মাসি পিসি (দুই বিধবার বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রামী জীবন কাহিনি)
- লেখক-পরিচিতি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকনাম মানিক। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। মাত্র আটচল্লিশ বছর তিনি বেঁচেছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি পড়ার সময়ে মাত্র বিশ বছর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে তিনি প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তারপর জীবনের বাকি আটাশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেছেন। মাঝে বছর তিনেক মাত্র তিনি চাকরি ও ব্যবসায়িক কাজে নিজেকে জড়ালেও বাকি পুরো সময়টাই তিনি সার্বক্ষণিকভাবে সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক হিসেবে মানিক বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান। অল্প সময়েই প্রচুর গল্প-উপন্যাস সৃষ্টি করেন। সেই সঙ্গে লিখেছেন কিছু কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও ডায়েরি। বিজ্ঞানমনস্ক এই লেখক মানুষের মনোজগৎ তথা অন্তৰ্জীবনের রূপকার হিসেবে সার্থকতা দেখিয়েছেন। একই সঙ্গে সমাজবাস্তবতার শিল্পী হিসেবেও স্বাক্ষর রেখেছেন। জননী, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, চিহ্ন প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাগৈতিহাসিক, সরীসৃপ, সমুদ্রের স্বাদ, কুষ্ঠরোগীর বৌ, টিকটিকি, হলুদ পোড়া, আজ কাল পরশুর গল্প, হারানের নাতজামাই, ছোট বকুলপুরের যাত্রী প্রভৃতি। কলকাতায় ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
- শেষবেলায় খালে এখন পুরো ভাটা। জল নেমে গিয়ে কাদা আর ভাঙা ইটপাটকেল ও ওজনে ভারি আবর্জনা বেরিয়ে পড়েছে। কংক্রিটের (সিমেন্ট-বালু ও পথরকুচির সংমিশ্রণে তৈরি শক্ত ঢালাই) পুলের কাছে খালের ধারে লাগানো সালতি (শাল বা তালকাঠ দ্বারা নির্মিত সরু ডিঙ্গি নৌকা) থেকে খড় তোলা হচ্ছে পাড়ে। পাশাপাশি জোড়া লাগানো দুটো বড় সালতি বোঝাই আঁটিবাধা খড় তিনজনের মাথায় চড়ে গিয়ে জমা হচ্ছে ওপরের মস্ত গাদায়। ওঠানামার পথে ওরা খড় ফেলে নিয়েছে কাদায় (চলাচলের সুবিধার্থে)। সালতি থেকে ওদের মাথায় খড় তুলে দিচ্ছে দুজন। একজনের বয়স হয়েছে, আধপাকা চুল, রোগা শরীর। অন্যজন মাঝবয়সী, বেঁটে, জোয়ান, মাথায় ঠাসা কদমছাটা রুক্ষ চুল।
পুলের তলা দিয়ে ভাটার টান ঠেলে এগিয়ে এল সরু লম্বা আরেকটা সালতি, দু-হাত চওড়া হয়নি না হয়। দু-মাথায় দাঁড়িয়ে দুজন প্রৌঢ়া (প্রবীণ/ যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যবর্তী বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তি) বিধবা লগি (নৌকা ঠেলে চালানোর জন্য বাঁশের সরু ও লম্বা লাঠি/ আঁকশি) ঠেলছে, ময়লা মোটা থানের আঁচল দুজনেরই কোমরে বাঁধা। মাঝখানে গুটিসুটি (জড়সড়) হয়ে বসে আছে অল্পবয়সী একটি বৌ। গায়ে জামা আছে, নকশা পাড়ের সস্তা সাদা শাড়ি। আঁটসাঁট থমথমে গড়ন, গোলগাল মুখ।
“মাসি-পিসি ফিরছে কৈলেশ”, বুড়ো লোকটি (রহমান) বলল।
কৈলাশ বাহকের মাথায় খড় চাপাতে ব্যস্ত ছিল। চটপট শেষ আঁটিটা চাপিয়ে দিয়ে সে যখন ফিরল, মাসি-পিসির সালতি দু-হাতের (অতি নিকটে) মধ্যে এসে গেছে।
