Skip to content

সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিকথা- Santhal Rebellion

সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিকথা

  • সাঁওতালদের পূর্বকথা-

  • ভারতের আদিবাসী জনজাতিগুলোর মধ্যে সাঁওতাল অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। চাষাবাদ ও শিকারের উদ্দেশ্যে তারা পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে বীরভূমে আসে। তারা মূলত দ্রাবিড় গোষ্ঠীর একটি উপজাতি এবং ভাষাগত দিক থেকে ‘কোলারিয়ান’ শ্রেণির। বীরভূম রাজাদের অত্যাচারে ১৮০৯ সালে সাঁওতালরা বীরভূম ত্যাগ করে এবং গোদ্দা মহকুমা অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন।

    সাঁওতাল পরগনা
    সাঁওতাল পরগনার অবস্থান
  • দামিন-ই-কোহের ইতিবৃত্ত- 

  • দামিন-ই-কোহ একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ পর্বতের পাদদেশ। রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। বর্তমানে অঞ্চলটি সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত। সাঁওতালদের কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে অঞ্চলটি সমৃদ্ধ হয়।
    ব্রিটিশ সরকার দামিন-ই-কোহ অঞ্চলকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় আনে এবং জমিদারদের সহজ শর্তে জমির বন্দোবস্ত দিতে থাকে। ফলে অঞ্চলটিতে বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। এসব বহিরাগত লোকদের ‘দিকু’ বলা হত।
    জমিদাররা সাঁওতালদের উপর খাজনার পরিমাণ বাড়াতে থাকে। তারা চড়া সুদে ঋণ দিত। এই অঞ্চলে যেন প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবনতি না হয় সেজন্য দীঘিতে একটি থানা স্থাপন করা হয়। এর প্রধান দারোগা মহেশলাল দত্ত ছিলে অত্যাচারী দারোগা। দিকুদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলেও সুবিচার পাওয়া যেত না।

    ১৮৩২-৩৩ সালে সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন টানারের নেতৃত্বে সাঁওতাল পরগনার সীমানা নির্ধারিত হয়। একসময় এই অঞ্চলের তাদের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজারে। এজন্য তারা ইংরেজ সরকারকে খাজনা দিত। পরবর্তীতে ভয়ংকর হারে এই খাজনার পরিমাণ বেড়ে যায়। কঠোর পরিশ্রম করেও তাদের হাতে কোনো অর্থ থাকত না। চাষের সময় বীজ কিনতে উচ্চ সুদে ধার করা ছাড়া উপায় থাকত না। মহাজনদের সুদের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে শস্য, গবাদি পশু, এমনকি নিজে কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যকে আজীবন বিক্রি করে দিতে হত। ফসল ঘরে তোলার সাথে সাথেই মহাজনরা হানা দিত।
  • সশস্ত্র প্রতিরোধ- 

  • ১৮৪৮ সালে মহাজনদের অত্যাচারে তিনটি সাঁওতাল পরিবার দামিন-ই-কোহ ছাড়তে বাধ্য হয়। তাদের এমন অবস্থা দেখে সিধু কানু প্রতিবাদে নেমে পড়ে। তারা লোকজনদের জমায়েত করে সাঁওতাল রাজ্য কায়েমের কথা ঘোষণা করেন। সাঁওতালদের এই সংগ্রামের কথা শুনে স্থানীয় জমিদার-পুলিশ সক্রিয় হয়ে উঠে। সাঁওতালদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিল দিঘী থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত। ১৮৫৫ সালের ৭ই জুলাই মহেশ দারোগাকে তারা হত্যা করে। এখান থেকেই প্রকৃত বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে।
    এই ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সাঁওতালরা বারহাইত বাজার লুট করে। মহাজনদের প্রধান ঘাঁটি লিটিপাড়া আক্রমণ করে। তাদের সাথে মালভুয়াল উপজাতিরা যোগ দেয়। এমনকি বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে অত্যাচারী মহাজনরা সাঁওতালদের হাতে নিহত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ১৭ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানানো হয়। বিদ্রোহীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। সরকার নৃশংসভাবে শত শত বিদ্রোহীদের হত্যা করে। কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার ভগনাডিহি গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।

