সুলতান মাহমুদ গযনভির ভারত অভিযান

সুলতান মাহমুদ গযনি কেন ভারতে আক্রমণ করে?

  • সিন্ধু অভিযানের প্রায় ২৫০ বছর পর দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে আফগানিস্তানের সুলাইমান পার্বত্য অঞ্চলের গজনিতে আলপ্তগীন (৯৬২-৯৭৬) একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। ক্রমেই রাজ্যটির উত্থান ঘটে। গজনির ক্রমশ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আতংকিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজা জয়পাল গজনি আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁর গজনি জয়ের আশা ব্যর্থ হয়।

    ৯৭৭ সালে আলপ্তগীনের জামাতা নাসিরউদ্দিন সবুক্তগীন গজনির সিংহাসনে বসেন এবং তুর্কি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সামানিদ বংশের সম্রাটদের আনুগত্য মৌখিকভাবে স্বীকার করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাজত্ব পরিচালনা করতে লাগলেন। তাঁর সাথে রাজা জয়পালের সংঘর্ষ হয়। জয়পাল কাশ্মীর থেকে মুলতান এবং সিরহিন্দ থেকে লামঘান (জালালাবাদ) পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন।

    মাহমুদ
           মাহমুদ

    মাহমুদের ক্ষমতারোহণ-

    ৯৯৭ সালে আলপ্তগীন মারা গেলে বহু প্রতিকূলতার পর তাঁর বড় ছেলে মাহমুদ ক্ষমতায় আসেন। খোরাসানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে সামানি বংশের সাথে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়। ৯৯৮ সালে সামানিদের পরাজিত করে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন মাহমুদ। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা কাদির বিল্লাহ তাঁকে ‘ইয়ামিনউদ্দৌলা’‘আমিনুল মিল্লাত’ খেতাবে ভূষিত করেন। রাজা জয়পালের সাথে পিতার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মাহমুদের পররাষ্ট্রনীতিকে আগ্রাসী করে তোলে। জয়পালের মিত্রজোটকে শায়েস্তা করতে মাহমুদ ভারতবর্ষে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হন। সুলতান মাহমুদ মোট ১৭ বার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। যথা-

