কার শাসনামলকে মুগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়?
শাহজাহানের শাসনামল
- শাহজাহান : জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর যুবরাজ খুররম নানা বাধা অতিক্রম করে ১৬২৮ সালে শাহজাহান নাম ধারণ করে মুগল সিংহাসনে বসেন। একজন জনপ্রিয় সম্রাটরূপে তিনি ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করেন। স্থাপত্য শিল্পের জন্য তাঁর শাসনামল মুগল ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত। সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর আমলে আহমদনগর, বিজাপুর, গোলকুন্ডায় মুগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সিংহাসনে বসার পর তিনি কয়েকটি জটিল সমস্যায় পতিত হন। প্রথমে তাঁকে দুটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়। বুন্দেলখণ্ডের রাজপুত নেতা জুঝর সিংহ ও দাক্ষিণাত্যের আমির খান লোদির বিদ্রোহ। শাহজাহান জুঝর সিংহকে পরাজিত করে মনসবদার নিযুক্ত করে কিন্তু ১৬৩৫ সালে পুনরায় বিদ্রোহ করলে তাকে হত্যা করা হয়। ১৬২৮ সালে জাহান লোদি পরাজিত হয়ে কালিঞ্জরে পালিয়ে যায়। সেখানে সে মারা যায়।
তিনি পর্তুগীজদের দমন করে হুগলি দখল করেন। প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগ নিজে তদারকি করতেন। তাঁর আমলে সর্বপ্রথম পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের সাথে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তিনি স্থাপত্য শিল্পে বেশ উন্নতি সাধন করেন। ময়ূর সিংহাসন, তাজমহল শিল্পানুরাগের অনন্য কীর্তি। তিনি ‘শাহজাহানাবাদ’ নামে একটি নতুন নগর নির্মাণ করেন যা বর্তমানে নয়াদিল্লি নামে পরিচিত। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, আড়ম্বর-ঐশ্বর্য, স্থাপত্য শিল্পের চরম উৎকর্ষ, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির কারণে শাহজাহানের রাজত্বকাল গৌরবের শিখরে উন্নীত হয়েছিল। তবে এই জাঁকজমক ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অন্তরালে মুগল সাম্রাজ্য পতনের বীজ অঙ্কুরিত ছিল বলে মনে করা হয়।
-
পর্তুগিজদের দমন করে কে? কেন দমন করা হয়?
- পর্তুগিজরা প্রথমে বাংলার সাতগাঁও নামক স্থানে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। ক্রমে তারা হুগলিতে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে। জাহাঙ্গীরের সময় তারা দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠে। শুল্ক ফাঁকি, কৃষকদের উপর অত্যাচার, বলপূর্বক খ্রিস্টান বানানোসহ নানা অপকর্মের সাথে তারা জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও শাহজাহান যখন বিদ্রোহ করে তখন পর্তুগিজরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ১৬৩২ সালে সুবাদার কাসিম খান পর্তুগিজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে। পরবর্তীতে শাহজাহান তাদের শান্তিপূর্ণ বসবাসের অনুমতি দেয়।
-
শাহজাহানের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি-
- শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর দাক্ষিণাত্য অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল আহম্মদনগর রাজ্য। এই সময়ে আহম্মদনগরের মন্ত্রী ফতে খাঁ নাবালক রাজার পরিবর্তে রাজ্য শাসন করত। ১৬৩১ সালে মুঘলরা আহম্মদনগরের দৌলতাবাদ দুর্গ আক্রমণ করে। ফতে খাঁর বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দুর্গের পতন হয়। আহম্মদনগর মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। নাবালক সুলতান হুসেন শাহ যাবজ্জীবন গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি জীবন কাটায়।
