ক্লাইভকে কলকাতার গভর্নর নিযুক্ত করে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পরে গভর্নর ড্রেককে মিরজাফর তার রাজকোষ থেকে দুই লক্ষ আশি হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
  • মানিকচাঁদ : রাজা মানিকচাঁদ ছিলেন নবাবের অন্যতম সেনাপতি। তিনি বাঙালি কায়স্থ, ঘোষ বংশে তার জন্ম। নবাবের গোমস্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে আলিবর্দির সুনজরে পড়ে মুর্শিদাবাদে সেরেস্তাদারি পেয়েছিলেন্ ১৭৫৬ সালে জুন মাসে কলকাতা দখল করে নবাব কলকাতা শহরের আলি নগর নামকরণ করেন। আর মাণিকচাঁদকে করেন কলকাতার গভর্নর।
    কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মানিকচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে সর্বদাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে কলকাতা পৌঁছে মানিকচাঁদকে পত্র লিখে তার সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেন। এক সময় নবাব সিরাজ মানিকচাঁদকে কলকাতার সোনাদানা লুঠ করে কুক্ষিগত করার অপরাধে বন্দি করেন। অবশেষে রায়দুর্লভদের পরামর্শে সাড়ে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে মানিকচাঁদ মুক্তি পেয়েছিলেন। মানিকচাঁদ ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধ না-করে কলকাতা ছেড়ে হুগলি পলায়ন করেছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধের পূর্বে ক্লাইভকে বিনা বাধায় মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছিলেন।
  • জগৎশেঠ : জগৎশেঠ জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন এবং তাঁর পেশা ছিল ব্যবসায়। বহুকাল ধরে হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে এই সমাজেরই অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার প্রকৃত নাম ফতেহ চাঁদ। জগৎশেঠ তার উপাধি। এর অর্থ হলো জগতের টাকা আমদানিকারী বা বিপুল অর্থের অধিকারী কিংবা অর্থ লগ্নির ব্যবসায়ী। নবাব সরফরাজ খাঁকে হটিয়ে আলিবর্দিকে সিংহাসনে আরোহনের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল। সুতরাং তিনি খুভ স্বাবাবিকভাবেই মনে করেছিলেন যে, নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাদের বশীভূত থাকবেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিবেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সততা ও নিষ্ঠার ভিন্ন প্রকৃতির এক যুবক। তিনি কিছুতেই এদের অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বরং জগৎশেঠকে তার ষড়যন্ত্রের জন্য বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। জগৎশেঠও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার পতনে নিষ্ঠুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
  • আমিনা বেগম : নবাব আলিবর্দির কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগম। আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমদের পুত্র জয়েন উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর তিন সন্তান। এরা হলেন মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা, একরামউদ্দৌলা ও মির্জা হামদি। স্বামী জয়েনউদ্দিন ও পুত্র সিরাজউদ্দৌলার জীবনের চরম দুর্ভাগ্যের সঙ্গে তাঁর জীবনও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিল। স্বামী জয়েনউদ্দিন প্রথমে উড়িষ্যার ও পরে বিহারের সুবেদার ছিলেন। ১৭৪৮ সালে আফগান অধিপতি আহমদ শাহ দুররানি পাঞ্জাব আক্রমণ করলে নবাব আলিবর্দির আফগান সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং পাটনা অধিকার করেন। বিদ্রোহীরা নবাবের বড় ভাই হাজি আহম্মদ ও জামাতা জয়েনউদ্দিনকে হত্যা করেন।
    অতি অল্প বয়সে বিধবা আমিনা বেগম পুত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতা হিসেবেও শান্তি লাভ করতে পারেননি। দেশি-বিদেশি বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে নবাব পরাজিত ও নিহত হলে এবং একটি হাতির পৃষ্ঠে তাঁর মরদেহ নিয়ে এলে মা আমিনা বেগম দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আর্তনাদ করতে করতে ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। এ সময় মিরজাফরের রক্ষীরা তাঁর উপর চড়াও হয় এবং তাঁকে নির্যাতন করে আন্দর মহলে পাঠিয়ে দেয়। আমিনার এক পুত্র একরামউদ্দৌলা পূর্বেই বসন্ত রোগে মারা যান। পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা মিরজাফর ও অন্যান্য অমাত্যের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত ও নিহত হন। কনিষ্ঠ পুত্র মির্জা হামদিকেও মিরনের আদেশে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর আমিনা বেগমকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
