মুসলিম ও খ্রিস্টানের মধ্যে বিতর্ক
- সূরা আল-ইমরানের ৬১ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম রাজি বলেন, “আমি খাওয়ারিযম শহরে বসবাস কালে শুনলাম, জনৈক খ্রিস্টান পণ্ডিত এই শহরে বাস করে। সুতরাং আমি তার কাছে গিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হই।খ্রিস্টান পণ্ডিত : মুহাম্মদের (স) এর নবুওতের প্রমাণ কী?
আল্লামা রাযী : মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীদের মুজিযাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঠিক তেমনি মুহাম্মদের মুজিযাগুলোও অগণিত মানুষের দ্বারা সূত্র পরম্পরায় আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে। এখন দুটো কাজ করা যেতে পারে-
ক. আমরা অগণিত মানুষ থেকে বর্ণিত এই মুজিযাগুলো সত্য বলে স্বীকার করবো না। অথবা এগুলো স্বীকার করে বলবো যে, কারো নবিত্ব প্রমাণের জন্য এইগুলো যথেষ্ট নয়। তাহলে ঈসা-মূসাসহ সবার নবিত্ব বাদ হয়ে যাবে।
খ. আমরা সবার মুজিযাগুলো স্বীকার করবো। তাহলে ঈসা-মুসাসহ সবার নবিত্ব প্রমাণিত হবে।খ্রিস্টান : আমি বলছি না, যীশু নবী ছিলেন। বরং আমি বলছি, তিনি খোদা ছিলেন।
রাজী : আপনার কথাটা বাতিল তা বিভিন্নভাবে প্রমাণ করা যায়। যথা-১. নবুওতের কথা বুঝার আগে খোদাকে চিনতে হয়। আপনার কথা বাতিলের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, খোদা হচ্ছে অনাদি-অনন্ত অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা। কিন্তু যীশু হলেন মানবীয় দেহের অধিকারী আদি ও অন্ত পরিবর্তনশীল সত্ত্বা। এবার আপনাদের মতানুসারেই তিনি নিহত হন। প্রথমে কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ এভাবে পরিবর্তিত হন। সুতরাং যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছেন, তিনি কখনো খোদা হতে পারেন না।২. আপনার বক্তব্যের দ্বিতীয় অসারতা : আপনাদের মতে যীশুকে ইহুদীরা শুলে চড়িয়েছে। তাঁর জামা-কাপড় ছিড়ে ফেলে। তিনি তাদের থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। যীশু যদি সত্য খোদা হতেন বা খোদার কোনো সত্ত্বা তার মাঝে থাকত তবে কেন তিনি নিজের আত্মরক্ষা করতে পারলেন না?
৩. যীশু ঈশ্বর বলতে আপনরা কী বোঝেন। হয় বলবেন, এই মানবদেহটিই ঈশ্বর অর্থাৎ স্বয়ং খোদা দুনিয়াতে এসেছেন। …অথবা বলবেন, ঈশ্বরের সত্ত্বার একটি বা আংশিক পৃথিবীতে এসেছে। এই সব কথাই ভুল। কারণ-
ক. যদি মনে করেন, খোদার পুরো সত্ত্বাই যীশুর মধ্যে আছে। তাহলে প্রমাণিত হবে যে, ইয়াহুদীরা যীশুকে হত্যা করে বিশ্বের স্রষ্টাকেই মেরে ফেলেছে। তবে খোদা ছাড়া পৃথিবী চলছে কিভাবে?
আর এটা প্রমাণিত যে, ইহুদীরা হলো সবচেয়ে দুর্বল ও লাঞ্চিত জাতি। সেই জাতি যে খোদাকে মারতে পারে, সেই খোদা কত না অসহায়!