শাহজাহান গোলাকুন্ডা ও বিজাপুর রাজ্য জয় করে। ১৬৩৬ সালে পুত্র আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের শাসক নিয়োগ করে। দাক্ষিণাত্য প্রদেশকে খান্দেশ, বেরার, তেলিঙ্গানা ও দৌলতাবাদ এই চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুঘলরা সেখান থেকে বৎসরে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব লাভ করত। -
শাহজাহানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি-
- শাহজাহান কান্দাহার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। এজন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। কান্দাহারের তৎকালীন শাসক আলী মর্দানকে অর্থ দ্বারা বশ করে তা দখল করে। আলী মর্দান দিল্লিতে আসলে মুঘল দরবারে তাকে কাশ্মির ও কাবুলের শাসক করা হয়। দশ বছর কান্দাহার মুঘলদের দখলে ছিল। ১৬৪৮ সালে পারস্যের শাহ আব্বাস কান্দাহার অবরোধ করে। শীতকালে তুষারপাতের ফলে শাহজাহান যথাসময়ে সামরিক সাহায্য পাঠাতে না পারায় মুঘলরা কান্দাহার হারায়। এরপর তিনবার চেষ্টা করেও মুঘলরা তা দখল করতে পারে নি।
-
শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি
- শাহজাহান মধ্য এশিয়ায় অভিযানের পরিকল্পনা নেয়। ১৬৪৬ সালে যুবরাজের মুরাদের নেতৃত্বে বলখ ও বাদাখশান দখল করে। কিন্তু সেখানকার আবহওয়া প্রতিকূল হওয়ায় মুরাদ বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আগ্রায় ফিরে আসে। এরপর প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ ও পুত্র আওরঙ্গজেবকে সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ধর্ষ উজবেকদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা বলখ ত্যাগ করে। এক্ষেত্রে রাজকোষের প্রচুর অর্থ নষ্ট হয়।
-
স্থাপত্য শিল্পে শাহজাহানের অবদান
- মধ্যযুগের ভারতবর্ষের মুঘল ইতিহাসে শাহজাহানের রাজত্বকাল স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই সময় ভারতে সকল দিক দিয়ে উন্নতি ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষের জন্যই ঐতিহাসিকগণ এই সময়কে মুঘল যুগের শ্রেষ্ঠ যুগ বলেছেন। জাহাঙ্গীরের আমলে যেমন চিত্রশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল, তেমনি শাহজাহানের আমলে স্থাপত্য শিল্পে মণিমানিক্যের ব্যবহার স্থাপত্য রীতিকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেয়।
-
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়? কেন হয়?
- ১৬৫৭ সালে শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। শাহজাহান বড় ছেলে দারাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ভুল করে। ফলে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে পড়ে। পুত্রদের অনেকেই দারার চেয়ে যোগ্য ছিল। মূলত তিনটি কারণে উত্তরাধিকার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যথা-
১. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব : মুগলদের সিংহাসন লাভের কোনো সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতি ছিল না। এজন্য সিংহাসন নিয়ে বিরোধ পূর্বের সম্রাটদের সময়ও ছিল।
২. ভাইদের প্রতি দারার অশোভন আচরণ : শাহজাহানের অসুস্থতার কথা দারা গোপন রাখে এবং আগ্রার সাথে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
৩. দারার প্রতি শাহজাহানের অন্ধ ভালোবাসা : শাহজাহান দারার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সিংহাসন লাভের জন্য আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেয়। তিনি দারার পরামর্শে আওরঙ্গজেবকে বিজাপুর ও গোলাকুন্ডা বিজয়ে বাধা দেন। - শাহজাহানের সন্তানদের নাম-
ক. দারাশিকোহ : তিনি ছিলেন শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয়। তিনি পাঞ্জাব, মুলতান ও এলাহাবাদের শাসক ছিলেন। সর্বদা পিতার আদেশ অনুসারে শাসন পরিচালনা করতেন। তিনি বিদ্বান, বিদ্যোৎসাহী ও ধর্ম সম্পর্কে উদার ছিলেন।
