চর্যাপদের ইতিবৃত্ত
- ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগ বলা হয়।
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের চেয়ে প্রাচীন। - চর্যাপদের সূত্র : পাঞ্জাবের মহারাজ রণজিৎ সিংয়ের পুত্র রাধাকিষণ ১৮৬৮ সালে ভারতের সকল পুঁথি সংরক্ষণের জন্য লর্ড লরেন্সকে অনুরোধ জানান। লরেন্স প্রাদেশিক গভর্নরদের সাথে পরামর্শ করে পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য রাজেন্দ্রলাল মিত্র পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করে। ১৮৮২ সালে তিনি The Sanskrit Buddhist Literature গ্রন্থে সর্বপ্রথম নেপালের বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। ১৮৯১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি ভারততত্ত্ববিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে এই দায়িত্ব দেয়। তিনি পুঁথি সংগ্রহের জন্য ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ সালে নেপালে যান। ১৯০৭ সালে (তৃতীয় অনুসন্ধানে) নেপালের ‘রাজ-দরবারের গ্রন্থাগার’ থেকে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামক পুঁথিটি আবিষ্কার করেন।
- বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাগীতিকোষ’। নাথগীতিকার উদ্ভব ঐ সময়েই হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ‘নাথগীতিকা’ সংক্রান্ত কোনো পুস্তক পাওয়া যায়নি। ‘চর্যাগীতিকোষ’ নাম থেকেই বুঝা যায়, এটি প্রাচীন যুগে লেখা কয়েকজন কবির ‘গীতবিতান’। ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কারের পূর্বে ঐতিহাসিকরা মনে করতেন যে, ময়না-মতীর গান, গোরক্ষবিজয়, শূন্যপুরাণ, ডাক ও খনার বচন, রূপকথা ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন দৃষ্টান্ত। কিন্তু ১৯০৭ সালে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
-
চর্যাপদ যে সময় লিখিত-
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন- ৬৫০ সালে এটি রচিত হয়। কিন্তু ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, ৯৫০ সালে চর্যাপদ রচিত হয়। প্রায় সব পণ্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন।
-
চর্যাপদ নেপালে পাওয়ার কারণ-
পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। পাল আমলেই চর্যাপদ রচনার কাজ শুরু হয়। পাল আমলের শুরুর দিকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। একসময় অরাজক ‘মাৎসান্যায়’ পরিস্থিতি দেখা দেয়। পালদের পরে বাংলায় আসে সেন বংশ, যারা হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। এমন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ এ দেশ থেকে চলে গিয়ে নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নেপাল তখন বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রস্থল ছিল।
- চর্যাপদসহ মোট চারটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। যথা-
১. চর্যাপদ
২. সরহপা দোহা
৩. কৃষ্ণপার দোহা
৪. ডাকার্ণব (গ্রন্থগুলোর মধ্যে কেবল চর্যাপদের ভাষাই বাংলা) - সান্ধ্য ভাষা : যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি ও যে ভাষার অর্থ একাধিক, তাকে পণ্ডিতরা সান্ধ্য ভাষা বলেছেন।
- সহজিয়া সম্প্রদায় : কায়িক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক কোনো পথকেই যারা অস্বীকার করেন না তাদের সহজিয়া সম্প্রদায় বলা হয়। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাথে বর্তমানে বাউলদের চিন্তার সাদৃশ্য আছে।
- চর্যাপদের ভাষা ও সান্ধ্য ভাষার ব্যবহার-
চর্যাপদের ভাষা মূলত বাংলা। দশম শতাব্দীর দিকে মাগধী অপভ্রংশ সামান্য বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় রূপলাভ করলে সিদ্ধাচার্যগণ পদগুলো রচনা করেন। এর বেশিরভাগ শব্দই মাগধী অপভ্রংশজাত।
চর্যাপদের ভাষা ছিল রহস্যময়। কিছুটা বুঝা গেলেও বাকিটুকু থেকে যেত অস্বচ্ছ। এজন্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একে ‘সান্ধ্যভাষা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এমন দুর্বোধ্য ভাষা ব্যবহারের একটি কারণ ছিল। চর্যাপদের কবিরা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। ফলে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতিকূল ব্যক্তি বা গোঁড়া ব্রাহ্মণদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কবিরা এই রূপক ভাষা ব্যবহার করেছেন।
