Skip to content

মামলুক শাসন (১২২৭-১২৮৫)- বঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস (২য় পর্ব)

মামলুকরা কীভাবে বঙ্গের ক্ষমতায় আসে?

  • ইওজ খলজির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৭ সাল পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লীর একটি প্রদেশে পরিগণিত হয়। এ সময় ১৫ জন শাসক বাংলা শাসন করেন। তাদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন দাস। দাসদের ‘মামলুক’ বলা হয়। এজন্য এই শাসনামলকে মামলুক শাসন বলে অভিহিত করা হয়। যদিও এই যুগের ১৫ জন শাসকের সকলেই তুর্কি বংশের ছিলেন। তাই একে তুর্কি যুগ বলাই যথার্থ।প্রথম তুর্কি শাসক ছিলেন নাসিরউদ্দীন মাহমুদ। ১২৩৬ সালে সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যুবরণ করলে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসন অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলার শাসকগণ এই সুযোগে বারবার বিদ্রোহ করে। দিল্লীর কর্তৃত্বের প্রতি বাংলার মামলুক শাসকবর্গের বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপের জন্য লখনৌতিকে বুলগাকপুর বা বিদ্রোহী নগরী নাম দেওয়া হয়েছিল। তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী রচিয়তা জিয়াউদ্দিন বারানি এই নামকরণ করেন। 