“ও মাসি, ওগো পিসি, রাখো রাখো। খপর আছে শুনে যাও।”
সামনের দিকে লগি পুঁতে মাসি-পিসি সালতির গতি ঠেকায়, আহ্লাদি সিঁথির সিঁদুর পর্যন্ত ঘোমটা (সামাজিক প্রথা) টেনে দেয়।। সামনে থেকে মাসি বলে বিরক্তির সঙ্গে, “বেলা আর নেই কৈলেশ।” পেছনে থেকে পিসি বলে, “অনেকটা পথ যেতে হবে কৈলেশ।”
মাসি-পিসির গলা ঝরঝরে (রুক্ষ মনোভাব), আওয়াজ একটু মোটা, একটু ঝংকার (তেজ) আছে। কৈলাশের খবরটা গোপন, দুজনে লম্বা লম্বা সালতির দু-মাথায় থাকলে সম্ভব নয় চুপে চুপে বলা (ব্যক্তিগত বিষয় সবাইকে জানাতে চায় না)। মাসি বড় সালতির খড় ঠেকানো বাঁশটা চেপে ধরে থাকে, পিসি লগি হাতে নিয়েই পিছন থেকে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। আহ্লাদি যেখানে ছিল সেখানে বসেই কান পেতে রাখে। কথাবার্তা সে সব শুনতে পায় সহজেই। কারণ, সে যাতে শুনতে পায় এমনি করেই বলে কৈলাশ (স্বামীর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে)।“বলি মাসি, তোমাকেও বলি পিসি”, কৈলাশ শুরু করে, “মেয়াকে একদম শ্বশুরঘর পাঠাবে না মনে করেছ যদি, সে কেমন ধারা কথা হয়? এত বড় সোমত্ত (উপযুক্ত) মেয়া, তোমরা দুটি মেয়েলোক বাদে ঘরে একটা পুরুষমানুষ নেই (নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই), বিপদ-আপদ ঘটে যদি তো-”
মাসি বলে, “খুনসুটি (হাসি-তামাশার রসালাপ) রাখো দিকি কৈলেশ তোমার, মোদ্দাকথাটা কী তাই কও, বললে না যে খপর আছে, কী?”
পিসি বলে, “খপরটা কী তাই কও। বেলা বেশি নেই কৈলেশ।”
মাসি-পিসির সাথে পারা যাবে না (ভাব জমানো যাবে না) জানে কৈলাশ। অগত্যা ফেনিয়ে রসিয়ে বলবার বদলে সে সোজা কথায় আসে, “জগুর সাথে দেখা হলো কাল। খড় তুলে দিতে সাঁঝ (সন্ধ্যা) হয়ে গেল, তা দোকানে এটটু-মানে আর কি চা খেতে গেছি চায়ের দোকানে, জগুর সাথে দেখা।”
মাসি বলে, “চায়ের দোকান না কীসের দোকান তা বুঝিছি কৈলেশ, তা কথাটা কী?”
পিসি বলে, “সেথা ছাড়া (মদ-জুয়ার আড্ডা) আর ওকে (জগুকে) কোথা দেখবে। হাতে দুটো পয়সা এলে তোমারও স্বভাব বিগড়ে যায়। কৈলেশ। তা, কী বললে জগু?”
কৈলাশ ফাঁপরে (কথায় আটকে পড়া/ হতবুদ্ধি হওয়া) পড়ে আড়চোখে (বাঁকা দৃষ্টি) চায় আহ্লাদির দিকে (মনোভাব জানার চেষ্টা), হঠাৎ বেমক্কা জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করে যে (জোর গলায় মাসি-পিসির কথার প্রতিবাদ করে না), তা নয়, পুলের কাছেই চায়ের দোকান, মাসি-পিসি গিয়ে জিজ্ঞাসা করুক না সেখানে। তারপরেই জোর হারিয়ে বলে, “ওসব একরকম ছেড়ে দিয়েছে জগু। লোকটা কেমন বদলে গেছে মাসি, সত্যি কথা পিসি, জগু আর সেই জগু নেই (সহমর্মিতা প্রকাশ)। বৌকে নিতে চায় এখন। তোমরা নাকি পণ করেছ মেয়া পাঠাবে না, তাতেই চটে আছে। সম্মান তো আছে একটা মানুষের, কবার নিতে এল তা মেয়া দিলে না, তাই তো নিতে আসে না আর। আমি বলি কী, নিজেরা যেচে (আগ্রহ সহকারে) এবার পাঠিয়ে দেও মেয়াকে।”মাসি বলে, “পেট শুকিয়ে লাথি ঝাঁটা খেতে? কলকেপোড়া ছ্যাঁকা (হুকার উপরে কলকেতে থাকা আগুন) খেতে? খুঁটির সাথে দড়িবাধা হয়ে থাকতে দিনভর রাতভর?”
পিসি-বলে, “মেয়া না পাঠাই, জামাই এলে রাখিনি জামাই-আদরে তাকে? ছাগলটা (সর্বস্ব দিয়ে আপ্যায়ন) বেচে দিয়ে খাওয়াইনি ভালোমন্দ দশটা জিনিস (পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য)?”
