Skip to content

লালসালু উপন্যাসের মূলকথা

 লালসালু উপন্যাসের মূলভাব
লালসালু উপন্যাসের মূলভাব

লালসালু উপন্যাসের সারাংশ

  • লালসালু একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয় যুগ-যুগ ধরে শেকরগাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সাথে সুস্থ জীবন আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণ সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস। কাহিনিটি ছোট, সাধারণ ও সামান্য; কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন।শ্রাবণের শেষে নিরাক-পড়া এক মধ্যাহ্নে মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশের নাটকীয় দৃশ্যটির মধ্যেই রয়েছে তার ভণ্ডামি ও প্রতারণার পরিচয়। মাছ শিকারের সময় তাহের ও কাদের দেখে মতিগঞ্জ সড়কের ওপর একটি অপরিচিত লোক মোনাজাতের ভঙ্গিতে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পরে দেখা যায়, ঐ লোকটিই গ্রামের মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে সমবেত গ্রামের মানুষকে তিরস্কার করছে, “আপনারা জাহেল, বেএলম, আনপাড়হ। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?”

    অলৌকিকতার অবতারণা করে মজিদ নামের ঐ ব্যক্তি জানায়, পীরের স্বপ্নাদেশে মাজার তদারকির জন্য  এ গ্রামে তার আগমন। তার তিরস্কার ও স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে গ্রামের মানুষ ভয়ে ও শ্রদ্ধায় এমন বিগলিত হয় যে তাঁর প্রতিটি হুকুম গভীর আগ্রহে গ্রামবাসী পালন করে। গ্রামপ্রান্তের বাঁশঝাড় সংলগ্ন কবরটি দ্রুত পরিচ্ছন্ন করা হয়। ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয় কবর। তারপর আর মজিদের পিছু ফেরার অবকাশ থাকে না। কবরটি অচিরেই মাজারে এবং মজিদের শক্তির উৎসে পরিণত হয়। যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; ভক্ত আর কৃপাপ্রার্থীরা সেখানে টাকা পয়সা দিতে থাকে প্রতিদিন। কবরটি এক মোদাচ্ছের পীরের বলে শনাক্তকরণের মধ্যেও থাকে মসজিদে সুগভীর চাতুর্য। মোদাচ্ছের কথাটির অর্থ নাম-না-জানা (যদিও বাস্তবিকে মোদাচ্ছের অর্থ চাদর পরিহিত ব্যক্তি)। মজিদের সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া মজিদ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বহুকাল ধরে বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গ্রামীণ সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি যথাযথভাবেই এখানে তুলে ধরেছেন।
  • মাজারের আয় দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়ে বসে এবং তার মনোভূমির এক অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় শক্ত-সমর্থ লম্বা চওড়া একটি বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে। আসলে স্ত্রী রহিমা ঠান্ডা ও ভীতু মানুষ। তাকে অনুগত করে রাখতে কোনো বেগ পেতে হয় না মজিদের। কারণ, রহিমার মনেও রয়েছে গ্রামবাসীর মত তীব্র খোদাভীতি। স্বামী যা বলে, রহিমা তাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। রহিমার বিশ্বাস তার স্বামী অলৌকিক শক্তির অধিকারী। প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি মজিদ সমাজেরও কর্তা-ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আদেশ-উপদেশ দেয়, গ্রাম্য বিচার-সালিশিতে সে-ই হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি। এক্ষেত্রে মাতব্বর খালেক ব্যাপারী তার সহায়ক শক্তি। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর পারিবারিক জীবনেও নাক গলাতে থাকে সে। তাহেরের বাপ-মার মধ্যকার একান্ত পারিবারিক বিবাদকে কেন্দ্র করে তাহেরের বাপের কর্তৃত্ব নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে।
  • নিজ মেয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাধে হুকুম করে মেয়ের কছে মাফ চাওয়ার এবং সেই সাথে মাজারে পাঁচ পয়সার সিন্নি দেয়ার। অপমান সহ্য করতে না পেরে তাহেরের বাপ শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়। খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় অধীর হয়ে মজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী পীরের প্রতি আস্থাশীল হলে মজিদ তাকেও শাস্তি দিতে পিছপা হয় না। আমেনার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে খালেক ব্যাপারীকে দিয়ে আমেনাকে তালাক দিতে বাধ্য করে। কিন্তু তবু মাজার ও মাজারের পরিচালক ব্যক্তিটির প্রতি আমেনা বা তার স্বামী কারুরই কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয় না।
    গ্রামবাসী যেন আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবন ধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সে জন্য যে শিক্ষিত যুবক আক্কাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রাম, সমাজ ও মানুষের বাস্তব-চিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযোজন।
  • লালসালুর প্রধান উপাদান সমাজ বাস্তবতা। গ্রামীণ সমাজ এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থবির, যুগযুগ ধরে এখানে সক্রিয় এই অদৃশ্য শৃঙ্খল। এখানকার মানুষ ভাগ্য ও অলৌকিকত্ব গভীরভাবে বিশ্বাস করে। দৈবশক্তির লীলা দেখে নিদারুণ ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে নয়ত ভক্তিতে আপ্লুত হয়। কাহিনির উন্মোচন-মুহূর্তেই দেখা যায়, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি। যেখানে বাচ্চাকাল থেকেই তাদের আমসিপারা শেখানো হয়। শস্য যা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। সুতরাং ঐ গ্রাম থেকে ভাগ্যের সন্ধানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে-গ্রামে গিয়ে বসতি নির্মাণ করতে চায় সেই গ্রামেও একইভাবে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের জয়-জয়কার। এ এমনই এক সমাজ যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবলই শোষণ আর শোষণ- কখনো ধর্মীয়, কখনো অর্থনৈতিক। প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শেকড় জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পরতে পরতে ছড়ানো। আর ঐ সব শেকড় দিয়ে প্রতিনিয়ত শোষণ করা হয় জীবনের প্রাণরস। আনন্দ, প্রেম, প্রতিবাদ, সততা- এই সব বোধ ও বুদ্ধি ঐ অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা সমাজের ভেতরে প্রায়শ ঢাকা পড়ে থাকে। এই কাজে ভূস্বামী, জোতদার ও ধর্মব্যবসায়ী একে অপরের সহযোগী। কারণ স্বার্থের ব্যাপারে তারা একাট্টা- পথ তাদের এক। একজনের আছে মাজার, অন্যজনের আছে জমিজোত প্রভাব প্রতিপত্তি। দেখা যায়, অন্য কোথাও নয় আমাদের চারপাশেই রয়েছে এরূপ সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে সমাজের ভেতর ও বাইরের চেহারা যেন এরূপ একই রকম।
  • লালসালু হচ্ছে লাল রঙের কাপড়। এমনিতে লাল কাপড়ের কোনো মহিমা নেই। তবে এটি খুব উজ্জ্বল রং হওয়ায় একে বিশেষ কাজে লাগানো যায়। বাংলাদেশের এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী যুগ-যুগ ধরে লাল রংটিকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। কবরের উপর লাল কাপড় বিছিয়ে দিলে কবরের গুরুত্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন তা সাধারণ কবরে সীমাবদ্ধ থাকে না, মাজারে পরিণত হয়। কবরটি তখন মানুষের ভক্তি প্রীতির আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের কবরে মানুষ প্রতিনিয়ত ভিড় জমায়, জিয়ারত করে, দোয়া দুরুদ পড়ে ও শিরনি দেয়।
  • পরবর্তী আলোচনা পড়ুন- লালসালু উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ

 শীটগুলো পেতে অর্ডার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page