ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন
-
ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রধান প্রতিবন্ধতা-
- ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ কর্তৃত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের সাথে সাথে উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম অধ্যায়ের সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটে। উপমহাদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের পথে ইংরেজদের তিনটি প্রধান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যথা-
ক. মহীশূর রাজ্যের হায়দর ও টিপু সুলতান
খ. মারাঠাদের সাম্রাজ্য বিস্তার
গ. রণজিৎ সিংহের শিখ শক্তি
পর্যায়ক্রমে সব বাধা অতিক্রম করে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে গভর্নর পদের মাধ্যমে বাংলায় শাসন শুরু করে। বাংলার প্রথম গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ। কিন্তু ১৭৭৩ সালে পাশ হওয়া রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে বাংলার ‘গভর্নর’ পদটি ‘গভর্নর জেনারেলে’ রূপান্তর হয়। বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে বাংলা গভর্নর জেনালের পদটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ভারতের গভর্নর জেনারেল’ নামকরণ হয়। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। ১৮৫৮ সালে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পরে ‘ভারতের গভর্নর জেনারেল’ পদের নাম পরিবর্তন করে ‘ভারতের ভাইসরয়’ রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভাইসরয়দের নিযুক্ত করতেন। ভারতের প্রথম ভাইসরয় ছিলেন লর্ড ক্যানিং।
-
ওয়ারেন হেস্টিংস-
- আঠারো বছর বয়সে তিনি কলকাতায় কোম্পানির একজন কেরানি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ে কাশিম বাজারের ‘রেসিডেন্ট’ পদে উন্নীত হন। তাঁর শাসনকালকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
প্রথম পর্ব : ১৭৭২-১৭৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন।
দ্বিতীয় পর্ব : ১৭৭৪-১৭৮৫ সাল পর্যন্ত গভর্নর জেনালের ছিলেন। -
সীমান্ত নীতি-
- গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়ে হেস্টিংস প্রথমেই সীমান্ত নীতি বিষয়ে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি লক্ষ করেন যে উপমহাদেশে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব স্থায়ী করতে হলে দেশীয় রাজাদের যথাসম্ভব ব্রিটিশ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল করতে হবে। এজন্য তিনি ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ নীতির সূচনা করেন যা পরবর্তীরা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে। তিনি মারাঠাদের আশ্রয়ে বাস করার অজুহাতে সম্রাট শাহ আলমকে দেওয়া বার্ষিক ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বন্ধ করে দেন এবং সম্রাটের নিকট হতে ‘বারানসির সন্ধি’ দ্বারা এলাহাবাদ ও কারা জেলা অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাকে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রদান করেন। এভাবে তিনি অযোধ্যার শক্তি বাড়িয়ে একে মারাঠা ও ইংরেজদের মধ্যে একটি শক্তিশালী বাফার স্টেট হিসেবে গড়ে তুলেন।
-
রোহিলা যুদ্ধ-
- বর্তমান যুক্ত প্রদেশের অধিবাসীগণ রোহিলা আফগান নামে পরিচিত ছিল। তাদের সাথে নবাব সুজাউদ্দৌলার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ১৭৭৪ সালে ইংরেজ বাহিনীর সাহায্যে সুজাউদ্দোলা রোহিলাদের পরাজিত করে রোহিলাখণ্ড দখল করে।
-
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ-
- তাঁর আমলে মারাঠাদের উত্তরাধিকার নিয়ে ইংরেজদের হস্তক্ষেপের কারণে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ হয়। তিনি মারাঠা সর্দার রঘুনাথ রাওয়ের পক্ষ নেন। তেলেগাঁয়ের যুদ্ধে ইংরেজরা পরাজিত হয় এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াড়গাঁও সন্ধি মোতাবেক তারা বিজিত রাজ্যগুলো মারাঠাদের নিকট ফেরত দিতে রাজী হয়। কিন্তু তিনি এ সন্ধি অস্বীকার করে সেনাপতি গর্ডাডের সহায়তায় আহমেদ নগর ও বেসিন দখল করেন। পুনার যুদ্ধে মারাঠাদের নিকট গর্ডাড পরাজিত হলেও সেনাপতি পপহামের নেতৃত্বে ইংরেজরা গোয়ালিয়ার দুর্গ দখল করে। অবশেষে ১৭৮২ সালে ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে ‘সলবাই সন্ধি’ স্বাক্ষর হয়। এই সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা মারাঠাদের বিশ বছর নিষ্ক্রিয় রাখে।