মাসি বলে, “ফের আসুক, আদরে রাখব যদ্দিন থাকে। বজ্জাত হোক, খুনে হোক, জামাই তো (প্রথানুগত্য)। ঘরে এলে খাতির না করব কেন? তবে মেয়া মোরা পাঠাব না।”
পিসি বলে, “নে কৈলেশ, মরতে মোরা মেয়াকে পাঠাব না।” (নির্যাতনকারীদের হাতে মেয়েকে তুলে দিব না)
বুড়ো রহমান একা খড় চাপিয়ে যায় বাহকদের মাথায়, চুপচাপ শুনে যায় এদের কথা। ছলছল চোখে একবার তাকায় (মেয়ের কথা মনে পড়ায়) আহ্লাদির দিকে। তার মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে মরেছে অল্পদিন আগে। কিছুতে যেতে চায়নি মেয়েটা, দাপাদাপি করে কেঁদেছে (বিলাপ করে কাঁদা) যাওয়া ঠেকাতে, ছোট অবুঝ মেয়ে (বাল্যবিবাহের ইঙ্গিত)। তার ভালোর জন্যেই তাকে জোর-জবরদস্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আহ্লাদির সঙ্গে তার চেহারায় কোনো মিল নাই। বয়সে সে ছিল অনেক ছোট, চেহারা ছিল অনেক বেশি রোগা। তবু আহ্লাদির ফ্যাকাশে (রক্তশূন্য) মুখে তারই মুখের ছাপ রহমান দেখতে পায়, খড়ের আঁটি তুলে দেবার ফাঁকে ফাঁকে যখনই সে তাকায় আহ্লাদির দিকে।
কৈলাশ বলে, “তবে আসল কথাটা বলি। জগু মোকে বললে, এবার সে মামলা করবে বৌ নেবার জন্য। তার বিয়ে করা বৌকে তোমরা আটকে রেখেছ বদ মতলবে (আহ্লাদির বাবার বাড়ি দখল করতে)। মামলা করলে বিপদে পড়বে। সোয়ামি নিতে চাইলে বৌকে আটকে রাখার আইন নেই। জেল হয়ে যাবে তোমাদের। আর যেমন বুঝলাম, মামলা জগু করবেই আজকালের মধ্যে। মরবে তোমরা জান মাসি (ভীষণ বিপদে পড়া), জান পিসি, মারা পড়বে তোমরা একেবারে।”
আহ্লাদি একটা শব্দ করে, অস্ফুট আর্তনাদের মতো (মাসি পিসির সমস্যার কথা ভেবে)। মাসি ও পিসি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কয়েকবার। মনে হয়, মনে তাদের একই কথা উদয় হয়েছে, চোখে চোখে চেয়ে সেটা শুধু জানাজানি করে নিল তারা।
মাসি বলল, “জেলে নয় গেলাম কৈলেশ, কিন্তু মেয়া যদি সোয়ামির কাছে না যেতে চায় খুন হবার ভয়ে? (সাহসিকতা ও বিচক্ষণতা প্রকাশ)”
বলে মাসি বড় সালতির খড় ঠেকানো বাঁশ ছেড়ে দিয়ে লগি গুঁজে দেয় কাদায়, পিসি তরতর করে পিছনে গিয়ে লগি কাদায় খুঁজে হেলে পড়ে, শরীরের ভারে সরু লম্বা সালতিটাকে এগিয়ে দেয় ভাটার টানের বিপক্ষে। বেলা একরকম নেই। ছায়া নামছে চারদিকে। (অন্ধকার নেমে আসা)শকুনরা (অশুভ প্রতীক মেনে কুসংস্কার) উড়ে এসে বসছে পাতাশূন্য শুকনো গাছটায়। একটা শকুন উড়ে গেল এ আশ্রয় ছেড়ে অল্প দূরে আরেকটা গাছের দিকে। ডাল ছেড়ে উড়তে আর নতুন ডালে গিয়ে বসতে কী তার পাখা ঝাপটানি! (শকুনের আনন্দ মানে মানুষের ক্ষতির ইঙ্গিত)
মায়ের বোন মাসি আর বাপের বোন পিসি ছাড়া বাপের ঘরের কেউ নেই আহ্লাদির। দুর্ভিক্ষ কোনোমতে ঠেকিয়েছিল তার বাপ। মহামারীর একটা রোগে, কলেরায়, সে, তার বৌ আর ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। মাসি-পিসি তার (আহ্লাদির বাবার) আশ্রয়ে মাথা গুঁজে আছে অনেক দিন, দূর ছাই সয়ে (কোনো রকমে বেঁচে থাকা) আর কুড়িয়ে পেতে খেয়ে নিরাশ্রয় বিধবারা যেমন থাকে। নিজেদের ভরণপোষণের কিছু তারা রোজগার করত ধান ভেনে (ঢেঁকিতে ছেটে চাল থেকে তুষ পৃথক করা), কাঁথা সেলাই করে, ডালের বড়ি (চালকুমড়া ও