তখন বঙ্গের রাজধানী ছিল গৌড়। অথচ তিনি গৌড় আক্রমণ না করে নদীয়াতে আক্রমণ করলেন কেন?
নালন্দা মহাবিহার কতবার ধ্বংস হয়েছিল এবং কতবার তা নির্মাণ করা হয়?
ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে ব্যর্থ হন কেন?
দিল্লীর শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন কে?
বঙ্গের কোন শাসক প্রথম আব্বাসীয় খলিফার স্বীকৃতি লাভ করেন?
কোন পথগুলো বঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত ছিল?
বঙ্গে প্রথম শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন কে?
ইখতিয়ার খলজি নাকি বখতিয়ার খলজি কে আক্রমণ করে?
আরবি ভাষায় নামের ক্ষেত্রে বিন ও বিনতে বেশ প্রচলিত। ছেলের নামের ক্ষেত্রে বিন ও মেয়ের নামের ক্ষেত্রে বিনতে লেখা হয়।মনে রাখতে হবে- বিন বা বিনতের পর বাবার নাম হয়। যেমন- মুহাম্মদ বিন কাসিম (কাসিমের ছেলে মুহাম্মদ)। বিন বা বিনতের প্রথম অংশে নিজের নাম থাকে। সেই হিসেবে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি (অর্থাৎ ওনার আসল নাম ইখতিয়ার উদ্দিন। আর বাবার নাম বখতিয়ার)। এজন্য আমরা এখানে ইখতিয়ার খলজি নামটি ব্যবহার করব।
উত্তর আফগানিস্তানের গরমশির (দস্ত-ই-মার্গ) এলাকার বাসিন্দা ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার তুর্কি জাতির খলজি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। ১১৯৫ সালে তিনি গজনীতে শিহাবুদ্দিন ঘুরীর সেনাবিভাগে কাজ করতে চাইলেও ব্যর্থ হন। পুনরায় ভাগ্য পরীক্ষার জন্য দিল্লীতে কুতুবুদ্দিন আইবেকের সেনা বিভাগে কাজ করতে চেয়েও সফল হন নি। কারণ, তিনি বেটে ও দীর্ঘবাহুবিশিষ্ট ছিলেন। এরূপ শারীরিক খুঁত তুর্কিদের নিকট অমঙ্গল বলে বিবেচিত হত। এরপর বাদাউনের (উত্তর প্রদেশ, ভারত) মালিক হিজবর উদ্দিন তাঁকে সাধারণ সৈনিক হিসেবে একটি চাকরিতে নিয়োগ দেন। কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে অযোধ্যায় চলে যান। অযোধ্যার শাসক হুসামুদ্দিন তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলি নামে দুটি পরগনার জায়গির দেন এবং মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই তিনি ভাগ্য উন্নয়ন শুরু করেন। এ সময়ে নববিজিত হিন্দুস্থানে খলজি ও তুর্কি লোকেরা জীবিকার আশায় ঘুরাফেরা করত। তাদের অনেককে নিয়ে ইখতিয়ার শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি শক্তিশালী হিন্দু জমিদারদের মোকাবিলা করার পরিবর্তে দক্ষিণ-বিহারের অরক্ষিত এলাকা আক্রমণ করেন। এর দ্বারা তিনি অর্থ ও ভূমি উভয় দখল করতে সক্ষম হন।
বিহার আক্রমণ : ১১৯৯ সালে তিনি দক্ষিণ বিহার অভিযান চালান এবং রাজা গোবিন্দপাল দেবকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি ওদন্তপুরি বিহারে অভিযান চালান যা মূলত ছিল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুর্গের মতো আকৃতির হওয়ায় তিনি এটি দুর্গ মনে করে আক্রমণ করেন। ওদন্তপুরি ছিল তখন বিহারের রাজধানী। তাঁর সেনাবাহিনী বৌদ্ধবিহারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। দুর্গ জয়ের পর দিনি দেখলেন যে দুর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক ও দুর্গটি বইপত্র দিয়ে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারেন যে, এটি একটি বৌদ্ধ বিহার। তখন থেকে মুসলমানরা স্থানটিকে বিহার শরিফ নামে ডাকে। বিহার জয়ের পর তিনি অনেক উপঢৌকন নিয়ে কুতুবউদ্দিন আইবেকের সাথে দেখা করতে যান। কুতুবুদ্দিন তাকে অভিনন্দন ও খিলাত প্রদান করে। ফলে তার মর্যাদা আরো বেড়ে যায়। এরপর তিনি বাংলা জয়ের শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন।
নালন্দা মহাবিহার কতবার ধ্বংস করা হয়?