-
ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ-
- মহীশূরের রাজা কৃষ্ণরায়কে নামমাত্র ক্ষমতায় রেখে তাঁর মন্ত্রী নানরাজ ও ভাই দেবরাজ ক্ষমতা দখল করে। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান হায়দর আলী পরবর্তীতে নানরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসেন এবং মহীশূরকে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন। ইংরেজ-মারাঠা-নিজাম এ তিন শক্তি সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের সম্মিলিত বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে হায়দর কূটনীতি দ্বারা মারাঠা ও নিজামকে ইংরেজপক্ষ ত্যাগ করিয়ে নিজ পক্ষে আনতে সক্ষম হন। ফলে হায়দরের নিকট বোম্বাই ও মাদ্রাজে ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়। ১৭৬৯ সালে ‘মাদ্রাজ সন্ধি’ দ্বারা প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটে। উভয়পক্ষ একে অন্যের দখলকৃত রাজ্য ও যুদ্ধবন্দী ফেরত দিতে সম্মত হয়।
-
দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধ-
- পরবর্তীকালে ইংরেজরা চুক্তিভঙ্গ করে। ১৭৭৮ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্র ধরে ইংরেজরা ফরাসিদের মাহে বন্দরটি দখল করে যা মহীশূর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে হায়দর নিজামের সাথে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৭৮২ সালে তাঁর মৃত্যু হলে পুত্র টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৭৮৪ সালে ইংরেজ ও টিপু সুলতানের মধ্যে সম্পাদিত ‘ব্যাঙ্গালোর সন্ধির’ মাধ্যমে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটে।
-
অর্থনৈতিক সংস্কার-
- রাজস্ব আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থার সংস্কার তাঁর অন্যতম সাফল্য। তিনি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে শাসন ও রাজস্ব বিভাগ কোম্পানির অধীনে স্থাপন করেন।
নায়েব দেওয়ান পদ বিলোপ করা হয়। রাজকোষ মুর্শিদাবাদ হতে কলকাতায় স্থানান্তর করে একটি রাজস্ব বোর্ড গঠন করেন। রাজস্ব খাতে আয় বৃদ্ধির জন্য ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’ চালু করেন। পরে তিনি একাসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। -
বাণিজ্য সংস্কার-
- তিনি কোম্পানির কর্মচারীদের বিনা শুল্কে ব্যক্তিগত বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। দস্তক প্রথা আইনত লোপ পায়। তিনি কলকাতা, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা ও পাটনা ছাড়া সমস্ত শুল্ক চৌকি বন্ধ করে দেন। ফলে জমিদারগণ শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা হারায়।
-
বিচার ব্যবস্থার সংস্কার-
- তিনি মোগল বিচার ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে একটি সুশৃঙ্খল বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বিচার ব্যবস্থায় তিনি ইউরোপীয় আইন চালু করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি কোম্পানির বাণিজ্য বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পথক রাখেন যাতে শাসনকাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। তিনি বিচার বিভাগকে রাজস্ব বিভাগ থেকে পৃথক করে প্রত্যেক জেলায় একটি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন। তিনি ‘সদর দেওয়ানি আদালত’ ও ‘সদর নেজামত আদালত’ নামে দুটি উচ্চ আদালত স্থাপন করেন। দেওয়ানি আদালত গভর্নর ও তাঁর পরিষদের দুজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। ফৌজদারি আদালতের প্রধান ছিলেন নবাব বা নাজিম।
-
রেগুলেটিং অ্যাক্ট-
- উপমহাদেশে কোম্পানির যাবতীয় কাজ প্রথমে ইংল্যান্ডের বোর্ড অব ডাইরেক্টরস পরিচালনা করত। পরবর্তীতে শাসন কাজে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ বিশৃংখলা দূর করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উপমহাদেশের শাসন কাজে হস্তক্ষেপ করে। তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ ১৭৭৩ সালে উপমহাদেশের জন্য ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ পাশ করেন। যার কারণে বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে ব্রিটিশ সরকারের নিকট কোম্পানির শাসন ও রাজস্ব সম্পর্কে সকল তথ্য পাঠাতে হত। বাংলার গভর্নরকে গভর্নর জেনারেল আখ্যা দেয়া হয়। তাঁকে সাহায্য করার জন্য চার সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘কাউন্সিল’ গঠিত হয়। এই অ্যাক্ট অনুসারে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন।