  • মিরন : বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের তিন পুত্র। তারা হলেন: জ্যেষ্ঠ মিরন, মেজো নাজমুদ্দৌলা এবং কনিষ্ঠ সাইফুদ্দৌলা। মিরন পিতার মতই দুশ্চরিত্র, ব্যাভিচারী, নিষ্ঠুর এবং ষড়যন্ত্রকারী। মিরজাফরের সঙ্গে অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক রাজ-অমাত্যদের যোগাযোগের কাজ করতেন মিরন। তারই ষড়যন্ত্রে এবং ব্যবস্থায় মোহাম্মদি বেগ হতভাগ্য নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। মিরন সিরাজউদ্দৌলার মধ্যম ভ্রাতা মৃত একরামউদ্দৌলার পুত্র মুরাদউদ্দৌলাকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। তিনি সিরাজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে বিবাহ করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসার তীব্র বিরোধিতার জন্য তার এই অভিলাষ পূর্ণ হয়নি। মিরনের অপরাধ ও পাপের সীমা নাই। বজ্রাঘাতে অকালে মারা যান এই কুৎসিত স্বভাবের মানুষটি।
  • মিরমর্দান : মিরমর্দান নবাব সিরাজউদ্দৌলার অত্যন্ত বিশ্বাসী সেনাপতি ছিলেন। পলাশির যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই অকুতোভয় বীর যোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে ইংরেজ শিবিরের দিকে এগুয়ে যাওয়ার সময় তার উরুতে গোলার আঘাত লাগে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং অধিকাংশ সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে যান।
  • মোহনলাল : মোহনলাল কাশ্মিরি সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা মোহনলালকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। একসময় তিনি নবাবের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। পলাশির যুদ্ধে মিরমর্দান গোলার আঘাতে মৃত্যুবরণ করলে মোহনলাল ফরাসি যোদ্ধা সাঁফ্রেকে সঙ্গে নিয়ে বীরদর্পে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু মিরজাফর ও রায়দুর্লভের পরামর্শে সিরাজ মোহনলালকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। মোহনলাল পুত্রসহ ইংরেজদের হাতে বন্দি হন এবং ক্লাইভের নির্দেশে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। অথচ ক্লাইভকে এক চিঠিতে ওয়াট্সন জানিয়েছেন যে, নবাবের শত্রুরা মোহনলালকে বিষ খাইয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল যাতে নবাবকে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ দেওয়ার কোনো লোক না থাকে।
  • মোহাম্মদি বেগ : মোহাম্মদি বেগ একজন নীচাশয় ও কৃতঘ্ন ব্যক্তি ও খুনি। পলাশির যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর স্ত্রী- কন্যাসহ পাটনার উদ্দেশ্যে যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন সিরাজ তখন মিরজাফরের ভাই মিরদাউদ সপরিবারে নবাবকে বন্দি করে রাজধানীতে নিয়ে আসে। গণবিক্ষোভের আশঙ্কায় ক্লাইভ দ্রুত সিরাজকে হত্যা করতে চান। তখন মিরনের আহবানে মোহাম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করতে রাজি হয়। অথচ সিরাজের পিতা মির্জা জয়নুদ্দিন অনাথ বালক মোহাম্মদি বেগকে আদর-যত্নে মানুষ করেছিলেন। অথচ সেই মোহাম্মদি বেগ অর্থের লোভে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। ২রা জুলাই ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা শহিদ হন।
  • রাজবল্লভ : রাজা রাজবল্লভ বিক্রমপুরের বাঙালি বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার স্বার্থপর, অর্থলোলুপ, বিশ্বাঘাতক অমাত্যদের তিনি একজন। রাজবল্লভ ঢাকায় নৌবাহিনীর কেরানির কাজ করতেন। পরে ঢাকার গভর্নর ঘসেটি বেগমের স্বামী নোয়াজিশ খাঁর পেশকারের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘসেটি বেগমের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে এবং তিনি নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি রাজা উপাধি লাভ করেন। হোসেন কুলী খাঁর মৃত্যুর পর রাজবল্লভ ঢাকার দেওয়ান নিযুক্ত হন। এ সময় গর্ভনর নোয়াজিশ খাঁর শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে রাজবল্লভ বিপুল অর্থবিত্তের অধিকারী হন। এই সংবাদ জেনে সিরাজ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজবল্লভকে বন্দি করেন। কিন্তু আলিবর্দি খাঁর নির্দেশে রাজবল্লভ মুক্তি পান। রাজবল্লভের অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য সিরাজ ঢাকায় লোক পাঠান। কিন্তু অতি ধুরন্ধর রাজবল্লভ পুত্র কৃষ্ণদাসের মাধ্যমে নৌকাভর্তি টাকাকড়ি ও স্বর্ণালংকার কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কৃষ্ণদাস তীর্থ যাত্রার নাম করে পুরি যাওয়ার পরিবর্তে কলকাতায় রোজার ড্রেকের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেন। নবাব ড্রেককে চিঠি দিয়ে কৃষ্ণদাসকে মুর্শিদাবাদে প্রেরণের জন্য বলেন। অর্থালিপ্সু ড্রেক তাকে পাঠাননি। রাজবল্লভ ইংরেজদের শক্তি সংহত করার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করার জন্য শেষ পর্যন্ত নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে গিয়েছেন।