নালন্দা মহাবিহার বিতর্ক : নালন্দা মহাবিহারের অবস্থান ছিল বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের রাজগিরে। নালন্দা মূলত একটি গ্রামের নাম। নালন্দা শব্দের অর্থ ‘দানে অকৃপণ’। রেকর্ড অনুসারে নালন্দা মহাবিহার তিনবার ধ্বংস হয়েছিল এবং দুইবার পুনর্নির্মাণ করা হয়।প্রথম : স্কন্দগুপ্তের শাসনামলে মিহিরকুলের অধীনে হিউন দ্বারা প্রথম ধ্বংস হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় : ৭ম শতাব্দীতে গৌদাস এটি ধ্বংস করে। তবে রাজা হর্ষবর্ধন এটি পুনরায় নির্মাণ করেন। তৃতীয় : ১১৯৩ সালে ইখতিয়ার খলজি এটি ধ্বংস করেন। তবে এই তথ্যটি নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। অনেক ঐতিহাসিক সনটি ১১৯৯ বলেছেন। কারণ, ইখতিয়ার খিলজি এই অঞ্চলে ১১৯৫ সালে আগমন করেন।
ঐতিহাসিক মিনহাজ তবাকাত-ই-নাসিরিতে লিখেন যে, ইখতিয়ারের সেনারা ওদন্তপুরি বিহার সেনাশিবির মনে করে ভুলক্রমে আক্রমণ করেন। ২০০ জন সেনা নিয়ে তিনি বিহার আক্রমণ করেন। এর চতুর্দিকে প্রাচীরের বেষ্টনী ছিল। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথ লিখেন, সেন আমলে তুর্কি অভিযানের ভয়ে বৌদ্ধ বিহারগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হত।ইখতিয়ার খিলজির বাংলা জয় নিয়ে ঘটনাগুলো মিনহাজের ভাষ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় না। ইখতিয়ারের বাংলা জয়ের ৪০ বছর পরে মিনহাজুস সিরাজ বাংলা সফর করেন এবং এই সম্পর্কে প্রচলিত মৌখিক কথা বিনা যাচাইয়ে গ্রন্থবদ্ধ করেন।
বঙ্গে মুসলিম আক্রমণ :বিহারে শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর ইখতিয়ার খলজি বঙ্গে দৃষ্টিপাত করেন। এ সময়ে বঙ্গের রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। গৌড় (লক্ষ্মণাবতী) ছিল তাঁর রাজধানী। নদীয়া বা নবদ্বীপ ছিল তাঁর রাজনিবাস। নদীয়া ছিল বঙ্গের দ্বিতীয় রাজধানী। নদীয়া ছিল শান্তিকামী পূণ্যার্থী লোকদের বাসভূমি। মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ আক্রমণের পূর্বে গৌড় বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও আভ্যন্তরীণ কলহের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। লক্ষ্মণসেন তখন বয়োবৃদ্ধ। তিনি রাজধানী থেকে দূরে নদীয়া বাস করছিলেন। বিহার বিজয়ের পরই লক্ষ্মণ সেনের সভাসদগণ তাঁকে নদীয়া ত্যাগ করতে বললেও তিনি তা আমলে নেন নি।
আক্রমণ পদ্ধতি : বিহার থেকে বঙ্গে প্রবেশ করতে হলে তেলিয়াগড়ি ও শিকরিগড়ি নামে দুটি গিরিপথ দিয়ে আসতে হত। এগুলো বঙ্গের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত ছিল ও বেশ সুরক্ষিত ছিল। ইখতিয়ার খলজি গৌড় আক্রমণ না করে ১২০৪ সালে তিনি ঝাড়খন্ডের দুর্গম অরণ্যের মধ্য দিয়ে লক্ষ্মণ সেনের অবকাশকালীন রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন। এই সময়ে নদীয়া আক্রমণ করবে তা লক্ষ্মণসেন ভাবতেও পারেন নি। এজন্য তিনি নদীয়ার সুরক্ষার ব্যবস্থাও করেন নি। দুটো কারণে ইখতিয়ার খলজি নদীয়া আক্রমণ করেন। যথা- ক. রাজা যেহেতু নদীয়াতে বাস করেন তাই এর গুরুত্ব রাজধানীর চেয়ে কম নয়। খ. গৌড় ছিল বেশ সুরক্ষিত। তার তুলনায় নদীয় বেশ অরক্ষিত ছিল।
বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ইখতিয়ার খলজি নদীয়া আক্রমণ করেন। যার মধ্যে মাত্র ১৭ জন তাঁর সাথে দ্রুতগতিতে আসে। প্রায় বিনা বাধায় নদীয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মুসলমানদের হস্তগত হয়। লক্ষ্মণসেন পালিয়ে গিয়ে পূর্ববঙ্গে কিছুদিন রাজত্ব করেন। নদীয়া বিজয়ের পর ইখতিয়ার খলজি গৌড়ে অভিযান পরিচালনা করেন। গৌড় বেশ সুরক্ষিত থাকলেও মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে নি। কারণ নদীয়াতে রাজনিবাস স্থানান্তরের পরই গৌড়ের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। ইখতিয়ার খলজি গৌড়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি এর নাম দেন লখনৌতি। অতঃপর তিনি বরেন্দ্র জয় করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এলাকাগুলোকে কয়েকভাগে ভাগ করে একজন করে সেনাপতির শাসনভারে অর্পণ করেন। তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে আলী মর্দান খিলজি বরসৌলে ও হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খিলজি গঙ্গাতীরের শাসক নিযুক্ত হন। তাঁর রাজ্য উত্তরে বর্তমান পূর্ণিয়া শহর থেকে দেবকোট (দিনাজপুর) জেলা হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে সোজাসুজিভাবে রংপুর শহর পর্যন্ত, দক্ষিণে পদ্মা নদী, পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তিব্বত অভিযান : এই সময় হিমালয়ের পাদদেশে কোট,মেচ ও ধারু নামক তিনটি উপজাতি বাস করত। ইখতিয়ার খলজি এই অঞ্চলে প্রবেশ করে মেচ উপাজাতির সর্দারকে বন্দি করেন এবং তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি সর্দারের নাম দেন আলীমেচ। এই সর্দারের কাছ থেকে তিব্বতে যাওয়ার খুঁটিনাটি জেনে নেন। তিনি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। তিব্বত আক্রমণের রাস্তা আবিষ্কারের জন্য তিনি আলীমেচকে নিয়োগ দেন। তিনজন সেনাপতি ও ১০ হাজার সেনা নিয়ে তিনি লখনৌতি থেকে তিব্বতের দিকে রওনা দেন। সেনাবাহিনী বর্ধনকোট নামক স্থানে পৌঁছলে তারা বাগমতি নামক একটি চওড়া নদীর মুখোমুখি হয়। ইখতিয়ার এই নদী পার না হয়ে দশদিন ধরে উত্তরদিক বরাবর নদীর ঊর্ধ্বমুখে সেনাদের চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সংকীর্ণ একটি স্থানে একটি পাথরের সেতু পান। সেখানে তাঁর দুই সেনাপতিকে রেখে তিনি সামনে অগ্রসর হন। তিনি এই সময় কামরূপের রাজার সাথে যোগাযোগ করেন। কামরূপ-রাজ পরের বছর তিব্বত আক্রমণের পরামর্শ দেন। কিন্ত তিনি পরামর্শ না শুনে তিব্বতের দিকে রওনা দেন।১৬ দিন পর তাঁর বাহিনীর সাথে স্থানীয়দের যুদ্ধ হয়। সেখানে একটি দুর্গে আক্রমণ করলে দুর্গবাসীরা রুখে দাঁড়ায়। ইখতিয়ারের বাহিনী এদের তুর্কি হিসেবে চিহ্নিত করে। লড়াইয়ে তাঁর বহু সেনা হতাহত হয়। বন্দিদের জেরা করে জানা যায়, এখান থেকে কিছু দূরে কারামবাত্তান নামে একটি শহর আছে যেখানে ৫০ হাজার অশ্বারোহী তুর্কি সেনা অপেক্ষা করছে। তিনি এগুলো শুনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার ফেরার পথ কামরূপ রাজা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল যাতে সেখানে মানুষ বা ঘোড়ার খাবার না পাওয়া য়ায়। তাঁর সেনারা তখন ঘোড়া খেতে বাধ্য হয়।