১৯৩৮ সালে প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন। মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা ও ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচীর আবিষ্কৃত চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদের কারণেই আমরা চর্যার আক্ষরিক অর্থ ও গূঢ়ার্থ সম্পর্কে অনেকটা জানতে পারি। চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদক কীর্তিচন্দ্র। - চর্যাপদের কবিতা ও কবির সংখ্যা-
সুকুমার সেনের মতে চর্যাপদে গানের সংখ্যা ৫১টি। কারণ, মুনিদত্তের মতে একটি পদ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যায় গানের সংখ্যা ৫০টি। চর্যাপদ ছিন্নাবস্থায় পাওয়া যায় বলে এই মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছে। - চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপি : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাণ্ডুলিপিটি নেপালের রাজদরবারে যথাসময়ে ফেরত দেন। ১৯৬৫ সালে নীলরতন সেন ঐ পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থ সম্পাদনা করে। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি রাজদরবারের গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যায় এবং সেটি জাদুঘরে পরিণত হয়। এই বইগুলো নেপালের জাতীয় আর্কাইভে নেওয়া হলেও চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপি আর পাওয়া যায়নি।
- চর্যাপদে চিত্রিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠি : মাঝি (কামালি), শিকারি (অহেরী), বেশ্যা (দারী), নেয়ে (নোবাহী)।
এছাড়াও ডোমিনীর নগরে তাঁত ও চেঙা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের কথা উল্লেখ আছে। চর্যাপদে কাপালি, যোগী, পণ্ডিত, শিষ্য ইত্যাদি জীবনগোষ্ঠীর কথা আছে। - চর্যাপদের ইংরেজি অনুবাদ (Mystic Poetry of Bangladesh) করেন : হাসনা জসিমউদ্দীন মওদুদ (কবি জসিমউদ্দীনের কন্যা)।
- চর্যাপদ রচনার সময় বাঙালি জীবনের মূল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি ছিল কৃষিভিত্তিক।
- নবচর্যাপদ ও নতুন চর্যাপদ : ১৯৬৩ সালে শশীভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাইভূমি থেকে ২৫০টি পদ আবিষ্কার করেন। ১৯৮৮ সালে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নবচর্যাপদ’ নামে ৯৮টি পদ সংকলন করে প্রকাশ করেন। পদগুলোর রচনা ১২-১৬ শতকের মধ্যে ধারণা করা হয়।
সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, চর্যাপদ কেবল প্রাচীন যুগে না, মধ্যযুগেও রচিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ নতুন চর্যাপদ নামে ৩৩৫টি পদের একটি সংগ্রহ প্রকাশ করেন ঢাকা থেকে। - চর্যাপদ নিয়ে মতবিরোধ-
- চর্যাপদের প্রবাদ বাক্যগুলো-
ক. আপণা মাংসে হরিণা বৈরী (নিজের মাংসের কারণেই হরিণ সকলের শত্রু)
খ. হাতের কাঙ্কন মা লোউ দাপন (হাতের কঙ্কন দেখার জন্য আয়নার দিকে তাকিও না)
গ. হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী (হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ প্রতিদিন অতিথি আসে)
ঘ. আণ চাহন্তে আণ বিণঠা (এক চাইতে আরেক বিনষ্ট হলো)
ঙ. বর সুণ গোহালী কি মো দুধ বলদে (দুষ্ট বলদের চেয়ে বরং শূন্য গোয়াল ভালো)
চ. দুহিল দুধু কি বেল্টে সামাই (দোয়ানো দুধ কী বাঁটে প্রবেশ করে) - কুক্কুরীপার পা যে পদটি লিখেন : দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাও; রাতি ভইলে কামরু জাও (দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত থাকে। রাত হলে সে কামরূপ যায়)। কুক্কুরীপাকে নারী বলে অনুমান করা হয়।
- চর্যাপদের পদকর্তা-
- ভুসুক নিজেকে ‘রাউতু ভুসুকু’ অর্থাৎ অশ্বারোহী যুদ্ধ ব্যবসায়ী বংশের সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। ভুসুকুপা যোগী সাধক ছিলেন, তবে বৈরাগী ছিলেন না। তিনি জয়দেবের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি নিজের কুটিরে সর্বক্ষণ গোপনে অধ্যয়ন করতেন। ভিক্ষুরা মনে করত যে, সে সর্বদা আহার ও নিদ্রায় সময় কাটায়। এজন্য ভিক্ষুরা তাঁকে ভুসুকু (ভু= ভক্ষণ, সু= সুপ্তি, কু=কুটির) নামে ডাকতেন।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপাধি : মহামহোপাধ্যায় ও শাস্ত্রী। পারিবারিক পদবী ভট্টাচার্য। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করায় শাস্ত্রী ও ১৮৯৮ সালে মহামহোপাধ্যায় উপাধি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন।
- বিশ্বের একমাত্র চর্যাকার (সম্পূর্ণ চর্যাপদ মুখস্থ) : জাকেরুল ইসলাম কায়েস।
- আরও পড়ুন- পাল বংশের শাসন