ডাল পিষে ছোট ছোট খাদ্যবস্তু যা শুকিয়ে সবজির সাথে দেয়) বেচে, হোগলা গেঁথে (এক জাতীয় উদ্ভিদ দিয়ে মাদুর তৈরি), শাকপাতা ফলমূল ডাঁটা কুড়িয়ে, এটা ওটা জোগাড় করে। শাকপাতা খুদকুঁড়ো ভোজন, বছরে দুজোড়া থান পরন খরচ তো এই। বছরের পর বছর ধরে কিছু পুঁজি পর্যন্ত হয়েছিল দুজনের, রূপোর টাকা আধুলি সিকি (চার আনা/ আট আনা রূপা)। দুর্ভিক্ষের সময়টা বাঁচবার জন্য তাদের (মাসি-পিসির) লড়তে হয়েছে সাংঘাতিকভাবে, আহ্লাদির বাপ তাদের থাকাটা শুধু বরাদ্দ রেখে খাওয়া ছাঁটাই করে দিয়েছিল (থাকার ব্যবস্থা করলেও খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না) একেবারে পুরোপুরি।
তারও (আহ্লাদির বাবা) তখন বিষম অবস্থা। নিজেরা বাঁচে কি বাঁচে না, তার ওপর জগুর লাথির চোটে মরমর মেয়ে এসে হাজির। সে কোনদিক সামলাবে? মাসি-পিসির সেবা-যত্নেই আহ্লাদি অবশ্য সেবার বেঁচে গিয়েছিল, তার বাপ-মাও সেটা স্বীকার করেছে (কৃতজ্ঞতাবোধ)। কিন্তু কী করবে, গলা কেটে রক্ত দিয়ে সে ধার শোধ করা যদি-বা সম্ভব, অন্ন দেওয়ার ক্ষমতা কোথায় পাবে। পাল্লা দিয়ে (প্রাণপণে চেষ্টা করা) মাসি-পিসি আহ্লাদির জীবনের জন্য লড়েছিল, পেল যদি তো খেয়ে, না-পেল যদি তো না-খেয়েই।অবস্থা যখন তাদের অতি কাহিল, চারদিকে না-খেয়ে মরা শুরু করেছে মানুষ, মরণ ঠেকাতেই ফুরিয়ে আসছে তাদের জীবনীশক্তি; একদিন মাসি বলে পিসিকে, “একটা কাজ করবি বেয়াইন? তাতেও তোরও দুটো পয়সা আসে, মোরও দুটো পয়সা আসে।” শহরের বাজারে তরিতরকারি ফলমূলের দাম চড়া। (দুর্ভিক্ষের কারণে)
গাঁ থেকে কিনে যদি বাজারে গিয়ে বেচে আসে তারা, কিছু রোজগার হবে। একা মাসির ভরসা হয় না সালতি বেয়ে অতদূর যেতে (নিরাপত্তাহীনতা), যাওয়া-আসাও একার দ্বারা হবে না তার। পিসি রাজি হয়েছিল। এতে কিছু হবে কি না হবে ভগবান জানে, কিন্তু যদি হয় তবে রোজগারের একটা নতুন উপায় মাসি পেয়ে যাবে আর সে পাবে না, তাকে না পেলে অন্য কারো সাথে হয়ত মাসি বন্দোবস্ত (আয়োজন) করবে, তা কি পারে পিসি ঘটতে দিতে (হিংসা থেকে মাসির সঙ্গদান)।
সেই থেকে শুরু হয় গেরস্তের বাড়তি শাকসবজি ফলমূল নিয়ে মাসি-পিসির সালতি বেয়ে শহরের বাজারে গিয়ে বেচে আসা। গাঁয়ের বাবু বাসিন্দারাও (সম্ভ্রান্ত লোক) নগদ পয়সার জন্য বাগানের জিনিস বেচতে দেয়।
মাসি-পিসির ভাব ছিল আগেও। অবস্থা এক, বয়স সমান, একঘরে বাস, পরস্পরের কাছে ছাড়া সুখ-দুঃখের কথা তারা কাকেই-বা বলবে, কেই-বা শুনবে। তবে হিংসা দ্বেষ রেষারেষিও ছিল যথেষ্ট, কোন্দলও (ছোট কারণে বড় ঝগড়া) বেধে যেত কারণে অকারণে।
পিসি এ বাড়ির মেয়ে, এ তার বাপের বাড়ি। মাসি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে (অযাচিতভাবে এসে সর্বেসর্বা হওয়া) এখানে। তাই মাসির উপর পিসির একটা অবজ্ঞা অবহেলার ভাব ছিল। এই নিয়ে পিসির অহংকার আর খোচাই সবচেয়ে অসহ্য লাগত মাসির। ধীর শান্ত দুঃখী মনে হতো এমনি তাদের, কিন্তু ঝগড়া বাধলে অবাক হয়ে যেতে হতো তাদের দেখে। সে কী রাগ, সে কী তেজ, সে কী গো! মনে হতো এই বুঝি কামড়ে দেয় একে অপরকে, এই বুঝি কাটে বঁটি দিয়ে।