খ. সুজা : তিনি ছিলেন বাংলার শাসক। মদ ও নারীর প্রতি আসক্তি তাঁর সর্বনাশ ডেকে আনে। যদিও রাজ্য শাসনে তিনি দক্ষ ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলায় বেশ উন্নতি হয়।
গ. আওরঙ্গজেব : তিনি ছিলেন দাক্ষিণাত্যের শাসক। ভাইদের মধ্যে তিনি যেমনি বিদ্বান, সাহসী ছিলেন তেমনি কূটনীতিজ্ঞ ও দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর মধ্যে সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার অভাব ছিল না। ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
ঘ. মুরাদ : সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসক। তিনি সাহসী ও শক্তিশালী ছিলেন; কিন্তু চিন্তাভাবনা, সংযম-ধর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি তার ছিল না। মদ ও নারীর প্রতি সুজার মতো তাঁরও আসক্তি ছিল।
ঙ. জাহানারা ও রৌশনারা : উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সময় তাঁর দুই কন্যার ভূমিকা লক্ষণীয়। জাহানারা বাবা ও বড় ভাই দারার পক্ষ নেন এবং রৌশনারা আওরঙ্গজেবের পক্ষ নেন। শাহজাহানের অসুস্থতার সময় দারা আগ্রায়, সুজা বাংলায়, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে এবং মুরাদ গুজরাটে উপস্থিত ছিল। স্বভাবতই দারা বাবার অসুস্থতার সুযোগে শাসনভার গ্রহণ করে তিন ভাইয়ের আগ্রায় আসার পথ বন্ধ করে দেয়। এমন কি রাজধানী থেকে কোন সংবাদ যাতে ভাইদের নিকট পৌঁছাতে না পারে সে ব্যবস্থাও করে।
রৌশনারার মাধ্যমে আওরঙ্গজেব সংবাদ পান যে দারা শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এই সংবাদে সবাই মনে করে যে, তাদের বাবা আর জীবিত নেই এবং দারা সিংহাসনে বসার জন্য এই সংবাদটি গোপন করেছেন। ফলে সবাই দারাকে পরাস্ত করে সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা নেয়।
প্রথমেই সুজা নিজেকে বাংলার সম্রাট বলে ঘোষণা দেয়। তিনি বিহার দখল করার জন্য আগ্রায় অগ্রসর হন।
এদিকে মুরাদ গুজরাটে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা দেয়।
কিন্তু আওরঙ্গজেব কোনো ঘোষণা না দিয়ে সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকেন। সুজা আগ্রায় অগ্রসর হলে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে উত্তর ভারতে যাত্রা করেন। ১৬৫৮ সালে দিপালপুরে মুরাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে। তিনি মুরাদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন। যেখানে বলা হয়, তারা দুজনে দারা ও সুজার বিরুদ্ধে মিলিতভাবে যুদ্ধ করবে এবং যুদ্ধে জয়ী হলে সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিবে।
দারা পুত্র সুলেমানের নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী সুজার বিরুদ্ধে পাঠায়। ১৬৫৮ সালে যুদ্ধে সুজা পরাজিত হয় এবং বাংলায় ফিরে আসে। দারা যশোবন্ত সিংহ ও কাশিম খাঁর নেতৃত্বে অপর একটি বাহিনীকে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠায়। তাদের মনোমালিন্যের কারণে আওরঙ্গজেব ধর্মাট নামক স্থানে এই বাহিনীকে পরাজিত করে। ফলে তাঁর সামরিক খ্যাতি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সম্মিলিত বাহিনী আগ্রার নিকটবর্তী সামুগড় নামক স্থানে উপস্থিত হয়। দারা প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা নিয়ে সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য দারার সেনাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল। তা সত্ত্বেও দারা নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করে। রাজপুতরা বীরত্বের সাথে দারার পক্ষে যুদ্ধ করে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের রণকৌশলের সামনে দারা পরাজিত হয়। সে পাঞ্জাবে পালিয়ে যায়। আওরঙ্গজেব আগ্রা দুর্গ অবরোধ করে। বাবার অনুরোধ উপেক্ষা করে আওরঙ্গজেব আগ্রা দুর্গ দখল করে। শাহজাহানকে নজরবন্দি করে রাখা হয়।