- চার্টার অ্যাক্ট (১৭৮৪) : হেস্টিংস ও প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থের উদ্যোগে চার্টার অ্যাক্ট পাশ হয়। এ আইনে সুপ্রিম কোর্ট ও গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়।
- পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট (১৭৮৪) : এ আইন দ্বারা পার্লামেন্ট উপমহাদেশে শাসনের সকল ক্ষমতা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সরকারের নিযুক্ত ৬ জন ও ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার ১ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোলের’ উপর উপমহাদেশ শাসন ও পর্যবেক্ষণের ভার অর্পিত হয়। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এছাড়াও কোম্পানির তিনজন ডাইরেক্টর নিয়ে একটি ‘সিক্রেট কমিটি’ গঠিত হয়।
- শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক : তাঁর আমলে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা (১৭৮১) প্রতিষ্ঠিত হয়। গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় চার্লস উইলকিন্স বাংলায় ছাপাখানা স্থাপন করেন।
- পদত্যাগ : হেস্টিংসের কার্যকালের শেষদিকে ইংল্যান্ডে তাঁকে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ১৭৮৫ সালে হেস্টিংস পদত্যাগ করে দেশে ফিরে যান। সাত বৎসর বিচার চলার পর তিনি অভিযোগ হতে মুক্ত হলেন বটে কিন্তু মামলার ব্যয় সংকুলান করতে গিয়ে তিনি একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
-
লর্ড কর্নওয়ালিস –
- ওয়ারেন হেস্টিংস পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে স্যার জন ম্যাকফারসন এক বৎসর অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল হিসেবে কাজ করেন। ইংল্যান্ডের জনগণ স্থির করে যে, কোম্পানির দুর্নীতিবাজ লোককে গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত করা যাবে না।
ফলে ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের সেনাপতি ছিলেন। তাঁকে প্রয়োজনে শাসন পরিষদের মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তিনি রাজ্য বিস্তরের চেয়ে বিজিত রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। - প্রশাসনিক সংস্কার : তিনি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করে ব্যক্তিগত বাণিজ্য কিংবা অবৈধ পথে উপার্জন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ‘কর্নওয়ালিস কোড’ নামে কতগুলো নিয়ম চালু করেন। তিনি কোম্পানির কমচারীদের কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন করে ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের’ ঐতিহ্য গঠনে সাহায্য করেন।
- বিচার সংস্কার : তিনি রাজস্ব ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করে পৃথক কর্মচারীদের উপর এর দায়িত্ব দেন। আগে কালেক্টররা রাজস্ব আদায়ের সাথে সাথে বিচার পরিচালনা করতেন। তিনি কালেক্টরদের কাজ কেবল রাজস্ব সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। তিনি দিওয়ানি বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন আদালত দেশীয় মুনসেফ ও সদর আমিনের অধীনে স্থাপন করেন। প্রতি জেলায় একটি করে জেলা-কোর্ট স্থাপন করা হয়। জেলা কোর্টগুলো এক একজন ইংরেজ জজের অধীনে ছিল এবং তাঁরা এদেশীয় আইনজ্ঞদের সাহায্যে বিচার করতেন। নিম্ন আদালত হতে আপিলের জন্য তিনি কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, পাটনা ও ঢাকায় চারটি প্রাদেশিক আদালত স্থাপন করেন। দিওয়ানি বিচারের সর্বোচ্চ বিচারালয় সদর দিওয়ানি আদালত নামে পরিচিত ছিল। গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলের সদস্যরা এর বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
- ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা : ফৌজদারি মোকদ্দমার বিচারের জন্য সর্বোচ্চ আদালত ‘সদর নিজামত আদালত’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি এই আদালত কলকাতায় স্থানান্তর করেন। ফৌজদারি বিচারের জন্য তিনি চারটি ‘সেশন আদালত’ স্থাপন করেন। এই আদালত নিজ নিজ জেলাগুলোতে ঘুরে ঘুরে ফৌজদারি মোকদ্দমার বিচার করত বলে এদের ‘ভ্রাম্যমান আদালত’ বলা হত। ভ্রাম্যমান বিচারালয়ের বিচারকগণ বছরে দু’বার করে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে স্থানীয় ফৌজদারি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন।
- বাণিজ্য ব্যবস্থা : তিনি কোম্পানির স্বার্থে সরাসরি দেশীয় বণিকদের নিকট থেকে মালামাল সংগ্রহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে আদেশ দেন। কোম্পানির কর্মচারীরা দেশীয় বণিকদের উপর অত্যাচার করত। তিনি দেশীয় বণিকদের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য আদেশ দেন।
- পুলিশ ব্যবস্থা : তিনি প্রদেশগুলোকে জেলায় এবং জেলাগুলোকে থানায় বিভক্ত করেন। প্রতি থানায় একজন করে এদেশীয় দারোগা নিযুক্ত করা হয়। জেলার সর্বময় কর্তা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং তাঁর উপর পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব ছিল। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেট জেলার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। জমিদারদের রক্ষিবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়।
- ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলের ভূমি রাজস্ব সংস্কার একটি গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। এ ব্যবস্থার ফলে জমিদাররা নিয়মিত কর প্রদান সাপেক্ষে স্থায়ীভাবে জমির মালিক হয়ে যায় এবং তাদের করের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তবে এর ফলে কৃষকদের দুর্দশা বেড়ে যায় ও জমির উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
- পররাষ্ট্রনীতি : দাক্ষিণাত্যে টিপু সুলতানকে দমন করার কর্নওয়ালিস নিজামের সাথে মিত্রতা করেন। ফলে টিপু ব্যাঙ্গালোরের সন্ধির শর্তাবালি ভঙ্গ করে ইংরেজদের মিত্র রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন। এভাবে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়। কর্নওয়ালিস মারাঠা ও নিজামের সাথে এক হয়ে টিপুর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অবরুদ্ধ করলে টিপু ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তানুসারে টিপু মহীশূর রাজ্যের একাংশ ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা দিতে বাধ্য হন। জামিন হিসেবে তাঁর দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন। এভাবে তিনি উপমহাদেশের দক্ষিণভাগে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের সক্ষম হন।
- জন শোর : ১৭৯৩ সালে তাঁকে গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি সংঘাত ও যুদ্ধ পরিহার করেন। তাঁর নীতি ছিল অভিযান না চালিয়ে ঔপনিবেশিক রাজ্যগুলি সুদৃঢ় করে শাসন করা। তাঁর শাসনামলের পাঁচ বছর বাংলায় শান্তি বজায় ছিল।
-
লর্ড ওয়েলেসলি-
- ১৭৯৮ সালে লর্ড ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। তাঁর শাসনকালকে উপমহাদেশের ইতিহাসে সংকটময় যুগ বলা যেতে পারে। জন শোরের উদার নিরপেক্ষনীতির অনুসরণ করার কারণে তিনি সমস্যার সম্মুখীন হন। যেমন-
ক. টিপু সুলতান প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফ্রান্সের জেকোবিন ক্লাব ও মরিশাসের ফরাসি শাসকের সাথে যোগাযোগ করেন।
খ. কোম্পানির শর্ত অনুযায়ী মারাঠাদের বিরুদ্ধে নিজামকে সাহায্য না করায় নিজাম অসন্তুষ্ট হয়ে ফরাসি সেনাপতি রেমন্ডের নেতৃত্বে নিজ বাহিনীকে সুসজ্জিত করে তোলেন।
গ. ফরাসি-ইংরেজ শত্রুতার জেরে নেপোলিয়ন উপমহাদেশ বিজয়ের পরিকল্পনা করে।
ঘ. কোম্পানির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে নেমে যায়। - উদ্দেশ্য ও নীতি : ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আরও শক্তিশালী করে তুলতে। ফরাসি প্রাধান্য সম্পূর্ণভাবে দূর করা তার উদ্দেশ্য ছিল। তিনি সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ নীতি অবলম্বন করেন।
- মিত্রতা নীতি : ওয়েলেসলি এই দেশীয় রাজাদের পুরোপুরি ইংরেজ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে ‘অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি’ চালু করেন। দেশীয় রাজাদের নিরাপত্তার বিনিময়ে তাঁদের স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তার বির্সজনই এ নীতির মূল লক্ষ্য ছিল। এই নীতিতে যা ছিল-
