নবাবি শাসনের ইতিহাস
-
মুর্শিদকুলী খান-
- আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে মুগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় যখন শুরু হয় তখন স্বীয় প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সুবাদার মুর্শিদকুলী খান। তাঁর জন্ম দাক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। হাজী শফি নামে পারস্যের এক ব্যক্তি ছোটবেলায় তাকে কিনে নিয়ে নাম দেন মুহাম্মদ হাদী। হাজী শফির নিকট রাজস্ব বিষয়ে শিক্ষালাভ করে ইরান চলে যান। ১৬৯৬ সালে হাজী শফির মৃত্যু হলে তিনি দাক্ষিণাত্যে চলে আসেন।
রাজস্ব বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনে আওরঙ্গজেব তাঁকে হায়দারাবাদের দিওয়ান নিযুক্ত করেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আওরঙ্গজেব তাঁকে ‘করতলব খান’ উপাধি দেন এবং ১৭০০ সালে বাংলার দিওয়ান নিযুক্ত করেন। তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন শাহজাদা আজিম। ১৭০১ সালে সম্রাট তাঁকে উড়িষ্যার দিওয়ান নিযুক্ত করেন এবং তাঁর উপাধি দেন মুর্শিদকুলী খান। -
রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার-
তাঁর চেষ্টায় পূর্বের রাজস্ব ঘাটতি দূর হয় এবং রাজস্ব উদ্বৃত্তে পরিণত হয়। প্রতি বছর এক কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করে তিনি সম্রাটকে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করেন। ফলে সম্রাট তাঁর উপর বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁর মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু শাহজাদা আজিমের সাথে সম্পর্ক ভালো না থাকায় প্রাণনাশের হুমকি দেখা দেয়। সুবাদারের অবৈধ বাণিজ্যে অর্থ উপার্জনের বিরোধিতা করায় এই মনোমালিন্যের সৃষ্টি।
মুর্শিদকুলী খান ১৭০৩ সালে সম্রাটের অনুমতি নিয়ে রাজস্ব দফতর ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। তাঁর নাম অনুসারে এর নাম হয় মুর্শিদাবাদ। সম্রাট আজিমকে পাটনায় স্থানান্তর করেন।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে মুগলদের মধ্যে লড়াই হয়। এই সময় দুই বছরের বেশি সময় তাঁকে বাংলার দিওয়ান পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ১৭১৩ সালে ফররুখ সিয়ার তাঁকে বাংলার নায়েবে সুবাদারের দায়িত্ব দেন। এক বছর পর তিনি উড়িষ্যার সুবাদার হন এবং ‘জাফর খান’ উপাধি লাভ করেন। ১৭১৭ সালে তিনি বাংলার সুবাদার হন। প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। মূলত তখন থেকেই বাংলায় নবাবি আমলের শুরু।
মুর্শিদকুলী খানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বপূর্ণ কাজ ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার। বাংলায় এসে তিনি রাজস্ব ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা দেখতে পান। তখন দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলে কর্মচারিদের বেতনের পরিবর্তে জায়গীর নির্দিষ্ট ছিল। এর ফলে ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের আয় ছিল না বললেই চলে এবং বাণিজ্য শুল্কই ছিল রাজকোষের আয়ের প্রধান উৎস। তাছাড়া ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের জন্য ভূমি জরিপের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থার এই দুর্দশা দেখে তিনি রাজস্ব সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
প্রথমে তিনি কর্মচারিদের জায়গিরগুলোকে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করেন এবং উড়িষ্যা প্রদেশে জায়গির প্রদান করতেন। তিনি ভূমি জরিপের মাধ্যমে প্রজাদের খাজনা নির্ধারিত করে দেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদারদের সঙ্গে ভূমির বন্দোবস্ত করেন। তিনি জমির উর্বরতা শক্তি, কয়েক বছরের উৎপন্ন শস্যের বাৎসরিক গড় ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে এক-তৃতীয়াংশ শস্য ভূমিকর হিসেবে নির্ধারিত করেন।
প্রজারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী শস্য বা টাকায় খাজনা দিতে পারত। ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের জন্য সমগ্র বাংলাকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করা হয়। মুর্শিদকুলী কর্তৃক প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা ‘মাল জামিনি’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর বাংলার রাজস্বে ১ কোটি ৫০ লক্ষ উদ্বৃত্ত হয়।