শাকসবজি বেচে বাঁচবার চেষ্টায় একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে (প্রাণপণে চেষ্টা করা) পড়ামাত্র সব বিরোধ সব পার্থক্য উড়ে গিয়ে দুজনের হয়ে গেল একমন, একপ্রাণ (বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন)। সে মিল জমজমাট হয়ে উঠল আহ্লাদির ভার ঘাড়ে পড়ায় (দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে)। নিজের পেট ভরানো শুধু নয়, নিজেদের বেঁচে থাকা শুধু নয়, তাদের দুজনেরই এখন আহ্লাদি আছে। খাইয়ে পরিয়ে যত্নে রাখতে হবে তাকে, শ্বশুরঘরের কবল থেকে বাঁচাতে হবে তাকে, গাঁয়ের বজ্জাতদের নজর থেকে সামলে রাখতে হবে, কত দায়িত্ব তাদের, কত কাজ, কত ভাবনা।বাপ মা বেঁচে থাকলে আহ্লাদিকে হয়ত শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো, মাসি-পিসিও বিশেষ কিছু বলতো কি না সন্দেহ (আপনজনের কর্তৃত্ব পর দেখাতে পারে না)। কিন্তু তারা তো নেই, এখন মাসি-পিসিরই সব দায়িত্ব। বিনা পরামর্শে আপনা থেকেই তাদের ঠিক হয়েছিল, আহ্লাদিকে পাঠানো হবে না। আহ্লাদিকে কোথাও পাঠানোর কথা তারা ভাবতেও পারে না। বিশেষ করে ওই খুনেদের কাছে (জগুর পরিবার) কখনো মেয়ে তারা পাঠাতে পারে, যাবার কথা ভাবলেই মেয়ে যখন আতঙ্কে পাঁশুটে (ফ্যাকাশে/ বিবর্ণ) মেরে যায়?
বাপের ঘরদুয়ার জমিজমাটুকু আহ্লাদিকে বর্তেছে (উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া), জগুর বৌ নেবার আগ্রহও খুবই স্পষ্ট (জমির লোভ)। সামান্যই ছিল তার বাপের, তারও (জগুর) সিকিমতো আছে মোটে, বাকি গেছে গোকুলের কবলে। তবু মুফতে (বিনামূল্যে) যা পাওয়া যায় তাতেই জগুর প্রবল লোভ।
খালি ঘরে আহ্লাদিকে রেখে কোথাও যাবার সাহস তাদের হয় না। দুজনে মিলে যদি যেতে হয় কোথাও আহ্লাদিকে তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। মাসি বলে, ‘ডরাস্নি আহ্লাদি (সংসার ভাঙার ভয়)। ভাঁওতা (ফাঁকিবাজি/ চাপাবাজি/প্রতারণা) দিয়ে আমাদের দমাবার ফিকির সব। নয় তো কৈলেশকে দিয়ে ওসব কথা বলায় মোদের? (সাহস থাকলে জগু নিজে এমন হুমকি দিত)
পিসি বলে, “দুদিন বাদে ফের আসবে দেখিস জামাই (স্ত্রীর টানে)। তখন শুধোলে বলবে, কই না, আমি তো ওসব কিছু বলি নি কৈলেশকে (দোষ আড়ালের চেষ্টা)।
মাসি বলে, ‘চার মাসে পড়লি (অন্তঃসত্ত্বা), আর কটা দিন বা। মা-মাসির কাছেই রইতে হয় এ সময়টা, জামাই এলে বুঝিয়ে বলব (প্রচলিত নিয়ম)।
পিসি বলে, “ছেলের মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়, জানিস আহ্লাদি (কঠোর মনের পুরুষও নরম হয়ে যায়)। তোর পিসে ছিল জগুর মতো। খোকাটা কোলে আসতে কী হয়ে গেল সেই মানুষ। চুপি চুপি এসে এটা ওটা খাওয়ায়, উঠতে বলি তো ওঠে, বসতে বলি তো বসে (স্ত্রীর অনুগত)। মাসি বলে, তোর মেসো ঠিক ছিল, শাউড়ি ননদ ছিল বাঘ (নিষ্ঠুর আচরণ)। উঠতে বসতে কী ছ্যাঁচা খেয়েছি (মানসিক নির্যাতন) ভাবলে বুক কাঁপে।
কিন্তু জানিস আহ্লাদি, মেয়েটা যেই কোলে এল শাউড়ি ননদ যেন মোকে মাথায় করে রাখলে বাঁচে।