ক. যে সকল দেশীয় রাজা অধীনতামূলক মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, তাঁরা ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া কোনো রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
খ. দেশীয় শক্তিশালী রাজ্যগুলো সেনাবাহিনী রাখতে পারবে তবে তা একজন ইংরেজ সেনাপতির অধীনে রাখতে হবে।
গ. মিত্র রাজ্যসমূহ থেকে ইংরেজ ব্যতীত সকল ইউরোপীয় নাগরিককে বিতাড়িত করতে হবে। -
এর ফলে যে সমস্যাগুলো হয়-
১. এই নীতির প্রথম শিকার হন হায়দ্রাবাদের দুর্বল নিজাম।
২. টিপু সুলতান এই নীতি গ্রহণ করতে রাজী হওয়ায় কোম্পানির সাথে যুদ্ধ হয় এবং তিনি পরাজিত হলে তাঁর রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়।
৩. মারাঠাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়।
৪. ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে অধীনতামূলক মিত্রতা গ্রহণে বাধ্য করা হয়। অযোধ্যার মতো বড় রাজ্যও এই নীতি থেকে বাদ পড়েনি। - শিক্ষার প্রসারতা : লর্ড ওয়েলেসলি এ উপমহাদেশে ইংরেজ কর্মচারীদের শিক্ষার জন্য কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে একটি কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তারই নির্দেশে কলকাতার বর্তমান গভর্নর ভবনটি নির্মিত হয়।
- জর্জ বারলো : ১৮০৫ সালে তাকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮০৭ সালে লর্ড মিন্টোর যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন।
- প্রথম মিন্টো (১৮০৭-১৮১৩) : তিনি অনেকটা হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করেন এবং ভারতে বড় ধরনের যুদ্ধকে এড়াতে সক্ষম হন। তিনি জোরপূর্বক পিন্ডারি দস্যুনেতা আমীর খানকে বেরারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখেন। পাঞ্জাবের শাসক রণজিৎ সিংয়ের সাথে ১৮০৯ সালে অমৃতসর চুক্তি সম্পাদন ছিল তার অন্যতম সফলতা।
- আর্মহাস্ট (১৮২৩-১৮২৮) : তাঁর ধারণা ছিল ভারতে যুদ্ধের তেমন সম্ভাবনা নেই কিন্তু শীঘ্রই পূর্ব বাংলার সীমান্তে গোলযোগ শুরু হয়। বার্মার রাজা আরাকান-আসাম জয় করে বাংলার পূর্বাংশের জন্য দাবি উত্থাপন করে। তিনি চট্টগ্রামের শাহপরী দ্বীপ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। ফলে ইংরেজ-বার্মা যুদ্ধ হয়। ব্রহ্মরাজ শান্তির জন্য আবেদন করেন। ইয়ানডাবু চুক্তি (১৮২৬) হয় যার মাধ্যমে আসাম, আরাকান ও টেনাসেরিম ইংরেজদের নিকট ছেড়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ চলাকালে দুটি ঘটনা সংঘটিত হয়।
প্রথমত, সামরিক অভিযানের সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহিরা ব্যারাকপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হিন্দু সিপাহিরা সমুদ্র পারাপারে আপত্তি জানায়। কিন্তু তাদেরকে নির্মমভাবে দমন করে রেজিমেন্টটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, বার্মার সঙ্গে যুদ্ধ ভারতের মূল ভূখন্ডে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভরতপুরে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধে (১৮২৬)।
-
উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-
- উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক প্রথম জীবনে মাদ্রাজ কাউন্সিলের গভর্নর নিযুক্ত হয়ে উপমহাদেশে আসেন। ১৮০৬ সালে ভেলোরে সিপাহী বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে তাঁকে স্বদেশে ফিরে যেতে হয়। ১৮২৮ সালে পুনরায তাঁকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে এদেশে পাঠানো হয়। তিনি একজন শান্তিপ্রিয় উদারপন্থী শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনামল উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেয়ে বিভিন্ন কল্যাণমুখী কাজের জন্য বিখ্যাত।
- অর্থনৈতিক সংস্কার : প্রথম ব্রহ্মযুদ্ধের পর কোম্পানির অর্থনৈতিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করলে বেন্টিঙ্ক আর্থিক সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেন। তিনি ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করেন। বোর্ড অব ডাইরেক্টরের নির্দেশে পেয়ে তিনি শান্তিকালীন সময়ে সামরিক সদস্যদের অর্ধেক ভাতা দেওয়ার নিয়ম তুলে দেন। ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেতন কমিয়ে দেন। কোম্পানির অতিরিক্ত কর্মচারীদের ছাঁটাই করেন। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য তিনি মালবে উৎপাদিত আফিমের উপর কর ধার্য করেন।