  • বিদ্রোহের কারণগুলো ছিল নিম্নরূপ-

    ১. রাজস্বের চাপ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাঁওতালদের বসবাস স্থল রাজস্বের অধীনে আসে। সরকার পরবর্তীতে সেখানে জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সাঁওতালদের উপর রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। ১৮৩৮ সালে কোম্পানি বছরে ২০০০ টাকা ঐ এলাকা থেকে আদায় করত অথচ ১৮৫১ সালে প্রায় ৪৪০০০ হয়। ফলে তারা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
    ২. মহাজনি শোষণ : নতুন পদ্ধতি অনুসারে সাঁওতালদের নগদ অর্থে খাজনা মিটাতে হত। রাজস্ব প্রদান করতে তাদের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত। এই সময় মহাজনরা উচ্চহারে সুদ নিত। তাদের রসদ সংগ্রহের জন্য ঋণগ্রহণে বাধ্য ছিল। সেখানবার জমি উর্বর হলেও একে কৃষির উপযুক্ত করে নেওয়া ছিল ব্যয় সাপেক্ষ। তারা দুই ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। যথা-
    ক. কামিয়াতি প্রথা- এই শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত মহাজনের জমিতে খাটতে হত।
    খ. হারওয়ারি প্রথা- এতে ঋণগ্রহীতাকে মহাজনের জমিতে লাঙল দিতে হত বা অন্যান্য কাজ করতে হত। এর জন্য অবশ্য তারা দৈনিক একসের করে ধান পেত।
    ৩. ব্যবসায়ীদের শোষণ : ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের অজ্ঞতার সুযোগে তাদের কাছে বেশি দামি জিনিস বিক্রি করত এবং কম দামে ফসল কিনে বাইরে চালান দিত। তারা কেনারামবেচারাম নামক দুধরনের বাটখারা ব্যবহার করে তাদের ঠকাত। তারা যখন সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনো জিনিস কিনত তখন তারা অপেক্ষাকৃত ভারী বাটখারা বা কেনারাম ব্যবহার করত।
    অনেক সময় বাটখারাতে ঠাকুরের সিঁদুর ঘষে ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করত। এই অসাধু কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পেরে সাঁওতালরা ফসল বিক্রি না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তখন ব্যবসায়ীরা জোর করে ফসল কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করে। এতে তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়।

    ৪. নীলকরদের শোষণ : নীলকররা খাদ্যশস্যের বদলে নীলচাষে বাধ্য করত এবং নীলচাষে অস্বীকৃতি জানালে তাদের উপর নির্যাতন চালাত।
    ৫. সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার : সরকারি কর্মচারীরা অত্যাচারীদের পক্ষাবলম্বন করে। সাঁওতালরা সরকারকে রক্ষাকর্তা মনে করলেও সরকার তাদের অভিযোগের কোনো প্রতিকার করেনি। তাই সার্বিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
    ৬. রেল কর্মচারীদের অত্যাচার : লর্ড ডালহৌসি শাসনকালে বিভিন্ন স্থানে রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে সেসব অঞ্চলে ঠিকাদারদের আবির্ভাব ঘটে। এরা সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ দিত এবং জোর করে তাদের হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নিত। এমনকি তারা নারীদের উপর নির্যাতন চালাত।
    ৭. ধর্মীয় উন্মাদনা : এই বিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় প্রচারণাও কাজ করেছিল। মিশনারিরা জোর করে সাঁওতালদের খ্রিস্টান বানাতে অপচেষ্টা করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। ১৮৫০ সালে সিধু ও কানু ঘোষণা করে যে, “ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিদ্রোহে তাদের জয় হবে।” তারা প্রচার করে যে, “ঈশ্বরের দয়ায় ইংরেজদের বুলেট নিষ্ফল হবে, যারা যুদ্ধে নিহত হবে তারা ঠাকুরের দোয়ায় আবার জীবিত হয়ে উঠবে।”এইসব বক্তব্য সাঁওতালদের মনে আশার সঞ্চার করে।
    ৮. প্রশাসনের অসহযোগিতা : সাঁওতালদের উপজাতীয় রাষ্ট্র কাঠামোকে অস্বীকার করে ইংরেজরা অন্য ধরনের প্রশাসন চাপিয়ে দিলেও তারা তা মেনে নেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। যেমন-
    ক. বারহাইকে প্রশাসনিক কেন্দ্র থাকলেও সেখানকার কর্মচারীরা সাঁওতালদের অভিযোগের প্রতিকার না করে স্থানীয় জমিদারদের থেকে রাজস্বের হিসাব নিয়েই ব্যস্ত থাকত।
    খ. দীঘি থানাতেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যেত না। দারোগা মহেশলাল সাঁওতালদের খুব শাসিয়ে দিত।
    গ. আদালতের উকিল-মোক্তার সব সাঁওতালদের বিরুদ্ধে ছিল।

  • সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রসার-

  • ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন (সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস) সংঘটিত বিদ্রোহ ভাগলপুর, মুঙ্গের, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ভগনাডিহি গ্রামের সেই বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতিরাও এগিয়ে আসে। সিধু-কানু ছাড়াও ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক প্রমুখ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
    সাঁওতালরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে। তারা ১৩টি খণ্ড যুদ্ধ করে। ভাগলপুরের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। সিধু, কানুকে ধরিয়ে দেবার জন্য বিপুল অর্থমূল্যের পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সিধু ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিশ্বাসঘাতকতার ফলে কানু ধরা পড়লে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্যান্যদের হাতির পায়ে পিষে ফেলে বা গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। বহু সাঁওতালকে গাছের ডালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।কমিশনার এলিয়টের এজলাসে বিচার হয়। আটমাস ব্যাপী এই বিদ্রোহে প্রায় ৩০ হাজার আদিবাসী প্রাণ হারান।
  • সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল- 

  • সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় হয়। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয় এবং সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
    ক. সাঁওতাল পরগনায় সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয় এবং মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্যান্য মিশনারিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
    খ. সাঁওতালদের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা হয়নি বা জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।
    গ. সাঁওতাল বিদ্রোহ সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগায়, যা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। 
  • আরও পড়ুন : চাকমা বিদ্রোহের ইতিহাস

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page