পিসি বলে, “তুইও যাবি, সোয়ামির ঘর করবি। ডরাসনি, ডর কীসের? (সংসার ভাঙার ভয় নেই)বাড়ি ফিরে দীপ জ্বেলে মাসি-পিসি রান্নাবান্না সারতে লেগে যায়। বাইরে দিন কাটলেও আহ্লাদির পরিশ্রম কিছু হয়নি, শুয়ে বসেই দিন কেটেছে। তবু মাসি-পিসির কথায় সে একটু শোয়। শরীর নয়, মনটা তার কেমন (অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে)? করছে। নিজেকে তার ছ্যাচড়া, নোংরা, নর্দমার মতো লাগে (অপরের আশ্রয়ে থাকায় আত্মমর্যাদায় লাগে)। মাসি-পিসির আড়ালে থেকেও সে টের পায় কীভাবে মানুষের পর মানুষ তাকাচ্ছে তার দিকে (খারাপ ইঙ্গিত), কতজন কতভাবে মাসি-পিসির সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছে তরিতরকারির মতো তাকেও কেনা যায় কি না যাচাই করবার জন্য (নামমাত্র টাকা দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব)। গাঁয়েরও কতজন তার কত রকমের দর দিয়েছে মাসি-পিসির কাছে। মাসি-পিসিকে চিনে (কঠোরতা দেখে) তারা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল, কিন্তু গোকুল হাল ছাড়েনি। (আহ্লাদিকে বিয়ের ব্যাপারে)
মাসি-পিসিকে পাগল করে তুলেছে গোকুল। মায়ের বাড়া (মায়ের চেয়ে অধিক যত্ন করে) তার এই মাসি-পিসি, কী দুর্ভোগ তাদের তার জন্য। মাসি-পিসিকে এত যন্ত্রণা দেওয়ার চেয়ে সে নয় শ্বশুরঘরের লাঞ্ছনা সইত, জগুর লাথি খেত। ঈষৎ তন্দ্রার ঘোরে শিউরে ওঠে (কেঁপে উঠে) আহ্লাদি।
একপাশে মাসি আর একপাশে পিসিকে না নিয়ে শুলে কি চলবে তার কোনোদিন? রান্না সেরে খাওয়ার আয়োজন করছে মাসি-পিসি, একেবারে ভাতটাত বেড়ে আহ্লাদিকে ডাকবে। ভাগাভাগি কাজ তাদের এমন সহজ হয়ে গেছে যে বলাবলির দরকার তাদের হয় না, দুজনে মিলে কাজ করে যেন একজনে করছে। এবার ব্যঞ্জনে (তরকারি) নুন দেবে এ কথা বলতে হয় না পিসিকে, ঠিক সময়ে নুনের পাত্র সে এগিয়ে দেয় মাসির কাছে। বলাবলি করছে তারা আহ্লাদির কথা, আহ্লাদির সুখদুঃখ, আহ্লাদির সমস্যা, আহ্লাদির ভবিষ্যৎ। জামাই যদি আসে, একটি কড়া কথা তাকে বলা হবে না, এতটুকু খোঁচা দেওয়া হবে না। (পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য) উপদেশ দিতে গেলে চটবে জামাই, পুরুষমানুষ তো যতই হোক, এটা করা তার উচিত নয়, এসব কিছু বলা হবে না তাকে।
জামাই এসেছে তাই আনন্দ রাখবার যেন ঠাঁই নেই এই ভাব দেখাবে মাসি-পিসি। আহ্লাদিকে শিখিয়ে দিতে হবে সোয়ামি এসেছে বলে যেন আহ্লাদে গদগদ (খুশির আবেগ প্রকাশ করে) হবার ভাব দেখায়। যে কদিন থাকে জামাই, সে যেন অনুভব করে, সে-ই এখানকার কর্তা, সে-ই সর্বেসর্বা (সবকিছুর প্রধান)।বাইরে থেকে হাঁক আসে কানাই চৌকিদারের। মাসি-পিসি পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, জোরে নিঃশ্বাস পড়ে দুজনের (ভয়ে)। সারাটা দিন গেছে লড়ে আর লড়ে (পরিশ্রম করে)। সরকারবাবুর সঙ্গে বাজারের তোলা (বাজারের খাজনা) নিয়ে ঝগড়া করতে অর্ধেক জীবন বেরিয়ে গেছে দু-জনের। এখন এল চৌকিদার কানাই।
হাঙ্গামা না আসে রাত্রে, গায়ে লোক যখন ঘুমোচ্ছে। রসুই চালায় (রান্নাঘর) ঝাঁপ এঁটে মাসি-পিসি বাইরে যায়। শুক্লপক্ষের একাদশীর উপোস করেছে (পুণ্যের আশায়) তারা দুজনে গতকাল। আজ দ্বাদশী, জ্যোৎস্না বেশ উজ্জ্বল।
কানাইয়ের সাথে গোকুলের যে তিনজন পেয়াদা এসেছে তাদের মাসি-পিসি চিনতে পারে, মাথায় লাল পাগড়ি-আঁটা লোকটা তাদের অচেনা।
কানাই বলে, ‘কাছারিবাড়ি যেতে হবে একবার (বিচারের জন্য)।
মাসি বলে, ‘এত রাতে?