    গযনভি সাম্রাজ্য
     গযনভি সাম্রাজ্য
  • মাহমুদের সকল ভারত অভিযান-

  • ১ম অভিযান (১০০০ সাল) : লামঘান ও পেশোয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চল ও খাইবার গিরিপথে অবস্থিত ভারতের কিছু সীমান্তবর্তী দুর্গ ও শহর দখল করে নিজের রাজ্যের সীমান্ত সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেন।
  • ২য় অভিযান (১০০১ সাল) : জয়পালের বিরুদ্ধে পেশোয়ারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বিশাল বাহিনী থাকা সত্ত্বেও জয়পাল পরাজিত হয় ও বন্দি হয়। পরবর্তীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে জয়পাল পরিবারসহ মুক্তি পায়। এই অপমান সহ্য করতে না পেলে জয়পাল আত্মহত্যা করে। তার ছেলে আনন্দপাল পাঞ্জাবের সিংহাসনে বসে। সিন্ধুর তীরবর্তী উন্দ শহর মাহমুদের দখলে আসে।
  • ৩য় অভিযান (১০০৫ সাল) : ভীরা রাজ্যের রাজা বিজয় রায় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। বিজয় রায় পরাজিত হয় ও আত্মহত্যা করে। ভীরা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মাহমুদের দখলে আসে।
  • ৪র্থ অভিযান (১০০৬ সাল) : মাহমুদকে প্রতিহত করার জন্য মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ আনন্দপালের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। মাহমুদ মুলতানে অভিযান পাঠালে আনন্দপাল প্রতিরোধ করে। শেষ পর্যন্ত আনন্দপাল পরাজিত হয়ে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়। এরপর মুলতান অবরোধ করলে দাউদ বার্ষিক কর প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে বশ্যতা স্বীকার করে। মাহমুদ আনন্দপালের ছেলে নওয়াজ শাহকে (পূর্বনাম : সুখপাল) মুলতানের শাসক নিযুক্ত করে।
  • ৫ম অভিযান (১০০৭ সাল) : সুখপাল ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মুলতানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মাহমুদ তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। সুখপাল বার্ষিক ৪ লক্ষ দিরহাম কর ও যাবজ্জীবনে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।
  • ৬ষ্ঠ অভিযান (১০০৮ সাল) : আনন্দপাল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দিল্লী, কনৌজ, কাশ্মীরের খোক্কার জাতি প্রমুখ দল নিয়ে বিশাল জোট গঠন করে। উন্দ নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হয়। আনন্দপালের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়
  • ৭ম অভিযান (১০০৯ সাল) : মাহমুদ নগরকোট বিজয় করে। এর ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে অভিযানের দ্বার উন্মুক্ত হয়। পাঞ্জাবের রাজাদের নৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
  • ৮ম অভিযান (১০১০ সাল) : মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ দাউদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়। আবুল ফতেহ মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
  • ৯ম অভিযান (১০১৪ সাল) : আনন্দপালের হৃত রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশায় মারা যায়। তার ছেলে ত্রিলোচন পাল নন্দনায় রাজধানী স্থাপন করে। ত্রিলোচন সংঘবদ্ধ সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মাহমুদের অতর্কিত আক্রমণে ত্রিলোচন পরাজিত হয়ে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়। নন্দনা দুর্গ মাহমুদের দখলে আসে।
  • ১০ম অভিযান (১০১৪ সাল) : থানেশ্বর বিজয় হয়।
  • ১১তম অভিযান (১০১৫-১৬ সাল) : কাশ্মীর বিজয়ের জন্য দুইবার চেষ্টা করলেও মাহমুদ ব্যর্থ হয়।
  • ১২তম অভিযান (১০১৮ সাল) : কনৌজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। একদিনেই কনৌজের ৭টি দুর্ভেদ্য দুর্গ দখল করে কনৌজ জয়লাভ করে। মথুরা মুসলমানদের দখলে আসে।
  • ১৩তম অভিযান (১০১৯ সাল) : প্রজতিহাররা রাজ্যপাল মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করায় রাজপুতদের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি জয়। গোয়ালিয়র ও কালিঞ্জরের সমন্বিত বাহিনী রাজ্যপালকে আক্রমণ করে। রাজ্যপাল নিহত হয়। মাহমুদ কালিঞ্জর দখল করে।

    ভারতের মানচিত্র
    ভারতের মানচিত্র
  • ১৪তম অভিযান (১০২১-২২ সাল) : গোয়ালিয়র রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। গোয়ালিয়রের রাজা মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করে।
  • ১৫তম অভিযান (১০২৩ সাল) : কালিঞ্জরের নন্দা রাজার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। রাজা বার্ষিক কর প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে আত্মরক্ষা করে।
  • ১৬তম অভিযান (১০২৫ সাল) : গুজরাটের সোমনাথ মন্দির মুসলমানদের দখলে আসে।
  • ১৭তম অভিযান (১০২৭ সাল) : সুলতান মাহমুদের বাহিনী জাঠদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি জাঠদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক জাঠরা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয় এই অভিযানে।
  • সুলতান মাহমুদ ৯৯৭-১০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি ইরানের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হন। এছাড়া হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিমাংশে তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি হিন্দুস্তানের ভূখণ্ড নিজের শাসনাধীনে নেন নি। সুলতান মাহমুদের প্রিয়তম দাস ছিলেন আইয়াজ। শাহনামা রচিয়তা ফেরদৌসি ও জ্যোতির্বিদ আল-বেরুনি তাঁর রাজসভার সদস্য ছিলেন।
  • ইউটিউবে এই সংক্রান্ত আলোচনা দেখতে এখানে ক্লিক করুন-
  • পূর্বের আলোচনা দেখুন- মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযান

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart

You cannot copy content of this page

Scroll to Top