ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলনের ইতিহাস। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রাম।
-
ফকিরদের উত্থান-
- সম্রাট আকবরের আমল হতে সমাজের ভিক্ষুক সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘নাগা’ ও ‘গিরি’ সন্ন্যাসীরা সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। অযোধ্যার নবাবের সেনাবাহিনীতে ‘গোসাই’ বাহিনী গঠিত হয় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে। বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ। আঠারো শতকের শেষার্ধে এই বিদ্রোহের শুরু। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম ফকির সন্ন্যাসীদের সাহায্য নিয়েছিলেন। কোম্পানি বিজয়ী হলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। এই সময় কোম্পানি ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে এবং তাদেরকে ‘দস্যু’ বলে আখ্যায়িত করে।
-
ফকির সন্ন্যাসীর পরিচয়-
-
বর্তমানে ফকির-সন্ন্যাসী বলতে আমরা যাদের বুঝি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে তারা ছিলেন একটু ভিন্ন। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ফকিরেরা ছিলেন মাদারিয়া সুফি তরিকার অনুসারী। সতেরো শতকের শেষার্ধে শাহ সুলতান সুরীয়া বুরহানার নেতৃত্বে এই সুফিরা বাংলায় বেশ প্রসার লাভ করে। অন্যদিকে সন্ন্যাসীরা ছিলেন বেদান্তীয় হিন্দু যোগী। এই সকল ফকির ও সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় আচার ও আনুষ্ঠানিকতায় অনেক সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়।
-
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট-
- পলাশীর যুদ্ধের পর সব ক্ষমতার অধিকারী হয় ইংরেজরা। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিলুপ্তির সাথে সাথে নবাবদের আয় বন্ধ হলে সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। মীর জাফর নিজে ৮০,০০০ সৈনিককে বরখাস্ত করে এবং নাজিমউদ্দৌল্লা তার দেশের নামমাত্র মর্যাদা রক্ষার জন্য যত সৈন্য রাখার প্রয়োজন ঠিক তত সৈন্যই রাখার অনুমতি পায়। ফলে বাংলা ও বিহারে হাজার হাজার মুসলমান চাকরি হারান। কোনো কোনো জমিদার দস্যু-ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বলে দেশে অরাজক পরিস্থিতি আরও বৃদ্ধি পায়।
১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানি বা রাজস্ব সংগ্রহ শুরু করে। ফলে কোম্পানির চোখে ফকির-সন্ন্যাসীদের দানগ্রহণ অবৈধ হয়ে পড়ে। তারা জনসাধারণের নিকট থেকে কোম্পানি কর্তৃক অননুমোদিত অর্থ আদায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে। ব্রিটিশ-ভারতের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ফকিরদের সম্পর্কে এই বলে কঠোর আদেশ জারি করেন যে, বাংলা ও বিহারের ফকির-সন্ন্যাসীরা ধর্ম-কর্ম পালন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দুই মাসের মধ্যে বাংলা-বিহার ছেড়ে চলে যেতে হবে। মূলত এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে মুঘল আমল থেকে প্রাপ্ত সকল সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করা হয়। বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তারা ছিল স্বাধীন ও মুক্ত। - বক্সারের যুদ্ধে নবাবকে সহায়তা করায় ইংরেজরা ফকিরদের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখতে থাকে। বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসীরা তাদের রীতি অনুসারে ভিক্ষাবৃত্তি সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। ধর্মীয় উৎসব, তীর্থস্থান দর্শন উপলক্ষে সারা বছর তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত। তাদের সাথে নিরাপত্তার জন্য নানা ধরনের অস্ত্র থাকত। কোম্পানির চোখে ফকির-সন্ন্যাসীদের এসব কার্যকলাপ মোটেই মনঃপূত হল না। তারা ছিল কোম্পানি শাসকদের আয়ত্তের বাইরে। সেই কারণে এই সকল গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে থাকে ব্রিটিশরা। ইংরেজ সরকার তাদের অবাধ চলাফেরায় বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। ইংরেজরা তীর্থস্থান ভ্রমণের উপর করারোপ করে, ভিক্ষাবৃত্তিকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে। তাছাড়া তাদেরকে ডাকাত-দস্যু বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। ফলে তারা আন্দোলনের নামতে বাধ্য হয়। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি কুঠি, জমিদারদের কাচারি ইত্যাদি।
-
বিদ্রোহের কারণ-
- এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক সন্ন্যাসী, ফকির, কৃষক এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। প্রায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই আন্দোলন। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কারণগুলো নিম্নরূপ-
ক. ভূমিরাজস্ব জনিত ক্ষোভ : ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। কোম্পানি বাংলা থেকে অত্যন্ত উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করতে শুরু করে। এর ফলে কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
খ. নিষ্কর জমি অধিগ্রহণ : ফকির-সন্ন্যাসীরা জায়গীর ও দান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্কর জমি ভোগ করে আসছিলেন। কিন্তু দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি নিষ্কর জমির অধিকার বাতিল করে এবং জমিগুলোর উপর উচ্চহারে করারোপ করে।
গ. মধ্যসত্ত্বভোগীর প্রাধান্য : ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য ইংরেজরা প্রথম থেকেই একদল মধ্যসত্ত্বভোগীর জন্ম দেয়। যারা এলাকা ছেড়ে সর্বোচ্চ পরিমাণে রাজস্ব তুলে দেওয়ার গ্যারান্টি দিতে পারত তাদেরকেই কোম্পানি ভূমি রাজস্ব আদায়ের অধিকার দিত। এর ফলে জমিদার, ইজারাদার, মহাজন দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকে। সন্ন্যাসী ফকিররাও সাধারণ কৃষকদের মতোই অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হন।
ঘ. ব্যাবসায়িক ক্ষতি : সন্ন্যাসী ফকিরদের একটি অংশ মশলা, রেশম, কাপড় ইত্যাদি ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘরে এই বাণিজ্যিক দ্রব্যগুলো বিক্রি করতেন। কিন্তু কোম্পানির আগ্রাসনের ফলে ইংজেরা ফকিরদের নামমাত্র দামে পণ্যগুলো বিক্রী করতে বাধ্য করে। রাজি না হলে তারা পণ্যগুলো কেড়ে নিত।
ঙ. তীর্থকর আরোপ : কোম্পানি শাসনের শুরুতে ফকিররা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়। অস্ত্রধারী সন্ন্যাসী ফকিরদের মতো কোনো যাযাবর গোষ্ঠী কোম্পানির শাসনতান্ত্রিক এলাকায় যখন তখন প্রবেশ করলে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে ভেবে ইংরেজরা তাদের নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। তাদের উপর তীর্থকর আরোপ করা হয়। তাদের অস্ত্রবহনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
চ. ফকিরদের হত্যা : ১৭৭১ সালে ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয়।
ছ. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : ১৭৭০ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই দুর্ভিক্ষের সময় অসংখ্য গরীব কৃষক মারা যায়। গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। এ সময় সাধারণ জনগণ এবং কৃষক শ্রেণি একত্র হয়ে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে এই বিদ্রোহের বিস্তৃতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। -
গৌরবময় বিপ্লবের ইতিবৃত্ত-