পাথরের সেতুর কাছে এসে দেখতে পান যে কামরূপ রাজা এর দুটো খিলান ধ্বংস করে দিয়েছে। ফেরার পথে তাঁর ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ, সেতুর নিকটবর্তী উপজাতিরা সেনাদের হত্যা করে। সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। নদী পার হওয়ার জন্য কোনো নৌকাও সেখানে ছিল না। তিনি সেখানে একটি মন্দিরে অভিযান চালাতে গেলে কামরূপের সেনারা তাদের ধাওয়া করে। তিনি সেনাদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। তাঁর অধিকাংশ সেনাই সেখানে মারা যান। মাত্র শ’খানেক সেনা নদী পার হতে সক্ষম হন, বাকিরা মারা যান। তাঁর ফিরে আসার খবর পেয়ে আলীমেচের আত্মীয়রা এগিয়ে আসে এবং অনেক সেবা করে দেওকোটে পৌঁছে দেয়। সেখানে ফিরে তিনি নিহত সেনাদের স্ত্রী-সন্তানদের রোষের মুখে পড়েন। সেই ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ১২০৬ সালে তিনি আলী মর্দান নামক জনৈক আমীরের হাতে মারা যান।
ইখতিয়ারের সেনারা যেখানে কামরূপ সেনাদের হাতে ধরাশায়ী হয়েছিল তা শনাক্ত করা হয়েছে। আসামের গৌহাটি থেকে কিছুটা দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর তীরে কানাই-বড়শি গ্রামের একটি পাহাড়ের গায়ে একটি লিপিতে ইখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের পরাজয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে : “শাকে তুরগযুগ্মেশে মধুমাস ত্রয়োদশে কামরূপং সমাগত্য তুরষ্কা: ক্ষয়মায়ষু।” {১১২৭ শকাব্দের ১৩ই চৈত্র (১২০৬ সালের ৭ই মার্চ), কামরূপে সমাগত তুর্কি বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।} কানাই বড়শি গ্রামের অদূরে সিলহাকোপুল এলাকায় পাথরের সেতুও আবিষ্কৃত হয়েছে। কারামবাত্তান শহরকে ভুটানের কারুগোম্পা ধরা হয়।
ইখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর খলজিদের মধ্যে গৃহবিবাদ শুরু হয়। একই সময় শিহাবউদ্দিন ঘুরি আততায়ীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান। কুতুবুদ্দিন আইবেক লাহোরে স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজ্যাভিষেক উদযাপন করেন। ১২০৬-১২২৭ সাল পর্যন্ত তিনজন খলজি আমির বঙ্গে শাসন করেন। দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিশ বারবার বঙ্গে স্বীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করেন।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব :ইখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তাঁর সহযোদ্ধা তিনজন খলজি মালিকের নাম জানা যায়। তারা হচ্ছেন- শিরান খলজি, আলী মর্দান খলজি ও হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি।
শিরান খলজি : খলজি আমির ও সেনারা শিরানকে নেতা বানায়। তিনি আলী মর্দানকে বন্দি করেন। আলী মর্দান কারারক্ষীকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে কুতুবউদ্দিন আইবেকের আশ্রয়প্রার্থী হন। আলী মর্দানের অনুরোধে কুতুবউদ্দিন আইবেক অযোধ্যার শাসক রুমিকে বঙ্গ অধিকারের নির্দেশ দেন। এসময় শিরানের অধীন আমির হুসামুদ্দিন রুমির পক্ষ নেয়। রুমি লখনৌতি দখল করে। দিল্লীর সুলতানের প্রতিনিধিরূপে ১২০৮ সালে হুসামউদ্দিনকে দেবকোটের আমির করা হয়। এ সময় লখনৌতির স্থলে দেবকোট মুসলিম শক্তির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।