    বঙ্গদেশে বিদ্রোহের কারণ-

  • ক. দিল্লী বঙ্গদেশ থেকে অনেক দূরে ছিল। এছাড়াও যেগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত।
    খ. বঙ্গদেশ ছিল ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ।
    গ. বঙ্গের পরিবেশ দিল্লীর মানুষের অনুকূলে ছিল না।
    ঘ. দিল্লীর সেনাবাহিনী নৌ চালনায় অনভিজ্ঞ ছিল। অথচ বঙ্গ নদীতে ভরপুর ছিল।
    পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় হয়। বলবন স্বীয়পুত্র বুঘরা খানকে বঙ্গদেশের শাসক নিযুক্ত করে। 
  • নাসিরুদ্দিন মাহমুদ : তিনি ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র। তিনি গিয়াস খিলজিকে পরাজিত করে অযোধ্যার সাথে বাংলাকে একত্র করেছিলেন। মাত্র দেড় বছর বাংলা শাসন করেছিলেন। ১২২৯ সালে তিনি মারা যান। 
  • তুঘরল তুঘান খান : ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর দিল্লীতে গোলযোগ দেখা যায়। এ সুযোগে আওর খানী আইবক লখনৌতির ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বিহারের শাসনকর্তা তুগরল তুগান খান এ ক্ষমতা দখল মেনে নেন নি। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করে তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন এবং লখনৌতি ও বিহার একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন। সুলতান রাজিয়ার নিকট থেকে স্বীকৃতি নিয়ে তিনি স্বীয়ে অবস্থানকে বৈধ করে নেন। দিল্লীতে যখনই কোনো নতুন সুলতান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেন তখনই তিনি তার জন্য উপহার পাঠিয়ে সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। মামলুক শাসকদের মধ্যে তুঘরল খান অনেকটা নিরাপদেই দেশ পরিচালনা করেন। তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক দূরদর্শী ছিলেন। দিল্লীর আনুগত্য স্বীকার করে নিজ শাসন ঝামেলামুক্ত রেখেছেন।
    এ সময়ে তিনি পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী না হয়ে উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারে ব্রতী হন। এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি ত্রিহুতে (উত্তর বিহার) প্রথম সফল অভিযান করেন এবং ১২৪২ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম অভিমুখে অগ্রসর হন। দিল্লীতে ক্ষমতা নিয়ে সংশয় তাঁকে আরও সাহসী করে তোলে এবং তিনি কারা (এলাহাবাদ) পর্যন্ত অগ্রসর হন। সেখানেই তিনি সুলতান মাসুদ শাহের দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার খবর পান। তুগরল তুগান খানের উত্তর ভারতে ব্যস্ততার সুযোগে উড়িষ্যার রাজা প্রথম নরসিংহ দেব দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে লখনৌর পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং মুসলিম রাষ্ট্রে লুটতরাজ শুরু করে। অতএব কারা থেকে তিনি সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মূল্যবান উপঢৌকনসহ প্রতিনিধিদল দিল্লী পাঠান আর নিজে ঐতিহাসিক মিনহাজকে নিয়ে ১২৪৩ সালের জুন মাসে লখনৌতিতে ফিরে আসেন।দিল্লীর সুলতানের অনুমোদন লাভের পর তুগরল ১২৪৪ সালের এপ্রিল মাসে উড়িষ্যা বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদেরকে লখনৌ প্রায় সত্তর মাইল দক্ষিণে কাটাসিন সীমান্তের ওপারে বিতাড়িত করেন। তিনি উড়িষ্যা রাজ্যে অকস্মাৎ পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রান্ত হন। তবে তিনি নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করেন। উড়িষ্যা বাহিনী লখনৌর দখল করে এবং এর শাসককে হত্যা করে। এ পরিস্থিতিতে সামরিক সাহায্য চেয়ে তুগরল দিল্লীতে প্রতিনিধি পাঠান। সুলতান মাসুদ শাহ সাথে সাথে কারা-মানিকপুরের (এলাহাবাদ) শাসনক মালিক কারা কাশ খান ও অযোধ্যার শাসনক মালিক তমার খানকে তাঁদের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে তুগরল খানের সাহায্যে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেন। ইতোমধ্যে উড়িষ্যা বাহিনী মুসলিম রাজ্যের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এমনকি ১২৪৫ সালের মার্চ মাসে তারা লখনৌতির উপকণ্ঠে পৌঁছে। তুগরলের সাহায্যার্থে উত্তর ভারত থেকে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে উড়িষ্যার সৈন্যরা পালিয়ে যয়।
    উড়িষ্যা বাহিনী চলে যাওয়ার পর মালিক তমার খান লখনৌতির শাসন কর্তৃত্ব তার হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তুগরলের উপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং কয়েকটি সংঘর্ষে তাঁকে পরাজিত করেন। আরও কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের পর ঐতিহাসিক মিনহাজের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। চুক্তি অনুসারে তুগরল লখনৌতি ও বিহারের অধিকার তমার খানকে ছেড়ে দেন; বিনিময়ে তুগরলকে নির্বিবাদে তার ধনসম্পদ নিয়ে লখনৌতি ত্যাগ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
    ১২৪৫ সালের জুলাই মাসে তুগরল দিল্লী পৌঁছান। তমার খানের ঔদ্ধত্য প্রতিহত করার সামর্থ্য সুলতান মাসুদের ছিল না। পরবর্তী সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (ছোট) তুগরলকে তমার খানের সাবেক প্রদেশ অযোধ্যার শাসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছার পরপরই ১২৪৬ সালের জুন মাসে তুগরল খানের মৃত্যু হয়। বিস্ময়করভাবে একই দিনে তমার খানেরও লখনৌতিতে মৃত্যু হয়। 
  • জালালুদ্দিন মাসুদ জানি : তিনি ছিলেন অযোধ্যার শাসক। তিনি লখনৌতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। সীমান্ত অঞ্চলে তিনি রাজ্যসীমার বিস্তার ঘটান। যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করার পর তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে ‘সুলতানুল আজম মুঘীসুদ্দিন উযবক’ উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১২৫৭ সালে তিনি কামরূপ অভিযানে নিহত হন। 
  • মুঘিসউদ্দিন তুঘরল খান : মামলুক বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক মুঘিসউদ্দিন তুঘরল খান। তিনি উত্তর-পশ্চিম বাংলা ছাড়াও ঢাকা ও ফরিদপুরের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করেন। সোনারগাঁওয়ের নিকট তিনি নারকেল্লা নামে এক দুর্গ তৈরি করেছিলেন যা জনসাধারণের নিকট তুঘরিলের কেল্লা নামে পরিচিত। এ সময় দিল্লীর সুলতান বলবন রোগাক্রান্ত থাকায় এবং মোগল আক্রমণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তুঘরল বঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বলবন দুইবার সেনা পাঠিয়েও তুঘরলের নিকট পরাজিত হন। তুঘরল তাঁর সেনাবাহিনী ও শক্তিবলের উপর যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন। তবে ১২৮১ সালে বলবনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন তুঘরিল। বাংলার শাসনকরা বিদ্রোহ করে বলে এবার বলবন তাঁর ছেলে বুঘরা খানকে বাংলার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করেন। পরবর্তী ছয় বছর বাংলা দিল্লীর অধীনে ছিল। ১২৮৭ সালে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান ‘নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ’ নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। এ সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন বুঘরা খানের ছেলে কায়কোবাদ।
  • পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : বঙ্গে খলজি বংশের শাসন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page