- এই বিদ্রোহের আহবায়ক ছিলেন মাদারিয়া তরিকার সুফিসাধক মজনু শাহ। তার খলিফা ছিলেন সুফিসাধক মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ এবং আরো অনেকে। পরবর্তীতে নাটোরের জমিদার দেবী চৌধুরাণীর সেনাপতি ভবানী পাঠক এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়ে হিন্দু বিদ্রোহীদের প্রেরণা ও নেতৃত্ব দ্রিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে রংপুর অঞ্চলের সাধারণ কৃষক নূরলদীনও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর কৃষিজীবীদের সংগঠিত করে এই বিদ্রোহে অংশ নেন। ফকিরদের নেতা ছিলেন মজনু শাহ ও সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন ভবানি পাঠক। বাংলায় দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, মালদা, কোচবিহারসহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এছাড়াও বিহারের পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ, নেপাল ও আসামসহ বিভিন্ন জায়গায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।১৭৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৬৩ সালে ফকির-সন্ন্যাসীরা ঢাকার ইংরেজ কুঠিতে প্রথম আক্রমণ করে। একই বছর বাকেরগঞ্জে কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি আক্রমণ করে। তারা সেখানকার কুঠিয়াল মি. ক্যালীকে কয়েকদিন আটক রাখে এবং কুঠি লুণ্ঠন করে। ঐ বছরই অতর্কিত আক্রমণ করে তারা ঢাকা কুঠি দখল করে। একই বছর দিনহাটার রামানন্দ গোঁসাইয়ের বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট মরিসনের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৭৬৯ সালে নেপাল সীমান্তে ইংরেজ সেনাপতি কিথকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। ১৭৭১ সালে মজনু শাহ সারা উত্তর বাংলায় ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। ১৭৭৩ সালে রংপুরে ক্যাপ্টেন টমাস নিহত হন। ১৭৭৭-১৮০০ সালে পর্যন্ত রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল উত্তরবঙ্গে।
-
মজনু শাহ ওরফে বাকের আলী-
- বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের মেওয়াট এলাকায় মজনু শাহের জন্মস্থান। তিনি মাদারি বোরহানা তরিকার ফকির ও দরবেশ। ভারতের কানপুর থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থিত মাকানপুরে শাহ মাদারের দরগায় তিনি অধিকাংশ সময় বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি তার দলবল সহ প্রতিবছর বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করতেন। এ অঞ্চলে স্থায়ী আস্তানা ছিল বগুড়ার মহাস্থানগড়। ১৭৭৬ সালে তিনি মহাস্থানগড়ে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে এই দুর্গ থেকেই এ স্থানের নাম হয় মস্তানগড়। মস্তানগড়ের এই দুর্গই বহুদিন পর্যন্ত ফকির বাহিনীর অভিযান পরিচালনার কেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া অপর একটি কেন্দ্র ছিলো বগুড়া থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত মাদারগঞ্জে। ফকির মজনু শাহ ছিলো ছদ্মনাম। সুরজিত দাশগুপ্ত পরিবেশিত এক তথ্য থেকে মেসবাহুল হক জানিয়েছেন, ‘মজনু’ শব্দটির অর্থ পাগল আর ‘শাহ’ শব্দটির অর্থ রাজা। তাহলে ‘মজনু’ ও ‘শাহ শব্দ দুটির অর্থ একত্রে পাগল রাজা বা পাগলা রাজা। আসলে এটি একটি প্রতীকি নাম। তাঁর প্রকৃত নাম বাকের আলী। -
আন্দোলনে ভিন্নখাত-
- ফকিরদের ক্রমাগত বিদ্রোহের ফলে সেনাবাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো─কিছুতেই দমন করা গেল না বিদ্রোহীদ্রের। অবস্থা বেগতিক দেখে জমিদারশ্রেণি টাকা পয়সার বিনিময়ে বিদ্রোহীদ্রের সাথে আপোষ করতে চাইল।