- শাসন সংস্কার : তিনি সর্বপ্রথম এদেশীয়দের শাসন ও বিচার সংক্রান্ত উচ্চপদে নিয়োগ করেন। কয়েকটি জেলাকে একত্র করে একটি বিভাগ গঠন করে প্রতিটি বিভাগে একজন বিভাগীয় কমিশনার নিযুক্ত করেন। এদেশীয় বিচারক ও কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়। তিনি রাজস্ব অফিসের সদর দপ্তর কলকাতা থেকে এলাহাবাদে স্থানান্তর করেন । আদালতে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে দেশীয় ভাষার প্রচলন শুরু করেন। তিনি লর্ড মেকলের সহায়তায় আইন কমিশন গঠন করে ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ তৈরি করেন যা ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গাইড বুক হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
- সামাজিক সংস্কার : সতীদাহ প্রথা বিলোপ ও ঠগী দমন বেন্টিঙ্কের উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তিনি সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করেন। প্রাচীনকাল থেকে এদেশে স্বেচ্ছায় ও জোরপূর্বক ‘সহমরণ’ (মৃত স্বামীর সাথে স্বেচ্ছায় একই চিতায় স্ত্রীর মৃত্যুবরণ) এবং ‘অনুমরণ’ (বিদেশে স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবাকে একাকী চিতায় পুড়িয়ে মারা) প্রথার প্রচলন ছিল। এভাবে স্ত্রীরা সতী প্রমাণিত হতেন। ইংরেজরা এই প্রথা উঠিয়ে দিতে চেষ্টা করেন কিন্তু এদেশীয় ভাবাদর্শে আঘাত লাগতে পারে বলে তারা জোর দেন নি। বেন্টিঙ্ক কয়েকজন এদেশীয় উদারপন্থী সংস্কারক বিশেষত রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহায়তা লাভ করেন। উচ্চ আদালতের সমর্থন নিয়ে ১৮২৯ সালে এসব প্রথা নিষিদ্ধ করেন। এছাড়া তৎকালীন হিন্দু রীতি অনুযায়ী দেবতাকে খুশি করার জন্য প্রথম সন্তানকে গঙ্গায় নিক্ষেপ ও বিবাহ দেয়ার অক্ষমতার কারণে শিশু কন্যাকে গলাটিপে হত্যা করার নিয়ম তিনি চিরতরে বন্ধ করে দেন। কোনো কোনো স্থানে নরবলির প্রথা যে নিয়ম ছিল তাও তিনি বন্ধ করে দেন।
ঠগীরা ছিল অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ডাকাতদল। এ দলে হিন্দু-মুসলিম উভয় গোত্রের লোক ছিল। এরা ছদ্মবেশে হঠাৎ করে এসে নিরীহ পথিকদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তাদের সবকিছু লুট করত। এটা ছিল ঠগীদের পেশা। কথিত আছে সম্রাট আকবর এটোয়া জেলাতে ৫০০ ঠগীকে হত্যা করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়েও ঠগীদের বেশ উৎপাত ছিল। তারা সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতো। জনগণের নিরাপত্তার জন্য বেন্টিঙ্ক কর্নেল পিমানের উপর ঠগী দমনের ভার দেন। কর্নেল পিমান ঠগীদের ভাষা আয়ত্ব করেন এবং একজন ঠগীর কাছে থেকে ঠগীদের কৌশল ও গোপন আস্তানাগুলোর খবর জেনে নিয়ে প্রায় ১৫০০ ঠগীকে ধরে হত্যা করেন (১৮৩০)।
-
শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার-
- এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন বেন্টিঙ্কের অন্যতম কীর্তি। বহু আগে থেকে উপমহাদেশে সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা প্রচলিত ছিল। ১৮৩৩ সালে তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের উদ্যোগ নিলে দুটি দলের সৃষ্টি হয়।
একদল প্রাচ্য ভাষা (সংস্কৃত ও ফারসি) শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন।
অন্যদল পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের (ইংরেজি) শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন। শেষোক্ত দলের সমর্থক ছিলেন আইন বিষয়ক সদস্য লর্ড মেকলে ও রাজা রামমোহন রায়। লর্ড মেকলে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ১৮৩৫ সালে একটি স্মারকলিপি বেন্টিঙ্কের কাছে পাঠান। বেন্টিঙ্ক ইংরেজি শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেন এবং ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে সরকারি ভাষারূপে ঘোষণা করেন। একই বছর পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষাদানের জন্য কলকাতায় একটি মেডিক্যাল কলেজ ও বোম্বাইয়ে এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। - অকল্যান্ড (১৮৩৬-১৮৪২) : পর্তুগিজদের সঙ্গে আতাঁতের অভিযোগে তিনি সাতারার রাজাকে অপসারণ করেন। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আফগান সমস্যা। যদিও প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে ইংরেজরা তেমন কোনো সাফল্য পান নি।