আগ্রা থেকে আওরঙ্গজেব দিল্লি যাত্রা করে। মথুরার কাছে সে কৌশলে মুরাদকে বন্দি করেন। ১৬৬১ সালে দেওয়ান আলীকে হত্যার অভিযোগে মুরাদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে সুজা পুনরায় সেনা সংগ্রহ করে। আওরঙ্গজেব আগ্রা দখল করে সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। ১৬৫৯ সালে খানুয়ার যুদ্ধে সুজা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। তাঁর সেনাপতি মীর জুমলা সুজার পশ্চাদ্ধাবন করলে তিনি বাংলা ত্যাগ করে আরাকানে পালিয়ে যান। কিছুদিন পর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়।
দারা পাঞ্জাব থেকে পারস্যে যাত্রা করে। পথে জিওন খাঁ নামক এক আফগান নেতা তাকে ধরিয়ে দেয়। বন্দি অবস্থায় দারাকে দিল্লিতে আনা হয়। ১৬৫৯ সালে তাকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এইভাবে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় বসে। ১৬৬৬ সালে শাহজাহান মারা যান।
আওরঙ্গজেবের শাসনামল
- অনেক প্রতিকূলতার পর ১৬৫৯ সালে দিল্লিতে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তিনি ‘আলমগীর বাদশাহ গাজী’ উপাধি ধারণ করে। তিনি ছিলেন মুগল বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। কোরআন নকল ও টুপি সেলাই করে অর্থোপার্জন করতেন। ভারতীয় মুসলমানরা তাঁকে ‘জিন্দাপির’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তাঁর শাসনকালে মুগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ ফিকহের কিতাব লেখা হয়। তিনি ১৬৬১ সালে কুচবিহার ও ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ জয় করেন। ৪৯ বছর তিনি শাসন করেন। ১৭০৭ সালে তিনি মারা যান। তাঁর রাজত্বকে দুভাগে বিভক্ত করা যায়-
ক. ১৬৫৮-১৬৮১ সাল পর্যন্ত। এই সময় তিনি উত্তর ভারতে অবস্থান করেন।
খ. ১৬৮১-১৭০৭ সাল পর্যন্ত। এই সময় তিনি দক্ষিণ ভারতে অবস্থান করেন। ১৬৮১ সালের পর তিনি উত্তর ভারতে ফিরে আসেননি। -
আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য বিস্তার-
- আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে। তাঁর পূর্বে কোন শাসকই এত বড় সাম্রাজ্যের শাসক হতে পারেনি। উত্তর-পূর্ব ভারতের কুচবিহার ও অহোম রাজ্য অভিযান ছিল তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই দুটি রাজ্য প্রাকৃতিক দিক থেকে সুরক্ষিত হওয়ায় মুসলমানরা এটি দখল করতে পারেনি।
তাঁর নির্দেশে ১৬৬১ সালে বিহারের শাসক দাউদ খাঁ পালামৌ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করে। সুবাদার মীর জুমলা কুচবিহার দখল করে। সে পরের বছর অহোমের রাজধানী গড়গাঁয় উপস্থিত হয়। অহোমরাজ রাজধানী থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু বর্ষা নামলে মুঘল সেনারা আসামের জলবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এই প্রতিকূল পরিবেশে মুঘলরা স্থানীয়দের সাথে লড়াইয়ে সুবিধা করতে পারছিল না। ফলে মীর জুমলা অহোমরাজের সাথে সন্ধি করে। এই অভিযানে মুঘলদের অনেক ক্ষতি হয়। আসামে অবস্থানকালে মীর জুমলা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৬৬৩ সালে তিনি ঢাকায় মারা যান।