এদিকে ফকির-সন্ন্যাসীদের এই মহান বিদ্রোহকে কলঙ্কিত করার চক্রান্তও শুরু হলো। একদল বিপথগামী সন্ন্যাসী অর্ধ উলঙ্গ ‘রামায়েত সন্ন্যাসীদের সাথে মিলিত হয়ে ডাকাতি শুরু করল। ডাকাতি লব্ধ অর্থ তারা দ্ররিদ্র কৃষকদের মধ্যে উচ্চ সুদে ঋণ দিত। জনসাধারণ এইসব ভণ্ড সন্ন্যাসীদের ভয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। ‘রামায়েত’ নামক লুণ্ঠণকারী ভণ্ড সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপে বিদ্রোহী ফকির-সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এসব ভণ্ড সন্ন্যাসীরা ছিলো ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণির মদদপুষ্ট। ১৭৭৭ সালে বগুড়ায় অনুরূপ একদল সন্ন্যাসীদের সাথে মজনুর পুনরায় সংঘর্ষ ঘটে। এ সংঘর্ষে মজনুর অনেক অনুচর নিহত হন এবং অনেক লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে যান। রায় বাহাদুর যামিনী মোহন ঘোষ তাঁর Sannyasi & Fakir Raiders in Bengal নামক গ্রন্থে এ সংঘর্ষকে হিন্দু-মুসলমানেদের দাঙ্গা বলে অভিহিত করেছেন। হিন্দু-মুসলমানদের যৌথ কৃষক বিদ্রোহকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজদের মদদপুষ্ট রামায়েতদের সাথে সন্ন্যাসীদের সংঘর্ষকে এভাবে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়। উদ্দেশ্য মজনুকে কিছুটা দুর্বল করা এবং বিদ্রোহী মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা।
মজনু শাহ এসব ভণ্ড সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেন। এক সংঘর্ষে সুদখোর সন্ন্যাসীদের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন প্রাণ হারাল। ১৭৮৩ সালে মজনু শাহ ময়মনসিংহ আক্রমণ করেন। ১৭৮৬ সালের মার্চ মাসে তিনি বগুড়ায় এক সংঘর্ষে বহু ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়। ডিসেম্বর মাসে ৫০০ সৈন্য নিয়ে মজনু শাহ পুনরায় বগুড়া জেলার মঞ্জুরা নামক স্থানে সংঘবদ্ধ হন। খবর পেয়ে ইংরেজ সেনাপতি লে. ব্রেনাল বহু সৈন্য সামন্তসহ মজনুকে আক্রমণ করে। মজনু শাহ শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে পলায়ন করতে সমর্থ হন। মি. ব্রেনালের রিপোর্ট অনুযায়ী মজনু শাহ জলকাদা মাখা অবস্থায় যমুনা অতিক্রম করেন। পরে গঙ্গা পার হয়ে বিহারের উত্তর সীমান্তে গমন করেন। সেখান থেকে পালিয়ে মজনু শাহ বিহারে চলে যান। এর দুই বছর পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৮৭ সালে তিনি মারা যান।একই বছর ভবানী পাঠক ইংরেজদের আক্রমণে মারা যান। ১৭৯২ সালে মুসা শাহের মৃত্যুর পরে এই আন্দোলনে ভাটা নেমে আসে। পরবর্তীতে চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, রওশন শাহ, অনুপ নারায়ণ, শ্রীনিবাসসহ অনেকেই এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। ১৮১২ সালের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আরও তিনজন নেতার পরিচয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা হলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ও নুরুলউদ্দীন। -
ভবানী পাঠক
- এই বিদ্রোহেই আমরা এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি। সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরাণী। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। দুজনেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ১৭৬৭ সালে ঢাকায় ইংরেজদের কাছে অভিযোগ আসে যে ভবানী পাঠক নামে এক ব্যক্তি তাদের নৌকা লুট করেছে। ইংরেজরা তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাকে বন্দী করতে সক্ষম হয় না। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করেন। দেবী চৌধুরাণীর সহায়তায় তিনি ইংরেজদের ওপর হামলা চালান। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা আচল হয়ে পড়ে। ভবানী পাঠক পরবর্তীকালে বর্তমান বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলাধীন রাজারহাট থানায় চাকিরপাশা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে ঐ গ্রামের নাম পাঠকপাড়া হয়েছে বলে জানা যায়।
- আরও পড়ুন- চাকমা বিদ্রোহের ইতিহাস