- লর্ড হর্ডিঞ্জ : তিনি প্রথম শিখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন যার পরিসমাপ্তি ঘটে লাহোর চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তির ধারা অনুযায়ী শিখরা সমগ্র শতদ্রু ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল ইংরেজদের নিকট ছেড়ে দেয় এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা দিতে সম্মত হয়। ১৮৪৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং ব্রিটেনে উচ্চপদে নিযুক্ত হন।
-
লর্ড ডালহৌসী-
- ১৮৪৮ সালে ডালহৌসী উপমহাদেশে আসেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রেরিত শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী ছিল ডালহৌসি। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির তিনটি লক্ষ্য ছিল-
ক. পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শাসনের প্রসার
খ. ইংরেজ সাম্রাজ্যের সংহতি স্থাপন ও
গ. উপমহাদেশে ব্রিটিশ পণ্যের বাজার সৃষ্টি - ডালহৌসী সাম্রাজ্য বিস্তারে যে নীতিগুলো গ্রহণ করেছিল তার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিক ছিল। যথা-
১. প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য জয়
২. স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা রাজ্য জয়
৩. কুশাসন ও অরাজকতার অজুহাতে পররাজ্য দখল -
স্বত্ববিলোপ নীতি (Doctrine of lapse)-
- এই নীতির মূলকথা হচ্ছে, ইংরেজদের আশ্রিত কোনো রাজা পুত্রহীন অবস্থায় মারা গেলে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে এবং দত্তক পুত্রের বা কন্যার উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না। ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। দত্তক প্রথা প্রয়োগ করার ব্যাপারে ডালহৌসি দেশীয় রাজ্যগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। যথা-
ক. কোম্পানির সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য
খ. কোম্পানির অধীন করদ রাজ্য
গ. স্বাধীন দেশীয় রাজ্য
ডালহৌসি এক নির্দেশনামায় প্রথম শ্রেণির দেশীয় রাজ্যগুলোতে দত্তক-প্রথা নিষিদ্ধ করেন। দ্বিতীয় শ্রেণির রাজ্যে কোম্পানির অনুমতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন এবং স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলোতে দত্তক প্রথা বহাল রাখেন। এটিই স্বত্ববিলোপ নীতি নামে খ্যাত।
ক. সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজ কোম্পানি প্রোম, দক্ষিণ বার্মা, পাঞ্জাব ও সিকিমের একাংশ দখল করে।
খ. স্বত্ববিলোপনীতি প্রয়োগ করে সাতারা (১৮৪৮), স্বম্বলপুর (১৮৪৯), ঝাঁসি, নাগপুর ইত্যাদি দখল করে।
গ. কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য দখল করা হয়।
ডালহোসির এই স্বত্ববিলোপ নীতির কারণে ১৮৫৭ সালে প্রথম আজাদি আন্দোলন তথা সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। - কুশাসনের অজুহাতে রাজ্যদখল : ডালহৌসী কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নবাবের হাতে থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হাতে। ফলে রাজ্য শাসনে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই তাকে অযোধ্যা ছেড়ে কলকাতায় বাস করতে বাধ্য করা হয়। হায়দ্রাবাদের নিজাম ইংরেজ সেনাবহিনীর ব্যয়ভার বহনের অর্থ বাকি পড়ায় ডালহৌসী বেরার প্রদেশটি দখল করে।
- দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ : হার্ডিঞ্জের সময়ের প্রথম শিখ যুদ্ধের পরাজয় শিখ জাতি ভুলতে পারেনি। হাডিঞ্জের কিছু পদক্ষেপ শিখদের উত্তেজিত করে তুলেছিল। লাহোরের ইংরেজ রেসিডেন্ট মূলরাজকে হিসাবপত্র দাখিল করতে বলায় মূলরাজ পদত্যাগের ভান করেন। দুজন ইংরেজ কর্মচারীসহ নবনিযুক্ত শাসককে কর্মস্থলে পাঠানো হলে মূলরাজ তাদের হত্যা করে পুনরায় পাঞ্জাবের ক্ষমতায় আসে। সাথে সাথে পাঞ্জাবের অন্যত্র শিখ যোদ্ধারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাধ্য হয়ে ডালহৌসী শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ নামে পরিচিত। গুজরাটের যুদ্ধে শিখ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। ডালহৌসী পাঞ্জাব দখল করে নেয়। ফলে উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