গ্রাম্য পাটোয়ারি, আমিল, দিওয়ান সকলের ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা হয়। রাজস্ব আদায়ে কোনো শিথিলতা প্রদর্শন করা হত না। পূর্বে জমিদারদের নিকট থেকে যে রাজস্ব পাওয়া অনিশ্চিত ছিল তাঁর আমলে তা শুধু নিশ্চিত হয় নি বরং বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এই রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রজারাও উপকৃত হয়। ইজারাদাররা নির্দিষ্ট হারেই খাজনা দিতেন। কোনোরূপ অতিরিক্ত কর আদায় নিষিদ্ধ ছিল। ফলে প্রজাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
তাঁর সময়ে বাংলায় ইউরোপীয়দের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সম্রাট ফররুখশিয়ার ওলন্দাজ বণিকদের ক্ষেত্রে বাণিজ্য শুল্ক ২% নির্ধারণ করেন। তিনিও ফরাসি বণিকদের এই সুবিধা দেন। ১৭১৭ সালে ইংরেজ বণিকরা মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের নিকট থেকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করে। বাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে তাদেরকে সমগ্র প্রদেশে শুল্কমুক্ত ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়। তাছাড়াও কলকাতার নিকটবর্তী ৩৮টি গ্রামের জমিদারি সনদ লাভের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে মুর্শিদকুলী খান এই ব্যাপারে সতর্ক ছিলন। তিনি ফররুখ সিয়ারের দেওয়ার সব সুবিধা ইংরেজদের দেন নি। ১৭২৭ সালে তিনি মারা যান। এরপর জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার ক্ষমতায় বসেন। -
সুজাউদ্দিন খান
- মুর্শিদকুলি খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর জামাতা সুজাউদ্দিন উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন। তবে মুর্শিদকুলি মনে করছিলেন জামাতা সুজাউদ্দিনের চেয়ে পৌত্র সরফরাজ খান অধিক যোগ্য। তাই তিনি সরফরাজকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে চেয়েছিলেন। সুজাউদ্দিন তা বুঝতে পারে সসৈন্যে মুর্শিদকুলির বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় বসেন এবং মুগল সম্রাট থেকে ফরমান লাভ করেন। এমন পরিস্থিতিতে ছেলে বাবার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
সুজাউদ্দিন বেশ দক্ষতার দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মিত্রতার নীতি অবলম্বন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও আস্থাভাজনদের উচ্চ পদে আসীন করেন। সরফরাজ খান বাংলার দেওয়ান হন। মির্জা হাবিবুল্লাহ সেনাপতির পদ লাভ করেন। সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার জন্য তিনি একটি কাউন্সিল গঠন করেন। কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন আলীবর্দি খান, হাজি আহমদ, জগৎশেঠ (ফতেহচাঁদ) প্রমুখ।
তিনি ত্রিপুরা রাজ্য দখল করেন। ত্রিপুরার নাম পরিবর্তন করে রওশনাবাদ রাখেন। বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। রাজস্ব ব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেন। তাঁর শাসনামলকে নবাবি বাংলার ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। ১৭৩৯ সালে তিনি মারা যান। তাঁর ছেলে সরফরাজ খান বাংলার ক্ষমতায় বসেন। -
সরফরাজ খান-
- বাংলার নবাব হিসেবে তিনি নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। পিতার মৃত্যুর পর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবি লাভ করেছিলেন। তিনি শাসক হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন নি। এই সময় থেকে বাংলার শাসন কাঠামোতে ধ্বস নামে। তার সময়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল। চারিত্রিক দুর্বলতা ও প্রশাসনিক অক্ষমতা তার দুর্দিন ডেকে আসে। নায়েবে নাজিম আলীবর্দি খান এর সুযোগ নেন। ১৭৪০ সালে আলীবর্দি খান সরফরাজকে হত্যা করে। পরবর্তীতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবি লাভ করে আলীবর্দি খান।
- পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : শায়েস্তা খানের শাসন
- পরবর্তী আলোচনা : আলীবর্দি খানের শাসন