আলী মর্দান খলজি :ইতোমধ্যে আলী মর্দান দিল্লীর সুলতানের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে। তার কাজে মুগ্ধ হয়ে কুতুবউদ্দিন আইবেক তাকেবঙ্গদেশের শাসকহিসেবে প্রেরণ করেন। হুসাম বিনা বাধায় রাজত্ব ছেড়ে দেয়। আলী মর্দান ক্ষমতায় বসেন। যতদিন আইবেক বেঁচে ছিলেন ততদিন আলী মর্দান দিল্লীর অনুগত ছিল। কিন্তু কুতুবউদ্দিনের মৃৃত্যুর পর আলী মর্দান ১২১০ সালেস্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সে অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠলে আমীরদের হাতে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর হুসাম ‘গিয়াসুদ্দিন ইওজ শাহ’ নাম ধারণ করে ক্ষমতায় আসেন এবং এইগৃহবিবাদের অবসান ঘটে।
গিয়াসউদ্দিন খলজি :গিয়াসউদ্দিন খলজি দিল্লীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন সুলতানহিসেবে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। এ সময় পূর্ববঙ্গে লক্ষ্মণসেনের বংশধররা কর দিয়ে রাজত্ব পরিচালনা করত। তিনি দেবকোট থেকেলখনৌতিতে রাজধানী স্থানান্তরকরেন। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তিনিই সর্বপ্রথমনৌবহর গঠনকরেন। আব্বাসীয় খলিফাআন-নাসিরের থেকে স্বীকৃতিলাভ করেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, বাংলার প্রাধান্য নিয়ে প্রতিযোগিতার অন্যতম কারণ এই স্বীকৃতি ছিল।
রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য এর তিন পাশে গভীর ও প্রশস্ত পরিখা নির্মাণ করা হয়। বার্ষিক বন্যার হাত থেকে লখনৌতি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে রক্ষার জন্য তিনি বহু খাল খনন ও সেতু নির্মাণ করেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ করে সেনা ও পণ্য চলাচলের বন্দোবস্ত করেন। তিনি সুশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজ্য বিস্তারেও তাঁর মনোযোগ ছিল। কামরূপ, উড়িষ্যা, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও ত্রিহুতের রাজারা তাঁকে কর দিত। দিল্লীর সুলতানইলতুৎমিশ তাঁর শাসন ভালোচোখে দেখে নি।কিন্তু অভ্যন্তরীণ গোলোযোগের কারণে বঙ্গের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারেন নি। ১২২৫ সালে শারিগলি গিরিপর্বতের নিকট উভয় দলের সেনা মুখোমুখি হলে ইওজ খলজিসন্ধির প্রস্তাবকরেন। ইলতুৎমিশ খুশি হয়ে মালিক আলাউদ্দিন জানিকে বিহারের শাসক নিযুক্ত করেনএবং ইওজ খলজিকে বঙ্গের শাসক পদে বহাল রেখে দিল্লীতে ফিরে যান। সুলতান দিল্লীতে চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইওজ খলজিপুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণাকরেন। আলাউদ্দিন জানিকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি বুঝতে পারেন যে ইলতুৎমিশ তাঁকে আক্রমণ করবে। তিনি প্রায় এক বছর প্রস্তুতি নিয়ে রাজধানীতে অবস্থান করেন এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করেন। এই সময় দিল্লীর বাহিনী অযোধ্যায় বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকে। ইওজ মনে করলেন যে, এই অবস্থায় দিল্লীর পক্ষে বাংলা আক্রমণ সম্ভব না। তাই তিনি এই অবসরে পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করেন। রাজধানী লখনৌতি এই অবস্থায়অরক্ষিতথাকে। এই সুযোগে ইলতুৎমিশ তাঁর ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে লখনৌতি আক্রমণের নির্দেশ দেন। ইওজ খলজির অনুপস্থিতিতে নাসিরউদ্দিন লখনৌতি আক্রমণ করেন। এই সংবাদ শুনামাত্রই ইওজ স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসেন। দিল্লীর বাহিনী পূর্বেই তাঁর বসনকোট দুর্গ দখল করেছিল।যুদ্ধে ইওজ খলজি পরাজিত হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।