  •  লুৎফুন্নেসা : নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা। তিনি মির্জা ইরাজ খাঁনের কন্যা। ১৭৪৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মহা ধুমধামে লুৎফুন্নেসার বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তার জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রাসাদ রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক না-থাকলেও তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়েছে সব কিছু। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ে তিনি স্বামীর হাত ধরে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে শত্রুর হাতে ধরা পড়েন তারা। সিরাজ বন্দি হয়ে চলে যান মুর্শিদাবাদে আর লুৎফুন্নেসাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। সুতরাং স্বামীকে হত্যার দৃশ্য তিনি দেখেননি। মৃতদেহের সৎকারেও তিনি ছিলেন না। পরে যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনা হয় তখন তিনি নিঃস্ব, আপন বলে পৃথিবীতে তাঁর কেউ নেই। খোশবাগের গোরস্থানে স্বামীর সমাধিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে তার নিঃসঙ্গ জীবন কাটে। মিরন তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু লুৎফুন্নেসা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখান করেন। ১৭৭০ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।
  • রায়দুর্লভ : নবাব আলিবর্দির বিশ্বস্ত অমাত্য রাজা জানকীরামের ছেলে রায়দুর্লভ। রায়দুর্লভ ছিলেন উড়িষ্যার পেশকার ও পরে দেওয়ানি লাভ করেন। রাঘুজি ভৌসলা উড়িষ্যা আক্রমণ করে রায়দুর্লভকে বন্দি করেন। ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ চলে আসেন এবং রাজা রামনারায়ণের মুৎসুদ্দি পদে নিয়োজিত হন। তিনি নবাব আলিবর্দির আনুকূল্যে লাভ করেন এবং নবাবের সৈন্যবিভাগে নিযুক্ত হন। কিন্তু নবাব সিরাজের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল না। তাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাকে পদোন্নতি প্রদান করেননি। ফলে নবাবের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পলাশির যুদ্ধে মিরজাফর ও রায়দুল্লভ অন্যায়ভাবে নবাব সিরাজকে যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। তাদের কুপরামর্শে সিরাজ যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। ফলে ক্লাইভের সৈন্যরা প্রায় বিনাযুদ্ধে জয় লাভ করে। পলাশির যুদ্ধের পর এই বিশ্বাসঘাতক সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারেননি। বরং মিরন তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। ইংরেজরা তাকে রক্ষা করেন এবং তিনি কলকাতা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু তত দিনে রায়দুর্লভ সর্বস্বান্ত ও নিঃস্ব।
  • ডাচ : হল্যান্ডের অধিবাসীগণ ওলন্দাজ বা ডাচ নামে পরিচিত। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতায় ডাচগণ ভারতবর্ষে ব্যবসা করার জন্য আসে ষোড়শ শতকে। ২০এ মার্চ ১৬০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে এশিয়ায় ২১ বছর ব্যবসা ও উপনিবেশ স্থাপনের অনুমতি দেয় সে দেশের সরকার। ভারতবর্ষে এরা বহু দিন ব্যবসা করেছে, কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। তাদের আর উপনিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৬০২ সাল থেকে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত এই কোম্পানি প্রায় দশ লক্ষ লোক ও ৪৭৮৫টি জাহাজ ভারতবর্ষে পাঠিয়েছিল।
  • ফরাসি : ফ্রান্সের অধিবাসীগণ ফরাসি নামে পরিচিত। ফ্রান্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৪ সালে। মোগল শাসনামলে ফরাসি সরকারের নীতি অনুযায়ী এই কোম্পানি ব্যবসা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। ফরাসিদের স্বার্থ রক্ষাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। পন্ডিচেরি ও চন্দননগরে ফরাসিদের একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এই দুটি স্থানে তারা বসতি ও ব্যবসা চালিয়েছিল।
  • ফোর্ট উইলিয়াম : কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য-কুঠি। ১৭০৬ সালে এই কুঠি নির্মিত হয়। পরে এই কুঠি দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইংল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামের সম্মানে এই কুঠির নামকরণ করা হয়।
  • আলিনগরের সন্ধি : ১৭৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং ভারতের ব্রিটিশ প্রতিনিধি রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তখন কলকাতা নগরী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইংরেজরা সেখানে দুর্গ স্থাপন এবং টাকশাল প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page