শিহাবউদ্দিন ঘুরি ও তরাইনের যুদ্ধের ইতিহাস
-
ঘুরি কারা?
- ঘুরি রাজবংশ মূলত পূর্ব ইরানের একটি রাজবংশের নাম। তাজিক বংশোদ্ভূত এই রাজপরিবার ৮৯৭-১২১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভূখণ্ড শাসন করে। এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল আফগানিস্তানের ঘুর প্রদেশ যা মান্দেশ নামেও পরিচিত। বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাত ও গজনি অঞ্চলের মধ্যবর্তী ছোট এলাকার নাম ঘুর। ঘুরের সামন্ত রাজা ছিল শিহাবউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরির বাবা বাহাউদ্দিন সাম। বাহাউদ্দিনের দুই ছেলে গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মদ ও মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ। এই মুইজউদ্দিন ‘শিহাবউদ্দিন ঘুরি’ নামে পরিচিত। মুইজউদ্দিন ও গিয়াসউদ্দিন ১১৭৩-১২০২ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। ১২০২ সালে গিয়াসউদ্দিন মারা গেলে শিহাবউদ্দিন স্বাধীন শাসক হিসেবে শাসন করেন।
-
শিহাবউদ্দিন ঘুরির পরিচয়-
- শিহাবউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি ১১৪৯ সালে আফগানিস্তানের ঘুর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মুয়িজউদ্দিন মুহাম্মদ। বাবার মৃত্যুর পর ১১৭৩ সালে তাঁর বড় ভাই গিয়াসউদ্দিন শাসক হন। শিহাবউদ্দিন তার ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উভয়ে গজনি দখল করেন। শিহাবউদ্দিনকে গজনির গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। ১১৭৫ সালে তিনি মুলতান আক্রমণ করেন। ইতঃপূর্বে সুলতান মাহমুদ কারামতি শাসক আবুল ফাতাহকে পরাজিত করে মুলতান দখলে নিলেও তাঁর মৃত্যুর পর কারামতিরা তা পুনর্দখল করে। শিহাবউদ্দিনের আক্রমণে কারামতিরা পালিয়ে যায়। ১১৭৯ সালে শিহাবউদ্দিন ঘুরি গজনভির শাসক খসরু শাহের কাছ থেকে পেশোয়ার দখল করেন।
১১৮১ সালে তিনি লাহোর আক্রমণ করেন। খসরু শাহ বার্ষিক কর দেওয়ার চুক্তি করলেও পরে তা ভঙ্গ করে। ১১৮৪ সালে শিহাবউদ্দিন শিয়ালকোট জয় করেন। ১১৮৬ সালে খসরু শাহের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করেন এবং গজনভী সাম্রাজ্যের অধীন লাহোরের পতন ঘটে। এরপর ঘুরি উত্তর ভারতের দিকে মনোযোগ দেন। -
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ-
- উত্তর প্রদেশের কনৌজের রাজা ছিলেন রাজপুত বংশোদ্ভূত জয়চন্দ্র। তাঁর মেয়ে সংযুক্তাকে বিয়ে করতে চায় আরেক রাজপুত বীর পৃথ্বীরাজ চৌহান। কিন্তু জয়চন্দ্র এই প্রস্তাব মেনে নেয় নি। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। জয়চন্দ্র অপহৃত মেয়েকে ফিরে পেতে প্রায় এক বছর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। অনন্যোপায় হয়ে পৃথ্বীরাজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জয়চন্দ্র শিহাবুদ্দিন ঘুরিকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১১৯১ সালে শিহাবুদ্দিন ঘুরি ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি খাইবার গিরিপথের মাঝ দিয়ে পাঞ্জাব এসে পৌঁছান। পাঞ্জাবের বাথিন্ডায় অবস্থিত পৃথ্বীরাজের দুর্গটি তিনি দখল করেন।
- পৃথ্বীরাজের নিকট এই অভিযানের কথা অজানা ছিল না। সে শশুর জয়চন্দ্রের সহযোগিতা চাইলে তিনি সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়ে পৃথ্বীরাজ তার ভাতিজা গোবিন্দকে নিয়ে ঘুরির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। হরিয়ানার থানেশ্বরের তরাইন গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয় যুদ্ধ শুরুর আগেই।
যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই মুহাম্মদ ঘুরি পরাজিত হয়ে বসে ছিলেন। কারণ, তিনি তাঁর বাহিনীকে রাজপুতদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই তুর্কি ছিলেন। এসব যোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে তুর্কি বিশেষ কৌশলে যুদ্ধ করতেই অভ্যস্ত ছিল। তুর্কিরা প্রতিপক্ষের আক্রমণের ভয়ে পিছিয়ে পড়ার ভাব দেখিয়ে চূড়ান্ত আক্রমণ করত। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে ঘুরি ভুল করেন। রাজপুতদের তীরবৃষ্টির সামনেই ঘুরি পরাজিত হন। শিহাবউদ্দিন ঘুরি কোনোমতে আফগানিস্তান ফিরে যান। পৃথ্বীরাজ নিজ দেশে বীরের মর্যাদা পান। -
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ-
- দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরির সেনা ১ লাখ ২০ হাজার আর রাজপুত সেনা ৩ লাখ ছিল। ঘুুরি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেকে ভীত হিসেবে প্রকাশ করেন। এতে রাজপুতদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় এবং ঢিলেঢালা মনোভাব চলে আসে। তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধে ঘুরি যে ভুলটি করেছিলেন, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি পুনরায় সে ভুল করেন নি। তিনি সেনাবাহিনীর তুর্কি ইউনিটকে তাদের নিজস্ব রীতিতে যুদ্ধ করার অনুমতি দেন। তুর্কিরা এগিয়ে আক্রমণ করে পিছু হটার ভাব নেয়। রাজপুতরা প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে তুর্কি অশ্বারোহীদের ধাওয়া করতে গেলে আকস্মিক তীর বৃষ্টি শুরু হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় রাজপুতরা হতভম্ব হয়ে পড়ে।
মুহাম্মদ ঘুরি এবার রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে আক্রমণ করেন। ফলে রাজপুত বাহিনীর শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে যায়। তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে পৃথ্বীরাজ চৌহান নিহত হন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে হিন্দুস্তান থেকে শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের পতন ঘটে। এজন্য হিন্দুস্তানের ইতিহাসে পৃথ্বীরাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনিই ছিলেন শেষ স্বাধীন রাজা যিনি বিক্রমাদিত্য হিমুর পূর্বে দিল্লীর সিংহাসন দখল রাখতে পেরেছিলেন।
-
মুসলমানদের ভারত জয়-
- পৃথ্বীরাজের পরাজয় ও বন্দি হওয়ার মাধ্যমে আজমির ঘুরির দখলে আসে। তিনি সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেককে দিল্লী দখল ও হিন্দুস্থানের বিজিত ভূখণ্ডের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে রাজধানী ফিরে যান। এবার পৃথ্বীরাজের শ্বশুর জয়চন্দ্র সতর্ক হয়ে উঠেন। তিনি ভেবেছিলেন মুহাম্মদ ঘুরি পূর্বসূরীদের মতো ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু ঘুরি তা অনুসরণ করেন নি। রাজা জয়চন্দ্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঘুরি ১১৯৪ সালে আবার ভারতে আক্রমণ করেন। যমুনা নদীর তীরে ফিরোজাবাদের চন্দবারে জয়চন্দ্রের বাহিনীর সাথে লড়াই হয় যা চন্দোয়ার যুদ্ধ নামে খ্যাত। জয়চন্দ্র পরাজিত হয়। একই বছর কুতুবুদ্দিন আইবেক পাটনা জয় করে। ১২০৬ সালে পাঞ্জাবের গোখররা বিদ্রোহ করে। তাদের দমানোর জন্য শিহাবউদ্দিন ও কুতুবুদ্দিন সমন্বিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে। উভয়ে মিলে গোখরদের পরাজিত করে। ঘুরি এবার লাহোর চলে যান। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে কুতুবুদ্দিনকে ভারতের শাসক নিযুক্ত করেন। কুতুবুদ্দিন ভারতের প্রথম মুসলমান সুলতান হন। ১২০৬ সালে মুহাম্মদ ঘুরি আততায়ী হামলায় নিহত হন।
- ইউটিউবে এই সংক্রান্ত আলোচনা দেখতে এখানে ক্লিক করুন-
- পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : মাহমুদ গযনভির ভারত অভিযান