আওরঙ্গজেব উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অভিযান পরিচালনা করে সফল হয়। তাঁর সীমান্ত নীতি সাময়িকভাবে সফল হলেও তা মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। প্রথমত, এই যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সীমান্ত অঞ্চল থেকে মুঘল সৈন্য সংগ্রহের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ছিল। সর্বশেষে দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মুঘল সেনাবাহিনীর এক বিরাট অংশকে স্থানান্তর করায় শিবাজীর পক্ষে মুঘল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা সহজ হয়েছিল। ১৬৭৫ সালের পরবর্তী দেড় বছরে শিবাজি গোলকুন্ডা, বিজাপুর, কর্ণাটক প্রভৃতি অঞ্চলে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে। -
আওরঙ্গজেবের রাজপুতনীতি-
- সম্রাট আকবর রাজপুতদের সাথে মিত্রতাসুলভ আচরণ করে তাদের সহায়তা লাভে সমর্থ হন। আকবরের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য যে গৌরবের শিখরে আরোহণ করে তা বহুলাংশে রাজপুতদের অকুণ্ঠ সহায়তা লাভেই সম্ভবপর হয়েছিল। আওরঙ্গজেব রাজপুতদের উপর বলপ্রয়োগ নীতি গ্রহণ করেন।
১৬৭৮ সালে মাড়োয়ার রাজা যশোবন্ত সিংহ আফগানিস্তান সীমান্তে মারা গেলে আওরঙ্গজেব তা দখল করতে যায়। এটি সামরিক ও ব্যাবসায়িক দিক থেকে রাজপুতনার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত ছিল। আওরঙ্গজেব প্রথমে মাড়োয়ার রাজ্যটি খালিসার অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি ৩৬ লক্ষ টাকা নজরানার বিনিময়ে যশোবন্ত সিংহের আত্মীয় ইন্দ সিংহকে মাড়োয়ার সিংহাসনে বসান। কিন্তু যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুর ছয় মাস পর কাবুলে তাঁর দুই রানির গর্ভে দুই পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তন্মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। এই অবস্থায় মাড়োয়ারের রাণীদ্বয় নবজাতক পুত্র অজিত সিংহকে মাড়োয়ার সিংহাসনে বসানোর দাবি জানায়। আওরঙ্গজেব অজিত সিংহকে মুঘল হারেমে রেখে লালন-পালন করার শর্ত দেয়। কিন্তু দুর্গাদাস নামে এক রাঠোর নেতা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সে কৌশলে মুঘল হারেম থেকে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে যৌধপুরে নিয়ে যায়। তাঁর আচরণে রাঠোররা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি ১৬৭৯ সালে যৌধপুর দখল করেন। কিন্তু তাঁর এই আক্রমণ মাড়োয়ারের রাঠোরদের সাথে মেবারের রাজা রাজসিংহের ঐক্য স্থাপন করে। এদিকে মেবারের রাজা রাজসিংহ আওরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনে ক্ষুব্ধ হয়।
এই সম্মিলিত বাহিনীর মোকাবিলা শাহজাদা আকবর ব্যর্থ হয়। ফলে শাহজাদা আজমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে আকবর ক্ষুব্ধ হয়ে ১৬৮১ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আওরঙ্গজেব কূটনীতির মাধ্যম তাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়। আকবর সেখান থেকে চলে যায় এবং মারাঠা নেতা শিবাজির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।
আওরঙ্গজেবের সাথে মেবার ও মাড়োয়ারের যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ১৬৮১ সালে শাহজাদা মুয়াজ্জমের মধ্যস্থতায় মেবারের সাথে মুঘলদের সন্ধি হয়। কিন্তু মাড়োয়ারের সাথে যুদ্ধ আওরঙ্গজেবের জীবদ্দশায় শেষ হয়নি। ১৭০৯ সালে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (মুয়াজ্জম) অজিত সিংহকে মাড়োয়ারের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। -
দাক্ষিণাত্য আক্রমণের কারণ-
- আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সর্বাপেক্ষা আলোচিত বিষয় ছিল দাক্ষিণাত্য নীতি। দাক্ষিণাত্যে অভিযানের কয়েকটি কারণ ছিল। যথা-
ক. দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো মুগল সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ ছিল।