খ. খোদার সব সত্ত্বা যদি যীশুর দেহে রূপান্তর হয়, তবে সেটাও ভুল ধারণা। কারণ খোদা হলো নিরাকার, আর যীশু সাকার। তো নিরাকার যদি সাকারে আসে,তবে তো খোদার রূপই পরিবর্তন হয়ে গেল।
গ. যদি বলেন, খোদার আংশিক তার মাঝে ছিলো। এটাও ভুল।কারণ, খোদার যেই অংশটা যীশুর মধ্যে ছিলো, সেটা কি খোদার জন্য প্রয়েজনীয় না অপ্রয়োজনীয়? যদি বলেন প্রয়োজনীয়, তবে প্রশ্ন হবে সেই প্রয়োজনীয় অংশ ছাড়া খোদা থাকলেন কিভাবে? মূল ঈশ্বর তো ঈশ্বরত্ব হারাবেন।
আর যদি বলেন অপ্রয়োজনীয়, তবে প্রশ্ন হবে এই অপ্রয়োজনীয় অংশ খোদা নিজের সাথে রাখলেন কেন (যীশুর আগে)? আর যদি তা অপ্রয়োজনীয় হয়, তবে তাকে ঈশ্বরের অংশ বলা যায় না।
ঘ. আমরা জেনেছি যে যীশু ইবাদত-বন্দেগিতে নিষ্ঠাপ্রাণ ছিলেন। বিষয়টি সবাই জানেন। যদি তিনি ঈশ্বর হতেন, তবে তা কখনোই সম্ভব হত না। কারণ খোদা নিজেকে বা অন্য খোদার উপাসনা করে না।আল্লামা রাজী : এবার আমি তাকে বললাম, যীশুর খোদায়িত্বের প্রমাণ কী?
খৃস্টান : তার প্রমাণ হলো, তিনি অনেক মুজিযা দেখিয়েছেন। মৃতকে জীবিত করেছেন, কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেছেন। ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছাড়া এগুলো অসম্ভব।
রাজী : আমি বললাম, আপনি স্বীকার করেন যে, প্রমাণের অনুপস্থিতি দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণিত হয় না।….অর্থাৎ. যিশুর দেহে খোদার অবস্থান প্রমাণিত, তাই তাকে খোদা বলছেন। কিন্তু আমার আপনার দেহের মাঝে খোদা অবতরণ করেন নি, তা কিভাকে জানলেন??
খ্রিস্টান : এটা খুব স্পষ্ট। তাঁর দ্বারা মুজিযা প্রকাশ পেয়েছে আর আমাদের দ্বারা তা পায় নি।
রাজী : আমার মনে হয় আপনি ‘প্রমাণের অনুপস্থিতি দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণিত হয় না’ কথাটি বুঝতে পারেন নি।যীশুর অলৌকিক কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, তিনি ঈশ্বর। কারণ তা প্রমাণিত। আমার আপনার দ্বারা এই সব অলৌকিক কাজ প্রমাণিত না হওয়ায় আমাদের ঈশ্বরত্ব অপ্রমাণিত রয়ে গেলো। কিন্তু দেখুন, আমাদের ঈশ্বরত্ব অপ্রমাণিত রইলেও আমাদের মাঝে ‘ঈশ্বর না হওয়ার’ সম্ভাবনা কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি। অর্থাৎ যীশুর প্রমাণ পাওয়া গেছে তাই তিনি ঈশ্বর। কিন্তু আমার-আপনার ঈশ্বরত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নি কিন্ত ঈশ্বর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা কেবল প্রমাণের অপেক্ষায়।
আরেকটা জিনিস, মানব বুদ্ধিতে বিচার করলে প্রাণহীণ লাঠিকে সাপে রূপান্তর করা মৃত মানুষ জীবিত করার চেয়েও কঠিন। কারণ মৃত মানুষকে তো প্রাণ দেয়া হলো কেবল, দেহ তো দিতে হয় নি। কিন্তু লাঠির ক্ষেত্রে প্রাণ ও দেহ উভয়টিই দিতে হয়। তবে সে কেন খোদা হবে না?
এই কথা শূনে পণ্ডিত লা জওয়াব হয়ে গেলেন। তার কিছুই বলার থাকলো না। (ইজহারুল হক, দ্বিতীয় খণ্ড)