- দ্বিতীয় ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ : বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদের ফলে দ্বিতীয় বার্মা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ১৮২৬ সালে সংঘটিত প্রথম বার্মা যুদ্ধের থেকেই বর্মীরা ইংরেজদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল। ১৮৫১ সালে কয়েকজন ইংরেজ বণিক বর্মীদের হাতে অপমানিত হয়েছে সংবাদ পেয়ে ডালহৌসী তখনই কমোডর ল্যাম্বটিকে রণতরীসহ ব্রহ্মরাজের কাছে পাঠায়।
ব্রহ্মরাজ যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না বলে দুর্ব্যবহারের দায়ে রেঙ্গুনের গভর্নরকে পদচ্যুত করে। কিন্তু ল্যাম্বার্টি এতে খুশি না হয়ে ব্রহ্মরাজের একটি রণতরী দখল করে। ফলে বর্মীরা ল্যাম্বার্টির জাহাজে গোলাবর্ষণ শুরু করলে দ্বিতীয় বার্মা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
ডালহৌসী ল্যাম্বাটিকে সাহায্যের জন্য জেনারেল গডউইনকে প্রেরণ করেন। অল্পকালের মধ্যেই রেঙ্গুন প্রোম ও পেগু দখল হয়। ব্রহ্মরাজ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে ডালহৌসী সমগ্র পেগু প্রদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে। এভাবে বার্মার উপকূল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম হতে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ব্রিটিশ দখলে আসে। - ইংরেজ প্রদত্ত ভাতা ও খেতাবের স্বত্ব লোপ : ডালহৌসী ইংরেজ প্রদত্ত ভাতা ও খেতাবের ক্ষেত্রেও স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করেন। ১৮৫১ সালে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও মারা গেলে ডালহৌসী বাজীরাও এর দত্তকপুত্র নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ করে দেয়। ডালহৌসী মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের খেতাব ও ভাতা লোপ করার চেষ্টা করে কিন্তু পরিচালক সভা তাতে বাধা দেয়।
- সংস্কার : তিনি গভর্নর জেনারেলের কাজের চাপ কমানোর লক্ষ্যে বাংলার জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর (ছোট লাট) নিযুক্ত করেন। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতকে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করা হয়। তৎকালীন বাংলার সেনাদের সামরিক যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেক সুস্থ সবল লোকের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহায়তায় তিনি বিধবা বিবাহ আইন পাশ করান। তিনি এমন একটি আইন পাশ করান যাতে এদেশীয়রা ধর্মান্তরিত হলেও তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ করতে পারে।
তার সময়ে কলকাতা-পেশোয়ার পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পুনরায় চালু হয়। এদেশীয় রেলপথ ব্যবস্থার জনক ছিলেন ডালহৌসী। তাঁর সময়ে বোম্বাই-টানা পর্যন্ত রেললাইন চালু হয় (১৮৫৩)। তিনি ডাক বিভাগের সংস্কার, কলকাতা হতে আগ্রা পর্যন্ত টেলিগ্রাম ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি বনভূমি সংরক্ষণ নীতি প্রবর্তন করেন এবং চা ও কফি বাগানের প্রসার সাধন করেন।
-
লর্ড ক্যানিং
- তাঁর আমলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব। তিনি বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ১৮৫৮ সালে পার্লামেন্টারি আইন পাশ হয়। রানি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বিলুপ্ত করে ভারতের শাসনভার নিজে নেন। যারা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি, তাদের তিনি নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন। এভাবে তিনি ‘ক্ষমাশীল’ উপাধি অর্জন করেন।
আয়কর প্রবর্তন, ১০% হারে শুল্ক আরোপ ও কাগজের মুদ্রার প্রচলন করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি বাংলায় খাজনা আইন পাশ করান। ব্রিটিশরা চা ও কফি চাষ শুরু করে। কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নীল কমিশন গঠন করেন। তাঁর আমলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাশ করা যার দ্বারা বেসরকারি ভারতীয় সদস্যগণ ভাইসরয়ের আইনসভায় মনোনীত হতে পারতেন। - আরও পড়ুন- সিরাজ পতনের কারণ