খ. গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের সুলতানগণ কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
গ. মারাঠা নেতা শম্ভুজি সম্রাটের বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে আশ্রয় দেয়।
ঘ. এই সময়ে দাক্ষিণাত্যের মারাঠারা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠে। আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ ভারত অভিযানকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা-
১. সিংহাসনে আরোহণ করে শিবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা পর্যন্ত। শিবাজি দাক্ষিণাত্যে পরাক্রমশালী হয়ে উঠলে আওরঙ্গজেব তাকে দমন করার জন্য প্রথমে শায়েস্তা খান ও পরে জয়সিংহকে পাঠায়। শিবাজির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান সফল হলেও মারাঠা শক্তিকে পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি।
২. ১৬৮২-১৬৮৭ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে সম্রাটের বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে দমন ও শিবাজির ছেলে শম্ভুজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং গোলাকুন্ডা-বিজাপুর দখল করে।
৩. ১৬৮৭-১৭০৭ সাল পর্যন্ত। এই সময় তিনি শম্ভুজি ও অন্যান্য মারাঠা নেতাদের ধ্বংস করেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেন। এ সময়ে শম্ভুজি নিহত হয়। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুগল-মারাঠা সংঘর্ষ চলমান থাকে।
দক্ষিণ ভার বিজয়ের ফলে আওরঙ্গজেব ভারত উপমহাদেশের একচ্ছত্র সার্বভৌম সম্রাটের মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর রাজ্যসীমা কাবুল থেকে চট্টগ্রাম ও কাশ্মির থেকে কাবেরি পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। যদিও এই অবিরাম যুদ্ধের কারণে রাজকোষে অর্থ সংকট দেখা দেয়। -
আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. শাহজাহানের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
২. সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিক. শাহজাহানের আমলে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি : দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে তিনি দুইবারই (১৬৩৬-১৬৪৩ ও ১৬৫৩) আক্রমণাত্মক নীতি অনুসরণ করেন। প্রথমে তিনি শিয়ারাজ্য গোলকুন্ডা ও বিজাপুর দখলের চেষ্টা করেন। গোলাকুন্ডার মন্ত্রী ছিলেন মীর জুমলা। তাকে আওরঙ্গজেব নিজ দলে আনেন। কিন্তু দারাশিকোহ ও জাহানারার হস্তক্ষেপে তিনি গোলকুন্ডা জয় করতে পারেননি। সুলতান প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়ে নিজ রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করেন এবং নিজ কন্যার সঙ্গে আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহাম্মদের বিবাহ দেন। কুতুব শাহের মৃত্যুর পর গোলকুন্ডার শাসক হিসেবে মুহাম্মদ অধিষ্ঠিত হবে এই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
১৬৫৭ সালে আওরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ করে। মীর জুমলা এই যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করে। বিজাপুর দখলের সময় নিকটবর্তী হলেই শাহজাহান তাতে হস্তক্ষেপ করে। বিজাপুরের সুলতান সন্ধি করে প্রচুর ক্ষতিপূরণ ও কয়েকটি স্থান মুঘলদের দিয়ে দেন। এরপর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধের কারণে অভিযান বন্ধ থাকে।খ. সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি-