পিসি বলে, ‘মরণ নেই?
কানাই বলে, ‘দারোগাবাবু এসে বসে আছেন বাবুর (সরকারবাবু) সাথে। যেতে একবার হবে গো দিদিঠাকরুনরা। বেঁধে নিয়ে যাবার হুকুম আছে।
মাসি-পিসি মুখে মুখে তাকায়। পথের পাশে ডোবার ধারে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় তিন-চারজন ঘুপটি মেরে আছে (আহ্লাদিকে অপহরণ করতে)। স্পষ্টই দেখতে পেয়েছে মাসি-পিসি। ওরা যে গাঁয়ের গুন্ডা সাধু বৈদ্য ওসমানেরা তাতে সন্দেহ নেই, বৈদ্যের ফেটি-বাঁধা বাবরি চুলওয়ালা মাথাটায় পাতার ফাঁকে জ্যোৎস্না পড়েছে। তারা যাবে কাছারিতে কানাই আর পেয়াদা কনস্টেবলের সঙ্গে। ওরা এসে আহ্লাদিকে নিয়ে যাবে।
মাসি বলে, “মোদের একজন গেলে হবে না কানাই? (বিচক্ষণতা প্রকাশ ও আহ্লাদির নিরাপত্তার জন্য)
পিসি বলে, আমি যাই চলো?
কর্তা ডেকেছেন দুজনকে। মাসি-পিসি দুজনেই আবার তাকায় মুখে মুখে। মাসি বলে, কাপড়টা ছেড়ে (কাপড় পরিবর্তন) আসি কানাই।’
পিসি বলে, ‘হাত ধুয়ে আসি, একদণ্ড লাগবে না।’
তাড়াতাড়িই ফিরে আসে তারা। মাসি নিয়ে আসে বঁটিটা হাতে করে, পিসির হাতে দেখা যায় রামদার মতো মস্ত একটা কাটারি। মাসি বলে, ‘কানাই, কত্তাকে বোলো, মেয়েনোকের এত রাতে কাছারিবাড়ি যেতে নজ্জা করে। কাল সকালে যাব।
পিসি বলে, এত রাতে মেয়েনোককে কাছারিবাড়ি ডাকতে কত্তার নজ্জা করে না কানাই?কানাই ফুঁসে ওঠে (উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায়)। না যদি যাও ঠাকরুনরা ভালোয় ভালোয়, ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার হুকুম আছে। কিন্তু বলে রাখলাম।
মাসি বঁটিটা বাগিয়ে ধরে (আক্রমণাত্মক ভঙ্গি) দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে, “বটে? ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে? এসো। কে এগিয়ে আসবে এসো। বঁটির এক কোপে গলা ফাঁক করে দেব।’
পিসি বলে, ‘আয় না বজ্জাত হারামজাদারা, এগিয়ে আয় না? কাটারির কোপে গলা কাটি দু-একটার।
দু-পা এগোয় তারা দ্বিধাভরে। মাসি-পিসির মধ্যে ভয়ের লেশটুকু না দেখে সত্যিই তারা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। (মাসি-পিসির দৃঢ়তা দেখে) মারাত্মক ভঙ্গিতে বঁটি আর দা উঁচু হয় মাসি-পিসির।
মাসি বলে, “শোনো কানাই, এ কিন্তু এর্কি (রসিকতা) নয় মোটে। তোমাদের সাথে মোরা মেয়েনোক পারব না জানি কিন্তু দুটো-একটাকে মারব জখম করব ঠিক (নিজেদের রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা)।
পিসি বলে, ‘মোরা নয় মরব। (আহ্লাদিকে রক্ষায় জীবনত্যাগ)
তারপর বিনা পরামর্শেই মাসি-পিসি হঠাৎ গলা ছেড়ে দেয়। প্রথমে শুরু করে মাসি, তারপর যোগ দেয় পিসি। আশপাশে যত বাসিন্দা আছে সকলের নাম ধরে গলা ফাটিয়ে তারা হাঁক দেয়, ও বাবাঠাকুর! ও ঘোষ মশায়! ও জনাদ্দন! ওগো কানুর মা! বিপিন! বংশী …’