- সম্রাট হওয়ার পর তিনি তার উদ্দেশ্য সফল করতে সচেষ্ট হন। তাঁর শাসনকালের প্রথম যুগ মূলত উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে দক্ষিণ ভারতে শিবাজির অভ্যুদয় হয়। আওরঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যের শাসক তখন থেকেই শিবাজী ধীরে ধীরে ক্ষমতা বিস্তার করছিল। সিংহাসন লাভের পর আওরঙ্গজেব মাতুল শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণাত্যের শাসক নিয়োগ করেন। শায়েস্তা খান প্রথম দিকে সাফল্য লাভ করলেও মারাঠাদের অভ্যুত্থান প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। শায়েস্তা খানকে বাংলায় পাঠানো হয়। এরপর দুইজন সেনাপতিকে পাঠানো হলেও তারা পরিপূর্ণ সাফল্য আনতে পারে নি। উত্তর ভারতে নানা সমস্যায় ব্যস্ত থাকায় সম্রাট দাক্ষিণাত্যে দৃষ্টি দিতে পারেননি। এই সুযোগে শিবাজি স্বাধীন মারাঠা রাজ্যের সূত্রপাত করে। ১৬৮০ সালে তার মৃত্যুর পর বিদ্রোহী শাহজাদা আকবর যখন শিবাজির পুত্র শম্ভুজির সাথে মিত্রতা স্থাপন করে তখন আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে আসেন।
১৬৮১-১৭০৭ সাল পর্যন্ত সম্রাটের মূল কার্যক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ ভারত। ১৬৮৪ সালে তিনি বিজাপুর অবরোধ করলে সুলতান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ১৬৮৭ সালে গোলকুন্ডা রাজ্য আক্রমণ করে তা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করে। বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল করে আওরঙ্গজেব মারাঠা শক্তিকে বিনষ্ট করতে অগ্রসর হন। ১৬৮৯ সালে শিবাজীর পুত্র শম্ভুজি নিহত হয় এবং মারাঠা রাজধানী রায়গড় দখল করেন। শম্ভুজির নাবালক পুত্র শাহু বন্দি হয় এবং তাকে মুঘল অন্তঃপুরে রাখা হয়। ১৬৯০ সালে তাঞ্জোর ও ত্রিচিনপল্লীর রাজারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। এভাবে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়।
মুঘল সামরিক শক্তি মারাঠা জাতির উত্থান থামাতে পারেনি। ১৬৯১ সালের মারাঠারা রাজারাম ও তাঁর স্ত্রী তারাবাইয়ের নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৭০০ সালে রাজারামের মৃত্যু হলে তাঁর নাবালক পুত্র দ্বিতীয় শিবাজীর নামে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। এভাবে মারাঠাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ সৃষ্টি হয় যা দমন করা সম্ভব হয় নি। -
মুগল শাসনের প্রকৃতি-
- মুগল শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক ও স্বৈরতন্ত্রী হলেও জনকল্যাণকামী ছিল। এই শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত সামরিক প্রকৃতির। সদর ও কাজি ছাড়া অন্য সব কর্মচারিকে সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত। মুগল শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি রচিত হয় আরব-পারস্য শাসন ব্যবস্থার অনুকরণে। মুগল আমলের প্রশাসনিক বিভাগ-
ক. দিওয়ান : তিনি অর্থনৈতিক বিভাগের পরিচালনা করতেন। রাজস্ব আদায়ের যাবতীয় ভার দেওয়ানের উপর ছিল। এছাড়াও তিনি সরকারি অফিসার ও সম্রাটের মধ্যে প্রধান মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি হিসেবে থাকতেন।
খ. মীর বকসি : সামরিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ রাজ কর্মচারী।
গ. মীর সামান : সম্রাটের গৃহ পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী।
ঘ. সদর-ই সুদুর : ধর্মীয় সম্পত্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সহকারি দান বিভাগের অধিকর্তা।
ঙ. কাজিউল কুজ্জাত : প্রধান বিচারপতি।
মুগল আমলে বাংলায় মসলিন শিল্পের বিকাশ ঘটে। বণিকদের নিয়ে একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গঠিত হয়। - পূর্ববর্তী আলোচনা পড়ুন : আকবরের শাসনামল
- পরবর্তী আলোচনা : বাংলায় সুবেদারি শাসন