কানাই অদৃশ্য হয়ে যায় দলবল নিয়ে (লোকজন চলে আসায়)। হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায় পাড়ায়, অনেকে ছুটে আসে, কেউ কেউ ব্যাপার অনুমান করে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয় বাইরে না বেরিয়ে।এই হট্টগোলের পর আরও নিঝুম আরও থমথমে মনে হয় রাত্রিটা (ভয় কাটে না)। আহ্লাদিকে মাঝখানে নিয়ে শুয়ে ঘুম আসে না মাসি-পিসির চোখে। বিপদে পড়ে হাঁক দিলে পাড়ার এত লোক ছুটে আসে, এমনভাবে প্রাণ খুলে এতখানি জ্বালার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলিভাবে গোকুল আর দারোগা ব্যাটার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে সাহস পায়, জানা ছিল না মাসি-পিসির। তারা হাঁকডাক শুরু করেছিল খানিকটা কানাইদের ভড়কে দেবার জন্যে, এত লোক এসে পড়বে আশা করেনি। তাদের জন্য যতটা নয়, গোকুল আর দারোগার ওপর রাগের জ্বালাই যেন ওদের ঘর থেকে টেনে বার করে এনেছে মনে হলো সকলের কথাবার্তা শুনে।
কেমন একটা স্বস্তি বোধ করে মাসি-পিসি (লোকজন সাথে থাকায়)। বুকে নতুন জোর পায়। মাসি বলে, ‘জানো বেয়াইন, ওরা ফের ঘুরে আসবে মন বলছে। এত সহজে ছাড়বে কি।’
পিসি বলে, তাই ভাবছিলাম।
মেয়েটাকে কুটুমবাড়ি সরিয়ে দেওয়ায় সোনাদের ঘরে মাঝরাতে আগুন ধরিয়েছিল সেবার (নিরাপত্তাহীনতার কারণে সোনারা আহ্লাদিকে অন্য বাড়িতে পাঠায়, ফলে তাদের ঘরে আগুন দেয়)। খানিক চুপচাপ ভাবে দুজনে। মাসি বলে, “সজাগ রইতে হবে রাতটা (সতর্কতা)।
পিসি বলে, তাই ভালো। কাঁথা কম্বলটা চুবিয়ে রাখি জলে, কী জানি কী হয়। (দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য)
আস্তে চুপি চুপি তারা কথা কয়, আহ্লাদির ঘুম না ভাঙে। অতি সন্তর্পণে তারা বিছানা ছেড়ে ওঠে। আহ্লাদির বাপের আমলের গোরুটা নেই, গামলাটা আছে। ঘড়া (বড় পিতলের কলসি) থেকে জল ঢেলে মোটা কাঁথা আর পুরনো ছেঁড়া একটা কম্বল চুবিয়ে রাখে, চালায় আগুন ধরে উঠতে উঠতে গোড়ায় চাপা দিয়ে নেভানো যাতে সহজ হয়। ঘড়ায় আর হাঁড়ি কলসিতে আরও জল এনে রাখে তারা ডোবা থেকে। বঁটি আর দা রাখে হাতের কাছেই। যুদ্ধের আয়োজন করে তৈরি হয়ে থাকে মাসি-পিসি। (বজ্জাতদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাসি-পিসির বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিরোধ) - পাঠ–পরিচিতি- “মাসি-পিসি” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার পূর্বাশা পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল ১৯৪৬)। পরে এটি সংকলিত হয় ‘পরিস্থিতি’ (অক্টোবর ১৯৪৬) নামক গল্পগ্রন্থে। বর্তমান পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে ঐতিহ্য প্রকাশিত মানিক-রচনাবলি পঞ্চম খণ্ড থেকে। স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার পিতৃমাতৃহীন এক তরুণীর করুণ জীবনকাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে। “মাসি-পিসি” গল্প। আহ্লাদি নামক ওই তরুণীর মাসি ও পিসি দুজনই বিধবা ও নিঃস্ব। তারা তাদের অস্তিত্বরক্ষার পাশাপাশি বিরূপ বিশ্ব থেকে আহ্লাদিকে রক্ষার জন্য যে বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করে সেটাই গল্পটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। অত্যাচারী স্বামী এবং লালসা-উন্মত্ত জোতদার, দারোগা ও গুন্ডা-বদমাশদের আক্রমণ থেকে আহ্লাদিকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে অসহায় দুই বিধবার দায়িত্বশীল ও মানবিক ও প্রশংসনীয়। দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী স্মৃতি, জীবিকা নির্বাহের কঠিন সংগ্রাম, নারী হয়ে নৌকাচালনা ও সবজির ব্যবসায় পরিচালনা প্রভৃতি এ গল্পের বৈচিত্র্যময় দিক।
- আরও পড়ুন- বায়ান্নর দিনগুলো